গন্ধে শেয়ালগুলো পর্যন্ত দিনের বেলা হাঁক ছেড়ে ডাকতে আরম্ভ করে নির্ভয়ে , লোভে কি ক্ষোভে জানি নে। কাকগুলো জমির উপর ঠোঁট গুঁজে দিয়ে মরিয়া হয়ে পাখা ঝাপটায় তিন ঘণ্টা ধরে । এ তো গেল তরকারি । আর , জালা জালা ভর্তি ছিল কাঙ্চুটোর সাঙ্চানি । সে দেশের পাকা পাকা আঁক্সুটো ফলের ছোবড়া – চোঁয়ানো । এই সঙ্গে মিষ্টান্ন ছিল ইক্টিকুটির ভিক্টিমাই , ঝুড়িভর্তি । প্রথমে ওদের পোষা হাতি এসে পা দিয়ে সেগুলো দ’লে দিল ; তার পরে ওদের দেশের সব চেয়ে বড়ো জানোয়ার , মানুষে গোরুতে সিঙ্গিতে মিশোল , তাকে ওরা বলে গাণ্ডিসাঙ্ডুং , তার কাঁটাওয়ালা জিব দিয়ে চেটে চেটে কতকটা নরম করে আনলে । তার পরে তিনশো লোকের পাতের সামনে দমাদ্দম হামানদিস্তার শব্দ উঠতে লাগল । ওরা বলে , এই ভীষণ শব্দ শুনলেই ওদের জিবে জল আসে ; দূর পাড়া থেকে শুনতে পেয়ে ভিখারি আসে দলে দলে । খেতে খেতে যাদের দাঁত ভেঙে যায় তারা সেই ভাঙা দাঁত দান করে যায় বাড়ির কর্তাকে । তিনি সেই ভাঙা দাঁত ব্যাঙ্কে পাঠিয়ে দেন জমা করে রাখতে , উইল করে দিয়ে যান ছেলেদের । যার তবিলে যত দাঁত তার তত নাম । অনেকে লুকিয়ে অন্যের সঞ্চিত দাঁত কিনে নিয়ে নিজের বলে চালিয়ে দেয় । এই নিয়ে বড়ো বড়ো মকদ্দমা হয়ে গেছে । হাজারদাঁতিরা পঞ্চাশদাঁতির ঘরে মেয়ে দেয় না । একজন সামান্য পনেরোদাঁতি ওদের কেট্কু নাড়ু খেতে গিয়ে হঠাৎ দম আট্কিয়ে মারা গেল , হাজারদাঁতির পাড়ায় তাকে পোড়াবার লোক পাওয়াই গেল না । তাকে লুকিয়ে ভাসিয়ে দিলে চৌচঙ্গী নদীর জলে । তাই নিয়ে নদীর দুই ধারের লোকেরা খেসারতের দাবি করে নালিশ করেছিল , লড়েছিল প্রিভিকৌন্সিল পর্যন্ত।
আমি হাঁপিয়ে উঠে বললুম , থামো , থামো ! কিন্তু জিগেস করি , তুমি যে কাহিনীটা আওড়ালে তার বিশেষ গুণটা কী ।
ওর গুণটা এই , এটা কুলের আঁঠির চাটনি নয় । যা কিছুই জানি নে তাকে নিয়ে বাড়াবাড়ি করবার শখ মেটালে কোনো নালিশের কারণ থাকে না । কিন্তু , এতেও যে আছে উঁচু দরের হাসি তা আমি বলি নে । বিশ্বাস করবার অতীত যা তাকেও বিশ্বাস করবার যোগ্য করতে পার যদি , তা হলেই অদ্ভুত রসের গল্প জমে । নেহাত বাজারে – চল্তি ছেলে – ভোলাবার সস্তা অত্যুক্তি যদি তুমি বানাতে থাক তা হলে তোমার অপযশ হবে , এই আমি বলে রাখলুম।
আমি বললেম , আচ্ছা , এমন করে গল্প বলব যাতে পুপুদিদির বিশ্বাস ভাঙতে ওঝা ডাকতে হবে।
ভালো কথা , কিন্তু লাটসাহেবের বাড়িতে যাওয়া বলতে কী বোঝায় ।
বোঝায় , তুমি বিদায় নিলেই ছুটি পাই । একবার বসলে উঠতে চাও না , তাই ‘তুমি যাও’ অনুরোধটা সামান্য একটু ঘুরিয়ে বলতে হল।
বুঝেছি , আচ্ছা , তবে চললুম ।
সার্কাস দেখে আসার পর থেকে পুপুদিদির মনটা যেন বাঘের বাসা হয়ে উঠল । বাঘের সঙ্গে , বাঘের মাসির সঙ্গে সর্বদা তার আলাপ চলছে । আমরা কেউ যখন থাকি নে তখনই ওদের মজলিস জমে । আমার কাছে নাপিতের খবর নিচ্ছিল ; আমি বললুম , নাপিতের কী দরকার।
