গল্পের পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
রামহরি ভাবলেন, মনের ভুলই হবে। এই দুর্যোগে কে এসে তাঁর পেছনে লাগবে? তবে এখানে আর কালক্ষেপ করা যে যুক্তিযুক্ত হবে না সেটা বুঝতে পারলেন রামহরি। সুতরাং ঝড়বৃষ্টি উপেক্ষা করেই তিনি দাওয়া থেকে নেমে পড়লেন, তারপর বয়স অনুপাতে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে যত জোরে ছোটা যায় তত জোরেই ছুটতে লাগলেন। কিন্তু সম্মুখে এত ঘুটঘুটি অন্ধকার যে, দৌড় কেন হাঁটাও খুব কঠিন, রামহরি প্রথমে একটা বাগানের বেড়া ভেঙে কুড়মুড় করে পড়লেন, তাতে “চোর, চোর” বলে কেউ চেঁচিয়ে ওঠায় ভয় খেয়ে রামহরি আর এক দফা ছুটতে গিয়ে একটা গাছের সঙ্গে বেজায় ধাক্কা খেয়ে ধরণীতলে জলকাদায় প্রপাত হলেন, এবং ফের উঠে দিগভ্রান্ত হয়ে কোথায় যে যাচ্ছেন তা বুঝতে না পেরে হাঁটিতে লাগলেন।
একবার তাঁর মনে হল পথ ভুলে গাঁয়ে ঢোকার বদলে গাঁয়ের বাইরেই চলে এলেন নাকি? এখন চেপে বৃষ্টি হচ্ছে, বিদ্যুতের চমকানি নেই বলে রাস্তাঘাট কিন্তু ঠাহর করার উপায় দেখছেন না। এ অবস্থায় হাঁটা অতীব বিপজ্জনক। কোন খানাখন্দ পুকুরে-ডোবায় পড়েন তার ঠিক কী?
রামহরি সুতরাং একটা গাছ ঠাহর করে তার নিচে দাঁড়িয়ে পড়লেন। ছোটোছুটিতে যথেষ্ট ধকলও গেছে। একটু জিরোনোও দরকার। সরলাপিসির বাড়িতে কারা ঢুকে বসে আছে সে কথাটাও মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে। সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সার কথাও ভুলতে পারছেন না।
ঝড়বৃষ্টি এবং ঘুটঘুটি অন্ধকারের ভেতরে হঠাৎ রামহরি একটা ক্ষীণ আলোর রেশ দেখতে পেলেন। সামনে, পঞ্চাশ-ষাট গজ দুরে যেন একটা লণ্ঠনের আলো দেখা যাচ্ছে। মনে হল, কোনও বাড়ি থেকেই আলোটা আসছে, যার বাড়ি হোক আশ্রয় তো আপাতত জুটবে, গায়ের সব লোকই তো চেনা।”
রামহরি গুটি-গুটি আলোটার দিকে এগোতে লাগলেন, যত এগোচ্ছেন আলোটা বেশ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে, গাছপালার মধ্যে বাড়ির মতো কিছু একটার আকার দেখা যাচ্ছে। রামহরি ‘জয়দুর্গা’ বলে এগিয়ে একেবারে বাড়ির দাওয়ায় উঠে পড়লেন, পাকা দালান, সামনেই একটা ঘরের কাচের শার্শি দিয়ে লণ্ঠনের জোরালো বাতি দেখা যাচ্ছে। চিনতে আর ভুল হল না রামহরির, কাঁচের শর্শিওলা বাড়ি হরিপুরে একটাই আছে। এ হল সুজন বোসের বাড়ি।
সুজন বোসের বাড়িতে সর্বদা গরম কফি পাওয়া যায়। মানুষটি পণ্ডিতও বটে, কথা কয়ে যেন আরাম, গা পুছে একটু জিরিয়ে বৃষ্টির তোড়টা কমলে বাড়ি যাওয়া যাবে।
ও সুজনবাবু—”
কেউ সাড়া দিল না। রামহরি আরও বারকয়েক হাঁকডাক করলেন, আশ্চর্যের ব্যাপার! ভেতরে আলো জ্বলছে। তালাও দরজায় দেওয়া নেই, তবে লোকটা কি বাথরুম-টাথরুমে গোছে? রামহরি জানালা দিয়ে ভেতরে উকি দিলেন, জানালায় একটা হাফ পরদা টানা থাকায় কিছুই দেখতে পেলেন না প্রথমে। কিন্তু পরদার ডানদিকে নিচের কোনাটা সামান্য ফাঁক হয়ে আছে দেখে সেখানে চোখ পেতে রামহরি আপনমনেই বলে উঠলেন, সর্বনাশ! যা দেখলেন তা হল পায়জামা-পরা দুখানা পা মোঝতে সটান হয়ে আছে। এক পায়ে চটি, অন্য পা খালি, এর মানে সুজন হয় অসুস্থ হয়ে পড়ে গেছে, যেমনটা ষ্ট্রোক হলে হয় নইলে অন্য কিছু…
