সে — রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– সপ্তম অংশ

পুপুদিদি বললে , দাদামশায় , ওদের দুজনের বিয়ে হল কি না বললে না তো কিছু ।

বুঝলুম , বিয়ে হওয়াটা জরুর দরকার । বললুম , বিয়ে না হয়ে কি রক্ষা আছে ।

তার পরে তোমার সঙ্গে ওদের দেখা হয়েছে কি ।

হয়েছে বৈকি । তখন ভোর সাড়ে চারটে , রাস্তার গ্যাস নেবে নি । দেখলুম , নতুন বউ তার বরকে ধরে নিয়ে চলেছে ।

কোথায় ।

নতুন বাজারে মানকচু কিনতে ।

মানকচু !

হ্যাঁ , বর আপত্তি করেছিল ।

কেন ।

বলেছিল , অত্যন্ত দরকার হলে বরঞ্চ কাঁঠাল কিনে আনতে পারি , মানকচু পারব না ।

তার পরে কী হল ।

আনতে হল মানকচু কাঁধে করে ।

খুশি হল পুপু ; বল্‌লে , খুব জব্দ !

সকালে বসে চা খাচ্ছি এমন সময় সে এসে উপস্থিত ।

জিগেস করলুম , কিছু বলবার আছে ?

ও বললে , আছে ।

চট্‌ করে বলে ফেলো , আমাকে এখনি বেরতে হবে ।

কোথায় ।

লাটসাহেবের বাড়ি ।

লাটসাহেব তোমাকে ডাকেন নাকি ।

না , ডাকেন না , ডাকলে ভালো করতেন ।

ভালো কিসের ।

জানতে পারতেন , ওঁরা যাদের কাছ থেকে খবর পেয়ে থাকেন আমি তাদের চেয়েও খবর বানাতে ওস্তাদ । কোনো রায়বাহাদুর আমার সঙ্গে পাল্লা দিতে পারে না , সে কথা তুমি জান ।

জানি , কিন্তু আমাকে নিয়ে আজকাল তুমি যা – তা বলছ ।

অসম্ভব গল্পেরই যে ফরমাশ ।

হোক – না অসম্ভব , তারও তো একটা বাঁধুনি থাকা চাই । এলোমেলো অসম্ভব তো যে – সে বানাতে পারে ।

তোমার অসম্ভবের একটা নমুনা দাও ।

আচ্ছা বলি শোনো —

স্মৃতিরত্নমশায় মোহনবাগানের গোল – কীপারি করে ক্যাল্‌কাটার কাছ থেকে একে একে পাঁচ গোল খেলেন । খেয়ে খিদে গেল না , উলটো হল , পেট চোঁ – চোঁ করতে লাগল । সামনে পেলেন অক্‌‍টর্লনি মনুমেণ্ট । নীচে থেকে চাটতে চাটতে চুড়ো পর্যন্ত দিলেন চেটে । বদরুদ্দিন মিঞা সেনেট হলে বসে জুতো সেলাই করছিল , সে হাঁ – হাঁ করে ছুটে এল । বললে , আপনি শাস্ত্রজ্ঞ পণ্ডিত হয়ে এত বড়ো জিনিসটাকে এঁটো করে দিলেন !

‘ তোবা তোবা’ বলে তিনবার মন্যুমেণ্টের গায়ে থুথু ফেলে মিঞাসাহেব দৌড়ে গেল স্টেট্‌স‍্ম্যান – আপিসে খবর দিতে ।

স্মৃতিরত্নমশায়ের হঠাৎ চৈতন্য হল , মুখটা তাঁর অশুদ্ধ হয়েছে । গেলেন ম্যুজিয়মের দরোয়ানের কাছে । বললেন , পাঁড়েজি , তুমিও ব্রাহ্মণ , আমিও ব্রাহ্মণ — একটা অনুরোধ রাখতে হবে ।

পাঁড়েজি দাড়ি চুম্‌‍রিয়ে নিয়ে সেলাম করে বললে , কোমা ভূ পোর্তে ভূ সি ভূ প্লে ।

পণ্ডিতমশায় একটু চিন্তা করে বললেন , বড়ো শক্ত প্রশ্ন , সাংখ্যকারিকা মিলিয়ে দেখে কাল জবাব দিয়ে যাব । বিশেষ আজ আমার মুখ অশুদ্ধ , আমি মনুমেণ্ট চেটেছি ।

