সোনার দেশে লোহার মানুষ

বৈকুন্ঠে লক্ষীর সঙ্গে নারায়নের সামান্য একটূ তর্ক বেধেছিল।নারায়ন বলেছিলন,তোমার পুজো করে সামান্য লোকরা কৈ তেমন বড় কেউ করেছে বলে তো শুনিনি।পৃথিবীর যত বড় সাধক,ভক্ত আছে সবাই আমার জন্যই জপ-জপ করে,তপস্যা করে।এমন কি অসুর রাক্ষস যারা বড় হয়েছে,রাবনের বল বৃত্রাসুরই বল,তারাও কেউ তোমার পূজো করে বড় হয়নি-বৃক্ষা-বিষ্ণু মহেশ্বর এঁদের কাছে বর পেয়ে যা কিছু শক্তি।কেউ হয়নি বলে যেতে পারবো না।এর ত কোন মানে নেই।আমি প্রমান করে দিব যে শুধু আমারপ পূজো করে পৃথিবীতে মানুষ বৃত্র-বলি-রাবনের মতোই শক্তিশালি হতে পারে। এই বেলে লক্ষী পৃথিবীর দিকে তাকালেন।

নিচের দিকে চাইতেন চোখে পড়ল- সূবর্নপুরি!সোনার দেশ আহা সার্থক নাম!মাঠে তাঁর সোনার ধান-নদীতে ত জল নয়,যেন লক্ষীর ধারা বয়ে চলেছে।একই দেশের কোথাও সুমেরুর মতো ঠাণ্ডা,কোথাও সাহারা ,মতো উষ্ণ কোথাও বা স্বর্গের মত চিরবসন্তু বিরাজমান!কোথাও কোন অভাব নেই,কোথাও দুঃক্ষ নেই!মানুষ সে দেশে শুধু বেঁচে থাকার জন্য ছুটাছুটি করতে হয় না,খাটতে হয়না।তাঁরা বেশি চায়না।ফুলের গন্ধে পাখির ডাকের মধ্যে ছোট ছোট কুঠির বেঁধে লেখা পড়া নিয়ে থাকে।তাদের লোভ নেই।বেশি আশা নেই-যা পেয়েছে তাতেই খুশি।অন্যদের সাদরে ডেকে স্থান দেয়।বড় শান্ত,মধুর তাদের জীবন যেমন দেখা অমনি মন স্থির করা।লক্ষী নেমে এলেন সূবর্ণপুরিতে।

যেমন দেখা।প্রথমেই গেলেন রাজার কাছে।বললেন,তুমি আমার পূজো কর।তোমাকে আমি আরও দেব।সমস্ত পৃথিবীর রাজা করে দেব তোমাকে। রাজা মাথা নেড়ে হাত জোর করে বললেন দেবি,ভগমান আমাকে যে দেশটুকু দিয়েছেন শাশন করবার জন্য,সেইটিস যেন ভাল ভাবে শাশন করতে পারি এই আশির্বাদ করুণ।আমি ক্ষত্রিয়,প্রজাদের করা,দুর্বলকে রক্ষা করা,আর দুষ্টকে শাসন করতে করা এই আমার কাজ।আর কিছু চাই না,লোভই নেই।যদি সম্মুখ যুদ্ধে প্রান দিতে পারি তাহলেই আমার ঢের পুরুস্কার পাওয়া হবে। লক্ষী সেখানে থেকে গেলেন প্রজাদের কাছে।পুরুষরা বললে,লোভেতে লোভ বেড়েই যায়-ঐ শ্বর্যে মানুষের তৃপ্তি নেই।তোমাকে আমার চাই না,তুমি চলে যাও।মেয়েরা বললে,তোমার ও ধনদৌলতে আমার কি হবে?রোগ শোক মৃত্যু হাত থেক তুমি আমাদের বাচাতে পারবে না।আমরা চাই অমরত্ব-অর্থ নয়।তুমি যাও।রাগে লক্ষী জ্বলে উঠলেন।

