হরিপুরের হরেক কান্ড–একাদশ তম পর্ব-শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়

গল্পের দ্বাদশ তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সুজন বোস সকালবেলা থেকেই একটু চিন্তিত, তিন কাপ কালো কফি খেয়ে বাগানে পায়চারি করে চিন্তার জট ছাড়ানোর চেষ্টা করছেন, তাতে মাথার মেঘ কাটেনি। এখন বেলা সাড়ে দশটা নাগাদ নিজের ল্যাবরেটরিতে বসে একটা সায়েন্স ম্যাগাজিনের পাতা ওল্টাচ্ছেন।

দক্ষিণের জানালার দিকটায় ফণিমনসার ঝোপজঙ্গল, সেদিক থেকেই মৃদু একটু গলা খাঁকারির আওয়াজ এল।

সুজন ভ্রুটা সামান্য কুঁচকে মৃদু গলায় বললেন, আসতে পারো। মিনিটখানেক বাদে ল্যাবরেটরির খোলা দরজায় পাগলু এসে বশংবদ মুখ করে দাঁড়াল।

 

কী খবর পাগলু ?

আজ্ঞে খবর তো মেলা, ধীরে ধীরে বলতে হবে। সময় লাগবে। সুজন একটু হেসে বললেন, গাঁয়ের লোকের একটা দোষ কী জানো? তাদের কাছে সময়ের কোনও দামই নেই। সময় কেমন করে কাটাবে তাই তারা ভেবে পায় না। এক মিনিটের কথা এক ঘণ্টা ধরে ফেনিয়ে ফেনিয়ে বলে।

তা যা বলেছেন।

গুরুতর খবর হলে বলতে পারো, তবে সংক্ষেপে।

যে আজ্ঞে। আমার এক স্যাঙাত আছে, জগা। জানেন তো !

শুনেছি, চোর তো !

আজ্ঞে, তবে বিশেষ সুবিধে করতে পারেনি। আজ তাকে দিনুগুণ্ডা ধরেছিল একটা খুনের কাজে লাগানোর জন্য। আর গোঁসাই গোপেশ্বর আমাদের পাকড়াও করেছিল নিতাই পালের খবরের জন্য।

ভ্রুটা একটু কোঁচকালো সুজনের। বললেন, নিতাই পালের কথা সে কী বলছে?

সে বলছে নিতাই পালই নাকি শূলপাণিকে গুম করেছে।

সুজন গম্ভীরভাবে শুধু বললেন, গুম। আর কিছু ?

মাথা নেড়ে পাগলু বলল, সংক্ষেপে বলতে বলছেন, তাই সংক্ষেপেই বললুম, তবে গোপেশ্বরের বিশ্বাস সরলাবুড়ির দু ঘড়া মোহর আছে।

সুজন একটু হাসলেন, বললেন, মোহরের গপ্পো আমিও শুনেছি। মোহর কি ছেলের হাতের মোয়া?

আজ্ঞে, আমরাও তাই বলেছি।

ঠিক আছে, এখন যাও। পরঞ্জয়বাবুর খবর-টবর একটু নিও।

আজ্ঞে নিয়েছি। কাল রাতেই গিয়েছিলাম। দিব্যি মনের আনন্দে আছেন। কোনও খবর দিতে হবে কি ?

খবর দেওয়ার কিছু নেই। শুধু জেনে আসবে কিছু লাগবে-টাগবে কি না, কোনও অসুবিধে হচ্ছে কি না।

কিছু লাগবে না। মনের আনন্দে আছেন।

ঠিক আছে। এখন যাও !

পাগলু চলে যাওয়ার পর সুজন চুপ করে বসে রইলেন। মিনিট দশেক ধ্যানস্থ থাকার পর উঠে ল্যাবরেটরির দরজা বন্ধ করে খিল দিয়ে লোহার আলমারিটা খুললেন। ভেতর থেকে একটা কাঠের বাক্স বের করে ডালাটা খুলে কিছুক্ষণ চেয়ে রইলেন। বাক্সের ভেতর সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সা। রোজই কিছুক্ষণ তিনি জিনিসগুলো দেখেন। সাতটা কড়ি মানে সাতকড়ি নামের কেউ একজন—এটা বুঝবার জন্য বেশি বুদ্ধির দরকার হয় না। কিন্তু মুশকিল হল সাতটা পয়সা নিয়ে। পয়সার ধাঁধা তিনি এখনও সমাধান করতে পারেননি। সাতটা পয়সা মানে সাত পা হাঁটার সংকেত হতে পারে, সাত ফুট দূরত্ব হতে পারে, কিংবা আরও অনেক কিছু।

সুজন বাক্সটা আবার যথাস্থানে রেখে আলমারি বন্ধ করে চেয়ারে বসতে যাচ্ছেন এমন সময়ে বাইরে হেঁড়ে গলায় কে ডাকল, সুজনবাবু আছে নাক ?

