সাবধান ! চোরাবালি!

হলিউড বা বলিউডের অনেক সিনেমাতেই দেখানো হয় যে ভুল করে কেউ চোরাবালিতে ফেঁসে গিয়ে মারা গেল। কিন্তু এইসব ঘটনার পেছনে কতটুকু সত্য আর কতটুকু মিথ্যে?

১৯৬৪ সালে দুই বন্ধু, জ্যাক আর ফ্রেড, দুজনেই কলেজের ছাত্র, দক্ষিণ ফ্লোরিডার অকীচবী হ্রদের চারপাশের জলাভূমিতে পরাশ্রয়ী উদ্ভিদ খুঁজছিল। হঠাৎ জ্যাকের পা নরম বালিতে ঢুকে গেল। সে তার বন্ধুকে সতর্ক করতে বলল যেন সে সামনে না আসে। কিন্তু সে নিজে ধীরে ধীরে সেই চোরাবালির মধ্যে ডুবে যেতে থাকল। তার বন্ধু ফ্রেড তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করল, কিন্তু সবই বৃথা গেল। কিচ্ছুক্ষণের মধ্যেই জ্যাক চোরাবালির ভেতরে সম্পূর্ণভাবে তলিয়ে গেল। এটি একটি সত্য ঘটনা।

তুমি বিশ্বাস করো বা না করো, চোরাবালির মধ্যে ফেঁসে গিয়ে আজ পর্যন্ত শুধু মানুষই নয়, জন্তু-জানোয়ার, গাড়ি, ট্রাক, এমনকি একবার একটি আস্ত রেলের বগিও গায়েব হয়ে গিয়েছিল।

চোরাবালি কী এবং কতটা বিপজ্জনক?

অধিকাংশ চোরাবালি সাধারণত মারাত্মক নয়, তবে এটি প্রকৃতির একটি বিস্ময়কর ঘটনা। এটি ভালোভাবে বোঝা দরকার। সাধারণত যখন বালি, কাদা বা নুড়ি ভূগর্ভস্থ জলের প্রবাহের সংস্পর্শে আসে, তখন বালি বা নুড়ির কণাগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ শক্তি কমে যায় এবং মাটি ভার সহ্য করতে পারে না।

এই ধরনের ঘটনা আমরা সমুদ্র সৈকতে দেখতে পাই। সমুদ্রধারের বালিতে যদি তুমি দাঁড়িয়ে থাকো, তাহলে খানিকক্ষণ পর দেখবে ধীরে ধীরে তোমার পা বালির ভেতর বসে যাচ্ছে। এটাও এক ধরনের ছোটখাটো চোরাবালি। তবে সাধারণত এই ধরনের চোরাবালির গভীরতা কয়েক ইঞ্চির বেশি হয় না।

কিন্তু প্রকৃত চোরাবালির ক্ষেত্রে মাটি বা বালির ভার সহ্য করার ক্ষমতা একেবারেই কমে যায়। প্রবাহমান জলের কারণে বালি বা মাটির কণাগুলোর মধ্যে ঘর্ষণ একেবারে কমে যায় এবং পুরো জায়গাটি তরল অবস্থায় চলে যায়। এই ধরনের চোরাবালির গভীরতা যদি কয়েক মিটার বা বেশি হয়, তাহলে তা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।

চোরাবালিতে কীভাবে আটকে যায় মানুষ বা অন্য প্রাণী?

চোরাবালিতে ফেঁসে গেলে বেরিয়ে আসা খুব কঠিন হয়ে যায়। হাত-পা বালিতে আটকে যেতে পারে এবং নিজে থেকে বেরিয়ে আসা প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। অনেক সময় চোরাবালির গভীরতা বেশি না হলে মানুষ পুরোপুরি না ডুবে গিয়ে অর্ধেক আটকে যায়। তবে এই পরিস্থিতিও কম বিপজ্জনক নয়। পুরো না ডুবলেও ঠান্ডা বা ক্ষুধার কারণে মৃত্যু হতে পারে। অনেক সময় চোরাবালিতে আটকে গিয়ে বন্য প্রাণীর আক্রমণের শিকার হয়ে মানুষের মৃত্যু হয়েছে।

চোরাবালি কোথায় পাওয়া যায়?

