গল্পের ত্রেয়োদশ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
হরিপুর ছাড়িয়ে মাইল পাঁচেক আসার পর মোপেড থামিয়ে কাঁধের থলি থেকে একটা শক্তিশালী ক্ষুদে দূরবীন বের করে পেছনের দিকটা ভাল করে লক্ষ্য করলেন সুজন, না, কেউ আসছে না অনুসরণ করে। নিশ্চিন্ত হয়ে তিনি ফের গাড়ি ছাড়লেন ।
প্রায় কুড়ি মাইল তফাতে সাতগাঁ। গ্রামের উত্তর দিকে একখানা পাকা বাড়ির সামনে গাড়ি থামিয়ে নামলেন সুজন। বারান্দায় উঠে দরজায় টোকা দিতেই দরজা খুলে একটা বেঁটে লোক উকি দিল। .
আরে, আপনি ?
জরুরী কথা আছে।
আসুন, ভেতরে আসুন।
সুজন ভিতরে ঢুকে দরজাটা বন্ধ করে দিলেন।
সন্ধের মুখে আজও ঝোড়ো হাওয়া ছাড়ল এবং ঘন মেঘ করে চারদিক অন্ধকার হয়ে গেল। তারপর নামল তেড়ে বৃষ্টি।
কবিরাজ রামহরি কিছু গাছ-গাছড়ার খোঁজে হরিপুরের দক্ষিণে গড়নাসিমপুরের জঙ্গলে গিয়েছিলেন। ফেরার সময়ে এই দুর্যোগ। সঙ্গে অবশ্য ছাতা ছিল, কিন্তু ঝোড়ো হাওয়ায় ছাতা উল্টে শিকগুলো ছয় ছত্ৰখান। ঠাণ্ডা হাওয়ায় বরফের কুচির মতো বৃষ্টির ফোঁটা থেকে মাথা বাঁচাতে রামহরি দৌড়ে সামনে যে বাড়িটা পেলেন তার মধ্যেই ঢুকে পড়লেন।
ঢুকেই খেয়াল হল এটা সরলাবুড়ির বাড়ি। এ-বাড়ি থেকে শূলপাণি নিরুদ্দেশ হওয়ার পর থেকে তালাবন্ধ হয়ে পড়ে আছে। ভয়ে লোকে এবাড়ির ত্রিসীমানায় আসে না।
রামহরি দাওয়ায় উঠে দাঁড়ালেন। কিন্তু দাওয়াতেও বৃষ্টির প্রবল ছাঁট আসছে। হাতড়ে-হাতড়ে ঘরের দরজাটা দেখলেন। বেশ বড়সড় তালা লাগানো। সুতরাং ঘরে ঢুকে যে গা বাঁচাবেন সে উপায় নেই। চারদিকে ঘুটঘুট করছে অন্ধকার। ব্যাঙ ডাকছে পেছনের পুকুরে। গাছপালায় বাতাসের অতিপ্রাকৃত শব্দ হচ্ছে। যেন পেত্নীর শ্বাস।
রামহরি গাঁয়ের লোক, সহজে ভয় খান না। কিন্তু আজ যেন গা-টা একটু ছমছম করছে। সরলাবুড়ির বাড়িটা গাঁয়ের বাইরে। কাছেপিঠে অন্য বাড়িঘড় নেই। সরলা পিসির সাহস ছিল বটে। একা এই নির্জন পুরীতে বুড়ি দীর্ঘদিন বাস করেছে। শূলপাণি তো এল এই সেদিন। .
কবিরাজি চিকিৎসায় খুব বিশ্বাস ছিল পিসির। শেষ কয়েক বছর রামহরিই তার চিকিৎসা করেছেন। বাড়িটার দাওয়ায় দাঁড়িয়ে আজ অনেক কথা মনে পড়ছিল রামহরির। বিশেষ করে এক সন্ধেবেলার কথা। খুব শীত পড়েছিল সেদিন। গড়নাসিমপুরের জঙ্গলে সেইদিনই সন্ধেবেলা বাঘের ডাক শোনা যাচ্ছিল। খুব কুয়াশা ছিল চারদিকে। এটা যে সময়ের কথা তখন শূলপাণি আসেনি।
রামহরি যখন বুড়ির নাড়ী দেখছিল মন দিয়ে তখন বুড়ি হঠাৎ বলল, “ও বাবা রামহরি, তোকে একটা কথা বলব?”
“বলুন পিসিমা।”
আগে এ-গাঁয়ে মেলা চোর-ছ্যাঁচড় ছিল। বাইরে থেকেও আসত সব দেহাতি চোর। এ-বাড়িতে মাঝরাতেই আনাগোনা করত তারা। তখন ঘরের দোর এঁটে বসে খুব বকাঝকা করতুম তাদের। তা তারাও মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বাইরে থেকে ঝগড়া করত। দু-চারটে চোরের সঙ্গে এ-ভাবেই বেশ ভাব সাব হয়ে গিয়েছিল।
রামহরি অবাক হয়ে বললেন, “তাই নাকি? এতো সাঙ্ঘাতিক কথা পিসি !”
একগাল হেসে বুড়ি বলল, “তা কী করি বল। আমার তিনকুলে কেউ নেই, গাঁয়ের লোকও কেউ বড় একটা আসে না। একা থাকি। তা চোরছ্যাঁচড়দের সঙ্গেই যা একটু কথাটথা বলতুম। এখন তারা আর আসে না। কেন বলতে পারিস?”
“তা তো জানি না পিসি। চোর-ছ্যাঁচড়দের সঙ্গে আপনারই বা দরকারটা কী।”
“ওই যে বললুম তোকে, তারা এলে দুটো কথা কয়ে বাঁচতুম। দু চারজনের সঙ্গে তো বেশ ভাবই হয়ে গিয়েছিল। কালীচোর ছিল, সাতগাঁয়ে বাড়ি। চার ছেলে, দুই মেয়ে নিয়ে বড় সংসার। তার আবার হাতে বাতব্যাধি ছিল। বউটী দজ্জাল বলে কত দুঃখ করত। আর ছিল নবা চোর। একেবারে ছেলেমানুষ। তার সৎ-মা বলে বাড়িতে আদর ছিল না। একবার তাকে জানালা গলিয়ে এক বাটি পান্ত ভাত খাইয়েছিলুম। আরও ছিল গণশ চোর। খুব পাজি ছিল। জানালায় দমাদম ইট মারত। একখানা টাকা ছিল তার বরাদ্দ। টাকা দিলেই চলে যেত।”
রামহরি হাসলেন, “উরেববাস ! এ তো সাঙ্ঘাতিক কথা।”
“তা বাবা, চোরসকল যে উধাও হয়ে গেল। এরকমটা কি ভাল ?”
“লোকে তো বলে চোর-ছ্যাঁচড় না থাকাই ভাল।”
“সে তোদের বেলায়। আমার বাপু, চোরটোর তেমন খারাপ লাগে না।”
রামহরি মাথা চুলকে বললেন, “একা থেকে থেকে আপনার মাথাটাই গেছে দেখছি পিসি। তা একা থাকবার দরকারটাই বা কী ? একজন কাজের মেয়ে রেখে দিন না, সে দিনরাত থাকবে আর মনের আনন্দে তার সঙ্গে বকবক করবেন।”
ওরে বাবা, কাজের মেয়ে রাখব কী রে ? তারা যে ভীষণ চোর হয়। আমি বুড়োমানুষ, কোথা থেকে কোন জিনিসটা সরাবে টেরও পাব না।”
রামহরি হেসে ফেললেন, “তা সরালে সরাক না। আপনি তো চোরই খুঁজছেন ?”
“না, না বাবা, ঘরে চোর পুষতে পারব না। তবে আমার এখন একজন চোর খুব দরকার। একটা ভাল দেখে চোর খুঁজে পেতে দিবি বাবা? আনাড়ি হলে চলবে না। বেশ পাকা চোর চাই। পারবি?”
রামহরির তো একগাল মাছি। সরলা পিসির মাথাটা যে একটু বিগড়েছে যে বিষয়ে তাঁর আর সন্দেহ রইল না। কিন্তু মুশকিল হচ্ছে মাথা বিগড়োনোর অন্যান্য লক্ষণ ঠিকমতো মিলছে না। তিনি আমতা আমতা করে বললেন, “আচ্ছা দেখবখন। আমার কাছে রুগি যারা আসে তাদের মধ্যে খুঁজলে হয়তো একআধজন চোর পাওয়া যেতেও পারে ”।
“ওরে না না, ব্যাপারটা হালকাভাবে নিসনি। শক্ত কাজ, পাকা হাতের চোর ছাড়া পেরে উঠবে না।”
রামহরি অবাকের ওপর আরও অবাক হয়ে বললেন, চোরকে দিয়ে কী কাজ করবেন পিসি?”