পাঁড়েজি দেশালাই দিয়ে বর্মা চুরুট ধরালো । দু টান টেনে বললে , তা হলে এক্ষুনি খুলুন ওয়েব্‌স্টার ডিক্‌সনারি , দেখুন বিধান কী ।

স্মৃতিরত্ন বললেন , তা হলে তো ভাটপাড়ায় যেতে হয় । সে পরে হবে , আপাতত তোমার ঐ পিতলে – বাঁধানো ডাণ্ডাখানা চাই ।

পাঁড়ে বললে , কেন , কী করবেন , চোখে কয়লার গুঁড়ো পড়েছে বুঝি ?

স্মৃতিরত্ন বললেন , তুমি খবর পেলে কেমন করে । সে তো পড়েছিল পরশু দিন ।

ছুটতে হল উল্টোডিঙিতে যকৃত – বিকৃতির বড়ো ডাক্তার ম্যাকার্টনি সাহেবের কাছে । তিনি নারকেলডাঙা থেকে শাবল আনিয়ে সাফ করে দিলেন ।

পাঁড়েজি বললে , তবে ডাণ্ডায় তোমার কী প্রয়োজন ।

পণ্ডিতমশায় বললেন , দাঁতন করতে হবে ।

পাঁড়েজি বললে , ওঃ , তাই বলো , আমি বলি নাকে কাঠি দিয়ে হাঁচবে বুঝি , তা হলে আবার গঙ্গাজল দিয়ে শোধন করতে হত ।

এই পর্যন্ত বলে গুড়্‌গুড়িটা কাছে নিয়ে দু টান টেনে সে বললে , দেখো দাদা , এইরকম তোমার বানিয়ে বলবার ধরন । এ যেন আঙুল দিয়ে না লিখে গণেশের শুঁড় দিয়ে লম্বা চালে বাড়িয়ে লেখা । যেটাকে যেরকম জানি সেটাকে অন্যরকম করে দেওয়া । অত্যন্ত সহজ কাজ । যদি বল লাটসাহেব কলুর ব্যাবসা ধরে বাগবাজারে শুটকি মাছের দোকান খুলেছেন , তবে এমন সস্তা ঠাট্টায় যারা হাসে তাদের হাসির দাম কিসের ।

চটেছ বলে বোধ হচ্ছে ।

কারণ আছে । আমাকে নিয়ে পুপুদিদিকে সেদিন যাচ্ছে – তাই কতকগুলো বাজে কথা বলেছিলে । নিতান্ত ছেলেমানুষ বলেই দিদি হাঁ করে সব শুনেছিল । কিন্তু , অদ্ভুত কথা যদি বলতেই হয় তবে তার মধ্যে কারিগরি চাই তো ।

সেটা ছিল না বুঝি ?

না , ছিল না । চুপ করে থাকতুম যদি আমাকে সুদ্ধ না জড়াতে । যদি বলতে , তোমার অতিথিকে তুমি জিরাফের মুড়িঘণ্ট খাইয়েছ , সর্ষেবাঁটা দিয়ে তিমিমাছ – ভাজা আর পোলাওয়ের সঙ্গে পাঁকের থেকে টাটকা ধরে আনা জলহস্তী , আর তার সঙ্গে তালের গুঁড়ির ডাঁটা – চচ্চড়ি , তা হলে আমি বলতুম , ওটা হল স্থূল । ওরকম লেখা সহজ ।

আচ্ছা , তুমি হলে কী রকম লিখতে ।

বলি , রাগ করবে না ? দাদা , তোমার চেয়ে আমার কেরামতি যে বেশি তা নয় , কম বলেই সুবিধে । আমি হলে বলতুম —

তাসমানিয়াতে তাস খেলার নেমন্তন্ন ছিল , যাকে বলে দেখা-বিন্‌‍তি । সেখানে কোজুমাচুকু ছিলেন বাড়ির কর্তা , আর গিন্নির নাম ছিল শ্রীমতী হাঁচিয়েন্দানি কোরঙ্কুনা । তাঁদের বড়ো মেয়ের নাম পাম্‌কুনি দেবী , স্বহস্তে রেঁধেছিলেন কিণ্টিনাবুর মেরিউনাথু , তার গন্ধ যায় সাত পাড়া পেরিয়ে ।

গল্পের অষ্টম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

 

দুঃখিত!