অন্ধকারে হাতি দেখা

বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি যে, যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আচ্ছা, হঠাৎ যদি কোথাও ধোঁয়া উড়তে দেখো, তাহলে কি তোমরা ধরে নেবে যে, সেখানে আগুন লেগেছে? না না, এমনটি ভাবা ঠিক নয়, কারণ ধোঁয়া দেখলেই সেখানে আগুন লেগেছে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ অনুমান বা ধারণা সব সময় সত্য নাও হতে পারে। পবিত্র কুরআনে ধারণা বা অনুমান করতে নিষেধ করা হয়েছে। সূরা হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা ধারণা করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চয় কিছু কিছু ধারণা ‘গোনাহ’। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান কর না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”

বন্ধুরা, কেবল অনুমানই নয়, কোন বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে সে সম্পর্কে কথা বলতে যাওয়াও ঠিক নয়। কোনো কারণে সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হলে অপমানিত হতে হয়। কিন্তু তারপরও আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা কোন কিছু না জেনেই অযথা কথা বলে থাকে। নিজের অজ্ঞতাকে লুকিয়ে রাখতে তারা সবকিছু জানার ভান করে। এ ধরনের লোকদের পরিণতি সম্পর্কে মাওলানা রুমী তার মসনবী গ্রন্থে একটি মজার গল্প লিখেছেন।

আজকের গল্পের নাম ‘অন্ধকারে হাতি দেখা’। অনেক দিন আগের কথা। হিন্দুস্তান থেকে একদল লোক একটি হাতি নিয়ে বের হলো বিদেশ সফরে। যেসব দেশের মানুষ হাতি দেখেনি, সেসব দেশে তারা হাতির খেলা দেখাতো আর এভাবে অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করতো। একদিন তারা এক শহরে গিয়ে পৌঁছল এবং রাত হয়ে যাওয়ায় তারা একটি বাড়ী ভাড়া করে সেখানে অবস্থান নিলো।

এদিকে শহরে হাতি আসার খবর নিমিষেই পৌছে গেল মানুষের বাড়ী বাড়ী। শহরের বেশী লোকই ভাবলো, ঠিক আছে, হাতির খেলা শুরু হলে তখন গিয়ে তারা দেখবে যে, হাতি দেখতে কেমন। কিন্তু কিছু লোক এমন ছিল যাদের আর তর সইছিল না। তাদের কথা হলো, সবার আগে হাতি দেখতে পেলে অন্যদের সাথে এ নিয়ে গর্ব করতে পারবে যে, আমার সবার আগে হাতি দেখেছি। এতে করে শহরে তাদের নাম ডাক বেড়ে যাবে।

ব্যস আর যায় কোথায়! ওরকম কয়েকজন দল বেধে রাতেই রওনা হলো হাতি দেখতে। তারা হাতির মালিককে গিয়ে বলল, আমাদের হাতি দেখাও, আমরা এ রাতেই হাতি দেখতে চাই। মালিক : আমরা সবে মাত্র এসে পৌছেছি, খুবই ক্লান্ত, খেলার কোনো ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। তোমরা বরং কালকে এসো। লোক : অসম্ভব, এখনই হাতি দেখতে চাই। হাতি না দেখে কিছুতেই যাবো না আমরা।

মালিক : আহা, তোমরা অস্থির হচ্ছো কেন, দেখছো এখন অন্ধকার। আর তাছাড়া হাতির ঘরেও কোন বাতি নেই। অন্ধকারে হাতি দেখবে কেমন করে? লোক : আমরা অন্ধকারেই হাতি দেখব। আলোর কোন দরকার নেই। এখন হাতি না দেখে ফিরে গেলে আমাদের সারারাত ঘুমই হবে না। মালিক : ঠিকাছে, এতই যখন তোমাদের তাড়াহুড়া তাহলে অন্ধকারেই হাতি দেখাব। তবে হাতি দেখার জন্য কিন্তু প্রথম রাতে দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে।

লোক : আরে বাপু, টাকা পয়সা কোন বিষয় হলো? এই নাও তিনগুণ টাকা রাখো। এবার হাতি দেখার ব্যবস্থা কর। মালিক: ঠিকাছে, তোমরা যখন ছাড়বেই না তাহলে দেখার ব্যবস্থা করছি। তবে হাতি খুবই ক্লান্ত। তাই এক মিনিটের বেশি সময় দেব না। এক মিনিটেই দেখা শেষ করতে হবে।

