
চারদিক সাজসাজ রব। বেজে উঠেছে যুদ্ধের দামামা—বদর যুদ্ধ। কে আর ঘরের কোণে অলসভাবে বসে থাকতে চায়? কোন মুমিন আল্লাহর প্রিয় বান্দা এই সুবর্ণ সুযোগ হাতছাড়া করবে? এমন হতভাগ্য, দুর্বল মুমিন কেউ ছিল না। বরং, যুদ্ধের মাদকতায়, জিহাদের নেশায় রাসূল (সা.)-এর সাথীরা মাতোয়ারা হয়ে উঠেছিল। কে প্রথম হবে শহীদ? সেই প্রতিযোগিতার তুমুল তুফান সাহাবীদের মধ্যে। সবার ভেতর প্রাণচাঞ্চল্য দেখা গেল, কি যুবক, কি বৃদ্ধ—এমনকি কিশোরদের মধ্যেও চলছে সেই প্রতিযোগিতা।
রাসূল (সা.)-এর সাথীরা যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত। তারা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। সেই সারিতে একটু জায়গা করে দাঁড়িয়ে আছেন এক কিশোর। কিশোরের হৃদয়ে জিহাদের প্রত্যাশা যেন বঙ্গোপসাগরের বিশাল ঢেউয়ের মতো। সাহসী কিশোর যেন উহুদ পর্বত, আর তার ঈমানের তুফান আরব সাগরের মতো বিশাল।
রাসূল (সা.) একে একে সাথীদের দেখে যাচ্ছেন। তার দৃষ্টি কিশোরটির ওপর পড়ল। কিশোরটি মুহূর্তেই কেঁপে উঠল। রাসূল (সা.) জানতে চাইলেন, “তোমার বয়স কত?” কিশোরটি বলল, “বার বছর।” রাসূল (সা.) মুচকি হাসলেন। “তাহলে তুমি যুদ্ধে যাবার জন্য উপযুক্ত নও,” বললেন তিনি।
এই কথা শোনার পর কিশোরের চোখে পানি চলে এল। ফিরে গেলেন তিনি, এক বুক কষ্ট ও বেদনা নিয়ে। বদর যুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি, কিন্তু তার হৃদয়ে ছিল যুদ্ধে যাওয়ার এক তীব্র আকাঙ্ক্ষা। সে প্রতীক্ষায় সময় কাটাচ্ছিল—যতদিন না আসছে সেই সুবর্ণ সুযোগ। অবশেষে, উহুদ যুদ্ধ এলো।
কিশোরের বয়স তখন পনের। এবার দৃঢ় বিশ্বাস নিয়ে, সাহস ও আবেগে ভরপুর তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন জিহাদী কাফেলায়। রাসূল (সা.) তাঁর সাথীদের দেখে যাচ্ছেন, এক এক করে। এবং, রাসূল (সা.) যখন কিশোরটির সামনে এসে পৌঁছালেন, তখন কিশোরের বুকের গভীরে তুও এক আশঙ্কা ছিল—কী জানি, আবার বাদ পড়বেন না তো? কিন্তু না, এবার রাসূল (সা.) তাকে মনোনীত করলেন উহুদ যুদ্ধের জন্য।
রাসূল (সা.) থেকে অনুমতি পাওয়ার পর কিশোরটি আনন্দের জলপ্রপাতের মতো শুকরিয়া জানালেন। যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতি নিলেন। যুদ্ধ শুরু হল। একদিকে মিথ্যার কালো ছায়া, অন্যদিকে আলোর মিছিল। যুদ্ধের দামামা বাজল। ইসলামের বীর মুজাহিদরা ঝাঁপিয়ে পড়লেন শত্রুপক্ষের ওপর। যুদ্ধ করতে গিয়ে, শত্রুপক্ষের একটি তীর এসে বিঁধে গেল কিশোরটির বুকের ভেতর। তীরটি হাড় ভেদ করে ঢুকে গেল তার বুকের গভীরে।
যুদ্ধ শেষে কিশোরকে রাসূল (সা.)-এর কাছে আনা হলো। তীরটি তখনো আটকে ছিল তার বুকের ভেতর। রাসূল (সা.) দেখে বললেন, “তুমি চাইলে আমি তীরটি এবং ফলাটা বের করে আনতে পারি, অথবা শুধু তীরটা বের করে আনতে পারি—তাহলে ফলাটি থাকবে তোমার বুকের ভেতর।”
কিশোরটি বলল, “আপনি কেবল তীরটা বের করে নিন। আর ফলাটা থাকুক, যাতে কিয়ামতের দিনে আপনি সাক্ষ্য দিন, আমি একজন শহীদ।”
রাসূল (সা.) বুঝলেন তার মনোবাসনা। একটানে তীরটি বের করে আনলেন, কিন্তু ফলাটি রয়ে গেল কিশোরের বুকের গভীরে। তার পর, কিশোরটি হাসি মুখে যুদ্ধ করেছে। উহুদ যুদ্ধের পর খন্দকসহ সকল যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল সেই তীরবিদ্ধ বুক নিয়ে।
রাসূল (সা.)-এর মৃত্যুর পরও সিফফীনের যুদ্ধসহ আরো যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল। কিন্তু একদিন, সেই তীরবিদ্ধ ক্ষতস্থানে পচন ধরে তিনি ইন্তেকাল করলেন। যদিও তিনি চলে গেছেন, তার বুকে রয়ে গেল রাসূল (সা.)-এর সাক্ষ্য—তীরের ফলাটি।
এটাই ছিল একজন মুমিনের শহীদি তামান্না, শহীদি পিপাসা। এই অসীম সাহসী কিশোরের নাম ছিল রাফে ইবনে খাদীজ। আল্লাহর রাসূল (সা.)-এর সাক্ষ্যদাতা। হযরত রাফে, কি সৌভাগ্যবান এক আলোচিত মানুষ ছিলেন তিনি!