হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর শোক বর্ষ-২য় পর্ব
আবু তালেবের ইন্তেকালে রাসূল (সাঃ)-এর মাথার উপর যেন মুসীবতের পাহাড় ভেঙ্গে পড়ল। তাঁর একান্ত হিতৈষী, একমাত্র পার্থিব জগতের মেহেরবান ও নেগাহবান চাচা আবু তালেব। তিনি তাকে সর্বপ্রকার সাহায্য সহানুভূতি করেছেন। আজ তার ছায়া মাথার উপর হতে উঠে গেল। রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত শোকাবিভূত হয়ে পড়েন। তখন তার বয়স ছিল ঊনপঞ্চাশ বছর আট মাস এগার দিন। হাদিস শরীফে বর্ণিত আছে, কাফেরগণের মধ্যে কম আযাব আবু তালেবকে দেয়া হবে। দোযখে শুধু তাকে দুটি আগুনের জুতা পরিধান করানো হবে এবং মাত্র দুটি জুতার কারণে তার মাথার মগজ গরম পানির মত জোশ মেরে বের হবে।
আবু তালেবের মৃত্যুতে রাসূল (সাঃ)-এর উপর যে মুসীবতের তরঙ্গ প্রবাহিত হচ্ছিল বিবি খাদীজা (রাঃ) তাঁকে সান্ত্বনা দিয়ে অনেকটা লাঘব করেছিলেন। কিন্তু অল্প কিছুদিন পরেই হযরত খাদিজা (রাঃ) ও চিরতরে দুনিয়া হতে বিদায় হয়ে যান। (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তখন বিবি খাদীজার বয়স ছিল ৬৫ বছর। একই বছরে পর পর উভয় ডালা ভেঙ্গে যাওয়াতে মহানবীর অন্তরে কি যে, ব্যথা-বেদনার সঞ্চার হয়েছিল তা বর্ণনা করার ভাষা খুঁজে পাওয়া মুশকিল। একটু চিন্তা করলেই ব্যাপারটা সাধারণ বোধগম্য হয়ে যায়। আল্লাহর রাসূল (সাঃ) ভারাক্রান্ত হৃদয়ে কেবলমাত্র আল্লাহর দ্বীনের জরুরী আহকাম প্রচার ছাড়া মানুষের সঙ্গে পার্থিব আলাপ আলোচনা ও চলাফেরা কিছু দিনের জন্য সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেন।
তাই ইসলামের ইতিহাসে এ বছরকে আম্মুল হুজন বা শোক বর্ষ বলা হয়।
মোটকথা একই বছর রাসূল (সাঃ)-এর পরম মঙ্গলকামী, বিপদে আপদে পরম দরদী, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে হিতৈষী উভয় সঙ্গী পর্দার অন্তরালে প্রস্থান করলেন। মুসলমানদের চারিপার্শ্বে তখন কেবল বিপদ সংকেত আর মৃত্যুর বিভীষিকা।
তখন জানাজার নামাজের প্রথা ছিল না। মাকামে হাজুমে বিবি খাদীজাকে দাফন করা হল। স্বয়ং রাসূল (সাঃ) তাঁকে কবরে নামিয়েছিলেন। রাসূল (সাঃ) অত্যন্ত চিন্তিত ও ব্যতিত দেখে হযরত সিদ্দিকে আকবর (রাঃ) তাঁর সান্ত্বনার জন্য নিজের ছয় বছর বয়স্কা শিশু কন্যা আয়েশাকে মহানবীর সাত্থে নিকাহ দেন। কিছুদিন পর হযরত ছাওদাকে বিবাহ কাফেরগণ এখন স্বাধীনভাবে মুসলমান ও রাসূল (সাঃ)-এর উপর নির্যাতন চালাতে লাগলেন। নির্মমভাবে রাসূল (সাঃ)-এর উপর অত্যাচার চালাল। আবু তালেবের মৃত্যুতে তাদের জন্য প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে গিয়েছিল।