যেসব জায়গায় ভূগর্ভস্থ জলের প্রবাহ বেশি থাকে, সেখানে চোরাবালি থাকার সম্ভাবনাও বেশি। যেমন—জলা, নদী, খাঁড়ি, সমুদ্রতীর এবং জলাভূমি। তবে মরুভূমিতে কখনো চোরাবালি থাকে না, কারণ সেখানে জল থাকে না।

চোরাবালির ভূমিকা ভূবিজ্ঞান এবং ফসিল তৈরিতে

প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই চোরাবালি পৃথিবীতে রয়েছে। সেই সময়কার অনেক প্রাণী চোরাবালিতে আটকে মারা গিয়েছিল, আর তাদের দেহাবশেষ ধীরে ধীরে মাটির তলায় থেকে ফসিলে পরিণত হয়েছে। আমরা আজকে যেসব ডাইনোসরের ফসিল পাই, তার অনেকগুলিই চোরাবালিতে আটকে পড়া প্রাণীদের দেহাবশেষ। চোরাবালির কারণে তারা প্রাকৃতিক ক্ষয় ও অন্য প্রাণীর আক্রমণ থেকে রক্ষা পেয়ে গেছে এবং সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পাথরে পরিণত হয়েছে।

চোরাবালি কোথায় আছে বোঝা যায় কিভাবে?

অনেক সময় চোরাবালির ওপরে শুকনো পাতা, ডালপালা পড়ে থাকে, যা এটিকে সহজেই চোখে পড়ার মতো করে না রাখে। আবার কখনো কখনো এর ওপরে শুকনো বালির স্তর পড়ে যায়, ফলে বোঝা যায় না নিচে চোরাবালি রয়েছে। নদীর নিচেও চোরাবালি থাকতে পারে, যা পারাপারের সময় বিপজ্জনক হতে পারে।

যদি তুমি চোরাবালিতে আটকে যাও, তাহলে কী করবে?

চোরাবালিতে আটকে গেলে, প্রথমেই আতঙ্কিত হবে না। কারণ বেশি হাত-পা নাড়ালে তুমি আরও বেশি আটকে পড়বে। মনে রেখো, চোরাবালি জলের তুলনায় অনেক বেশি ঘন, তাই এতে ভেসে থাকা তুলনামূলকভাবে সহজ। যদি তোমার সঙ্গে কোনো ভারী বস্তু থাকে, যেমন ব্যাকপ্যাক, তাহলে সেটি ছেড়ে দাও, কারণ এটি তোমাকে দ্রুত নিচে টেনে নিতে পারে।

বেশিরভাগ চোরাবালির গভীরতা কম হয়। কিছুটা ডোবার পর হয়তো তোমার পা নিচে আটকে যাবে। যদি চোরাবালি খুব গভীর হয়, তাহলে পুরোপুরি ডুবে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই শরীরটিকে অনুভূমিক করে যতটা সম্ভব শুয়ে পড়তে হবে এবং ধীরে ধীরে সাঁতরে চোরাবালির বাইরে আসার চেষ্টা করতে হবে।

একবার, আমেরিকার ইউএসজিএস-এর একজন বিজ্ঞানী কলোরাডো নদীর তীরে চোরাবালিতে ফেঁসে গিয়েছিলেন। তিনি কোনোরকমে নিজের পা ওপরে তুলে শরীরটাকে অনুভূমিক করে আস্তে আস্তে সাঁতরে চোরাবালির বাইরে আসতে সক্ষম হন। মাত্র দশ ফুট সাঁতরাতে তাঁর আট ঘণ্টা সময় লেগেছিল! কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি বেঁচে গিয়েছিলেন।

তাই, চোরাবালির এলাকায় সতর্ক থাকো, বিশেষ করে একা কোথাও গেলে আগে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করো!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *