হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) এর ওহী লাভ
যখন নবীজীর বয়স চল্লিশ বছর হতে ছয়মাস কম তখন হতে তাঁর রিসালাতের প্রকাশ নিদর্শন পরিলক্ষিত হতে লাগল। তিনি লোক সমাজে অবস্থান করা তাঁর নিজেরাই মনপুত হত না। তাই কয়েক দিনের খাদ্য নিয়ে মক্কা হতে সাড়ে চার কিলোমিটার দূরে হেরা পর্বতের এক নির্জন গুহায় চলে যেতেন। সেখানে তিনি আল্লাহর ধ্যানেও জিকিরে মশগুল থাকতেন। এভাবে ছয়মাস অতিবাহিত করলেন।
অতঃপর রবিউল আউয়ালের বার তারিখে সোমবার ঐ হেরা পর্বতের গুহায় হযরত জিব্রাইল (আঃ) সর্বপ্রথম ওহী নিয়ে উপস্থিত হন তখন মহানবী (সাঃ) গুহার বাইরে অবস্থান করেছিলেন। হঠাৎ আওয়াজ শুনতে লাগলেন, হে মুহাম্মদ! তিনি উপরে দৃষ্টি উঠায়ে কিছুই দেখলেন না। এভাবে তিনবার আওয়াজ হল কিন্তু কিছুই দেখলেন না। তিনি ভীত হয়ে গেলেন। হঠাৎ মানব আকৃতি ধারণ করে সমারোহময় সবুজ লেবাছ পরিহিত নুরের তাজ শিরে ধারণ করে জ্যোতির্ময় নুরানী চেহারার এক ফেরেশতা আবির্ভূত হন।
তিনিই হযরত জিব্রাইল (আঃ) আল্লাহর নির্দেশে হযরত রাসূল (সাঃ) কে বললেন, আপনি পড়ুন। তিনি বললেন, আমি পড়তে জানি না। তখন জিব্রাইল (আঃ) তাঁর বক্ষের সাথে জড়িয়ে ধরে ছেড়ে দেন এবং বলেন, পড়ুন। নবীজী এবারও অনুরূপ উত্তর দিলেন। অতঃপর জিব্রাইল (আঃ) তাঁকে পুনরায় জড়িয়ে ধরলেন। এভাবে তিনবার জড়িয়ে ধরার পর তাঁর ছীনা প্রশস্ত হয়ে গেল। তিনি কিছুক্ষণ ভয়ে নিশ্চল অবস্থায় দাঁড়িয়ে রইলেন। জিব্রাইল (আঃ)-এর চেহারার চতুর্দিক তিনি দেখতে পেলেন। কাঁপতে কাঁপতে গৃহে প্রত্যাবর্তন করলেন। তা ছিল প্রথম ওহী এবং নবুয়তের বহিঃপ্রকাশ। তখন তাঁর বয়স ছিল চল্লিশ বছর। আল্লাহর খাছ রহমতে জিব্রাইল (আঃ)-এর মাধ্যমে মহানবী (সাঃ)-এর রূহের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ফয়েজের সঞ্চার হল, যা অন্য কোন মানুষের ভাগ্যে জুটে নি। তিনবার জিব্রাইল (আঃ) তাঁকে বক্ষের সাথে মিশিয়ে সজোরে চাপ দেয়ার মাধ্যমেই জিব্রাইল (আঃ)-এর রূহ হতে সে ফয়েজ রূহে মোহাম্মাদীর মধ্যে পৌঁছিয়ে ছিল এবং বহু বেদনা ও কষ্টের মধ্যে নবীজী এ ফয়েজ গ্রহণ করেন।
হযরত ওমর (রাঃ) বলেন, জাহিলিয়াতের যুগে একবার একটি মূর্তির সামনে একটি গরু জবেহ করে উৎসর্গ করা হল। আমি সেখানে উপবিষ্ট ছিলাম। হঠাৎ জবাই করা গরুটি হতে পরিষ্কার শব্দ হতে লাগল, লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। অনুরূপ আর একটি ঘটনা বর্ণিত আছে যে, শামদেশে ইবনুল হাইয়্যান নামক জনৈক ধর্মভীরু ইহুদি আলেম হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর আবির্ভাবের বেশ কয়েক বছর পূর্বে মদিনায় আগমন করে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ)-এর অপেক্ষায় বনু কোরায়জার মধ্যে অবস্থান করতে লাগলেন। বনু কোরায়জা মদিনার ইহুদি সম্প্রদায়। তার