হযরত হিযকীল (আঃ)
তাওরাত কিতাবে উল্লেখিত হয়েছে যে, হযরত হিযকীল (আঃ)-এর পিতা ছিলেন একজন জ্যোতিষী। কারো কারো মতে তার পিতার নাম ছিল সাওরী। কারো কারো মতে কোরআন কারীমে উল্লেখিত যুলকিফলই হচ্ছে হযরত হিযকীল (আঃ)। হিযকীল ইবরানী ভাষার শব্দ। এর দুটি অংশ হিযকী ও ঈল। হিযকী অর্থ কুদরত আর ঈল অর্থ আল্লাহ। অর্থ অনুসারে তার নাম দাঁড়ায় আল্লাহর কুদরতী অর্থাৎ তিনি ছিলেন আল্লাহর কুদরতের নিদর্শন। বর্ণিত আছে, হযরত হিযকীল (আঃ) শৈশবেই তাঁর পিতাকে হারান। হযরত হিযকীল (আঃ) যখন নবুয়ত প্রাপ্ত হন তখন তাঁর মা অতিশয় বৃদ্ধা হয়ে পড়েছিলেন। তাই লোকেরা তাঁকে বৃদ্ধার পুত্র বলে সম্বোধন করত। তিনি এ সম্বোধনেই সাধারণ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন। দীর্ঘকাল পর্যন্ত তিনি বনী ইসরাইলের মাঝে দ্বীনে হক প্রচার করেন।
পবিত্র কোরআনে হযরত হিযকীল (আঃ)-এর সাথে সম্পর্কিত একটি ঘটনা বর্ণিত হয়েছে। তা হচ্ছে- কোন এক পল্লীতে বনী ইসরাইলের কিছু লোক বসবাস করত। একদা সে পল্লীতে মহামারী আকারে প্লেগ রোগ ছড়িয়ে পড়ে। এতে বহু লোক মৃত্যুর করাল গ্রাসে নিপতিত হয়। এক বর্ণনায় রয়েছে, হযরত হিযকীল (আঃ) বনী ইসরাইলীদেরকে এক শত্রুর বিরুদ্ধে জিহাদের প্রস্তুতি গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছিলেন, কিন্তু তারা তাদের স্বভাবগত মুর্খতার বশবর্তী হয়ে এ নির্দেশ পালনে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে। তাই আল্লাহ তায়ালা অসুন্তুষ্ট হয়ে তাদের উপর প্লেগ রোগ মহামারী আকারে চাপিয়ে দেন। এতে তাদের অনেক লোক মৃত্যু মুখে পতিত হয়। মৃত্যু ভয়ে ভীত হয়ে প্লেগ আক্রান্ত পল্লীর বেশ কিছু লোকজন অন্যত্র চলে যাওয়ার উদ্দেশ্যে স্বীয় আবাসস্থল ত্যাগ করে। তারা ভেবেছিল, অন্যত্র গমন করতে পারলেই মৃত্যুর করালগ্রাস থেকে রক্ষা পাবে। তারা দু পাহাড়ের মধ্যবর্তী এক সমতল ভূমিতে পৌঁছে। কারো কারো মতে জায়গাটি ছিল তাদের আবাসস্থল থেকে একশ ক্রোশ দূরে অবস্থিত। তখন আল্লাহ তায়ালা সেখানে দুজন ফেরেশতা প্রেরণ করেন। ফেরেশতাদ্বয় দুদিকে পাহাড়বেষ্টিত সমতল ভূমির দু পার্শ্বে দাঁড়িয়ে আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে এমন জোরে আওয়াজ দেন যে, মুহূর্তে কোলাহলপূর্ণ সমতল ভূমি মৃত নগরে পরিণত হয়। পলায়ন উদ্দেশ্যে এ সমতল ভূমিতে আগতদের কেউই মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পায়নি। সমতল ভূমির আশেপাশে বসবাসরত লোকজন এ ভয়াবহ সংবাদ অবহিত হয়ে ঘটনাস্থলে যায় কিন্তু এক সাথে এত অধিক সংখ্যক মৃতের সৎকার সম্পূর্ণ অসম্ভব বিধায় তারা চতুর্দিকে দেয়াল নির্মান করে দেয়। সূর্যের তাপে পঁচে গলে শুধু হাড়গোড়গুলোই অবশিষ্ট থাকে। এ ভয়াবহ ঘটনা সংঘটনকালে হযরত হিযকীল (আঃ) পার্শ্ববর্তী শহরে ইতিকাফরত ছিলেন।
এ ঘটনায় মৃত ব্যক্তিদের সংখ্যা একাধিক বর্ণনা রয়েছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রাঃ) বলেন, আট বছর। হযরত ওয়াহাব বিন মোনাব্বেহ (রঃ)-এর রেওয়ায়েতে আশি হাজারের কথা উল্লেখ আছে।
