হযরত দাউদ তায়ী (রঃ) – ৪র্থ পর্ব
হযরত দাউদ তায়ী (রঃ) – ৩য় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের সময় হযরত ফোজায়েল ইবনে ইয়াজ (রঃ) তাঁর কাছে কিছু উপদেশ চাইলে তিনি বললেন, লোক-সংসর্গ থেকে দূরে থাকুন।
হযরত মারুফ কারখী (রঃ) বলেন, দুনিয়ার যাবতীয় বস্তু, দুনিয়াদার ও তাদের অহংকার অহমিকা সব কিছুই তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ ও ঘৃণার বস্তু ছিল। আর এই জন্য তিনি দুনিয়াদার মানুষকে অপবাদ দিতেন। তাদের অবস্থার জন্য তিনি খুব দুঃখও প্রকাশ করতেন। তিনি যখন কাপড় ধুতেন তখন বলতেন, আমি যদি আমার অন্তরকেও এভাবে ধুয়ে-মুছে সাফ করতে পারতাম, তাহলে কত ভালোই না হত। গরীব-দুঃখীদের তিনি খুব সম্মান করতেন।
এই প্রসঙ্গে একটি ঘটনার কথা উল্লেখ করেন হযরত জুনায়েদ বাগদাদী (রঃ) একবার ক্ষৌরকর্মের পারিশ্রমিক বাবদ ক্ষৌরকারকে তিনি একটি মুদ্রা দেন। তা দেখে কেউ বলেন, এটি নিছক অপব্যয় ছাড়া কিছু নয়। তিনি বলেন, মোটেই নয়। বরং এটি গরীবের প্রতি সহৃদয়তার নিদর্শন। যাদের মধ্যে মানবতা নেই, আল্লাহ তাদের এবাদত কবুল করেন না।
ইমাম আবু ইউসুফ ও ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ) এই দুজনের মধ্যে ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ)-কেই তিনি সম্মান ও সমাদর করতেন। পক্ষান্তরে আবু ইউসুফ (রঃ)-কে সেভাবে নিতে পারতেন না। তাঁদের দুজনের মধ্যে মাসআলা-সংক্রান্ত কোন মতবিরোধ সৃষ্টি হলে হযরত দাউদ (রঃ)-এর কাছে আসতেন। দাউদ তায়ী (রঃ) আবু ইউসুফ (রঃ)-এর দিকে পিঠ রেখে ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ)-এর দিকে মুখ করে বসতেন। যা কিছু জিজ্ঞেস বা বলার, তা বলতেন ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ)-কে। ) আবু ইউসুফ (রঃ)-এর সঙ্গে কথা বলতেন না। এমনকি তাঁর নামটা পর্যন্ত মুখে আনতেন না। ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ)-এর বক্তব্য সঠিক হলে বলতেন হ্যাঁ এই লোকটি ঠিকই বলেছে।
দুজনের প্রতি দু’রকম ব্যবহারের কারণ জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন, ইমাম মুহাম্মাদ (রঃ) ধন-সম্পদ তুচ্ছ করে সাধনার পথে এসেছেন। ধন-মান খ্যাতি-প্রতিষ্ঠার চেয়ে তিনি বেশী মূল্য দিয়েছেন ধ্যান-জ্ঞানকে। কিন্তু আবু ইউসুফ (রঃ) ঠিক এর বিপরীত। ইমাম আজম নীতির প্রশ্নে কারাবরণ করেছেন, কিন্তু কাজীর পদ গ্রহণ করেননি। অথচ তাঁরই শিষ্য আবু ইউসুফ (রঃ) শিক্ষাগুরুর দৃষ্টান্ত সামনে থাকা সত্ত্বেও কাজীর পদ গ্রহণ করেন। কাজেই পার্থিব ধনাকাঙ্ক্ষা ও খ্যাতির লোভে যে লোক শিক্ষাগুরুর নীতি বিসর্জন দেয়, তিনি তাঁর সাথে কথা বলবেন কী করে?
একবার খলীফা এসেছেন হযরত দাউদ (রঃ)-এর সঙ্গে দেখা করতে। সঙ্গে রয়েছেন আবু ইউসুফ (রঃ)। কিন্তু তাঁদের ভেতরে আসার অনুমতি দিলেন না। অগত্যা খলীফা ধরলেন তাঁর জননীকে। তিনি যেন এ ব্যাপারে একটু সুপারিশ করেন। কিন্তু মায়ের সুপারিশও তিনি গ্রাহ্য করলেন। সাফ বলে দিলেন, অত্যাচারীর নিকট তাঁর কোন প্রয়োজন নেই। তাঁর মা তখন উপায়ান্তর না রেখে আল্লাহর কাছে মোনাজাত করলেন, মায়ের নির্দেশ পালন করা আপনার বিধান। খলীফার কাছে
আমার কোন পার্থিব প্রয়োজন নেই। শুধু তাঁকে ভেতরে ঢুকতে দেওয়াই আমার ইচ্ছা। হযরত তায়ী (রঃ) মায়ের এই মোনাজাত শুনে বাধ্য হয়ে খলীফাকে ভেতরে আসার অনুমতি দেন।
যাক, খলীফা ভেতরে এসে তাঁর সামনে বসলেন। কিন্তু কোন কথাবার্তা নেই। একটি শব্দহীন সময় পার হয়ে গেল। অবশেষে বিদায় নেবার জন্য খলীফা উঠে দাঁড়ালেন আর একটি স্বর্ণমুদ্রা তাঁর সামনে রেখে বললেন, এটি গ্রহণ করুন। আমার হালাল উপার্জন। এতে কোন রকম দোষত্রুটি নেই। দাউদ তায়ী (রঃ) বললেন, এটি আপনি তুলে নিন। আমার অর্থের প্রয়োজন নেই। আমার বাড়ীখানা বৈধ মালপত্রের বিনিময়ী বিক্রি করেছি। তাতেই আমার চলছে। আল্লাহকে বলেছি, যেদিন মালপত্র শেষ হয়ে যাবে, তিনি যেন সেদিন আমাকে তাঁর কাছে ডেকে নেন। পৃথিবীর কারো কাছে আমি হাত পাততে চাই না। আশা করি আল্লাহ আমার প্রার্থনা পূরণ করবেন। খলীফা বাধ্য হয়ে মুদ্রাটি তুলে নিয়ে চলে গেলেন।
সূত্রঃ তাযকিরাতুল আউলিয়া