হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রঃ) – পর্ব ৫
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রঃ) – পর্ব ৪ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
হযরত সোয়াহেল (রঃ) নামে এক সাধক প্রায়ই হযরত আবদুল্লাহ (রঃ)-এর দরবারে আসেন। নানা বিষয়ে আলাপ আলোচনা হয়। একদি আসর শেষে ফিরছেন। হঠাৎ আবদুল্লাহ (রঃ)-কে বললেন, আমি আর কোনদিনই এখানে আসছি না। কারণ আজ আমি আপনার বাড়ীর নিকটবর্তী হলে ছাদের ওপর থেকে আপনার দাসীরা সোহায়েল ওপরে আসুন বলে আমাকে ডাকাডাকি করছিল। আমার খুব খারাপ লেগেছে।
একথা শোনামাত্র হযরত আবদুল্লাহ (রঃ) উপস্থিত লোকজনকে বললেন, তোমরা এসো। সোহায়েলের জানাজা আদায় করতে হবে। হলও ঠিক তাই। কিছুক্ষণ পরেই সোহায়েল (রঃ) শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। কাফন-দাফন-জানাজা যথারীতি সম্পন্ন করে কৌতূহলী লোকজন তাঁকে জিজ্ঞেস করল, সোহায়েল (রঃ) জীবিত থাকতেই আপনি আগাম তাঁর জানাজার কথা কিভাবে ঘোষণা করলেন? তিনি বললেন, যখন তিনি ছাদের দাসীদের আহবানের কথা বললেন, তখনই আমি বুঝে নিয়েছিলাম, সে ডাক দাসীদের নয়, জান্নাতের হুরগণ তাঁকে ডাক দিয়েছে। কেননা আমার এখানে দাসী-বাঁদী নেই।
এক পাদ্রী আল্লাহর ভয়ে ভীত হয়ে প্রচুর এবাদত-উপাসনা করে দুর্বল হয়ে পড়েছিলেন। হযরত আবদুল্লাহ (রঃ) তাঁকে জিজ্ঞেস করেন, আল্লাহর পথ কেমন?
পাদ্রী বললেন, আপনি যখন বিজ্ঞ ব্যক্তি, তখন আল্লাহ ও তাঁর পথের পরিচয় নিশ্চয় আপনার অজ্ঞাত নয়। সত্যি বলতে কি, আমি আজ অবধি আল্লাহকে চিনতে পারিনি। আর তাঁর পরিচয় না জেনেই উপাসনা করতে করতে দুর্বল হয়ে পড়েছি। আমি জানি, আপনি কেমন আরেফ! আপনার অন্তরে এখনও আল্লাহভীতি সৃষ্টি হয়নি। পাদ্রীর কথা শুনে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রঃ)-এর মনে সেদিন থেকে আল্লাহর ভয় ক্রমশঃ বৃদ্ধি পেতে লাগল।
এক অগ্নিপূজক কাবাঘর ঢুকতে গিয়ে ভয়ে কাঁপতে কাঁপতে হঠাৎ বেহুঁশ হয়ে পড়ে গেল। জানা গেল, সে ছদ্মবেশ কাবা শরীফে আসে। কিন্তু সেখানে ঢুকতে গিয়েই সে অদৃশ্য শব্দ শুনতে পায়- বন্ধুর শত্রু হয়ে বন্ধুর গৃহে প্রবেশ কর কিভাবে? দৈববাণী শুনেই সে ইসলাম ধর্মে ছিলেন। আর তিনিই পরে পুরো ব্যাপারটি খুলে বলেন।
নিশাপুর শহর। শীতের মওসুম। হযরত আবদুল্লাহ দেখলেন, এক ভৃত্য শীতে বড় কষ্ট পাচ্ছে। তিনি তাকে বললেন, তুমি তোমার মনিবের কাছে একখানি কম্বলের কথা বল না কেন? সে অভিযোগের ভঙ্গিতে বলল, আমাকে বলতে হবে কেন? তিনি আমার অবস্থা দেখতে পান না? তার এ কথায় গভীরভাবে আলোড়িত হয় আবদুল্লাহর মন। তিনি বলতেন, কেউ তরীকত হাসিল করতে চাইলে সে যেন এই ভৃত্যের কাছে তা শিখে নেয়।
এক অগ্নি উপাসক কথা প্রসঙ্গে বললেন, জ্ঞানীগণ সেই কাজটি প্রথম দিনই করে, নির্বোধরা যা তিন দিন পরে করে। কথা খুব মূল্যবান মনে হয় হযরত আবদুল্লাহর। তিনি লোকদের বললেন, তোমরা এ কথাটি মনে রাখবে। এটি বড় উপদেশ।
হযরতের নিজস্ব উপদেশগুলোও উত্তম জ্ঞানগর্ভ ছিল। যেমন-
১. মানুষের জন্য সর্বাপেক্ষা উত্তম কি?