পুপু জানালে , বাঘ ওকে অত্যন্ত ধরে পড়েছে । খোঁচা খোঁচা হয়ে উঠেছে ওর গোঁফ , ও কামাতে চায় ।
আমি জিগেস করলেম , গোঁফ কামানোর কথা ওর মনে এল কী করে ।
পুপু বললে , চা খেয়ে বাবার পেয়ালায় তলানি যেটুকু বাকি থাকে আমি বাঘকে খেতে দিই । সেদিন তাই খেতে এসে ও দেখতে পেয়েছিল পাঁচুবাবুকে ; ওর বিশ্বাস , গোঁফ কামালে ওর মুখখানা দেখাবে ঠিক পাঁচুবাবুরই মতো।
আমি বললুম , সেটা নিতান্ত অন্যায় ভাবে নি । কিন্তু , একটু মুশকিল আছে । কামানোর শুরুতেই নাপিতকে যদি শেষ করে দেয় তা হলে কামানো শেষ হবেই না।
শুনেই ফস্ করে পুপের মাথায় বুদ্ধি এল ; বলে ফেললে , জান দাদামশায় ? বাঘরা কখ্খনো নাপিতকে খায় না ।
আমি বললুম , বল কী । কেন বলো দেখি ।
খেলে ওদের পাপ হয় ।
ওঃ , তা হলে কোনো ভয় নেই । এক কাজ করা যাবে , চৌরঙ্গিতে সাহেব – নাপিতের দোকানে নিয়ে যাওয়া যাবে ।
পুপে হাততালি দিয়ে বলে উঠল , হাঁ হাঁ , ভারি মজা হবে । সাহেবের মাংস নিশ্চয় খাবে না , ঘেন্না করবে।
খেলে গঙ্গাস্নান করতে হবে । খাওয়া – ছোঁওয়ায় বাঘের এত বাছবিচার আছে , তুমি জানলে কী করে , দিদি।
পুপু খুব সেয়ানার মতো মুখ টিপে হেসে বললে , আমি সব জানি ।
আর , আমি বুঝি জানি নে ?
কী জান , বলো তো ।
ওরা কখনো চাষী কৈবর্তর মাংস খায় না ; বিশেষত যারা গঙ্গার পশ্চিম – পারে থাকে । শাস্ত্রে বারণ ।
আর , যারা পুব – পারে থাকে ?
তারা যদি জেলে কৈবর্ত হয় তো সেটা অতি পবিত্র মাংস । সেটা খাবার নিয়ম বাঁ থাবা দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে ।
বাঁ থাবা কেন ।
ঐটে হচ্ছে শুদ্ধ রীতি । ওদের পণ্ডিতরা ডান থাবাকে নোংরা বলে । একটি কথা জেনে রাখো দিদি , নাপতিনীদের ‘পরে ওদের ঘেন্না । নাপতিনীরা যে মেয়েদের পায়ে আল্তা লাগায়।
তা লাগালেই বা ?
সাধু বাঘেরা বলে , আলতাটা রক্তের ভান , ওটা আঁচড়ে কামড়ে ছিঁড়ে চিবিয়ে বের করা রক্ত নয় , ওটা মিথ্যাচার । এরকম কপটাচরণকে ওরা অত্যন্ত নিন্দে করে । একবার একটা বাঘ ঢুকেছিল পাগড়িওয়ালার ঘরে , সেখানে ম্যাজেণ্টা গোলা ছিল গামলায় । রক্ত মনে করে মহা খুশি হয়ে মুখ ডুবোলে তার মধ্যে । সে একেবারে পাকা রঙ । বাঘের দাড়ি গোঁফ , তার দুই গাল , লাল টক্টকে হয়ে উঠল । নিবিড় বনে যেখানে বাঘেদের পুরুতপাড়া মোষমারা গ্রামে , সেইখানে আসতেই ওদের আঁচাড়ি শিরোমণি বলে উঠল , এ কী কাণ্ড ! তোমার সমস্ত মুখ লাল কেন । ও লজ্জায় পড়ে মিথ্যে করে বললে , গণ্ডার মেরে তার রক্ত খেয়ে এসেছি । ধরা পড়ে গেল মিথ্যে । পণ্ডিতজি বললে , নখে তো রক্তের চিহ্ন দেখি নে ; মুখ শুঁকে বললে , মুখে তো রক্তের গন্ধ নেই । সবাই বলে উঠল , ছি ছি ! এ তো রক্তও নয় , পিত্তও নয় , মগজও নয় , মজ্জাও নয় — নিশ্চয় মানুষের পাড়ায় গিয়ে এমন একটা রক্ত খেয়েছে যা নিরামিষ রক্ত , যা অশুচি । পঞ্চায়েত বসে গেল । কামড়বিশারদ – মশায় হুঙ্কার দিয়ে বললে , প্রায়শ্চিত্ত করা চাই । করতেই হল ।