হযরত হিযকীল (আঃ) ইতিকাফ সমপনান্তে ঘটনাস্থলে গিয়ে অসংখ্য লোকের মৃত্যুজনিত পরিস্থিতি পরিদর্শনে বিস্ময়ে হতবাক হয়ে পড়েন। কারো কারো মতে এ মৃত্যু ঘটনা সংঘটনের বহুকাল পরে হযরত হিযকীল (আঃ) সেখান দিয়ে যাওয়ার সময় অসংখ্য মৃত দেহের মৃত্যুর ঘটনা জানিয়ে দেন। তিনি খুবই মর্মাহত হন এবং এসব মৃতকে পুনর্জীবন দেয়ার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করেন। তাঁর দোয়া কবুল হয়। তিনি আল্লাহ পাকের নির্দেশে মৃতদের জীর্ণশীর্ণ শুকনা হাড়গুলোকে লক্ষ্য করে বলেন-
হে হাড়সমূহ! আল্লাহ পাক তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তোমরা যেন স্ব স্ব একত্রিত হও। হাড়গোড়সমূহ হযরত হিযকীল (আঃ)-এর মুখে আল্লাহর আদেশপ্রাপ্তি মাত্র স্ব স্ব স্থানে লেগে যায়। তিনি স্ব স্ব স্থানে লেগে যাওয়া হাড়গুলোকে লক্ষ্য করে আবার বলেন- হে হাড়সমূহ! আল্লাহ পাক তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন তোমরা যেন গোশত, রগ এবং চামড়া পরিধান কর। সাথে সাথে হাড়সমূহের উপর গোশত, রগ চামড়া ইত্যাদি সৃষ্টি হয়ে পূর্ণ মানব দেহে পরিণত হয়। এবার হযরত হিযকীল (আঃ) মৃতদের রূহসমূহের উদ্দেশ্যে বলেন- হে এখানে পতিত মৃতদেহের রূহসমূহ! নিজ নিজ দেহে প্রবিষ্ট হবার জন্য আল্লাহ পাক তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন। হযরত হিযকীল (আঃ)-এর আহবানের সাথে সাথে সব রূহ স্ব স্ব দেহে প্রবেশ করে এবং মৃত দেহগুলো পুনরায় জীবিত হয়ে উঠে বিস্ময় বিষ্ফোরিত নেত্রে চতুর্দিকে তাকাতে থাকে। এ ঘটনার প্রতি ইঙ্গিত করেই আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে ইরশাদ করেন-
أَلَمْ تَرَ إِلَى الَّذِينَ خَرَجُوا مِن دِيَارِهِمْ وَهُمْ أُلُوفٌ حَذَرَ الْمَوْتِ فَقَالَ لَهُمُ اللَّهُ مُوتُوا ثُمَّ أَحْيَاهُمْ ۚ إِنَّ اللَّهَ لَذُو فَضْلٍ عَلَى النَّاسِ وَلَـٰكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَشْكُرُونَ
অর্থঃ তুমি কি সেসব লোককে দেখনি, যারা স্বীয় ঘর থেকে বের হয়েছিল, মৃত্যু হতে বাঁচার জন্য, আর তারা ছিল সহস্র- সুতরাং আল্লাহ তাদের উদ্দেশ্যে বলেন, মরে যাও, অতঃপর তিনি তাদেরকে পুনরায় জীবিত করেন, নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি অত্যন্ত অনুগ্রহশীল, কিন্তু অধিকাংশ লোক কৃতজ্ঞ নয়। (সূরা বাকারাঃ আয়াত- ২৪৩)
কথিত আছে, এ সকল মৃত লোক এবং তাদের পরবর্তী বংশধরদের ঘর্ম থেকে মৃতের গন্ধ আসত। তারা পুনর্জীবন লাভ করে স্ব স্ব প্রত্যাবর্তন করে এবং নিজেদের ধন-সম্পদের স্বত্বাধিকারী হয়ে বসে। পরবর্তীতে এরা আস্তে আস্তে তারা মূসা (আঃ)-এর দ্বীন পরিত্যাগ করে মূর্তিপূজা শুরু করে দেয়। হযরত হিযকীল (আঃ) এসব অবাধ্য অকৃতজ্ঞদের কাছে থেকে হিজরত করে বাবেলে গিয়ে অবস্থান করতে থাকেন এবং তথায়ই ইন্তিকাল করেন। কুফা এবং দজলা নদীর মধ্যবর্তী স্থানে তাঁকে সমাহিত করা হয়।