সুজন দরজা খুলে দেখলেন, গদাই নস্কর আর নগেন দারোগা দাঁড়িয়ে আছেন।

সুজন মৃদু হেসে বললেন, আসুন আসুন।

ল্যাবরেটরির এক ধারে চেয়ার-টেয়ার পাতা আছে। দুজনে বসবার পর নগেন দারোগা বলল, এসে ডিস্টাব করলাম নাকি? কোনও বৈজ্ঞানিক গবেষণা করছিলেন না তো !

সুজন হেসে বললেন, কথাটা ঠাট্টার মতো শোনাচ্ছে। এই ল্যাবরেটরিতে কি গবেষণা হয়? যন্ত্রপাতি কোথায়? ইলেকট্রিক কোথায়? গবেষণা টবেষণা নয়, বসে বসে চিন্তা-ভাবনা করি আর কি, তা কী খবর বলুন?

নগেন দারোগা পা ছড়িয়ে বসে বললেন, এ গাঁয়ে আপনিই সবচেয়ে মান্যগণ্য লোক। অনেক লেখাপড়া করেছেন, বিলেত-বিদেশ ঘুরে এসেছেন। আপনার কাছে একটা কথা বলতে আসা |

বলুন।

হরিপুর বড় শান্তির জায়গা ছিল। কখনও কোনও গণ্ডগোল হয়নি, কিন্তু ইদানীং এসব কী হচ্ছে বলুন তো!

সুজন শান্ত গলায় বললেন, শূলপাণির নিরুদ্দেশ হওয়া নিয়ে ভাবছেন নাকি?

শুধু শূলপাণি কেন? আমাদের পরঞ্জয়দাদারওতো একই কথা। দু-দুটো লোক গাঁ থেকে উবে গেল মশাই, এ কি সোজা কথা ?

সুজন একটু চিন্তিতভাবে বললেন, ঘটনা দুটি নিয়ে আমিও ভাবছি। শূলপাণির সঙ্গে আমার সামান্য আলাপ ছিল। পরঞ্জয়বাবু অবশ্য একরকম বন্ধু মানুষ। কিন্তু এরা কোথায় যেতে পারেন তা আমিও ভেবে পাচ্ছি না।

গদাই নস্কর বলল, এ অঞ্চল আমার চেয়ে ভাল কেউ চেনে না। একসময়ে সারা তল্লাট জুড়ে আমি ডাকাতি করে বেড়িয়েছি। সব জায়গাতেই আজও আমার পুরনো চরেরা আছে। কিন্তু তারাও কেউ কোনও হদিস দিতে পারেনি।

সুজন গম্ভীরভাবে বললেন, চিস্তার কথা। নগেন দারোগা বলল, আপনি বুড়ো মানুষ, একা থাকেন, চোর ডাকাত জানে যে আপনি বিদেশ থেকে মেলা টাকা পয়সা নিয়ে এসেছেন। তাই আপনাকে নিয়েও আমাদের ভাবনা হচ্ছে। আপনি দুর্জয় সাহসী না হলে এভাবে একা থাকতেন না। কিন্তু আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি আপনার নিরাপত্তার জন্য একটা পাহারা বসাব ।

সুজন চমকে উঠে বললেন, সর্বনাশ ! ও কাজও করতে যাবেন না।

কেন বলুন তো !

সুজন মাথা নেড়ে বললেন, আপনাদের ধারণা ভুল। টাকা-পয়সা আমার বিশেষ কিছু নেই। বিদেশে আমি অনেক রোজগার করেছিলুম বটে, কিন্তু দেশে ফিরে একটা ব্যবসা করতে গিয়ে আমার বেশিরভাগ টাকাপয়সাই নষ্ট হয়েছে। এখন যা সামান্য আছে তা দিয়ে কোনওরকমে চলে যায়। চিন্তা করবেন না, টাকা-পয়সা আমার ঘরে থাকে না, কালীপুরের ব্যাংকে রাখা আছে।

নগেন দারোগা মাথা নেড়ে বলল, কিন্তু চোর-ডাকাতরা তো আর তা জানে না, তার হানা দিতে পারে।

সুজন একটু চুপ করে থেকে বললেন, আপনি প্রাক্তন দারোগা বলেই বলছি, দোষ ধরবেন না, এ-তল্লাটের চোর-ডাকাতদের আমি চিনি, কিছু ভাবসাবও আছে। আমাকে নিয়ে মোটেই উদ্বিগ্ন হবেন না। আপনাদের কি ধরণা হয়েছে যে, শূলপাণি আর পরঞ্জয়ের পর এবার আমার নিরুদ্দেশ হওয়ার পালা ?

নগেন দারোগা মাথা চুলকে বলে, বলা তো যায় না।

সুজন বললেন, গুম করলে অন্যকথা, কিন্তু নিজের ইচ্ছেয় হঠাৎ এ বয়সে নিরুদ্দেশ হওয়ার ইচ্ছে আমার নেই। আর গুম করার চেষ্টা কেউ করলেও কাজটা সহজ হবে না। সত্তরেও আমি বেশ তেজী লোক। বালিশের পাশে পিস্তল নিয়ে শুই। ঘাবড়াবেন না, পিস্তলের লাইসেন্স আছে।

গদাই লস্কর চিন্তিতভাবে বলল, তবু সাবধানের মার নেই। আপনার বাড়িতে আলাদা করে পাহারা না বসালেও সারা গাঁয়ে সারা রাত পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছে।

সুজন বললেন, ভালই করেছেন। তবে আমার বিশ্বাস, এসব গুম-টুম নয়।

নগেন বলল, তাহলে কী?

