সে বুঝি যে – সে মাংস । ও – যে মন্ত্র দিয়ে শোধন করা ।
কিরকম মন্ত্র ।
ওদের সনাতন হালুম – মন্ত্র । সেই মন্ত্র পড়ে তবে ওরা হত্যা করে । তাকে কি হত্যা বলে ।
যদি হালুম – মন্ত্র বলতে ভুলে যায় ।
বাঘপুঙ্গব – পণ্ডিতের মতে তা হলে ওরা বিনা মন্ত্রে যে জীবকে মারে পরজন্মে সেই জীব হয়েই জন্মায় । ওদের ভারি ভয় পাছে মানুষ হয়ে জন্মাতে হয় ।
কেন ।
ওরা বলে , মানুষের সর্বাঙ্গ টাক – পড়া , কী কুশ্রী ! তার পরে , সামান্য একটা লেজ , তাও নেই মানুষের দেহে । পিঠের মাছি তাড়াবার জন্যেই ওদের বিয়ে করতে হয় । আবার দেখো – না , ওরা খাড়া দাঁড়িয়ে সঙের মতো দুই পায়ে ভর দিয়ে হাঁটে —দেখে আমরা হেসে মরি । আধুনিক বাঘের মধ্যে সব চেয়ে বড়ো জ্ঞানী শার্দৌল্যতত্ত্বরত্ন বলেন , জীবসৃষ্টির শেষের পালায় বিশ্বকর্মার মালমসলা যখন সমস্তই কাবার হয়ে গেল তখনই মানুষ গড়তে তাঁর হঠাৎ শখ হল । তাই বেচারাদের পায়ের তলার জন্যে থাবা দূরে থাক্ কয়েক টুকরো খুরের জোগাড় করতে পারলেন না , জুতো পরে তবে ওরা পায়ের লজ্জা নিবারণ করতে পারে — আর , গায়ের লজ্জা ঢাকে ওরা কাপড়ে জড়িয়ে । সমস্ত পৃথিবীর মধ্যে একমাত্র ওরাই হল লজ্জিত জীব । এত লজ্জা জীবলোকে আর কোথাও নেই।
বাঘেদের বুঝি ভারি অহংকার ?
ভয়ংকর । সেইজন্যেই তো ওরা এত করে জাত বাঁচিয়ে চলে । জাতের দোহাই পেড়ে একটা বাঘের খাওয়া বন্ধ করেছিল একজন মানুষের মেয়ে ; তাই নিয়ে আমাদের সে একটা ছড়া বানিয়েছে।
তোমার মতো সে আবার ছড়া বানাতে পারে নাকি।
তার নিজের বিশ্বাস সে পারে , এই তর্ক নিয়ে তো পুলিস ডাকা যায় না।
আচ্ছা , শোনাও – না ।
তবে শোনো —
এক ছিল মোটা কেঁদো বাঘ ,
গায়ে তার কালো কালো দাগ ।
বেহারাকে খেতে ঘরে ঢুকে
আয়নাটা পড়েছে সমুখে ।
এক ছুটে পালালো বেহারা ,
বাঘ দেখে আপন চেহারা ।
গাঁ – গাঁ করে ডেকে ওঠে রাগে ,
দেহ কেন ভরা কালো দাগে ।
ঢেঁকিশালে পুঁটু ধান ভানে ,
বাঘ এসে দাঁড়ালো সেখানে ।
ফুলিয়ে ভীষণ দুই গোঁফ
বলে , চাই গ্লিসেরিন সোপ ।
পুঁটু বলে , ও কথাটা কী যে
জন্মেও জানি নে তা নিজে ।
ইংরেজি – টিংরেজি কিছু
শিখি নি তো , জাতে আমি নিচু ।
বাঘ বলে , কথা বল ঝুঁটো ,
নেই কি আমার চোখ দুটো ।
গায়ে কিসে দাগ হল লোপ
না মাখিলে গ্লিসেরিন সোপ ।
পুঁটু বলে , আমি কালো কৃষ্টি
কখনো মাখি নি ও জিনিসটি ।
কথা শুনে পায় মোর হাসি ,
নই মেম – সাহেবের মাসি ।
বাঘ বলে , নেই তোর লজ্জা ?