রামহরি আতঙ্কিত হলেও তিনি কবিরাজ মানুষ, লোকের রোগ ভোগ, বিপদ দেখলে পালানো তাঁর ধর্মনয়, তিনি দরজায় ফের ধাক্কা দিলেন, তারপর ওপর দিকটা হাতড়ে দেখলেন, বাইরে থেকে শেকল তোলা আছে। শেকলটা খুলতেই বাতাসের ধাক্কায় দরজার দুটাে পাল্লা ধড়াস করে খুলে গেল।
ঘুরে ঢুকেই আগে দরজাটা বন্ধ করে ছিটকিনি দিলেন রামহরি। তারপর দেখলেন ঘরটার অবস্থা লণ্ডভণ্ড। স্টিলের আলমারিটা হা করে খোলা। সুজন মেঝেতে সটান হয়ে শুয়ে আছেন উপুড় হয়ে।
হাঁটু গেড়ে বসে আগে নাড়ীটা পরীক্ষা করলেন রামহরি, নাড়ী আছে, প্রাণে বেঁচে আছে লোকটা। ভাল করে পরীক্ষা করতে গিয়ে রামহরি সুজনের মাথার পেছনে ক্ষতস্থানটা আবিষ্কার করলেন। লাঠি বা ওরকম কিছু নয়, নরম ভারী জিনিস দিয়ে সুজনকে মারা হয়েছে মাথায়। তার ফলে জায়গাটা ফুলে কালশিটের মতো পড়লেও রক্তক্ষরণ তেমন হয়নি, রবারের হোস দিয়ে মারলে এরকম হতে পারে।
মুখে-চোখে একটু জল ছিটিয়ে দিলেন রামহরি, তারপর হাত-পা ভাঁজ করে কিছু প্রক্রিয়া চেষ্টা করলেন, মিনিট দশেকের চেষ্টায় সুজন চোখ মেলে চাইলেন, খুব ভ্যাবলা চোখ। যেন কিছুই চিনতে পারছেন না।
আরও মিনিটদশেক বাদে সুজন উঠে চেয়ারে বসতে পরলেন, মুখে কথাও ফুটল।
“ওঃ, মাথাটা ছিড়ে পড়ছে যন্ত্রণায়।”
“কে মারল আপনাকে?”
সুজন মাথা নেড়ে বললেন, “জানি না, মুখ ঢাকা দুটো লোক।”
“কখন হল ?”
“সন্ধের পর। ঘরে বসে কাজ করছিলাম, কে যেন দরজায় কড়া নাড়ল, উঠে দরজা খুলতেই দুই মূর্তি ধাক্কা দিয়ে ঢুকে পড়ল!”
“পিস্তল বার করার চেষ্টা করেছিলাম, পারলাম না, তার আগেই পেছন থেকে মাথায় এমন মারল, তারপর আর কিছু মনে নেই।”
“আপনার ঘরে ঢুকে ওরা তো লুটপাট করে নিয়ে গেছে বলেই মনে হবেই, নাঃ, এ-গাঁ ক্ৰমে বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠছে দেখছি।”
সুজন মাথাটা দুহাতে চেপে বসে ছিলেন, হঠাৎ মুখ তুলে আলমারিটার দিকে চেয়ে বললেন,“সর্বনাশ!”
বলেই তাড়াতাড়ি উঠে এসে আলমারিটার ভেতরে কী যেন আঁতিপাতি করে খুঁজে দেখলেন, তারপর বললেন, “নাঃ, নিয়েই গেছে!”
“কী নিয়ে গেছে সুজনবাবু ?”
“ওঃ সে একটা সোনার গয়না।”
“কীরকম গয়না ?”
“ঠিক গয়না নয়। একটা সোনার ঘড়ি । দামি জিনিস।”
কথাটা যেন একটু কেমন ভাবে বলা। রামহরি একটু সন্দিহান হলেন, কিন্তু কিছু বললেন না।
সুজন বললেন, আমার ঘরে দামি জিনিস বা টাকা-পয়সা তেমন কিছু থাকে না। সবই যেত।”
রামহরি চিন্তিতভাবে বললেন, “সোনার ঘড়িটাই বা কম কিসের? কত ভরি সোনা ছিল ওতে?”
“দু-তিন ভরি হবে বোধ হয় ওজন করিনি।”
“কী ঘড়ি ?”
“রোলেক্স ”
“টেবিলের ওপর এই যে ঘড়িটা দেখছি এটাও তো রোলেক্স বলেই মনে হচ্ছে। এটা নয় তো!”
সুজন যেন একটু তটস্থ হয়ে বললেন, “না ওটা তো আমি হাতে পরি। এটা ছিল তোলা ঘড়ি।”
“ওষুধপত্র ঘরে কিছু আছে? ক্ষতস্থানে একটু বরফ দিলে হত।”
“বরফ কোথায় পাব? তবে আমার কাছে কিছু ওষুধ থাকে। চিন্তা করবেন না, সামলে নেব, আপনি এসে না পড়লে কী যে হত।”
রামহরি বললেন, “আমি না এলেও তেমন কিছু হত না। একটু বেশিক্ষণ অজ্ঞান হয়ে থাকতে হত আর কি ”।
সুজন একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, “আমার একটা কথা রাখবেন রামহরি বাবু?”
“বলুন।”
“এ ঘটনাটার কথা কাউকে জানাবেন না।”
“কেন বলুন তো? এত বড় ঘটনা চেপে যাবো ?”
চাপতে হবে না। দুদিন সময় চাইছি। আমি নিজে একটু তদন্ত করতে চাই। তারপর বলবেন।
গল্পের পঞ্চম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।