তাঁর উত্তরঃ অধিক জ্ঞান ও বুদ্ধি।
প্রশ্নঃ তা যদি না থাকে?
উত্তরঃ তাহলে সৎ স্বভাবিশিষ্ট হওয়া।
প্রশ্নঃ যদি তাও না হয়?
উত্তরঃ তাহলে তাড়াতাড়ি সরে যাওয়া ভালো।
২. যে ব্যক্তি আদবের গুরত্ব বোঝে না, তার দৃষ্টান্ত হল, যারা সুন্নাত আদায় করে না তাদের থেকে ফরজ তরক হওয়াকে সম্ভাবনা দেখা দেয়। আর এ ধরণের লোক কখনও মারেফাত লাভ করতে সক্ষম হয় না।
৩. আল্লাহর প্রকৃত বন্ধু এক পলকও তাঁর স্মরণ থেকে বিরত থাকে না।
৪. বেশী বিদ্যার্জন অপেক্ষা কম আদব শিক্ষা করা অনেক ভালো।
৫. মানুষকে এক দেরহাম কর্জে হাসানা প্রদান করা হাজার দেরহাম দান করা অপেক্ষা বেশী পুণ্যের কাজ।
৬. সন্তান-সন্ততির ভরণ-পোষণের সঙ্গে সঙ্গে কেউ যদি তাদের ধর্মীয় শিক্ষা দান করে তবে সে জিহাদের পুণ্য-প্রাপ্ত হয়।
৭. অন্তরের মাধ্যমে অন্তরের ভয় দূরীভূত হয়। মনে সান্ত্বনা আসে।
৮. পরনিন্দা-পরচর্চা যদি করতেই হয়, তাহলে সে যেন পিতামাতার নিন্দা করে। কেননা, তাহলে সন্তানের অর্জিত পুণ্যগুলো পিতামাতার আমলনামায় গণ্য হবে।
৯. এক যুবক হযরতের দরবারে এসে অত্যন্ত দ্বিধাগ্রস্থ হতে বলল, হুজুর, আমি এমন পাপ করেছি যা লজ্জাবশতঃ খুলে বলতে পারছি না। আপনি আমাকে মুক্তির উপায় বলে দিন। হযরত বললেন, আগে কাজটা কী তা বলবে তো। তবে তো মুক্তির পথ বলে দেব। সে বলল, ব্যভিচার করেছি। তিনি বললেন, আমার আশঙ্কা ছিল তুমি কারো গীবত করেছ। কেননা গীবত হল মানুষের হক। সুতরাং যদি গীবত করা হয় এবং সে যদি তা মাফ না করে, তাহলে তা মার্জিত হবে না। আর ব্যভিচার হল আল্লাহর হক। অতএব ব্যভিচার করে যদি পরিষ্কার মনে তওবা করা হয়, তবে আল্লাহ তা মাফ করতে পারেন।
১০. আল্লাহর প্রতি লক্ষ্য রাখ। অর্থাৎ সর্বদা এভাবে চলবে যেন আল্লাহকে সামনে দেখছ।
১১. একদিন অতিথি এল ঘরে। কিন্তু আপ্যায়ন করার মতো কিছুই ছিল না তবুও তিনি স্ত্রীকে বললেন, আপ্যায়নের ব্যবস্থা কর। স্ত্রী তাঁর কথায় ভ্রূক্ষেপ করলেন না। ইসলামের বিধান, যে স্ত্রী স্বামীর সৎ নির্দেশ পালন না করে, তাকে তালাক দেওয়া যায়। তিনিও স্ত্রীর মোহরানা আদায় করে তালাক দিয়ে দিলেন।
অপর দিকে এক ধর্মানুষ্ঠানে তাঁর বক্তৃতা শুনে এক ধনী কন্যা তাঁর প্রতি আকৃষ্ট হন। পিতামাতার কাছে বিবাহের ইচ্ছা প্রকাশ করলে তাঁরা খুশী হয়ে হযরত আবদুল্লাহর (রঃ)-এর হাতে তাঁকে সোপর্দ করেন। আর কন্যাকে পঞ্চাশ হাজার মুদ্রাও দিয়ে দেন। শাদী মোবারক সম্পন্ন হলে হযরত স্বপ্নে দেখলেন, আল্লাহ বলছেন, আমার খুশীর জন্য তুমি তোমার স্ত্রীকে তালাক দিয়েছিলে। বিনিময়ে আমি তদপেক্ষা উত্তম স্ত্রীর ব্যবস্থা করে দিলাম। কারণ, তুমি যেন দৃঢ় বিশ্বাস রাখতে পার- যারা আল্লাহর খুশীর জন্য স্বীকার করে, আল্লাহ তার বদলা অবশ্যই দেন।
সূত্র: তাযকিরাতুল আউলিয়া
হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মোবারক (রঃ) -শেষ পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন