সভ্যরা দুই চক্ষু বুজে বললেন , শিবুরাম , আর নয় । সভা বন্ধ হল । এখন —
শিবু বললে , এখন আমার কাজ হবে শেয়াল – সমাজকে অবাক করা ।
এ দিকে শিবুরামের পিসি খেঁকিনি কেঁদে কেঁদে মরে । গাঁয়ের মোড়ল হুক্কুইকে গিয়ে বললে , মোড়ল মশায় , আজ এক বছরের উপর হয়ে গেল আমার হৌহৌকে দেখি নে কেন । বাঘ – ভাল্লুকের হাতে পড়ল না তো ?
মোড়ল বললে , বাঘ – ভাল্লুককে ভয় কিসের ? ভয় ঐ মানুষ জানোয়ারটাকে , হয়তো তাদের ফাঁদে পড়েছে ।
খোঁজ পড়ে গেল । ঘুরতে ঘুরতে ভলণ্টিয়ারের দল এল সেই চণ্ডীমণ্ডপের বাঁশবনে । ডাক দিলে , হুক্কা হুয়া ।
শিবুরামের বুকের মধ্যে ধড়্ফড়্ করে উঠল , একবার গলা ছেড়ে ঐ একতানমন্ত্রে যোগ দিতে ইচ্ছা হল । বহু কষ্টে চেপে গেল।
দ্বিতীয় প্রহরে বাঁশবনে আবার ডাক উঠল , হুক্কা হুয়া । এবার শিবুরামের চাপা গলায় কান্নার মতো একটুখানি রব উঠল । তবু থেমে গেল ।
তৃতীয় প্রহরে ওরা আবার যখন ডাক ছাড়লে শিবুরাম আর থাকতে পারলে না ; ডেকে উঠল , হুক্কা হুয়া , হুক্কা হুয়া , হুক্কা হুয়া।
হুক্কুই বললে , ঐ তো হৌহৌয়ের গলা শুনি । একবার হাঁক দাও তো ।
ডাক পড়ল , হৌহৌ !
সভাপতি বিছানা ছেড়ে এসে বললেন , শিবুরাম !
বাইরে থেকে আবার ডাক পড়ল , হৌহৌ !
গোঁসাইজি আবার সতর্ক করে দিলেন , শিবুরাম !
তৃতীয়বার ডাকে শিবুরাম ছুটে বেরিয়ে আসতেই শেয়ালরা দিল দৌড় । হুক্কুই , হৈয়ো , হূহূ প্রভৃতি বড়ো বড়ো শেয়াল – বীর আপন আপন গর্তের ভিতর গিয়ে ঢুকল।
সমস্ত শেয়াল – সমাজ স্তম্ভিত ।
তার পর ছ মাস গেল ।
শেষ খবর পাওয়া গেছে । শিবুরাম সারারাত হেঁকে হেঁকে বেড়াচ্ছে , আমার লেজ কই , আমার লেজ কই ।
গোঁসাইয়ের শোবার ঘরে সামনের রোয়াকে বসে উর্ধ্ব দিকে মুখ তুলে প্রহরে প্রহরে কোকিয়ে উঠে বলে , আমার লেজ ফিরে দাও।
গোঁসাই দরজা খুলতে সাহস করে না — ভয় পায় , পাছে তাকে খ্যাপা শেয়ালে কামড়ায় ।
শেয়ালকাঁটার বনে যেখানে শিবুরামের বাড়ি সেখানে ওর যাওয়া বন্ধ । জ্ঞাতিরা ওকে দূর থেকে দেখলে , হয় পালায় নয় খেঁকিয়ে কামড়াতে আসে । ভাঙা চণ্ডীমণ্ডপেই থাকে , সেখানে একজোড়া প্যাঁচা ছাড়া আর অন্য প্রাণী নেই । খাঁদু , গোবর , বেঁচি , ঢেঁড়ি প্রভৃতি বড়ো বড়ো ডানপিটে ছেলেরাও ভূতের ভয়ে সেখানকার জঙ্গল থেকে কর্মচা পাড়তে যায় না।
শেয়ালি ভাষায় শেয়াল একটা ছড়া লিখেছে , তার আরম্ভটা এইরকম —
ওরে লেজ , হারা লেজ , চক্ষে দেখি ধুঁয়া ।
বক্ষ মোর গেল ফেটে হুক্কা হুয়া হুয়া ।
পুপে বলে উঠল , কী অন্যায় , ভারি অন্যায় । আচ্ছা , দাদামশায় , ওর মাসিও ওকে নেবে না ঘরে ?
আমি বললুম , তুমি ভেবো না ; ওর গায়ের রোঁয়াগুলো আবার উঠুক , তখন ওকে চিনতে পারবে।
কিন্তু , ওর লেজ ?
হয়তো লাঙ্গুলাদ্য ঘৃত পাওয়া যেতে পারে কবিরাজমশায়ের ঘরে । আমি খোঁজ নেব।
সে আমাকে আড়ালে নিয়ে গিয়ে বললে , রাগ কোরো না দাদা , হক্ কথা বলব — তোমারও শোধনের দরকার হয়েছে।
বে – আদব কোথাকার , কিসের শোধন আমার ।
তোমার ঐ বুড়োমির শোধন । বয়স তো কম হয় নি , তবু ছেলেমানুষিতে পাকা হতে পারলে না।
প্রমাণ পেলে কিসে ।
এই – যে রিপোর্টটা পড়ে শোনালে , ওটা তো আগাগোড়া ব্যঙ্গ , প্রবীণ বয়সের জ্যাঠামি । দেখলে না পুপুদিদির মুখ কিরকম গম্ভীর ? বোধ হয় গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল । ভাবছিল , রোঁয়া – চাঁচা শেয়ালটা এখনি এল বুঝি তার কাছে নালিশ করতে। বুদ্ধির মাত্রাটা একটু কমাতে যদি না পার তা হলে গল্প বলা ছেড়ে দাও।
ওটা কমানো আমার পক্ষে শক্ত। তুমি বুঝবে কী করে ; তোমাকে তো চেষ্টাই করতে হয় না , বিধাতা আছেন তোমার সহায়।
দাদা , রাগ করছ বটে , কিন্তু আমি বলে দিলুম , বুদ্ধির ঝাঁজে তোমার রস যাচ্ছে শুকিয়ে । মজা করছ মনে কর , কিন্তু তোমার ঠাট্টা গায়ে ঠেকলে ঝামার মতো লাগে । এর আগে তোমাকে অনেকবার সতর্ক করে দিয়েছি — হাসতে গিয়ে , হাসাতে গিয়ে পরকাল খুইয়ো না। লেজকাটা শেয়ালের কথা শুনে পুপুদিদির চোখ জলে ভরে এসেছিল , দেখতে পাও নি বুঝি ? বল তো আজই তাকে আমি একটুখানি হাসিয়ে দিই গে — বিশুদ্ধ হাসি , তাতে বুদ্ধির ভেজাল নেই।
লেখা তৈরি আছে নাকি ?
আমার লেজ কই ! আমার লেজ কই !আছে । নাটকি চালের আলাপ । বললেই হবে , আমাদের পাড়ার উধো গোবরা আর পঞ্চুতে মিলে কথা হচ্ছে । ওদের সবাইকে দিদি চেনে।
আচ্ছা বেশ , দেখা যাক ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।