সুজন একটু চিন্তিতভাবে বললেন, শূলপাণি একজন বাতিকগ্রস্ত মাথাপাগলা লোক। আমি বৈজ্ঞানিক বলে সে আমার কাছে নানা উদ্ভট প্রস্তাব নিয়ে আসত। গুপ্তবিদ্যা আর অলৌকিকের ওপর খুব ঝোঁক ছিল। আমার মনে হয় সে সেরকমই কোনও বিদ্যা অর্জনের জন্য কোথাও গেছে। কিংবা…

নগেন ঝুঁকে বসে বলে, কিংবা?

সে কথা থাক। আর একটু বিচার-বিশ্লেষণ করে ভেবে তবে বলা যাবে।

গদাই বলল, আপনি কি শুনেছেন যে তার ঘরে একটা কাঠের বাক্সে সাতটা কড়ি আর সাতটা পয়সা ছিল?

হ্যাঁ, শুনেছি। জিনিসগুলো সে আমাকে দেখিয়েও গেছে।

কেন দেখিয়েছিল ?

মাথা নেড়ে সুজন বলল, তা জানি না, সে শুধু জিজ্ঞেস করেছিল এগুলো দেখে আমি কিছু বুঝতে পারছি কি না।

আপনি কী বললেন ?

আমি কিছু বুঝতে পারিনি আর সেটাই বললাম।

আপনি কি জানেন যেদিন সে গুম হয় সেদিন আমাদের নাকের ডগা দিয়ে বাক্সটা লোপাট হয়ে যায় ?

তাও জানি।

ব্যাপারটা রহস্যময় মনে হচ্ছে না?

হচ্ছে।

ওই কড়ি আর পয়সা কোনও সঙ্কেতও হতে পারে তো !

হতেই পারে। কিন্তু সেই সঙ্কেত ভেদ করার মতো বুদ্ধি আমার নেই। আপনাদের বলি, এসব তুচ্ছ ব্যাপার নিয়ে এত ভাবছেন কেন? গাঁয়ের মানুষ সহজেই রহস্যের গন্ধ পায়। আমি বিজ্ঞানী বলেই বাস্তবভাবে ব্যাপারটা দেখার চেষ্টা করি। ওই পয়সা আর কড়ির ভেতরে কোথাও সংকেত বা রহস্য না থাকারই সম্ভাবনা বেশি। যে বাক্সটা চুরি করেছে সে গুপ্তধনের সম্ভাবনার কথা ভেবেই করেছে হয়তো। কিন্তু লাভ হবে বলে মনে হয় না।

গদাই বলল, রাত আটটার সময় শূলপাণি রোজ অট্টহাসি হাসত। এখন সেটাকেও অনেকে সংকেত বলে মনে করছে। আপনার কী মনে হয় ?

সুজন মৃদু হেসে বললেন, হাসিটা আমিও শুনেছি। কিছু মনে হয়নি। বাতিক ছাড়া কিছু নয়।

নগেন দারোগা হতাশার গলায় বলল, না, আপনি দেখছি সবই উড়িয়ে দিচ্ছেন।

সব উড়িয়ে দিচ্ছি না। আপনারা যা বললেন এসব নিয়েও ভাবব। গদাই নস্কর আর নগেন দারোগ উঠতে যাচ্ছিল, সুজন বললেন, একটা কথা, গোপেশ্বর গোস্বামীকে তো চেনেন নিশ্চয়ই।

নগেন বলল, চিনবো না ? সে তো গাঁয়েরই লোক?

লোকটা কেমন?

মিটমিটে বিছু টাইপের, তবে তার নামে তেমন বড় কোনও অভিযোগ নেই। কেন বলুন তো?

এমনিই, কৌতুহল, সে মাঝে মাঝে আমার কাছে আসে।

কী বলে সে ?

সুজন একটু হেসে বললেন, কূটকচালি করতেই আসে। লোকটাকে সুবিধের ঠেকে না।

নগেন মাথা নেড়ে বলে, লোক সুবিধের নয় ও। তেমন কিছু হলে জানাবেন, ধমকে দেবো।

না, না, ধমকানোর কিছু নেই। দুজনে চলে যাওয়ার পর সুজন উঠলেন। স্নান-খাওয়া সেরে একটু বিশ্রাম করে বেরিয়ে পড়লেন। তাঁর একখানা মোপেড আছে। মোপেডটা ঘর থেকে বের করে উঠোনে নামিয়ে স্টার্ট দিলেন। তারপর গাঁয়ের দক্ষিণ প্রান্তের দিকে গাড়িটা চালিয়ে দিলেন।

গল্পের দ্বাদশ তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!