হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর সন্তানাদি ও ইন্তেকাল

হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর সন্তানের সংখ্যা ছিল বারজন। লাইয়ার গর্ভে জন্মলাভ করেন রাদবীন, শামুউন, লাভী, ইয়াহুদ, ওয়াইসহাকা, ফুলবুন।  রাহিলের গর্ভে জন্মলাভ করেন হযরত ইউসুফ (আঃ) আর বেনইয়ামীন। বালহার গর্ভে জন্মলাভ করেন দান, নফতালী আর যালহার গর্ভে জন্মলাভ করেন জাদ ও আশীর।

হযরত ইউসুফ (আঃ) মিসরের বাদশাহ হওয়ার কিছু দিন পর পূর্ববর্তী বাদশাহ রায়হান মৃত্যুবরণ করেন। তার কিছুদিন পর হঠাৎ একদিন ফেরেশ্তা জিব্রাঈল (আঃ) তাশরীফ এনে হযরত ইয়াকুব (আঃ)কে বললেন, হে আল্লাহর নবী! আপনি দুনিয়াতে এসে কিছুদিন খুবই কষ্ট ভোগ করলেন, যে দুঃখের কোন সীমা নেই। কিন্তু এর পরবর্তী সময় আল্লাহ আপনাকে এমন খুশী করলেন যার সীমা নেই। আপনার সম্মুখেই আল্লাহ পাক আপনার পুত্র হযরত ইউসুফ (আঃ) কে নবুয়তীর সঙ্গে মিসর রাজ্যের বাদশাহীও দান করলেন। আর তারই আহ্বান এবং সুব্যবস্থাপনায় আপনার পরিবার পরিজনের সকলেরই মিসরের রাজধানী নগরের বুকে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা হয়ে গেল। সকলেই পরম সুখ স্বাচ্ছন্দে বসবাস করতেছেন। তবে আজ আমি আল্লাহর পক্ষ হতে প্রেরিত হয়েছি। আল্লাহর ইচ্ছা এই যে, কেনানে আপনার মৃত্যু হবে। সুতরান আপন অতি স্বত্তর কেনানে চলে যান।

ফেরেশতা জিব্রাঈল (আঃ)-এর সতর্কীকরণ বাণীর কথা হযরত ইয়াকুব (আঃ) তাঁর পুত্র হযরত ইউসুফ (আঃ) এবং অন্যান্য পুত্রদের নিকট ব্যক্ত করলেন। তাঁরা সকলেই ভাবী পিতৃশোকের আশঙ্খায় ব্যাকুল হয়ে পড়লেন।

হযরত ইয়াকুব (আঃ) তাদেরকে নানারুপ প্রবোধ এবং স্বান্তনার বাণী শুনিয়ে একটি উটের পিঠে আরোহণ করে কেনানের অভিমুখে যাত্রা করলেন। যাত্রাকালে স্ত্রী, সন্তান-সন্ততিগণ নানাভাবে বিলাপাদি করে কাঁদতে কাঁদতে তাঁকে বিদায় দিলেন। পার্থিব জীবনে এটাই তাঁদের শেষ সাক্ষাত। তাই বিদায়কালীন হযরত ইয়াকুব (আঃ)-এর শেষবাণী এ ছিল, তোমরা সকলে পরস্পর মিলেমিশে থেকো এবং প্রতিপালক আল্লাহ পাককে খুশী করে চলিও। দুনিয়াতে তোমাদের সাথে এটাই আমার শেষ দেখা। আল্লাহ পাক চাইলে আবার বেহেশতের মধ্যে সাক্ষাত হবে ইনশা আল্লাহ।

হযরত ইয়াকুব (আঃ) কেনান পৌঁছে প্রথমেই পিতা-মাতা ও দাদা দাদীর কবরস্থানে পৌঁছেন এবং তাঁদের কবর যিয়ারত করেন। যিয়ারতকালে তাঁর কান্নায় দু’চক্ষু হতে অশ্রুর ধারা প্রবাহিত হল। তিনি কবরস্থানেই কাঁদতে কাঁদতে শুয়ে পড়লেন এবং হুশ হারিয়ে ফেলেন। দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়া সত্বেও তিনি আর জাগ্রত হলেন না। ঐ অবস্থায় তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন।

ঘুমের ঘোরে তিনি স্বপন দেখলেন, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বেহেস্তের অতি মনোরম আসনে উপবিষ্ট এবং ইসমাইল (আঃ) ও হযরত ইসহাক (আঃ) তাঁর দু’পার্শে বসে আছেন।

তাঁকে দেখে হযরত ইব্রাহীম (আঃ) বললেন, ইয়াকুব! আমরা তোমার অপেক্ষায় বসে আছি, তুমি শীঘ্র চলে আস।