খাব তোর হাড় মাস মজ্জা ।
পুঁটু বলে , ছি ছি ওরে বাপ ,
মুখেও আনিলে হবে পাপ ।
জান না কি আমি অস্পৃশ্য ,
মহাত্মা গাঁধিজির শিষ্য ।
আমার মাংস যদি খাও
জাত যাবে জান না কি তাও ।
পায়ে ধরি করিয়ো না রাগ !
ছুঁস নে ছুঁস নে , বলে বাঘ ,
আরে ছি ছি , আরে রাম রাম ,
বাঘনাপাড়ায় বদনাম
রটে যাবে ; ঘরে মেয়ে ঠাসা ,
ঘুচে যাবে বিবাহের আশা
দেবী বাঘা – চণ্ডীর কোপে ।
কাজ নেই গ্লিসেরিন সোপে ।
জান , পুপুদিদি ? আধুনিক বাঘেদের মধ্যে ভারি একাট কাণ্ড চলছে — যাকে বলে প্রগতি , প্রচেষ্টা । ওদের প্রগতিওয়ালা প্রচারকেরা বাঘ – সমাজে বলে বেড়াচ্ছে যে , অস্পৃশ্য বলে খাদ্য বিচার করা পবিত্র জন্তু – আত্মার প্রতি অবমাননা । ওরা বলছে , আজ থেকে আমরা যাকে পাব তাকেই খাব ; বাঁ থাবা দিয়ে খাব , ডান থাবা দিয়ে খাব , পিছনের থাবা দিয়েও খাব ; হালুম – মন্ত্র পড়েও খাব , না পড়েও খাব — এমন – কি , বৃহস্পতিবারেও আঁচড়ে খাব , শনিবারেও আমরা কামড়ে খাব । এত ঔদার্য । এই বাঘেরা যুক্তিবাদী এবং সর্বজীবে এদের সম্মানবোধ অত্যন্ত ফলাও । এমন – কি , এরা পশ্চিম – পারের চাষী কৈবর্তদেরও খেতে চায় , এতই এদের উদার মন । ঘোরতর দলাদলি বেধে গেছে । প্রাচীনরা নব্য সম্প্রদায়কে নাম দিয়েছে চাষী – কৈবর্ত – খেগো , এই নিয়ে মহা হাসাহাসি পড়েছে ।
পুপু বললে , আচ্ছা দাদামশায় , তুমি কখনো বাঘের উপর কবিতা লিখেছ ?
হার মানতে মন গেল না । বললুম , হাঁ লিখেছি ।
শোনাও – না ।
গম্ভীর সুরে আবৃত্তি করে গেলুম —
তোমার সৃষ্টিতে কভু শক্তিরে কর না অপমান ,
হে বিধাতা — হিংসারেও করেছ প্রবল হস্তে দান
আশ্চর্য মহিমা এ কী । প্রখরনখর বিভীষিকা ,
সৌন্দর্য দিয়েছ তারে , দেহধারী যেন বজ্রশিখা ,
যেন ধূর্জটির ক্রোধ । তোমার সৃষ্টির ভাঙে বাঁধ
ঝঞ্ঝা উচ্ছৃঙ্খল , করে তোমার দয়ার প্রতিবাদ
বনের যে দস্যু সিংহ , ফেনজিহ্ব ক্ষুব্ধ সমুদ্রের
যে উদ্ধত ঊর্ধ্ব ফণা , ভূমিগর্ভে দানবযুদ্ধের
ডমরুনিঃস্বনী স্পর্ধা , গিরিবক্ষভেদী বহ্নিশিখা
যে আঁকে দিগন্তপটে আপন জ্বলন্ত জয়টিকা ,
প্রলয়নর্তিনী বন্যা বিনাশের মদিরবিহ্বল
নির্লজ্জ নিষ্ঠুর — এই যত বিশ্ববিপ্লবীর দল
প্রচণ্ড সুন্দর । জীবলোকে যে দুর্দান্ত আনে ত্রাস
হীনতালাঞ্ছনে সে তো পায় না তোমার পরিহাস ।
চুপ করে রইল পুপু । আমি বললুম , কী দিদি , ভালো লাগল না বুঝি ।
ও কুণ্ঠিত হয়ে বললে , না না , ভালো লাগবে না কেন । কিন্তু , এর মধ্যে বাঘটা কোথায় ।
আমি বললুম , যেমন সে থাকে ঝোপের মধ্যে , দেখা যায় না তবু আছে ভয়ংকর গোপনে ।
পুপু বললে , অনেকদিন আগে গ্লিসেরিন – সোপ – খোঁজা বাঘের কথা আমাকে বলেছিলেন । তার খবরটা কোথা থেকে পেলে সে ।
আমার কথা ও করে চুরি , নিজের মুখে সেটা দেয় বসিয়ে ।
কিন্তু —
‘ কিন্তু’ না তো কী । লিখেছে ভালোই ।
কিন্তু —
হাঁ ঠিক কথা । আমি অমন করে লিখি নে , হয়তো লিখতে পারি নে । আমার মালটা ও চুরি করে , তার পরে যখন পালিশ করে দেয় তখন চেনা শক্ত হয় — এমন ঢের দেখেছি । ঠিক ঐরকম আর – একটি ছড়া বানিয়েছে ।
শোনাও – না ।
আচ্ছা , শোনো তবে । —
সুঁদরবনের কেঁদো বাঘ ,
সারা গায়ে চাকা চাকা দাগ ।
যথাকালে ভোজনের
কম হলে ওজনের
হত তার ঘোরতর রাগ ।
একদিন ডাক দিল গাঁ – গাঁ —
বলে , তোর গিন্নিকে জাগা ।
শোন্ বটুরাম ন্যাড়া ,
পাঁচ জোড়া চাই ভ্যাড়া ,
এখনি ভোজের পাত লাগা ।
বটু বলে , এ কেমন কথা ,
শিখেছ কি এই ভদ্রতা ।
এত রাতে হাঁকাহাঁকি
ভালো না , জান না তা কি ,
আদবের এ যে অন্যথা ।
মোর ঘর নেহাত জঘন্য ,
মহাপশু , হেথায় কী জন্য ।
ঘরেতে বাঘিনী মাসি
পথ চেয়ে উপবাসী ,
তুমি খেলে মুখে দেবে অন্ন ।
সেথা আছে গোসাপের ঠ্যাঙ ।
আছে তো শুট্কে কোলা ব্যাঙ ।
আছে বাসি খরগোশ ,
গন্ধে পাইবে তোষ ,
চলে যাও নেচে ড্যাঙ ড্যাঙ ।
নইলে কাগজে প্যারাগ্রাফ
রটিবে , ঘটিবে পরিতাপ —
বাঘ বলে, রামো, রামো,
বাক্যবাগীশ থামো,
বকুনির চোটে ধরে হাঁপ।
তুমি ন্যাড়া, আস্ত পাগল,
বেরোও তো, খোলো তো আগল।
ভালো যদি চাও তবে
আমারে দেখাতে হবে
কোন্ ঘরে পুষেছ ছাগল।
বটু কহে, এ কী অকরণ,
ধরি তব চতুশ্চরণ—
জীববধ মহাপাপ,
তারো বেশি লাগে শাপ
পরধন করিলে হরণ।
বাঘ শুনে বলে, হরি হরি,
না খেয়ে আমিই যদি মরি,
জীবেরই নিধন তাহা—
সহমরণেতে আহা
মরিবে যে বাঘী সুন্দরী।
অতএব ছাগলটা চাই,
না হলে তুমিই আছ ভাই।
এত বলি তোলে থাবা।
বটুরাম বলে, বাবা,
চলো ছাগলেরই ঘরে যাই।
দ্বার খুলে বলে, পড়ো ঢুকে,
ছাগল চিবিয়ে খাও সুখে।
বাঘ সে ঢুকল যেই,
দ্বিতীয় কথাটি নেই,
বাহিরে শিকল দিল রুখে।
বাঘ বলে, এ তো বোঝা ভার,
তামাসার এ নহে আকার।
পাঁঠার দেখি নে টিকি,
লেজের সিকির সিকি
নেই তো, শুনি নে ভ্যাভ্যাকার।
ওরে হিংসুক সয়তান,
জীবের বধিতে চাস্ প্রাণ!
ওরে ক্রূর, পেলে তোরে
থাবায় চাপিয়া ধ’রে
রক্ত শুষিয়া করি পান—
ঘরটাও ভীষণ ময়লা—
বটু বলে, মহেশ গয়লা
ও ঘরে থাকিত, আজ
থাকে তোর যমরাজ
আর থাকে পাথুরে কয়লা।
গোঁফ ফুলে ওঠে যেন ঝাঁটা,
বাঘ বলে, গেল কোথা পাঁঠা!
বটুরাম বলে নেচে,
এই পেটে তলিয়েছে,
খুঁজিলে পাবে না সারা গাঁটা।
ভালো লাগল?
তা, যাই বলো দাদামশায়, কিন্তু বাঘের ছড়া খুব ভালো লিখেছে।
আমি বললুম, তা হবে, হয়তো ভালোই লিখেছে। কিন্তু, ও ভালো লেখে কি আমি ভালো লিখি সে সম্বন্ধে শেষ অভিমতটা দেবার জন্যে অন্তত আরো দশটা বছর অপক্ষো কোরো।
পুপু বললে, আমার বাঘ কিন্তু আমাকে খেতে আসে না।
সে তো তোমাকে প্রত্যক্ষ দেখেই বুঝতে পারছি। তোমার বাঘ কী করে।
রাত্তিরে যখন শুয়ে থাকি বাইরে থেকে ও জানলা আঁচড়ায়। খুলে দিলেই হাসে।
তা হতে পারে, ওরা খুব হাসিয়ে জাত। ইংরেজিতে যাকে বলে হিউমরাস্। কথায় কথায় দাঁত বের করে।
৭পুপে এসে জিগেস করলে, দাদামশায়, তুমি যে বললে শনিবারে সে আসবে তোমার নেমন্তন্নে। কী হল।
সবই ঠিক হয়েছিল। হাজি মিঞা শিক্কাবাব বানিয়েছিল, তোফা হয়েছিল খেতে।
তার পরে?
তার পরে নিজে খেলুম তার বারো-আনা আন্দাজ, আর পাড়ার কালু ছোঁড়াটাকে দিলুম বাকিটুকু। কালু বললে, দাদাবাবু, এ-যে আমাদের কাঁচকলার বড়ার চেয়ে ভালো।
সে কিছু খেল না?
জো কী।
সে এল না?
সাধ্য কী তার।
তবে সে আছে কোথায়।
কোত্থাও না।
ঘরে?
না।
দেশে?
না।
বিলেতে?
না।
তুমি যে বলছিলে, আণ্ডামানে যাওয়া ওর একরকম ঠিক হয়ে আছে। গেল নাকি।
দরকার হল না। তা হলে কী হল আমাকে বলছ না কেন।
ভয় পাবে কিংবা দুঃখ পাবে, তাই বলি নে।
তা হোক, বলতে হবে।
আচ্ছা, তবে শোনো। সেদিন ক্লাস-পড়াবার খাতিরে আমার পড়ে নেবার কথা ছিল ‘বিদগ্ধমুখমণ্ডন’। এক সময় হঠাৎ দেখি, সেটা রয়েছে পড়ে, হাতে উঠে এসেছে ‘পাঁচুপাক্ড়াশির পিস্শাশুড়ি’। পড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়েছিলুম, রাত হবে তখন আড়াইটা।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।