যদি না করত ।
সর্বনাশ ! ও যে পাঁচ – পাঁচটা মেয়ের বাপ ; বড়ো বড়ো খরনখিনীর গৌরীদানের বয়স হয়ে এসেছে । পেটের নীচে লেজ গুটিয়ে সাত গণ্ডা মোষ পণ দিতে চাইলেও বর জুটবে না । এর চেয়েও ভয়ংকর শাস্তি আছে ।
কী রকম ।
মলে শ্রাদ্ধ করবার জন্যে পুরুত পাওয়া যাবে না , শেষ কালে হয়তো বেত – জঙ্গল গাঁ থেকে নেকড়ে – বেঘো পুরুত আনতে হবে ; সে ভারি লজ্জা , সাত পুরুষের মাথা হেঁট ।
শ্রাদ্ধ নাই বা হল ।
শোনো একবার । বাঘের ভূত যে না খেয়ে মরবে ।
সে তো মরেইছে , আবার মরবে কী করে ।
সেই তো আরো বিপদ । না খেয়ে মরা ভালো , কিন্তু ম’রে না খেয়ে বেঁচে থাকা যে বিষম দুর্গ্রহ ।
পুপুদিদিকে ভাবিয়ে দিলে । খানিকক্ষণ বাদে ভুরু কুঁচ্কিয়ে বললে , ইংরেজের ভূত তা হলে খেতে পায় কী করে ।
তারা বেঁচে থাকতে যা খেয়েছে তাতেই তাদের সাত জন্ম অমনি চলে যায় । আমরা যা খাই তাতে বৈতরণী পার হবার অনেক আগেই পেট চোঁ – চোঁ করতে থাকে ।
সন্দেহ মীমাংসা হতেই পুপে জিগেস করলে , প্রায়শ্চিত্ত কিরকম হল ।
আমি বললুম , হাঁকবিদ্যা – বাচস্পতি বিধান দিলে যে , বাঘাচণ্ডীতলার দক্ষিণপশ্চিম কোণে কৃষ্ণপঞ্চমী তিথি থেকে শুরু করে অমাবস্যার আড়াই পহর রাত পর্যন্ত ওকে কেবল খ্যাঁক্শেয়ালির ঘাড়ের মাংস খেয়ে থাকতে হবে ; তাও হয় ওর পিসতুতো বোন কিংবা মাসতুতো শ্যালার মেজো ছেলে ছাড়া আর কেউ শিকার করলে হবে না — আর , ওকে খেতে হবে পিছনের ডান দিকের থাবা দিয়ে ছিঁড়ে ছিঁড়ে । এত বড়ো শাস্তির হুকুম শুনেই গা বমি – বমি করে এল ; চার পায়ে হাত জোড় করে হাউ – হাউ করতে লাগল ।
কেন , কী এমন শাস্তি ।
বল কী , খ্যাঁক্শিয়ালির মাংস ! যত দূর অশুচি হতে হয় । বাঘটা দোহাই পেড়ে বললে , আমাকে বরঞ্চ নেউলের লেজ খেতে বলো সেও রাজি , কিন্তু খ্যাঁক্শেয়ালির ঘাড়ের মাংস !
শেষকালে কি খেতে হল ।
হল বৈকি।
দাদামশায় , বাঘেরা তা হলে খুব ধার্মিক ?
ধার্মিক না হলে কি এত নিয়ম বাঁচিয়ে চলে । সেইজন্যেই তো শেয়ালরা ওদের ভারি ভক্তি করে । বাঘের এঁটো প্রসাদ পেলে ওরা বর্তিয়ে যায় । মাঘের ত্রয়োদশীতে যদি মঙ্গলবার পড়ে তা হলে সেদিন ভোর রাত্তিরে ঠিক দেড় প্রহর থাকতে বুড়ো বাঘের পা চেটে আসা শেয়ালদের ভারি পুণ্যকর্ম । কত শেয়াল প্রাণ দিয়েছে এই পুণ্যের জন্যে ।
পুপুর বিষম খটকা লাগল । বললে , বাঘরা এতই যদি ধার্মিক হবে তা হলে জীবহত্যে করে কাঁচা মাংস খায় কী করে ।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।