সেখান থেকে সোজা চলে গেলেন স্বেতদ্বিপে।সেখানকার রাজাকে বললেন সেই কথাই যা সুবর্নপুরীর রাজাকে বলেছিলেন।শ্বেতদ্বিপের রাজা বললেন,সেবি আমার বড় লোভ ঐ সবর্ণপুরীর উপর ওটি দিতে পারেন?লক্ষীবললেন,পারি সমস্ত পৃথিবীর রাজা করে দেব তোমাকে।সবর্ণপুরির পাবে তুমি। রাজা বললেন,কি করে? লক্ষীজবাব দিলেন,আমার অন্য অস্ত্র নেই,আছে লোভ আর আছে এই টাকা।এই দিয়েই জয় করতে পারবে এই বলে তিনি একটি টাকা রাজার হাতে দিলেন।বললেন,টাকা দিলেই সব জিনিস পাওয়া যায়।এইটে ওদের বুঝিয়ে দাও।ওদের শশ্য নিয়ে টাকা দাও,কাপড় নিয়ে টাকা দাও।আর সুন্দর বিলাশের জিনস নিয়ে গিয়ে ওদের সামনে ধরো,টাকা দিলেই সে গুলো পাওয়া যাবে ওদের কে বুঝিয়ে দাও।

এমনি করে আগে যা বানিজ্য করতে,টাকাতে ওদের লোভ বাড়িক লোভ বাড়লেই দলাদলি হবে,সেই সুযোগ তুমি ওদের রাজ্য জয় করবে।টাকার চেয়ে বড় অস্ত্র আর কিছু নেই বৎস।তাই হল। শ্বেতদ্বিপের রাজা সুবরনপুরের রাজার কাছে লোক পাঠালেন,তোমাদের দেশে ত প্রচুর শশ্য হয়,আর আমরা খেতে পাইনে।কিছু দাও না!অবিশ্যি অমনি নেবো না,তাঁর সঙ্গে অন্য জিনিসও দেব- সূবর্ণপুরীতে রাজা বললেন বেশ ত!এল ওরা,সোনার টাকা দুহাতে ছড়াতে লাগল দেশে। যে জিনিসের কোন অভাব নেই তা দিয়ে যদি এমন চকচকে টাকা পাওয়া যায় মন্দ কি?সূবর্ণপুরীর লোকরা এই ভেবে টাকা নিয়ে জামাতে লাগল।এমনি করে দেশে একদল বড়লোক।যারা বড়লোক হল তাদের লোভ বেড়ে গেল-আরও চাই।কারণ তাঁরা ইতিমধ্যে বুঝেছিল টাকা দিয়ে এমন অনেক বিলাশসামগ্রী পাওয়া যায়,টাকা না থাকলে যার স্বপ্ন দেখাও দুরাশা।

ফলে ঝগড়াঝাটি বেড়ে গেল-মিথ্যা কথা বলে ঠকিয়ে যেমন করে হোক তাদের আরও চাই।ঠিক সেই সময়ে সুযোগ বুঝে শ্বেতদ্বিপের রাজা সূবর্ণপুরী আক্রমন করলেন।সূবর্ণপুরীর রাজা প্রজাকে ডাকলেন যুদ্ধ করবার জন্য কেউ এল না।ওদের মধ্যে ঝগড়া ঝাটি বেঁধে উঠেছে ভিষন রকমের আসবে কেন?বরং কেউ কেউ শত্রু পক্ষের যোগ দিলে। ফলে একরকম বিনাচেষ্টায় সূবর্ণপুরীর শ্বেতদ্বিপের অধীন হল।শুধু সূবর্ণপুরীর নয় বলতে গেলে সারা পৃথিবীর ওদের হাতে এসে গেল।টাকা আর লোভ এই হল ওদের অস্ত্র।কিন্তু সবচেয়ে বড় দূর্দশা হল সূবর্ণপুরীই।ভগবান অনেক দিয়েছেন,তাই ওরা এ জীবনের দুঃখকষ্ট কি জানত না-লেখা পড়া নিয়ে থাকত সবাই।সংসারের খারাপ লোকেদের সঙ্গে চলতে চলতে গেলে যতটা প্যাঁচালো বুদ্ধি থাকা দরকার ততটা কারুরই ছিল না।শ্বেতদ্বিপের লোকেরা ওদের এই সরলতার সুযোগ নিয়ে খুব থকাটে লাগল।আর ঐশ্বর্যও এঁদের কম ছিল না,লোভটা সেইজন্য সকলের বেশি এই দেশের অপরই ফলে অমন সোনার দেশ অভাব যেন পুড়ে গেল।সূবর্ণপুরীওতে লোক খেটে পায়না।