মৃত্যু ঘনিয়ে আসল কিন্তু শেষ নবীর কোন প্রকার সন্ধান পেলেন না। তিনি ইহুদিগণকে ডেকে বললেন, তোমরা আমাকে মক্কায় নিয়ে যাও। শেষ নবীর আবির্ভাবের সময় নিকটবর্তী। যার অপেক্ষায় আমি এ নগরীতে অবস্থান করছিলাম। তা তাঁর হিজরতের স্থান তোমরা তাঁকে পেলে সর্বপ্রথম ইসলাম গ্রহণ করিও। এমনিভাবে সৃষ্টির স্তরে স্তরে তাঁর নবুয়ত ও রিসালাতের প্রকাশ ও প্রচার হতে লাগল।
নবুয়ত প্রাপ্তির প্রায় তিন বছর যাবৎ ওহী বদ্ধ থাকে। একদিন হঠাৎ মক্কার পথে চলাকালীন দেখতে পান ঐ ফেরেশতা যিনি হেরা পর্বতে আগমন করেছিলেন। আকাশ জমীনের মাঝখানে জগত জোড়া হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। তিনি ভীত হয়ে গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। হযরত খাদীজাকে বলেন, আমাকে চাদর দ্বারা ঢেকে দেও। তিনি চাদর শুয়ে পড়েন। তাঁর শরীরে জ্বর এসে যায়। এমন সময় জিব্রাইল (আঃ) মানব আকৃতি ধারণ করে আল্লাহর ওহী নিয়ে উপস্থিত হন।
আট প্রকারে ওহী নাজিল হত। (১) স্বপ্নযোগে। (২) জিব্রাইল (আঃ) অদৃশ্যভাবে অন্তরে ওহীর সঞ্চার করতেন। (৩) জিব্রাইল (আঃ) মানুষের আকার ধারণ করে ওহী নিয়ে আসতেন। (৪) ঘন্টায় আওয়াজের ন্যায়। (৫) জিব্রাইল (আঃ) প্রকৃত রূপ ধারণ করে ওহী নাজিল করতেন। (৬) আল্লাহ তায়ালা পর্দা উঠিয়ে দিয়ে সরাসরি যে ওহী দান করেছেন, অর্থাৎ মেরাজের রাতে। (৭) পর্দার আড়াল হতে আল্লাহর কথা বলা। (৮) অন্তরে এলকা ও এলহাম হওয়া।
কোন কোন পর্যায়ে দেখা যায় প্রথম তিন বছর যাবৎ হযরত ইসরাফিল (আঃ) ওহী নিয়ে আসতেন। পরে হযরত জিব্রাইল (আঃ)-এ কাজের জন্য নির্ধারিত হলেন এবং মহানবী (সাঃ) তাঁর নিকট ২৪ (চব্বিশ) হাজার বার এসেছিলেন। হযরত আদম (আঃ) তাঁর নিকটে জিব্রাইল (আঃ) ১২ (বার) এবং ইব্রাহীম (আঃ)-এর নিকট ৪২ (বিয়াল্লিশ) বার এবং হযরত মুসা (আঃ)-এর নিকট চল্লিশ বার, হযরত ঈসা (আঃ)-এর নিকট ১০ বার নাজিল হয়েছিলেন। হযরত নূহ (আঃ)-এর নিকট পঞ্চাশ বার এবং ইদ্রীস (আঃ)-এর নিকট চার বার ওহী নিয়ে নাজিল হয়েছে।
হযরত খাদীজা (রাঃ) কোরাইশ বংশের একজন পুণ্যময়ী মহীয়সী মহাজ্ঞানী ধনী বিধবা মহিলা ছিলেন। তিনি বহু ধনরত্নের অধিকারিণী ছিলেন। ইতোপূর্বে তাঁর দু’বিবাহ হয়েছিল। দ্বিতীয় স্বামী আবু এলাহা খুব ধনী ছিল। তাঁর মৃতুতে হযরত খাদীজা (রাঃ) ঐ সকল ধনসম্পদের মালিক হন। বহু তেজারতী মাল উত্তরাধিকারিণী সূত্র প্রাপ্ত হন।
এসব ধন সম্পদ রক্ষণাবেক্ষণের এবং ব্যবসা বাণিজ্য করার জন্য আমানতদার এবং বিশ্বস্ত মানুষের তাঁর বিশেষ প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। তাঁর ভ্রাতুষ্পুত্র কাতিমার নিকট মহানবী (সাঃ)-এর উত্তম চরিত্র ও আমানতদারীর কথা শুনে তাঁর প্রতি খাদিজার অন্তর আকৃষ্ট হয়ে পড়ে। অতঃপর তেজারতী সফরে তারে প্রেরণ করে অপ্রত্যাশিত মুনাফা এবং হযরত রাসূলে পাক (সাঃ)-এর প্রতি গায়েবী সহানুভূতি স্বচক্ষে দেখার পর তাঁর বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন।
হযরত খাদীজা (রাঃ) তাঁর সমস্ত ধন সম্পদ দোজাহানের বাদশাহের চরণতলে আল্লাহর দ্বীনের সাহায্যে উৎসর্গ করে দেন। মহানবী (সাঃ) বলেন, হযরত খাদীজা (রাঃ) এর মাল দ্বারা আল্লাহর দ্বীনের অবর্ণনীয় সাহায্য হয়েছে। আল্লাহ পাক সন্তুষ্ট হয়ে একবার হযরত জিব্রাইল (আঃ)-এর মারফত বিবি হযরত খাদীজা (রাঃ)-কে সালাম প্রেরণ করেন।
বিবি খাদীজাতুল কোবরা (রাঃ) হযরত রাসূল (সাঃ)-এর সকল দুঃখ দরদে তাঁকে সর্বদা সান্ত্বনা দিয়ে থাকতেন। নবীজী বলেন, বেহেশতের মাঝখানে মুক্তা নির্মিত একটি সুবৃহৎ প্রাসাদের সুসংবাদ খাদীজাকে দেয়ার জন্য আমি আল্লাহর তরফ হতে আদিষ্ট হয়েছি।
মে’রাজের রাত্রে হযরত জিব্রাইল (আঃ) আবির্ভূত হয়ে হযরত মুহাম্মাদ (সাঃ) বলেন, আল্লাহ পাক আপনাকে সালাম বলেছেন এবং তৌহীদের প্রতি মানুষকে আহবান করার আদেশ দিয়েছেন। অতঃপর আকাবার পেছনে উন্মুক্ত মাঠে নবীজীকে নিয়ে যান। সেখানে যেয়ে হযরত জিব্রাইল (আঃ) জমীনে পদাঘাত করেন। জিব্রাইলের পদাঘাতে সেখানে একটি ঝর্ণার সৃষ্টির হল। সেই ঝর্ণার পানি দ্বারা জিব্রাইল (আঃ) অযু করলেন। উদ্দেশ্য ছিল রাসূল (সাঃ) অযু শিক্ষা দেয়া। জিব্রাইলের অযু দেখে রাসূলে পাক (সাঃ) অনুরূপভাবে অযু করলেন। তারপর হযরত জিব্রাইল (আঃ) ইমাম হয়ে হযরত রাসূলে পাক (সাঃ) দু’রাকাত নামাজ পড়লেন এবং অদৃশ্য হয়ে যান। হজরত রাসূল (সাঃ) গৃহে প্রত্যাবর্তন করে খাদীজাকে উক্ত ঘটনা বললেন এবং অযু ও নামাজ শিক্ষা দিয়ে খাদীজাকে নামাজ পড়ালেন।
হযরত খাদীজার সঙ্গে সঙ্গে হযরত আলী, হযরত হারেছ এবং অন্যান্য মুসলমানগণও নামাজ পড়লেন। এটাই ছিল ইসলামের প্রথম নামাজ। তখন দুই দু’রাকাত করে ফরজ ছিল। পরে ছফরের হালাতে দু’রাকাত আমল নামাজ বহাল থাকে এবং একামতের হালাতে দু’রাকাত বৃদ্ধি করা হয়। মুতাকেল নামক জনৈক তাবেয়ীর বর্ণনা অনুসারে দেখা যায় তখন সকাল ও বিকালে দু’রাকাত করে দ’ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয়েছিল। কোন কোন ঐতিহাসিকের মতে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্তের পূর্বে দু’ওয়াক্ত নামাজ ছিল। তাহজ্জুদের নামাজও ফরজ হয়েছিল। তারপর মে’রাজের রজনীতে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ ফরজ হয় এবং পূর্বেকার নামাজ সমূহের ফরজিয়াত রহিত হয়ে যায়। মে’রাজের দিবসে হযরত জিব্রাইল (আঃ) এসে দু’দিন যাবৎ রাসূল (সাঃ)-কে নামাজ শিক্ষা দেন। হেরেম শরীফে দাঁড়িয়ে জোহরের নামাজ হতে আরম্ভ করেন। জিব্রাইল ইমাম হন। প্রথম দিন ওয়াক্তের প্রথমভাগে এবং দ্বিতীয় দিন ওয়াক্তের শেষভাগে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করেন। অতঃপর বলেন, এ দু’সময়ের মধ্যেই প্রত্যেক নামাজের ওয়াক্ত।