লোক: আরে বাবা, ওই এক মিনিটই দেখা। ওই এক মিনিটই আমাদের জন্য শত মিনিট। হাতি যদি আমাদের লাথি দেয় তাও আমরা রাজি। মোটকথা, আমরা এখনই হাতি দেখতে চাই। হয় হাতি নয় মরণ। বাধ্য হয়ে হাতির মালিক লোকদের কাছ থেকে টাকা গুণে নিল এবং হাতির মাহুত তাদেরকে নিয়ে গেল হাতির ঘরে। তবে একজন লোক দাঁড়িয়ে রইল। সে কেন হাতি দেখতে যাচ্ছে না, হাতির মালিক তা জানতে চাইল। লোকটি বললো : হাতি দেখার ব্যাপারে আমার ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও আমি যেতে পারছি না কারণ আমি একজন রাতকানা মানুষ। রাতের আঁধারে কিছুই দেখি না।

তার চেয়ে তুমি যদি বল, হাতি দেখতে কী রকম আর কি কি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাহলে খুব খুশী হব। মালিক : মাশাল্লাহ! মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা বুদ্ধিমান। আসলে কোনো কিছু বুঝার পথই হচ্ছে ওই বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ তাদের কাছ থেকে জেনে নেয়া। রাতকানা: তুমি ঠিকই বলেছো। এবার সংক্ষিপ্তভাবে হাতির বর্ণনাটা দাও।

মালিক: ঠিকাছে শোনো। হাতি, ঘোড়া কিংবা উটের মতোই একটি প্রাণী। তবে তার দেহ বিশাল এবং ওজনও ভারী। অন্যান্য প্রাণীর ঘাড় আছে কিন্তু হাতির ঘাড় নেই। তার মাথা শরীরের সাথেই যুক্ত। তার মুখও চেহারার নিম্নভাগে। ঘাড় না থাকার ফলে মুখ মাটিতে পৌঁছাতে পারে না, তাই ঘাস মুখ দিয়ে ছিঁড়ে খেতে পারে না। তবে এ জন্য তার একটি লম্বা শুঁড় আছে। হাতির শুঁড় দেখতে লম্বা রাবারের পাইপের মতো। হাতির শুঁড় নাকের কাজও করে। হাতি তার শুঁড় দিয়ে শরীরে পানি টেনে নেয়। হাতির দুটো লম্বা দাঁতও আছে। হাতির দাঁতের দাম হাতির দামেরই সমান। কারণ তা অনেক কাজে লাগে। এভাবে হাতির মালিক রাতকানা লোকটিকে হাতির শারীরিক বর্ণনা ও বৈশিষ্ট্যগুলো জানিয়ে দিল।

ওদিকে বাকী লোকগুলো অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে হাতির কাছে পৌছে গেল। তারা হাতির গায়ে হাত বুলাতে পেরে খুব খুশী হলো এবং গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠল। তবে আগে যেহেতু তারা হাতি দেখেনি তাই হাতির যে অংশে যার হাত লেগেছে, সেই অংশকেই সে হাতি বলে ধরে নিল। কেউ হাতির শুঁড়ে হাত বুলালো, কেউ হাতির দাঁতে, কেউবা হাতির সামনের অংশে, কেউবা আবার হাতির পায়ে হাতের ছোঁয়া লাগালো। হাতি দেখা শেষ করে তারা দলবেধে রওনা হলো বাড়ির দিকে।

কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার শেষ মাথায় তারা একদল লোককে দেখতে পেল। তারা এক বিয়ে বাড়ী থেকে বের হয়েছে। ব্যস, আর যায় কোথায়! শুরু হলো সবার আগে হাতি দেখার গৌরব আর বাহাদুরীর আলাপ।

একজন আগ্রহের সাথে বলল, আশ্চর্যের কথা! হাতি আসতে না আসতেই তোমরা দেখে ফেলেছো? ঠিকাছে বলো দেখি-হাতি দেখতে কেমন? লোকদের আগ্রহ দেখে যে ব্যক্তি হাতির শুঁড়ে হাত বুলিয়েছিল সে বললো, হাতি এক আজব জীব। দেখতে অজহর সাপের মতো যেন গাছ থেকে ঝুলে আছে নিচের দিকে। সোজা হয়, বাঁকা হয়, গোল হয় আবার নড়াচড়াও করে। মোট কথা এক ভয়ঙ্কর প্রাণী এই হাতি। আমি তো ভয়ে অস্থির। তাই দ্রুত চলে এলাম।

এবার যে ব্যক্তি হাতির পায়ে হাত বুলিয়েছিল সে বলল, হাতি যে যতো কথাই বলুক না কেন, হাতি আসলে সে রকম কিছু নয়। হাতি হলো এমন দুটি থামের মতো যা কিছু উপরের দিকে গিয়ে পরস্পর মিলিত হয়েছে। যারা হাতির পেঠ ও পিঠ ধরেছিল, তারা বলল, হাতি আসরে একটি বড় উঁচু খাটের মত। চারটি পায়ের ওপর বিরাট একটি ছাদের মতো শরীর দাঁড়িয়ে আছে। এই ছাদের ওপর মানুষ আরোহণ করে। যারা হাতির দাঁত ছুয়েছিল তারা বলল, হাতি তলোয়ারের মতো। পাশাপাশি দুটি নাঙ্গা তলোয়ার বের হয়ে আছে। তবে তাতে কোন ধার নেই।

যে ব্যক্তি হাতির লেজ স্পর্শ করেছে সে বলল, হাতি দেখতে অনেকটা চাবুকের মতো। এসব বিবরণ শুনে সে রাতে যারা হাতি দেখার সুযোগ পায়নি তাদের যেন দুঃখের সীমা রইল। লোকদের কাছে হাতির আজব বিবরণ শুনে রাতকানা লোকটি আর চুপ করে থাকতে পারলো না। সে সবাইকে ডেকে বলল, এরা হাতি সম্পর্কে যা বলছে, তার কোনটাই ঠিক নয়। আমি ওদের চেয়ে বেশী জানি হাতি সম্পর্কে।

এ কথা শুনে লোকজন বলল, তুমি কি হাতি দেখেছো? রাতকানা লোকটি বলল, না আমি নিজ চোখে দেখিনি। তবে ওরা যখন অন্ধকারে হাতির ঘরে হাতি দেখতে যায়, তখন আমি রাতকানা বলে তাদের সাথে না গিয়ে হাতির মালিকের সাথে কথা বলে হাতি সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনেছি। এখন বুঝতে পারছি, আমার বন্ধুরা অন্ধকারে হাতির শরীরের যে অংশ স্পর্শ করেছে, সে সেই অংশইকেই হাতি বলে মনে করেছে।

এরপর রাতকানা লোকটি হাতির শরীরের বর্ণনা দিল। হাতির শরীরের বিবরণ শুনে অতি উৎসাহী লোকদের কেউই আর কথা বললো না। পরদিন যখন হাতির খেলা হলো, তখন সবাই হাতি দেখে সাক্ষ্য দিলে যে, রাতকানা লোকটি হাতির যে বর্ণনা দিয়েছে তাই সঠিক। কিন্তু যারা তড়িঘড়ি করে হাতির গায়ে হাত বুলিয়ে এসে হাতি সম্পর্কে বলেছিল, তারা দিনের আলোয় হাতি দেখে নিজেরাই হেসে ফেলল নিজেদের বোকামী ও অজ্ঞতার জন্য। তারা বুঝতে পারলো যে, অন্ধকারে হাতি দেখা যায় না, দেখলে অবাস্তব ও আংশিক কিছু দেখা যায়। এভাবে কোন কিছু সম্পর্কে কোন কথা বলা ঠিক নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

অন্ধকারে হাতি দেখা

বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশাকরি যে, যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। আচ্ছা, হঠাৎ যদি কোথাও ধোঁয়া উড়তে দেখো, তাহলে কি তোমরা ধরে নেবে যে, সেখানে আগুন লেগেছে? না না, এমনটি ভাবা ঠিক নয়, কারণ ধোঁয়া দেখলেই সেখানে আগুন লেগেছে এমনটি মনে করার কোনো কারণ নেই। কারণ অনুমান বা ধারণা সব সময় সত্য নাও হতে পারে। পবিত্র কুরআনে ধারণা বা অনুমান করতে নিষেধ করা হয়েছে। সূরা হুজরাতের ১২ নম্বর আয়াতে মহান আল্লাহ বলেছেন, “হে মুমিনগণ! তোমরা ধারণা করা থেকে বিরত থাক। নিশ্চয় কিছু কিছু ধারণা ‘গোনাহ’। এবং গোপনীয় বিষয় সন্ধান কর না। তোমাদের কেউ যেন কারও পশ্চাতে নিন্দা না করে। তোমাদের কেউ কি তারা মৃত ভ্রাতার মাংস ভক্ষণ করা পছন্দ করবে? বস্তুতঃ তোমরা তো একে ঘৃণাই কর। আল্লাহকে ভয় কর। নিশ্চয় আল্লাহ তওবা কবুলকারী, পরম দয়ালু।”

বন্ধুরা, কেবল অনুমানই নয়, কোন বিষয় সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে সে সম্পর্কে কথা বলতে যাওয়াও ঠিক নয়। কোনো কারণে সে ধারণা মিথ্যা প্রমাণিত হলে অপমানিত হতে হয়। কিন্তু তারপরও আমাদের সমাজে অনেক মানুষ আছে যারা কোন কিছু না জেনেই অযথা কথা বলে থাকে। নিজের অজ্ঞতাকে লুকিয়ে রাখতে তারা সবকিছু জানার ভান করে। এ ধরনের লোকদের পরিণতি সম্পর্কে মাওলানা রুমী তার মসনবী গ্রন্থে একটি মজার গল্প লিখেছেন।

আজকের গল্পের নাম ‘অন্ধকারে হাতি দেখা’। অনেক দিন আগের কথা। হিন্দুস্তান থেকে একদল লোক একটি হাতি নিয়ে বের হলো বিদেশ সফরে। যেসব দেশের মানুষ হাতি দেখেনি, সেসব দেশে তারা হাতির খেলা দেখাতো আর এভাবে অনেক টাকা-পয়সা রোজগার করতো। একদিন তারা এক শহরে গিয়ে পৌঁছল এবং রাত হয়ে যাওয়ায় তারা একটি বাড়ী ভাড়া করে সেখানে অবস্থান নিলো।

এদিকে শহরে হাতি আসার খবর নিমিষেই পৌছে গেল মানুষের বাড়ী বাড়ী। শহরের বেশী লোকই ভাবলো, ঠিক আছে, হাতির খেলা শুরু হলে তখন গিয়ে তারা দেখবে যে, হাতি দেখতে কেমন। কিন্তু কিছু লোক এমন ছিল যাদের আর তর সইছিল না। তাদের কথা হলো, সবার আগে হাতি দেখতে পেলে অন্যদের সাথে এ নিয়ে গর্ব করতে পারবে যে, আমার সবার আগে হাতি দেখেছি। এতে করে শহরে তাদের নাম ডাক বেড়ে যাবে।

ব্যস আর যায় কোথায়! ওরকম কয়েকজন দল বেধে রাতেই রওনা হলো হাতি দেখতে। তারা হাতির মালিককে গিয়ে বলল, আমাদের হাতি দেখাও, আমরা এ রাতেই হাতি দেখতে চাই। মালিক : আমরা সবে মাত্র এসে পৌছেছি, খুবই ক্লান্ত, খেলার কোনো ব্যবস্থা এখনো করা হয়নি। তোমরা বরং কালকে এসো। লোক : অসম্ভব, এখনই হাতি দেখতে চাই। হাতি না দেখে কিছুতেই যাবো না আমরা।

মালিক : আহা, তোমরা অস্থির হচ্ছো কেন, দেখছো এখন অন্ধকার। আর তাছাড়া হাতির ঘরেও কোন বাতি নেই। অন্ধকারে হাতি দেখবে কেমন করে? লোক : আমরা অন্ধকারেই হাতি দেখব। আলোর কোন দরকার নেই। এখন হাতি না দেখে ফিরে গেলে আমাদের সারারাত ঘুমই হবে না। মালিক : ঠিকাছে, এতই যখন তোমাদের তাড়াহুড়া তাহলে অন্ধকারেই হাতি দেখাব। তবে হাতি দেখার জন্য কিন্তু প্রথম রাতে দ্বিগুণ টাকা দিতে হবে।

লোক : আরে বাপু, টাকা পয়সা কোন বিষয় হলো? এই নাও তিনগুণ টাকা রাখো। এবার হাতি দেখার ব্যবস্থা কর। মালিক: ঠিকাছে, তোমরা যখন ছাড়বেই না তাহলে দেখার ব্যবস্থা করছি। তবে হাতি খুবই ক্লান্ত। তাই এক মিনিটের বেশি সময় দেব না। এক মিনিটেই দেখা শেষ করতে হবে।

লোক: আরে বাবা, ওই এক মিনিটই দেখা। ওই এক মিনিটই আমাদের জন্য শত মিনিট। হাতি যদি আমাদের লাথি দেয় তাও আমরা রাজি। মোটকথা, আমরা এখনই হাতি দেখতে চাই। হয় হাতি নয় মরণ। বাধ্য হয়ে হাতির মালিক লোকদের কাছ থেকে টাকা গুণে নিল এবং হাতির মাহুত তাদেরকে নিয়ে গেল হাতির ঘরে। তবে একজন লোক দাঁড়িয়ে রইল। সে কেন হাতি দেখতে যাচ্ছে না, হাতির মালিক তা জানতে চাইল। লোকটি বললো : হাতি দেখার ব্যাপারে আমার ব্যাপক আগ্রহ থাকলেও আমি যেতে পারছি না কারণ আমি একজন রাতকানা মানুষ। রাতের আঁধারে কিছুই দেখি না।

তার চেয়ে তুমি যদি বল, হাতি দেখতে কী রকম আর কি কি বৈশিষ্ট্যের অধিকারী তাহলে খুব খুশী হব। মালিক : মাশাল্লাহ! মনে হচ্ছে তুমি কিছুটা বুদ্ধিমান। আসলে কোনো কিছু বুঝার পথই হচ্ছে ওই বিষয়ে যারা অভিজ্ঞ তাদের কাছ থেকে জেনে নেয়া। রাতকানা: তুমি ঠিকই বলেছো। এবার সংক্ষিপ্তভাবে হাতির বর্ণনাটা দাও।

মালিক: ঠিকাছে শোনো। হাতি, ঘোড়া কিংবা উটের মতোই একটি প্রাণী। তবে তার দেহ বিশাল এবং ওজনও ভারী। অন্যান্য প্রাণীর ঘাড় আছে কিন্তু হাতির ঘাড় নেই। তার মাথা শরীরের সাথেই যুক্ত। তার মুখও চেহারার নিম্নভাগে। ঘাড় না থাকার ফলে মুখ মাটিতে পৌঁছাতে পারে না, তাই ঘাস মুখ দিয়ে ছিঁড়ে খেতে পারে না। তবে এ জন্য তার একটি লম্বা শুঁড় আছে। হাতির শুঁড় দেখতে লম্বা রাবারের পাইপের মতো। হাতির শুঁড় নাকের কাজও করে। হাতি তার শুঁড় দিয়ে শরীরে পানি টেনে নেয়। হাতির দুটো লম্বা দাঁতও আছে। হাতির দাঁতের দাম হাতির দামেরই সমান। কারণ তা অনেক কাজে লাগে। এভাবে হাতির মালিক রাতকানা লোকটিকে হাতির শারীরিক বর্ণনা ও বৈশিষ্ট্যগুলো জানিয়ে দিল।

ওদিকে বাকী লোকগুলো অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে হাতির কাছে পৌছে গেল। তারা হাতির গায়ে হাত বুলাতে পেরে খুব খুশী হলো এবং গর্বে তাদের বুক ফুলে উঠল। তবে আগে যেহেতু তারা হাতি দেখেনি তাই হাতির যে অংশে যার হাত লেগেছে, সেই অংশকেই সে হাতি বলে ধরে নিল। কেউ হাতির শুঁড়ে হাত বুলালো, কেউ হাতির দাঁতে, কেউবা হাতির সামনের অংশে, কেউবা আবার হাতির পায়ে হাতের ছোঁয়া লাগালো। হাতি দেখা শেষ করে তারা দলবেধে রওনা হলো বাড়ির দিকে।

কিছুদূর যাওয়ার পর রাস্তার শেষ মাথায় তারা একদল লোককে দেখতে পেল। তারা এক বিয়ে বাড়ী থেকে বের হয়েছে। ব্যস, আর যায় কোথায়! শুরু হলো সবার আগে হাতি দেখার গৌরব আর বাহাদুরীর আলাপ।

একজন আগ্রহের সাথে বলল, আশ্চর্যের কথা! হাতি আসতে না আসতেই তোমরা দেখে ফেলেছো? ঠিকাছে বলো দেখি-হাতি দেখতে কেমন? লোকদের আগ্রহ দেখে যে ব্যক্তি হাতির শুঁড়ে হাত বুলিয়েছিল সে বললো, হাতি এক আজব জীব। দেখতে অজহর সাপের মতো যেন গাছ থেকে ঝুলে আছে নিচের দিকে। সোজা হয়, বাঁকা হয়, গোল হয় আবার নড়াচড়াও করে। মোট কথা এক ভয়ঙ্কর প্রাণী এই হাতি। আমি তো ভয়ে অস্থির। তাই দ্রুত চলে এলাম।

এবার যে ব্যক্তি হাতির পায়ে হাত বুলিয়েছিল সে বলল, হাতি যে যতো কথাই বলুক না কেন, হাতি আসলে সে রকম কিছু নয়। হাতি হলো এমন দুটি থামের মতো যা কিছু উপরের দিকে গিয়ে পরস্পর মিলিত হয়েছে। যারা হাতির পেঠ ও পিঠ ধরেছিল, তারা বলল, হাতি আসরে একটি বড় উঁচু খাটের মত। চারটি পায়ের ওপর বিরাট একটি ছাদের মতো শরীর দাঁড়িয়ে আছে। এই ছাদের ওপর মানুষ আরোহণ করে। যারা হাতির দাঁত ছুয়েছিল তারা বলল, হাতি তলোয়ারের মতো। পাশাপাশি দুটি নাঙ্গা তলোয়ার বের হয়ে আছে। তবে তাতে কোন ধার নেই।

যে ব্যক্তি হাতির লেজ স্পর্শ করেছে সে বলল, হাতি দেখতে অনেকটা চাবুকের মতো। এসব বিবরণ শুনে সে রাতে যারা হাতি দেখার সুযোগ পায়নি তাদের যেন দুঃখের সীমা রইল। লোকদের কাছে হাতির আজব বিবরণ শুনে রাতকানা লোকটি আর চুপ করে থাকতে পারলো না। সে সবাইকে ডেকে বলল, এরা হাতি সম্পর্কে যা বলছে, তার কোনটাই ঠিক নয়। আমি ওদের চেয়ে বেশী জানি হাতি সম্পর্কে।

এ কথা শুনে লোকজন বলল, তুমি কি হাতি দেখেছো? রাতকানা লোকটি বলল, না আমি নিজ চোখে দেখিনি। তবে ওরা যখন অন্ধকারে হাতির ঘরে হাতি দেখতে যায়, তখন আমি রাতকানা বলে তাদের সাথে না গিয়ে হাতির মালিকের সাথে কথা বলে হাতি সম্পর্কে অনেক তথ্য জেনেছি। এখন বুঝতে পারছি, আমার বন্ধুরা অন্ধকারে হাতির শরীরের যে অংশ স্পর্শ করেছে, সে সেই অংশইকেই হাতি বলে মনে করেছে।

এরপর রাতকানা লোকটি হাতির শরীরের বর্ণনা দিল। হাতির শরীরের বিবরণ শুনে অতি উৎসাহী লোকদের কেউই আর কথা বললো না। পরদিন যখন হাতির খেলা হলো, তখন সবাই হাতি দেখে সাক্ষ্য দিলে যে, রাতকানা লোকটি হাতির যে বর্ণনা দিয়েছে তাই সঠিক। কিন্তু যারা তড়িঘড়ি করে হাতির গায়ে হাত বুলিয়ে এসে হাতি সম্পর্কে বলেছিল, তারা দিনের আলোয় হাতি দেখে নিজেরাই হেসে ফেলল নিজেদের বোকামী ও অজ্ঞতার জন্য। তারা বুঝতে পারলো যে, অন্ধকারে হাতি দেখা যায় না, দেখলে অবাস্তব ও আংশিক কিছু দেখা যায়। এভাবে কোন কিছু সম্পর্কে কোন কথা বলা ঠিক নয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

আরো পড়তে পারেন...

মুগীরা ইবন শু’বা (রা)

নাম আবু আবদিল্লাহ মুগীরা, পিতা শু’বা ইবন আবী আমের। আবু আবদিল্লাহ ছাড়াও আবু মুহাম্মাদ ও…

সাপের তওবা

একটি সাপের ঘটনা বর্ণনা করছি। আমার কাছে যারা তালীম গ্রহন করতে আসে প্রথমেই আমি কাউকে…

আবদুল্লাহ ইবন হুজাফাহ আস-সাহমী-(রা)

আবু হুজাফাহ আবদুল্লাহ নাম। পিতার নাম হুজাফাহ। কুরাইশ গোত্রের বনী সাহম শাখার সন্তান। ইসলামী দাওয়াতের…