পরনে ওদের কাপড় নেই লেখাপড়া করতে পারে না।দেশে অরাজকতা দেখা দিল।রাজার লোকেরা এসেছ ওদের সর্বস্ব নিতে শাসন করতে,রক্ষা করতে ত আসে নি!দুর্ভিক্ষ মড়ক এখন ওদের নিত্যসঙ্গী-পেটে অন্ন নেই বলে স্বাস্থ্য দিন দিন সকলের খারাপ হয়ে গেল।এত বড় দেশের এতগুলো দেশের এতগুলো লোক বেঁচে রইল যেন মাডার মত।বুদ্ধি নেই স্বাস্থ্য নেই,আনন্দ নেই,আনন্দ নেই,জ্ঞানচর্চা নেই-শুধু একবেলা আধাপেটা খেয়ে কোনমতে বেঁচে আছে,পরমায়ু ফুরিয়ে গেলে মরছে।এই পর্যন্ত! সবচেয়ে মজার কথা এই যে যে-দেশে অন্ন-বস্ত্রের লোভেই বিদেশীরা এসেছিল,সে দেশেরই এমন অবস্থা দাড়াল যে বিদেশ থেকে চাল আসে তবে খেটে পায়ন,কাপড় এলে তবে পড়তে পারবে,চাষীরা চাষ ভুলল,তাতিরা ভুলল কাপড় বুনতে –শুধু উদয় গোলামি করে বিদেশে রাজার লোকেদের কাছে;সামান্য যা পায় আবার ওদের কাছেই খাবার,কাপড়,অষুধ কেনবার নাম করে ফিরিয়ে দেয়।অবস্থা যখন চরমে দাড়াল তখন লক্ষী মুচকি হেসে নারায়নকে বললেন,একবার চেয়ে দ্যাখো। লক্ষী চাইলেন,অবিশ্বাস ভরে।

মনের ভাব এই যে,নারায়ন হেরে গেছেন এবং মানতে চাইছেন না-কি ছেলেমানুষী! কিন্তু চেয়ে দেখেই চমকে উঠলেন – ওমা এ কি ঐ শ্নাশানপুরীর মধ্যে থেকেই এক শীর্ন বৃদ্ধ উঠে দাড়িইয়েছন।সর্বঙ্গ নগ্ন পরনে একটিমাত্র কটিবাস,শিরা-বার-বার করা দুর্বল হাতে একটি লাঠি,দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ-অত্যন্ত দুর্বল অসহায় মানুষটি।বয়সে ও রোগের বেকে পড়েছেন।কিছুই না,তবু লক্ষী শিউরে উঠলেন।বৃদ্ধ বললেন,শ্বেতদ্বিপের লোকেরা লক্ষ লক্ষ জোঁকের মতো আমদের উপর এসে পড়েছেন,রক্ত ফুরিয়ে এসেছে আমাদের,তবুও ছাড়ছে না।এমন যে আমরা কেউই বাচব না।এখনও হয়ত উপায় আছে ওদের তাড়াবার।কেউ শুনল না।যারা শুনল তাঁরাও অবিশ্বাসের শুরেই বললে,ওদের তাড়ানো অত সহজ নয়—– তা ছাড়া ওদের দোষ কি,আমরাই এক হতে পারি না।

আমরাই পয়সা লোভে আমাদের কি আছে?ওরা চলে গেল আমরা আরও বেশি করে মরব। পঙ্গু বৃদ্ধ যেন সিংহ-গর্জন করে উঠলেন,বললেন,মিছে কথা।এ আমাদের ওরাই শিখিয়েছে,ওদের সুবিধার জন্য যা কিছু আমাদের খারাপ,তাঁর জন্য ওরাই দায়ী।আমাদের সব সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে ওরা চলে গেলে।আগে ওদের তাড়াও।উপহাসের হাসি হাসে হবাই বললেন কেমন করে তাড়াবে ওদের?ওদের সঙ্গে লড়াই করে পেরে উঠবে? লড়াই করবই না।এমন ব্যবস্থা করব যাতে ওরা আপনিই চলে যাবে।কি করে? এবার যেন সকলের একটু আগ্রহ হল কথাটা শোনবার। বৃদ্ধ জবাব দিলেন,ওরা কি জন্য এখনও আমাদের দেশে পড়ে রয়েছে?আমাদের পয়সা লিঠ করবার জন্যই ত?এখনও আমাদের যা কিছু আছে যৎসামন্য,ওদের জিনিস বেঁচে দাম হিসাবে তাও নিয়ে যাচ্ছে।ওদের জিনিস কেনা বন্ধ করো,তাহলেই ওরা জব্দ হবে।এদেশের যদি ওদের লাভ না হয়,ওরা আপনিই ছেড়ে চলে যাবে।কথাটা সবাই বুঝল না,কেউ ঠাট্টা করলে,কেউ মুখ ফিরিয়ে নিলে।

