হরিপুরের হরেক কান্ড –দ্বাবিংশ তম পর্ব – শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

তিনজনেই ফের উঠে পড়লেন ।

পরঞ্জয় বললেন, বিশ্রাম নিয়ে ভাববেন না। আমরা বরং সাতকড়ির বাড়ির ধারে কাছে থানা গেড়ে থাকি।

পবনকুমার বললেন, সেইটাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে।

মহেন্দ্র বলে উঠলেন, কিন্তু সুজনবাবু যে রকম মরিয়া হয়ে উঠেছেন তাতে গুলিটুলি চালিয়ে দেবেন না তো !

পরঞ্জয় গম্ভীর হয়ে বললেন, অসম্ভব নয়। আমি যতদূর জানি সুজনবাবু একটা ল্যাবরেটরি বানানোর চেষ্টা করছেন। বিজ্ঞানের গবেষণাগার তৈরি করতে অনেক টাকা লাগে। সেই টাকার জন্যই উনি হন্যে হয়ে উঠেছেন।

পবনকুমার বললেন, কিসের ল্যাবরেটরি তা জানেন? বিজ্ঞানের তো অনেক শাখা।

পরঞ্জয় বললেন, উনি সেটা আমাকে ভেঙে বলেননি। আমেরিকায় উনি কী করতেন তাও কখনও আলোচনা করেননি।

মহেন্দ্র বললেন, “যতদূর মনে হয় ওঁর বিষয় হল পদার্থবিদ্যা। উনি একজন পণ্ডিত ও গুণী মানুষ। তবু এই বেআইনি কাজটি কেন করতে যাচ্ছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।”

পবনকুমার বললেন, এ গাঁয়ের অপরাধীদের সঙ্গে ওঁর যোগাযোগ আছে। সেটাও খুব ভাল ব্যাপার নয়।

মহেন্দ্র বললেন, গন্ধটা থেকেই যাচ্ছে।

তিনজন হাঁটতে হাঁটতে সাতকড়ির বাড়ির ফটকের কাছে পৌঁছে গেলেন।

পরঞ্জয় বললেন, বাড়ির কম্পাউন্ডটা বিশাল বড়। তবু একটা চক্কর সেরে আসবে নাকি হে?

পবন বললেন, সেটা মন্দ প্রস্তাব নয়। সাতকড়ির বাড়ির চারদিকে দশ ফুট উঁচু দেয়াল। দেয়ালের ওপরে কাঁচ বসানো। তবু দেয়ালটা ডিঙোনো খুব একটা শক্ত কাজ নয়। কারণ, বাড়ির উত্তর আর পশ্চিমে দেয়ালের বাইরেই বিশাল আমবাগান। সেই আম বাগানের মেলা গাছের ডাল সাতকড়ির দেয়াল ডিঙিয়ে ভেতরে ঝুলে পড়েছে। গাছের ডাল বেয়ে দিব্যি ঢোকা যায়।

পরঞ্জয় সেই কথাটাই বললেন, চারদিকে দেয়াল থাকলে কী হবে, চোরের পক্ষে কোনও সমস্যাই নয়।

পবনকুমার বললেন, চোরেরা পারলেও সুজনবাবুর পক্ষে পারা মুশকিল। তাঁর বয়স সত্তরের ওপর।

পরঞ্জয় বললেন, আমার বয়সও সত্তরের কাছাকাছি। আমি জঙ্গলে যে ভাবে বাস করি তোমরা পারবে না। বয়সটা ফ্যাকটর নয়। আসল কথা হল প্র্যাকটিস। সুজনবাবু বেশ চটপটে এবং শক্তিমান মানুষ।

মহেন্দ্র বললেন, হ্যা, তা বটে।

পরঞ্জয় বললেন, সত্তর বছর বয়সেও সুজন ব্যায়াম করেন। নিয়মিত খাওয়া-দাওয়া আর পরিশ্রমের ফলে সুজন বেশ ফিট। কিন্তু এই বয়সে বেশি আকাঙ্ক্ষা করাটা ঠিক নয ! ওঁর উচ্চাশা বড্ড বেশি।

তাঁরা হাঁটছেন আগাছা এবং ঝোপ-জঙ্গলের ভেতর দিয়ে। নিকস্যি অন্ধকার চারদিকে। পরঞ্জয় মাঝে মাঝে টর্চ জেলে পথ দেখে নিচ্ছেন। তাঁর পেছনে পবন এবং মহেন্দ্র।

পবন কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, হঠাৎ পরঞ্জয় থমকে দাঁড়িয়ে হাত তুলে বললেন, চুপ।

টর্চটা নিবিয়ে খানিকক্ষণ অপেক্ষা করলো পরঞ্জয়। তারপর খুব চাপা গলায় বললেন, হুঁশিয়ার।

পবন বললেন, কী হল?

সামথিং ইজ হ্যাপেনিং অ্যাহেড। শব্দ না করে এসো।

একটু থেমে তিনজন আবার সাবধানে এগোতে লাগলেন। দশ-বারো গজ এগিয়ে পরঞ্জয় আবার দাঁড়ালেন। টর্চটা জেলে চারদিকটা খুঁটিয়ে দেখে বললেন, এখান দিয়েই ঢুকেছে।

পবন বললেন, একটু বুঝিয়ে বলুন। সামনে একটা আমগাছের গায়ে টর্চ ফেলে পরঞ্জয় বললেন, এ গাছটায় ওঠা সবচেয়ে সহজ একখানা ডাল কেমন বাঁকা হয়ে উঠে গেছে দেখেছে? এই ডাল বেয়ে যে-কেউ দেয়াল পেরোতে পারে।

কেউ দেয়াল পেরিয়েছে বলে মনে হচ্ছে কেন আপনার?

আমি জঙ্গলে থাকি তো তাই আমার কান খুব সজাগ। সামান্য ডালপালা নাড়া বা পাতা খসে পড়ার শব্দও টের পাই। কেউ যে এই গাছ বেয়েই ভেতরে ঢুকেছে তাতে সন্দেহ নেই।

পরঞ্জয়বাবু টর্চ জেলে দুজনকে দেখালেন, গাছের তলায় ঝোপঝাড়ে কিছু দলিত মথিত ভাব। আর হেলানো ডালটার গা থেকেও একটু বাকল খসার চিহ্ন।

পবন বললেন, তাহলে আমরা এখন কী করব?

পরঞ্জয় দৃঢ়স্বরে বললেন, আমাদেরও মহাজনপন্থা নিতে হবে।

সর্বনাশ! বুড়োবয়সে পড়েটড়ে যে হাড় ভাঙবে। প্রাণও যেতে পারে।

তুমি না বিপ্লবী ছিলে! ছোঃ, প্রাণের ভয় আবার একটা ভয় নাকি? আর বয়সের কথা তুললে বলতেই হয় যে, তোমরা আমার হাঁটুর বয়সী। বুড়ো হওয়ার আগেই বুড়িয়ে গেলে চলবে কেন ?

আচ্ছা ঢুকে হবেটা কী?

তা জানি না। আমার মন বলছে আমাদের ভেতরে যাওয়া একাত্ত দরকার।

আপনাকে নিয়ে আর পারা যায় না। সবসময় আপনি অ্যাডভেঞ্চার খোঁজেন। কী আর করা যাবে। চলো হে মহেন্দ্র।

গাছে উঠতে খুব যে একটা অসুবিধে হল, তা নয়। তবে অন্ধকার বলে একটু সময় লাগছিল। তবে ডালটা বড় চমৎকার। দেয়াল পেরিয়ে একটা প্যারাবোলার মতো মাটির কাছাকাছি নেমে গেছে। পরঞ্জয় এই বয়সেও দারুণ চটপটে। ডাল বেয়ে সাতকড়ির বাগানে নামতে তাঁর তিন মিনিটও লাগল না। পবন আর মহেন্দ্রর সময় একটু বেশি লাগল।

অন্ধকার বাগানে নেমে তিনজন একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। চারদিক নিস্তব্ধ। শুধু ঝিঁঝির ডাক শোনা যাচ্ছে। কাছেপিঠেই কোথাও একঝাঁক শেয়াল ডাকল।

মহেন্দ্র বললেন, এবার?

পরঞ্জয় চাপা গলায় বললেন, চারদিকে মেলা গাছপালা রয়েছে। কিছু দেখার উপায় নেই। চলো, বাড়িটার দিকে এগোই।

পবন বললেন, কুকুর নেই তো !

থাকতে পারে। তবে কুকুর যদি তাড়া করে তবে ওদেরই আগে করবে। এসো।

চারদিকে দুর্ভেদ্য গাছপালা। বাগান না বলে জঙ্গল বলাই ভাল। পরঞ্জয় অভিজ্ঞ মানুষ। জঙ্গল ভেদ করে তিনিই আগে চললেন। পেছনে পবন আর মহেন্দ্র । খানিক দূর গিয়ে একটা পুকুরধারে পৌঁছালেন তারা। পুকুরের ওপাশে দুর্গের মতো বাড়ি।

পবন বললেন, ও বাবা, এ তো বিশাল বাড়ি। সাতকড়ি কোন ঘরে থাকে তা বুঝব কী করে?

পরঞ্জয় বললেন, আগে থেকে অত ফ্যাঁকড়া তুলে লাভ কী? চলো দেখাই যাক।

পুকুরধার ধরে এগিয়ে গিয়ে তাঁরা বাড়ির পেছন দিকটায় পৌঁছলেন। গোটা বাড়িটাই অন্ধকার । কোথাও কোনও সাড়াশব্দ নেই। দরজা জানালা সবই আঁট করে বন্ধ।

পবন বললেন, পরঞ্জয়বাবু, সুজন আর নিতাইকে তো দেখা যাচ্ছে না।

না, ওরাও এন্ট্রান্স খুঁজছে নিশ্চয়ই। এসো, আমরাও চারদিকটা ঘুরে দেখি।

ঘুরে দেখাও সোজা ব্যাপার নয়। বাড়ির চারদিকে মেলা ঝোপজঙ্গল এবং বড় বড় গাছ।

পরঞ্জয় টর্চ আর জ্বালছিলেন না। অন্ধকারেই ঠাহর করে করে এগোতে এগোতে হঠাৎ থেমে হাত তুললেন।

কেউ কোনও কথা বলল না। সামনেই একটা নিমগাছ। গাছটা দোতলা ছাড়িয়ে ছাদে গিয়ে পৌঁছেছে।

পরঞ্জয় একটু ইশারা করে গাছটা বেয়ে উঠতে লাগলেন।

কোথায় উঠছেন? পবন চাপা স্বরে জিজ্ঞেস করে।

ছাদে।

এখানে হেলানো ডাল নেই। খাড়া গাছে ওঠাও শক্ত। তাছাড়া মহেন্দ্র কাঠের বাক্সটা নিয়ে উঠতেও পারবেন না।

পরঞ্জয় উঠতে উঠতেই বললেন, তোমরা দাঁড়াও, আমি দেখে আসছি। মনে হয় এটা দিয়েই ওরা ছাদে উঠেছে। ছাদ দিয়ে বাড়িতে ঢোকার চেষ্টা করবে।

অগত্যা দুজনে নিচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতে লাগলেন। হনুমানকেও লজ্জা দেওয়ার মতো দক্ষতায় টারজানকেও হারিয়ে দেওয়ার মতো দ্রুতবেগে পরঞ্জয় দোতলা ছাড়িয়ে ছাদের কাছে উঠে গেলেন। তারপর আর তাঁকে দেখা গেল না।

মহেন্দ্র বললেন, “আশ্চর্য লোক বটে!”

 

প্রথম কিছুক্ষণ কিছুই ঘটল না। চারদিক নিশ্চুপ, শুধু ঝিঁঝি ডাকার শব্দ। মহেন্দ্র উৎকর্ণ হয়ে ছিলেন, চাপা গলায় বললেন, ভেতরে কী হচ্ছে কে জানে। আমাদেরও কি ভেতরে যাওয়া উচিত?

পবন বললেন, ক্ষেপেছো? ওই খাড়া নিমগাছ বেয়ে ওঠা আমার কৰ্ম্ম নয়। আমি বাঘ ভালুককেও ডরাই না, কিন্তু খাড়া জায়গায় উঠতে আমার ভারি ভয়।

কিন্তু তা বলে তো হাত পা গুটিয়ে বসে থাকা যায় না। পরঞ্জয়বাবুকে তো দেখলে, এই বয়সেও কেমন তরতর করে উঠে গেলেন।

আরে ওঁর কথা বাদ দাও। জঙ্গলে থেকে থেকে ওঁর একটা জংলি ভাব এসে গেছে। হয়তো হনুমান আর বাঁদরদের কাছে ট্রেনিং নেন। উনি পারলে কি আমাদেরও পারতে হবে?

একটু চেষ্টা করলে হত। আমার বেশ উদ্বেগ হচ্ছে।

আচমকা পবন হাত বাড়িয়ে মহেন্দ্রর মুখে চাপা দিয়ে বলল, চুপ! কে যেন আসছে। এসো, ওই ঝোপটার আড়ালে দাঁড়াই।

অন্ধকার তাঁদের চোখে সয়ে গেছে। তাই দেখতে তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না। পুকুরের ধার ধরে একজন নয়, পরপর তিনটে ভূতুড়ে মূর্তিকে সন্তপর্ণে আসতে দেখা গেল। হাবভাব মোটেই ভাল নয়।

খুব চাপা গলায় পবন বললেন, অন্ধকারে ঠাহর করা মুশকিল। তবে মনে হচ্ছে এরা সেই তিন চোর।

কাদের কথা বলছো?

একজন হল জগা, অন্যজন পাগলু, তিন নম্বরটা ওদের এক স্যাঙাৎ। নাম জানি না।

মহেন্দ্র বললেন, হুঁ, জগা আর পাগলুকে চিনি। এরা চায় কী?

গুপ্তধন ছাড়া আর কী চাইবে বলো! কয়েক ঘণ্টা আগেই এদেরই তো অজ্ঞান করে ফেলে রেখে এসেছিলেন আমাদের সুজনবাবু ওষুধটা হয়তো তেমন জোরালো ছিল না, তাই চটকা ভাঙতেই তিনজন হাজির হয়েছে এসে। ভালই হয়েছে। এদের কাজে লাগানো যেতে পারে।

তার মানে?

শোনো, মানে না জেনে কি আর কথাটা তুলেছি? ভেতরে কী ঘটছে না ঘটছে আমরা জানি না, এদের তিনজনকে যদি ভেতরে পাঠানো যায় তাহলে পরঞ্জয়বাবুর একটু জোর হয়। এদের কাছে গাছ বেয়ে ছাদ ডিঙানো কোনও সমস্যা নয় । লোকবলও তো দরকার।

কিন্তু এরা যদি খুনোখুনি করে?

সে এলেম এদের নেই। ছাপোষা ছিচকে চোর সব। তুমি বাক্সটা নিয়ে আড়ালে থাকো, আমি গিয়ে ওদের সঙ্গে কথা কই।

দেখো, অধিক সন্ন্যাসীতে গাজন না নষ্ট হয়।

হবে না। কোনও ভয় নেই, তাছাড়া সুজনের ওপর এদের রাগও আছে সেই রাগটাও আমাদের কাজে লাগবে।

পাগলু, জগা আর রামু ইতিউতি চাইতে চাইতে নিমগাছটার তলাতেই এসে দাঁড়াল। তাদের চোরের চোখ, বাড়ির ভেতরে ঢোকার এইটাই যে সোজা পথ তা লহমায় বুঝতে পেরেছে।

জগা বলল, পাগলুদাদা, এবার কী করা?

জয় মা বলে ঢুকে পড়তে হবে। সুজনবাবু এতক্ষণে কাজ সেরে ফেলেছে কি না কে জানে।

রামু বলল, আরে নেহি ভাই, কাম সারতে সোময় লাগবে। লেকিন হামলোক ঘুসে করব কী?

কেন, আর কিছু না হোক সাতকড়ির বাড়িতে দামি জিনিসের অভাব কী? সুজনবাবু ভাগ না দিলে অন্যভাবে পুষিয়ে নিতে পারবে।

জগা আর পাগলু একইসঙ্গে বলে উঠল, হ্যাঁ, সেটা ঠিক কথা। তাছাড়া সুজনবাবুও পিস্তল হাতে সাতকড়ির বাড়িতে ঢুকেছে, তাকেও পেয়ে যাবে। মোকাবিলাটাও করে নিতে পারবে।

জগা আর পাগলু সোৎসাহে বলে উঠল, তা তো বটেই। হঠাৎ রামু বলে উঠল, আরে ভাই, ই তো তাজ্জব কি বাত, হামলোগ তো তিন আদমি থা, লেকিন এই চৌঠা আদমি কোন আছে?

জগা বলল, হ্যাঁ হ্যাঁ, তাই তো, এ পাগলুদাদা, আমরা তো তিনজন ছিলাম, তাই না?

তাই তো মনে হচ্ছে। দাঁড়াও তো গুনে দেখি, এক…দুই…তিন…চার…নাঃ, এ তো চারজনই দাঁড়িয়ে যাচ্ছে দেখছি, তবে কি চারজনই ছিলাম?

পাগলু একটু মাথা চুলকে বলল, মাথাটা ভাল কাজ করছে না। সুজনবাবু যে কী ওষুধটা খাওয়ালেন, মাথাটা একেবারে গুবলেট হয়ে গেছে। তিনজন না চারজন থাকার কথা সেটা পর্যন্ত ভুল হয়ে যাচ্ছে।

এ     বার চতুৰ্থজন মোলায়েম গলায় বলল, দুশ্চিন্তা কোরো না হে, আমি তোমাদের দলের লোক নই। আমার নাম পবনকুমার সামন্ত ।

গল্পের শেষ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!