হংপাল–অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর-২য় পর্ব

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

ওদিকে মেঘনা, এদিকে পদ্মা – এই দুই নদী যেখানে মিলেছে, সেই কোণটিতে হল সুরেশ্বর মঠ। চারদিকে আম বাগান, জাম বাগান, ঠাকুরবাড়ি, অতিথিশালা, ভোগমন্দির, দোলমঞ্চ, আনন্দবাজার, রথতলা, নাটমন্দির, রন্ধনশালা, ফুলবাগান, গোহাল গোষ্ঠ, পঞ্চবটী, তুলসীমঞ্চ, রাসমঞ্চ, রামকুণ্ড, সীতাকুণ্ড, গোলকধাম, দেবদেবী স্থান – এমনি একটা পরগণা জুড়ে প্রকাণ্ড ব্যাপার! এরি এক কোণে বন আর মাঠ।

সেইখানে হাঁসেদের সঙ্গে রিদয় নেমেছে।

কেন যে এত বেলা থাকতে এখানে হাঁসেরা এসে আড্ডা গেড়ে বসল রিদয় তা বুঝলে না, ভেবেও দেখলে না, নিজের মনে বনে-বনে ঘুরে পাত-বাদাম আর শাক পাতা কুড়িয়ে ছায়ায়-ছায়ায় খেলে বেড়াতে লাগল।

লুসাই-হাঁসেরা ডানা ভালো হওয়া পর্যন্ত হাঁসেরা সেখানে অপেক্ষা করবার মতলব করেছে। একদিন খোঁড়া-হাঁস দুটো শোল-মাছের ছানা এনে রিদয়কে দিয়ে বললে – “খেয়ে ফেল।

মাছ না খেলে রোগা হবে।” রিদয় এবারে টপ-করে হাঁসের মতো সে-দুটো গিলে ফেললে। তারপর খোঁড়া-হাঁসের পিঠে চড়ে নানা রকম খেলা চলল। কোনো দিন জলে বুনো-হাঁসদের সঙ্গে সাঁতার-খেলা, কোনো দিন দৌড়াদৌড়ি, লুকোচুরি, হাঁসের লড়াই – এমনি সারাদিন ছুটোছুটি চেঁচামেচি! এমন আনন্দে রিদয় জন্মে কাটায়নি।

পড়াশুনো সব বন্ধ, একেবারে কৈলাস পর্যন্ত লম্বা ছুটি আর ছুট! খেলা শেষ হলে দু’তিন-ঘণ্টা দুপুর-বেলায় ধলেশ্বরীর ভাঙনের উপরে বসে জিরোনো; বিকালে আবার খেলা; আবার চান; সন্ধ্যাবেলা খেয়ে নিয়েই ঘুম। রিদয়ের খাবার ভাবনা গেছে, শোবারও কষ্ট মোটেই নেই। খোঁড়া-হাঁসের ডানায় এখন বেশ ভালো পালকের গদি পেতে সে বিছানা করে নিয়েছে, ঘুম পেলেই সেখানে ঢোকে।

কেবল রাত হলেই তার ভয় আসে, বুঝি কাল সকালে বাড়ি ফিরতে হয়! কিন্তু হাঁসেরা তার ফেরবার কথা আর তোলেই না। একদিন, দু’দিন, তিনদিন হাঁসেরা সুরেশ্বরেই রইল; কোনো দিকে যাবার নামটি করলে না।

রিদয়ও মনে ভরসা পেয়ে সুরেশ্বরের ম্নদির, মঠ লুকিয়ে দেখে নিতে লাগল – চারদিক ঘুরে। চারদিনের দিন চকা-নিকোবরকে কাছে আসতে দেখেই রিদয় ভাবলে – এইবার যেতে হল ফিরে! চকা গম্ভীর হয়ে তাকে শুধোলে – “এখানে খাওয়া-দাওয়া চলছে কেমন?”

রিদয় একটু হেসে বললে – “চলছে মন্দ নয়। তবে শীতকাল, ফল বড় একটা নেই।”

চকা তাকে সঙ্গে নিয়ে এক-ঝাড় কাঁচা বেত দেখিয়ে বললে – “বেত খেয়ে দেখ দেখি কেমন মিষ্টি!”

রিদয় বেত অনেকবার খেয়েছিল, আরো খাবার তার মোটেই ইছে নেই! কিন্তু চকার হুকুমে খেতে হল। খেয়ে দেখে মিষ্টি গুড়! ঠিক যেন আক চিবোচ্ছে।

চকা বললে – “কেমন ভালো লাগল কি? গুরুমশায় খাওয়ান শুকনো বেত, তাই লাগে বিশ্রী। যাহোক এখন বলি শোনো। এই বাগানে, বনে যে তুমি আজকাল একলাটি ঘুড়ে বেড়াতে আরম্ভ করেছ, এটা ভালো হচ্ছে না।”

রিদয় ভাবলে, এইবার যেতে হল রে!

চকা বললে – “এই যে বনে তোমার কত শত্রু রয়েছে জান? প্রথম হচ্ছে শেয়াল, সে তোমার গন্ধে গন্ধে ফিরছে, সুবিধে পেলেই ধরবে। তারপর ভোঁদড়, ভাম দুজনে আছে – যেখানে সেখানে গাছের কোটরে ঢুকতে গেলে বিপদে পড়বে কোনদিন!

জলের ধারে উদ্বেড়াল আছে – একলা চান করবার সময় সাবধান! যেখানে-সেখানে জড়ো-করা পাথরের উপর বসতে যেও না, তার মধ্যে বেঁজি লুকিয়ে থাকতে পারে। শুকনো পাতা-বেছানো জায়গা দেখলেই সেখানে শুতে যেও না; পাতাগুলো নেড়ে, তলায় সাপ কি বিছে আছে কিনা, দেখা ভালো।

মাঠ দিয়ে যখন চল, তখন আকাশের দিকে একবার চেয়ে দেখ – সেখানে বাজ-পাখি, চিল, কাক, শকুনি আছে কিনা? সেটা একবার-একবার দেখে চলা মন্দ নয়।

ফস করে ঝোপে-ঝাড়ে উঠতে যেও না; গেরো-বাজগুলো অনেক সময় সেখানে শিকার ধরতে লুকিয়ে থাকে। সন্ধ্যা হলে কান পেতে শুনবে, কোনো দিকে পেঁচা ডাকল কি না। পেঁচারা এমন নিঃশব্দে উড়ে আসে যে টের পাবে না কখন ঘাড়ে পড়ল।”

গল্পের ৩য় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!