এমন সময় তাঁর নিদ্রা ভঙ্গ হল। তখন তিনি বুঝতে পারলেন তাঁর অন্তিম সময় অত্যাসন্ন। তখনই তিনি মিসরে তাঁর পুত্রগনের নিকটি দূত যোগে খবর পাঠালেন যে, আমি মহান প্রতিপালকের আহ্বান দুনিয়া পরিত্যাগ করে চললাম।

মিসরে পুত্রদের নিকট এরুপ খবর পাঠিয়ে তিনি পুনরায় উক্ত কবরস্থানে গিয়ে একটি নতুন খননকৃত কবর দেখতে পেলেন। তা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন সুন্দর সজ্জিত একটি মনোরম কক্ষের মত মনে হচ্ছি। তার ভিতর হতে মনোমুগ্ধকর সুঘ্রাণ বের হচ্ছিল।

কবরটির পার্শ্বে এক প্রশস্ত চেহারা বিশিষ্ট লোক দেখে হযরত ইয়াকুব (আঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন, জনাব, বলুন তো এ কবরটি কার জন্য নির্ধারিত?

লোকটি উত্তর দিলেন, এটা মহান আল্লাহ পাকের অতি প্রিয় এক বিশিষ্ট নেককার বান্দার জন্য নির্ধারিত। তখন হযরত ইয়াকুব (আঃ) আল্লাহ পাকের দরবারে আরজ করলেন। হে আল্লাহ! আপনি এ মোবারক কবরটি আমার জন্য ঠিকানা করে দিন। হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর দোয়া আল্লাহ পাকের দরবারে মঞ্জুর হল এবং এক অদৃশ্য আওয়াজ আসল, হে ইয়াকুব! তোমার জন্য এটা নির্দিষ্ট করলাম। তুমি এর মধ্যেই অবস্থান করবে। ঠিক এই মুহুর্তে আজরাঈল (আঃ) সেখানে তাশরীফ এনে হযরত ইয়াকুব (আঃ) কে সালাম করলেন। হযরত ইয়াকুব (আঃ) বললেন, আজরাঈল! আপনি যদি আমার জান কবজ করার জন্য এসে থাকেন, তবে আমার একটি অনুরোধ রাখবেন, খুব আরামের সাথে আমার জান কবজ করবেন। আজরাঈল হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর অনুরোধ রক্ষা করলেন।

হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর জান কবজ করার সাথে সাথে ফেরেশতা জিব্রাঈল (আঃ) অন্যান্য বহু ফেরেস্তা নিয়ে হাজির হলেন এবং তাঁর গোসল ও কাফন দাফনের কাজ সমাধা করলেন।

হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর ইন্তেকাল সম্পর্কে উল্লেখিত বর্ণনা ছাড়া আর একটি বর্ণনা এরুপ যে, তিনি একশত ছিচল্লিশ মতান্তরে একশত পয়তাল্লিশ আবার কারও কারও মতে দু’শত বছর জীবন ধারণ করে মিশর দেশেই প্রাণ ত্যাগ করেন।

কিন্তু হযরত ইউসুফ (আঃ) পিতা হযরত ইয়াকুব (আঃ) কে মিসরে দাফন করতে অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। তিনি তাঁর দাদা পর দাদা নবীদের রওজাস্থল শাম দেশে তাঁকে দাফন করতে মনস্থ করলেন এবং সে অনুসারে তিনি কাঠের বাকস তৈরী করে মৃত পিতার লাশ গোসল ও কাফন পরিয়ে বাক্সের ভিতরে রেখে দিলেন। অতঃপর তিনি বেশ কিছু লোককে অসিয়ত করলেন যে, তোমরা নবীর লাশ শাম দেশে নিয়ে তথাকার হারান নামক মৌজায় যেখানে হযরত ইব্রাহীম (আঃ), ইসমাঈল (আঃ) ও হযরত ইসহাক (আঃ) প্রমুখ নবীদের রওজা অবস্থিত, সেখানে দাফন করে আসবে।

ঘটনাক্রমে ঠিক একই সময় হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর জৈষ্ঠ্য ভাই হযরত ঈসু (আঃ) ও রোমে ইন্তেকাল করলেন।

হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর লাশ মোবারক নিয়ে লোকজন যখন মিসর হতে শাম দেশে পৌঁছালেন, ঠিক সেই মুহুর্তে রোম হতে লোকজন হযরত ঈসু (আঃ)এর লাশ নিয়েও সেখানে পৌঁছালেন। তখন উপর পক্ষের লোকগণ এ ঘটনার মধ্যে আল্লাহ পাকের কোন গভীর রহস্য নিহিত আছে মনে করে সম্মিলিতভাবে পরামর্শক্রমে সহোদর নবী ভ্রাতাদ্বয়কে পাশাপাশি দাফন করলেন।

সূত্রঃ কুরআনের শ্রেষ্ঠ কাহিনী

হযরত ইয়াকুব (আঃ) এর জন্ম ও বংশ পরিচয় পড়তে এখানে ক্লিক করুন

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।