হ্যাঁ তাই কখনও সম্ভব!খাবো কি,ওষুধ পাবো কোথায়,কাপড় কৈ?কিন্তু বৃদ্ধ হাল ছাড়লেন না,একা সেই লাঠি গাছিতে ভর দিয়ে বেরিয়ে পড়লেন।দেশে দেশে গায়ের গায়ে ঘুরে নিজের কথা বোঝাতে লাগলেন।বললেন নিজেরা নিজেদের কাপড়ের সুতা কেটে নাও,নিজেদের তাতে বোনো।অভ্যস নেই বলে মোটা হবে?হোক না দুদিন পরেই হয়ে যাবে,আর না হয় মোটা কাপড়ের পড়লে,এতকালে ত তোমরা সবচেয়ে সুরু কাপড় বুনতে সেটা ভুলে যেওনা।তোমাদের বনে অনেক অষুধের গাছ আছে,তাই দিয়ে অষুধ তৈঁরি করো।স্বাস্থের নিয়ম মেনে চল তাহলে,অসুখ করবেন না,খাঁবার নেই? অনেক জমি এখনও পড়ে আছে,ওদের ছেড়ে চাষ করো-খাঁবরের ভাবনা থাকবে না।মোটকথা নিজিদের যা দরকার নিজেরা করে নাও,ওদের জিনিস শুনলো।তাতেই শ্বেতদ্বীপের লোকের টনক।তাঁর চেষ্টা করতে লাগল বৃদ্ধকে জব্দ করার।

আর তাঁরা বৃদ্ধকে ভয় করেছে দেখেই সূবর্ণপুরীর লোকেরা বুঝতে পারলে কেন? পাগল বলে ত তাদের মত ওরা উড়িয়ে দিচ্ছে না!তবু দু চার জন বলে কিন্তু ওদের মত কলকারখার ত আমদের নেই আমরা এত জিনিস দেশের লোককর জোগাতে পারব কেন? বৃদ্ধ বললেন,জয়গাতে হবে কেন?সবাই নিজের দরকার জিনিস করে নিবে।আগে যেমন করে আমাদের ছিল কুল তেল সবাইকে,তাকে তাতী দেব কাপড় দেব মুচি দেব জুতো দেব,কবিরাজ দেব ওষুধ।তাই কি সম্ভব?সেকালে হত-এখন সময় কৈ?সময়ের অভাবটা যে তোমার সৃষ্টি ওদের মত হতে গিয়ে অদের চাকরি করতে গিয়ে।

আমরা যদি এমনই থাকি ত শ্বেতদ্বিপের লোকেরা গেলে অন্য দ্বিপের লোকেরা আসবে আমাদের লুঠ করতে,আমাদের দোহন করতে।আমাদের এদেশটা নাকি ভাল বাজার ভাল বিক্রি হয় ওদের জিনিস-তাই সবাই আসতে চাই।সেই বাজার নষ্ট করো,বিক্রি বন্ধ করো-আর কেউ আসবে না।এবার বুড়োর কথা অনেক বুঝল।আরম্ভ হল তাঁর কথামত কাজ।নিজেরা চাষ করে,নিজেরদের চরকায় সুত কাটে কাপড় বোনে ওষুধ তৈঁরি করে শ্বেতদ্বিপের লোকদের মুখ গেল শুকিয়ে।ওরা নানা রকমে চেষ্টা করতে লাগল যাতে সূবর্ণপুরীর লোকদের নিজেদের মধ্যে ঝগড়া বাধে।

শেষ পর্যন্ত কিন্তু কিছুতেই হল না-একদিন ওদের সূবর্ণপুরী ছেড়ে দিয়ে চলে যেতেই হল।আবার সূবর্ণপুরীতে শ্বাস্থ্য-সুখ-শান্তি-জ্ঞান সব ফিরে এল।আবার সবাই বলতে লাগল,সূবর্ণপুরীর নাম,হ্যাঁ,সোনার দেশ বটে!নারায়ন হেসে লক্ষীকে বললেন,দেখলে?লক্ষী মাথা হেট করে জবাব দিলেন,দেখলুম।

আরো পড়তে পারেন...

প্রতারণার কোয়ান্টাম মেথড

কয়েক মাস আগে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরি মিলনায়তনের একটি অনুষ্ঠানের খবর আমরা জানতে পারি পরদিন প্রকাশিত দেশের…

সৌভাগ্যের ভেজাল চিঠি

কয়েকদিন আগে একটা চিঠি পেয়েছি, ডাকযোগে। টাইপ করা চিঠিটাতে কোন নাম ঠিকানা ছিল না, খামের…

বুনো রাজা ও রাজকুমারী– শ্রী ক্ষিতীশচন্দ্র কুশারী

এক বুনো রাজা। বনেই তাঁর রাজত্ব। যত অসভ্য জংলী তাঁর প্রজা। প্রজাদের ঘর নেই, দোর…