এ বছর পারস্য সম্রাট ও রোমদের মধ্যে এক বিরাট যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। যুদ্ধে পারস্য সম্রাট জয়লাভ করেছে। এ সংবাদ মক্কায় পৌঁছালে, কাফেরগণ মুসলমানদের উপর ফখর করে বলতে লাগল। রুমীগণ আহলে কিতাব। তারা যেভাবে পরাজিত হয়েছে এমনিভাবে তোমরাও আহলে কিতাব অচিরেই আমাদের হাতে পরাজিত হবে। তাদের কথায় মুসলমানগণের ভঙ্গ হৃদয় আরও ভেঙ্গে গেল। কাটাঘায়ে যেন লবণের ছিটা দেয়া হল। আল্লাহ পাক তাঁর রাসূলকে সান্ত্বনা দিয়ে সূরায়ে রুমের কয়েকটি আয়াত নাজিল করে সুসংবাদ প্রদান করলেন। আগামী কয়েক বছরের (দশ বছরের) মধ্যেই পুনরায় রুমীগন পারস্য সম্রাটের উপর অবশ্যই জয়লাভ করবেন। এ হিসাব অনুযায়ী জঙ্গে বদরের পর রুম ও ইরানের মধ্যে বিরাট সংঘর্ষ হয়। শেষ পক্ষে রুমীগন বিরাট জয়লাভ করেন।
কাফেরগণের জুলুম অত্যাচার বহুগুণে বেড়ে গেল। ছাহাবায়ে কেরাম জোরে কুরআন পাঠ করতে পারত না। হযরত সিদ্দিক আকবর (রাঃ) সুমধুর কণ্ঠে কুরআন তিলাওয়াত করতে লাগলেন। মুশরিকগণের ছেলেমেয়েগণ তাঁর চতুষ্পার্শ্বে জড় হয়ে যেত। কাফেরগণ বলল, তুমি হেরেম শরীফে নামাজ পড়তে পারবে না। বাধ্য হয়ে ঘরে নামাজ পড়তেন। কিন্তু চুপে চুপে নামাজ পড়া তাঁর মনে শান্তি লাগত। তাই তিনি পুনরায় বায়তুল্লাহ হতে যেয়ে নামাজ আদায় করতে লাগলেন এবং উচ্ছঃস্বরে কুরআন পাঠ করতেন। কোরাইশগণ অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে তাঁর উপর দুঃ সহনীয় নির্যাতন চালাল। তিনি হিজরত করতে বাধ্য হলেন। পথে জনৈক বন্ধুর সাথে দেখা হল সে তাঁকে ফিরিয়ে আনল এবং কাফেরগণকে বলল, খবরদার! তোমরা এমন ব্যক্তিকে দেশ ছাড়া কারো না। যে এতীম, অনাথ এবং বিধবাকে সর্বদা সাহায্য করে।
মোটকথা মুসলমানগণ অবর্ণনীয় দুঃখ দুর্দশার সম্মুখীন হয়ে পড়েন। অতিষ্ঠ হয়ে একদিন হযরত খাব্বাব (রাঃ) রাসূল (সাঃ) কে বললেন, তাদের জন্য বদদোয়া করুন, যেন আল্লাহ তাদেরকে ধ্বংস করে দেন। নবীজী (সাঃ) বললেন, ছবর কর। তোমাদের পূর্বেও বহু লোক এমন গত হয়েছে, যাদের মাথার উপর করাত চলেছে, অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হয়েছে। কিন্তু তবুও তারা আল্লাহর দ্বীন ও স্বীয় কর্তব্য হতে তিলমাত্র এদিক সেদিক হন নি। তোমরা জেনে রাখ জুলুমের সময় সীমা শেষ হয়ে এসেছে। বেশী দিন বাকী নেই। তোমরা দেখতে পাবে ছায়না হতে হাজরামাউত পর্যন্ত উটের পিঠে নির্ভয় লোকজন সওয়ার হয়ে চলাফেরা করবে। আল্লাহর ভয় ছাড়া অন্য কোন ভয় তাদের থাকবে না।
হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর শোক বর্ষ প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন