হংপাল–অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-শেষ পর্ব

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

রিদয় রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে সেই দিকে চেয়ে আছে, এদিকে পিছনে প্রায় একশো লোক জমা হয়েছে – নাকে তিলক, কপালে ফোঁটা, নেড়া মাথা বৈরাগীর দল! রিদয় যেমনি ফিরেছে অমনি সবাই মাটিতে দণ্ডবৎ হয়ে প্রণাম করে বললে – “জয় প্রভু বামনদেব, ঠাকুর, কৃপা কর!”বামন কে, রিদয় তা জানত না, কিন্তু প্রণামের ঘটা দেখে সে বুঝলে সবাই তাকে দেবতা ভেবেছে। রিদয় অমনি গম্ভীর হয়ে বললে – “তোমরা আমার হাঁস চুরি করেছ, এখনি এনে দাও। না হলে হংসেশ্বরীর কোপে পড়ে যাবে।”

সবাই মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। তখন হংসেশ্বরীর পাণ্ডা গলবস্তর হয়ে বললে, – “ঠাকুর, হাঁস কোথায় আছে বলে দিন, এখনি এনে দিচ্ছি!”

রিদয় রেগে বলে উঠল – “কোথায় জানলে কি তোমাদের আনতে বলি? এই গ্রামের দুটো ছেলে তাকে নিয়ে এসেছে – এই দিকে।”

এই কথা হচ্ছে এমন সময় মন্দিরের পিছন দিকে হাঁসের ডাক শোনা গেল। বেচারা প্রাণপণে চেঁচাচ্ছে! রিদয় দৌড়ে সেদিকে গিয়ে দেখে একটা ঘরের উঠোনে এক বুড়ি খোঁড়া-হাঁসকে দুই হাঁটুতে চেপে ধরে ডানা কেটে দেবার উদ্যোগ করছে।

– দুটো পালক কেটেছে, আর দুটো মুঠিয়ে কাটবার চেষ্টায় আছে। হঠাৎ বুড়ো-আংলা-রিদয়কে দেখে বুড়ি একেবারে হাঁ হয়ে গেল! সেই সময়ে যত নেড়ানেড়ির দল ছুটে এসে হৈ-হৈ করে বুড়ির হাত থেকে খোঁড়া-হাঁস ছাড়িয়ে নিলে। রিদয় হাঁসের উপরে চরে বসল আর অমনি রাজহাঁস তাকে নিয়ে আকাশে মিলিয়ে গেল।

বৈরাগীর দল সেই হাঁসের পালক হংসেশ্বরীর পরমহংস-বাবাজীর কাছে হাজির করে দিলে। তিনি পালক-কটি একটা হাড়ীতে রেখে খবরের কাগজে বিজ্ঞাপন দিলেন – “অভূতপূর্ব ঘটনা! হংসেশ্বরীর রাজহংস স্বশরীরে বামনদেবকে নিয়ে উপস্থিত হয়ে দুটি পালক রক্ষা করে গেছেন। সে জন্য একটি সোনার কৌটার প্রয়োজন। হিন্দুমাত্রেরই এই বিষয় মুক্তহস্ত হওয়া উচিত। চাঁদা আমার কাছে মঃ অঃ করিয়া পাঠাইবেন। ইতি – সুরেশ্বরের পরমহংস বাবাজী।”

মানুষদের মধ্যে যেমন খবরের কাগজ, পাখিদের মধ্যে তেমনি খবর রটাবার জন্য পাখি আছে। কোথাও কিছু নতুন কাণ্ড হলেই সেই জায়গাটার প্রথমে কাক-চিল জড়ো হয়, তারপর তাদের মুখে এ-পাখি, এ-পাখির মুখে ও-পাখি – এমনি এ-বন, সে-বন, এ-দেশ, সে-দেশে দেখতে দেখতে খবর রটে যায়।

কাঠবেরালির কথা আর খোঁড়া-হাঁস উদ্ধারের কথা রিদয় ফিরে আসার পূর্বে হাঁসের দলে, বনে-জঙ্গলে, জলে-স্থলে কোনো জানোয়ারের জানতে আর বাকি রইল না। গাছে গাছে তাল-চড়াই, গাং-শালিক – এরা সুরে-তালে রিদয়ের কীর্তি-কথা ঢেঁড়া-পিটিয়ে বলে বেড়াতে লাগলঃ

শুন এবে অবধান পশুপক্ষিগণ।

বুড়ো-আংলা মহাকাব্য করি বিবরণ।।

কাঠবেরালি রামদাস তাহারে উদ্ধারি।

বীরদাপে চলে যথা রাজ হংসেশ্বরী।।

হাঁসের পালক দুটা কেটে নিল বুড়ি।

যাহে লেখা যায় মহাকাব্য ঝুড়ি ঝুড়ি।।

হাঁসের দুর্দশা দেখি বুড়ো-আংলা ধায়।

হংসেশ্বরী ছাড়ি বুড়ি পালায় ঢাকায়।।

মোহন্ত তুলিয়া নিল হংসের কলম।

সোনা চাই বলি তাহে লেখে বিজ্ঞাপন।।

তালচটক তাল ধরে গানশালিক কয়।

সুবচনী হাঁস নিয়ে চলিল রিদয়।।

খোঁড়া-হাঁসেরে লইয়া, খোঁড়া-হাঁসেরে লইয়া

রচিলাম মহাকাব্য যতন করিয়া।

আংলা বিজয় নামে কাব্য চমৎকার।

গোটা দুই শ্লোক তারি দিনু উপহার।।

সকলে শুনাহ অন্যকে।

ক্ষীর হতে নীর পিয়ে ধন্য হোক লোকে।।

ইতি আংলা বিজয় মহাকাব্যে প্রথম সর্গঃ।

আজ চকা-নিকোবর ভারি খুশি। সে রিদয়কে কুর্নিস করে বললে – “একবার নয়, বার-বার তিনবার তুমি দেখিয়েছ যে পশু-পাখিদের তুমি পরম বন্ধু! প্রথমে শেয়ালের মুখ থেকে বুনো-হাঁস ‘লুসাইকে’ উদ্ধার, তার পরে কাঠবেরালির উপকার, সব-শেষে পোষা-হাঁসকে বাঁচানো। তোমার ভালোবাসায় আমরা কেনা হয়ে রইলেম। তোমার যদি মানুষ হতে ইচ্ছে হয় তো বল আমি নিজে গণেশঠাকুরকে তোমার জন্যে ‘রেকমেণ্ডেসন’ পাঠিয়ে দিচ্ছি।”

রিদয়ের আর মোটেই মানুষ হতে ইচ্ছে ছিল না। হাঁসেদের সঙ্গে দেশ-বিদেশ দেখতে-দেখতে বড় মজাতেই সে দিন কাটাচ্ছে, তবু মানুষ হবার রেকমেণ্ডেসনখানা না নিলে চকা পাছে কিছু মনে করে, সেই ভয়ে বললে – “মানুষ হবার সময় হলে আমি তোমাকে জানাব। এখন কিছুদিন তোমাদের সঙ্গে থাকতে আমি ইচ্ছে করেছি।”

চকা ঘার নেড়ে বললে – “সেই ভালো; যখন ইচ্ছে হবে বল, আমি সাট্টিফিকিট দিয়ে তোমাকে গণেশের কাছে পাঠাব। এখন হাঁসের দলে হংসপাল হয়ে থাক।” বলে চকা রিদয়ের মাথাটা ঠোঁট দিয়ে চুলকে দিলে। অমনি চারিদিকে বুনো-হাঁস রিদয়ের নতুন উপাধি ফুকরে উঠল – “হংপাল! হংপাল!”

বনের পাখিরা প্রতিধ্বনি করলে – “হি-রি-দ-য় হংসপাল!

গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!