“তোর মাথায় কি গোবর রে রামহরি ? চোর চাইছি কি চণ্ডীপাঠ করবে বলে?”
“তাহলে ?”
“চোরকে দিয়ে চুরিই করাব বাবা। তবে কাজটা শক্ত। তাই পাকা হাতের লোক খুঁজছি।”
“চুরি করাবেন পিসি ? কী সব্বোনেশে কথা! কী চুরি করাবেন ? কেন চুরি করাবেন ? চুরি করা যে মহা পাপ।”
ফোকলা মুখে এক গাল হেসে সরলা পিসি বলল, “শাস্তরের কথা কি আর জানি না রে বাপ! সব জানি, চুরি করা পাপ, মিথ্যে কথা বলা পাপ, আরও কত পাপ আছে।”
“তাহলে চুরি করতে চাইছেন কেন ?”
“কথাটা ভেঙে বলতে পারছি না রে বাপ। বলতে ইচ্ছে যাচ্ছে বটে, কিন্তু কথাটা এখুনি ফাঁস হয়ে গেলে মুশকিল। আগে একটা ভাল দেখে চোর এনে দে, কাজটা উদ্ধার হোক, তারপর একদিন তোকে সব খুলে বলব।”
রামহরির যদিও সরলা পিসির মাথার গণ্ডগোল হয়েছে বলে সন্দেহ রয়ে গেল, তবু চোরও তিনি কিন্তু খুঁজেছিলেন। তাঁর রুগিদের মধ্যে একজন ছিল নিতাই পাল। তার আধকপালে মাথা ধরার জন্য চিকিৎসা করাতে আসত। নিতাই নানা জায়গায় ঘোরে, খুব ফিকিরফন্দি জানে। তা তাকেই রামহরি চোরের কথা বললেন, “ও নিতাই, আমাকে ভাল একজন চোরের সন্ধান দিতে পারো?”
“চোর !” বলে নিতাইয়ের যে কী হাসি, হাসি আর থামেই না, তারপর বলল, “কবরেজমশাই, ব্যাপারটা কী?”
“সে আছে, বলা যাবে না।”
“বলি চোর ধরে তাকে বেটে বা থেতো করে ওষুধ বানাবেন না তো ! আয়ুর্বেদে নাকি কিম্ভূত আর বিটকেল নানা জিনিস দিয়ে ওষুধ বানায়।”
“আর না না অন্য ব্যাপার ”
তা নিতাই এনেছিল দুটো চোরকে, একজন ফিচকে, অন্যজন ফটিক, দুজনেরই বয়স কম, দুজনেই রোগা, দুজনেই কালো, দুজনেরই মাথায় বাবরি চুল, দুজনের চোখেই বেশ চালাক-চালাক দৃষ্টি আর দুজনেরই মুখে মিচকে হাসি, রামহরি বুঝলেন, এরা সত্যিই কাজের লোক।
দুজনকেই সরলা পিসির কাছে নিয়ে গিয়েছিলেন রামহরি, চোর দেখে পিসির আনন্দ আর ধরে না। তাড়াতাড়ি মুড়ির মোয়া আর নাড়ু খেতে দিলেন। তারপর রামহরিকে বললেন, “তোর উপকারের কথা ভুলব না। এবার তুই বাড়ি যা এদের সঙ্গে আমার গোপন শলাপরামর্শ আছে।”
এতদিন বাদে সেইসব কথা মনে পড়ে রামহরির একটু হাসি পাচ্ছিল, চোর দিয়ে সরলা পিসি কী করেছিল তা আজও জানে না রামহরি।
সামনেই একটা তালগাছের মাথায় নীল একটা বিদ্যুতের ধাঁধানো শিখা নেমে এল। দপ করে আগুন জ্বলে উঠল গাছের মাথায়। তারপর যে বাজের শব্দটা হল তা থেকে কান বাঁচাতে রামহরি দুকান চেপে ধরে রইলেন।
তারপরই হঠাৎ শুনতে পেলেন খুব কাছে কারা যেন কথা কইছে, একটু থতমত খেয়ে ঠাহর করে শুনলেন, তালাবন্ধ ঘরের ভেতর থেকে কথা শোনা যাচ্ছে। রামহরির মেরুদণ্ড বেয়ে হিমের স্রোত নেমে গেল।
গল্পের ত্রেয়োদশ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।