হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) – পর্ব ৭

হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) – পর্ব ৬ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

হযরত বায়েজীদ (রঃ) বললেন, মারেফতে আমার কী প্রয়োজন? একমাত্র আল্লাহ্‌ ছাড়া কোন কিছুতেই আমার প্রয়োজন নেই। তখন ইয়াহইয়া (রঃ) তাঁর কাছে কিছু উপদেশ চাইলেন। তিনি বললেন, যদি আল্লাহ্‌ আপনাকে হযরত আদম (আঃ)-এর মতো দানশীলতা, হযরত জিব্রাঈল (আঃ)-এর মতো পবিত্রতা, হযরত ইব্রাহিম (আ)-এর মতো বন্ধুত্ব, হযরত মূসা (আঃ)-এর মতো প্রেমানুরক্তি, হযরত ঈসা (আঃ)-এর মতো বিশুদ্ধতা ও শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সঃ)-এর মতো ভালোবাসা দান করেন, তবুও আপনি কেবল আল্লাহকেই কামনা করবেন। অন্য কিছুর ওপর মনোযোগ দেবেন না। কেননা, সবকিছুই উদ্দেশ্য পূরণের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়।

অতএব, আপনি শুধু আল্লাহ্‌র সাহায্য সম্বল করে একমাত্র তাঁর সন্তুষ্টিই কামনা করবেন।

একবার হযরত যুননুন মিসরী (রঃ) তাঁর কাছে একখানি খুব সুন্দর জায়নামাজ পাঠান। তিনি বললেন, জায়নামাজের দরকার নেই। তবে একখানা মসনদ হলে ভালো হয়।

অতএব, একদিন মসনদও এল। কিন্তু আসলে তিনি তো মসনদ চাননি। জায়নামাজ নেবেন না বলেই মসনদের উল্লেখ করেন। কাজেই তিনি মসনদও ফিরিয়ে দিলেন। তাঁর কথা হল, যার কাছে মহান প্রভুর ভালোবাসার মসনদ বর্তমান, তার আবার অন্য মসনদের দরকার কী?

শীতের এক রাত। হযরত বায়েজীদ (রঃ) শুয়ে ছিলেন এক গভীর জঙ্গলে। তার গায়ে ছিল পশমের এক পুরু কম্বল। নিদ্রিত অবস্থায় তাঁর যা হল, তাতে স্নানের প্রয়োজন। কিন্তু প্রচণ্ড শীত। স্নান করতে মন গড়িমসি করতে লাগল। তখন তিনি ভাবলেন, প্রবৃত্তিকে শাস্তি না দিলে সে জব্দ হবে না। অতএব, একটি কুয়ার পানিতে সুন্দরভাবে স্নান করে সারারাত সেই ভেজা কম্বল পরেই কাটিয়ে দিলেন।

হযরত বায়েজীদ (রঃ) ফিরছেন কবরস্থান থেকে। পথে এক যুবকের সঙ্গে দেখা। এক আমীর তনয়। বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে এন্তার ফুর্তি করেছে। তিনি নরম কথায় তাকে থামতে বললেন। তাতে যুবকের রাগ হল। সে তাকে অশ্লীল ভাষায় গালি-গালাজ করতে শুরু করল। তখন তিনি পাঠ করলেন- লা-হাওলা ওয়ালা কুওয়াতা ইল্লা বিল্লাহ। সুমতি দেবার শক্তি আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারোর নেই। তাঁর কথা শুনে যুবক আরও বিরক্ত ও ক্রুদ্ধ হয়ে বাদ্যযন্ত্র দিয়ে তাঁর মাথায় সজোরে আঘাত করল। আর মাথা ফেটে রক্ত গড়িয়ে পড়ে তাঁর সারা শরীর লাল হয়ে গেল ঐ অবস্থায় তিনি বাড়ী ফিরলেন। অবশ্য যুবকের বাদ্যযন্ত্রটিও ভেঙে যায়।

পরদিন সকালে তিনি বাদ্যযন্ত্র মূল্য বাবদ কিছু টাকা ও হালুয়া মিষ্টি এক লোক মারফত যুবকের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। আর একখানি চিঠিও দিলেন। গতকাল আমার মাথায় আঘাত করায় তোমার বাদ্যযন্ত্রটি ভেঙে গেছে। তাঁর ক্ষতিপূরণস্বরূপ কিছু টাকা পাঠালাম। আর তোমার মুখে যে তিক্ততার পরিচয় পেলাম, তা দূর করার জন্য কিছু মিষ্টি হালুয়াও পাঠিয়ে দিলাম। আশা করি তা খেয়ে মুখের তিক্ততা দূর করবে।

চিঠি পড়ে যুবক হতবাক। যাকে অকথ্য ভাষায় গালি-গালাজ করলাম, মাথা ফাটিয়ে সর্বাঙ্গ রক্তে রঞ্জিত করলাম, আর সে কিনা…। বুকের ভেতর যেন ভাবনার ঘূর্ণিপাক খেয়ে গেল। সে ছুটে গেল হযরত বায়েজীদ (রঃ)-এর দরবারে। আর লুটিয়ে পড়ল তাঁর পায়ে ক্ষমা চাই, ক্ষমা…। বলা বাহুল্য, হযরত বায়েজীদ (রঃ) তাকে ক্ষমা করলেন।

এক গলিপথ দিয়ে তিনি চলেছেন। সঙ্গে রয়েছে শিষ্যের দল। হঠাৎ উল্টো দিক থেকে এসে পড়ল এক কুকুর। বায়েজীদ (রঃ) ও শিষ্যগণ একপাশে সরে গেলেন। কুকুরটি চলে গেল। শিষ্যগণ জিজ্ঞেস করলেন, মানুষ হল সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব। আর কুকুর নিকৃষ্ট। তৎসত্ত্বেও আপনি তাকেই পথ ছেড়ে দিলেন? হযরত বললেন, কুকুরটি আমাকে জিজ্ঞেস করছিল, আজকের দিনে আমাকে কুকুর আর আপনাকে শ্রেষ্ঠ ওলী হিসেবে কেন নির্দিষ্ট করা হল? আমার এমন কি অপরাধ ছিল, আর আপনারই বা এমনই পুণ্য ছিল, যার ফলে এমন তারতম্য হল? এই প্রশ্নটি উদয় হওয়ায় সৌজন্য প্রকাশে আমি ওকে পথ ছেড়ে দিয়েছি।

আর একদিন একটি কুকুর তাঁর পাশ দিয়ে গেলে তিনি তাঁর কাপড়ের আঁচল সরিয়ে নিলেন। কুকুর বলল, আপনি এরকম করলেন কেন? আমার শরীর শুকনা হলে তো নাপাক নয়। আর যদি ভেজাও হয়, তাহলে আপনার ছোঁয়া লাগলে আপনি পানি দিয়ে ধুয়ে পাক করে নিতে পারতেন। কিন্তু আপনি যা করলেন, তা নিছক অহংকার ছাড়া কিছু নয়। আর এ অহংকার রূপ অপবিত্রতা সাত সমুদ্রের পানি দিয়ে ধুয়ে ফেললেও তা কখনও পবিত্র হবে না।

হযরত বায়েজীদ বোস্তামী (রঃ) – পর্ব ৮ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।