শেষ কথা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– ষষ্ঠ অংশ

অচিরার সঙ্গে স্পষ্ট কথা বলার যুগ এল সংক্ষেপেই। সেদিন চড়িভাতি হয়েছিল তনিকা নদীর তীরে।

অধ্যাপক ছেলেমানুষের মতন হঠাৎ আমাকে জিগ্‌গেসা করে বসলেন, “নবীন, তোমার কি বিবাহ হয়েছে।”

প্রশ্নটা এতই সুস্পষ্ট ভাবব্যঞ্জক যে, আর কেউ হলে ওটা চেপে যেত। আমি উত্তর করলুম, “না, এখনো তো হয় নি।”

অচিরার কাছে কোনো কথাই এড়ায় না। সে বললে, “দাদু, ঐ এখনো শব্দটা সংশয়গ্রস্ত কন্যাকর্তাদের মনকে সান্ত্বনা দেবার জন্যে। ওর কোনো যথার্থ মানে নেই।”

“একেবারে মানে যে নেই, এ কথা নিশ্চিত স্থির করলেন কী করে।”

“এটা গণিতের প্রব্লেম— তাও হাইয়ার ম্যাথ্‌মেটিক‍্‍স্ বললে যা বোঝায়, তা নয়। পূর্বেই শোনা গেছে, আপনি ছত্রিশ বছরের ছেলেমানুষ। হিসেব করে দেখলুম, এর মধ্যে আপনার মা অন্তত পাঁচ-সাতবার আপনাকে বলেছেন, ‘বাবা, ঘরে বউ আনতে চাই।’ আপনি বলেছেন, ‘তার আগে চাই লোহার সিন্দুকে টাকা আনতে’। মা চোখের জল মুছে চুপ করে রইলেন। তার পরে ইতিমধ্যে আপনার আর-সব হয়েছে, কেবল ফাঁসি ছিল বাকি। শেষকালে এখানকার রাজসরকারে যখন মোটা মাইনের পদজুটল, মা আবার বললেন, ‘বাবা, এবার বিয়ে করতে হবে, আমার আর কদিন বা সময় আছে।’ আপনি বললেন, ‘আমার জীবন আর আমার সায়ান্স এক, সে আমি দেশকে উৎসর্গ করব। আমি কোনোদিন বিয়ে করব না।’ হতাশ হয়ে আবার তিনি চোখের জল মুছে বসে আছেন। আপনার ছত্রিশ বছর বয়সের গণিতফল গণনা করতে আমার গণনায় ভুল হয়েছে কি না বলুন, সত্যি করে বলুন।”

এ মেয়ের সঙ্গে অনবধানে কথা কওয়া বিপদজনক। কিছুদিন আগেই একটা ব্যাপার ঘটেছিল। প্রসঙ্গক্রমে অচিরা আমাকে বলেছিল, “আমাদের দেশে মেয়েদের আপনারা পান সংসারের সঙ্গিনীরূপে। সংসারে যাদের দরকার নেই, এ দেশের মেয়েরাও তাদের কাছে অনাবশ্যক। কিন্তু বিলেতে যারা বিজ্ঞানে তপস্বী, তাদের তো উপযুক্ত তপস্বিনী জোটে, যেমন ছিল অধ্যাপক কুরির সধর্মিণী মাদাম কুরি। সেরকম কোনো মেয়ে আপনি সে দেশে থাকতে পান নি? ” মনে পড়ে গেল ক্যাথারিনের কথা। একসঙ্গে কাজ করেছি লণ্ডনে থাকতে। এমন-কি, আমার একটা রিসর্চের বইয়ে আমার নামের সঙ্গে তাঁর নামও জড়িত ছিল। মানতে হল কথাটা। অচিরা বললে, “তাঁকে আপনি বিয়ে করলেন না কেন। তিনি কি রাজি ছিলেন না।”

আবার মানতে হল, “হাঁ, প্রস্তাব তাঁর দিক থেকেই উঠেছিল।”

“তবে? ”

“আমার কাজ যে ভারতবর্ষের। শুধু সে তো বিজ্ঞানের নয়।”

“অর্থাৎ ভালোবাসার সফলতা আপনার মতো সাধকের কামনার জিনিস নয়। মেয়েদের জীবনের চরম লক্ষ্য ব্যক্তিগত, আপনাদের নৈর্ব্যক্তিক।”

এর জবাবটা হঠাৎ মুখে এল না। আমাকে চুপ করে থাকতে দেখে অচিরা বললে, “বাংলা সাহিত্য আপনি বোধ হয় পড়েন না। কচ ও দেবযানী ব’লে একটা কবিতা আছে। তাতে ঐ কথাই আছে, মেয়েদের ব্রত হচ্ছে পুরুষকে বাঁধা, আর পুরুষদের ব্রত সে-বাঁধন কাটিয়ে অমরলোকের রাস্তা বানানো। কচ বেরিয়ে পড়েছিল দেবযানীর অনুরোধ এড়িয়ে, আপনি কাটিয়ে এসেছেন মায়ের অনুনয়। একই কথা। মেয়েপুরুষের এই চিরকালের দ্বন্দ্বে আপনি জয়ী হয়েছেন। জয় হোক আপনার পৌরুষের। কাঁদুক মেয়েরা, সে-কান্না আপনারা নিন পূজার নৈবেদ্য। দেবতার উদ্দেশে আসে নৈবেদ্য, কিন্তু দেবতা থাকেন নিরাসক্ত।”

অধ্যাপক এই আলোচনার মূল লক্ষ্য কিছুই বুঝলেন না। সগর্বে বললেন, “দিদির মুখে গভীর সত্য কেমন বিনা চেষ্টায় প্রকাশ পায়, বাইরের লোকে শুনলে মনে করবে—”

তাঁর কেবলই ভয়, বাইরের লোক তাঁর নাতনিকে ঠিক বুঝতে পারবে না। অচিরা বললে, “বাইরের লোক মেয়েদের জেঠামি সইতে পারে না, তাদের কথা তুমি ভেবো না। তুমি আমাকে ঠিক বুঝলেই হল।”

অচিরা খুব বড়ো কথাও বলে থাকে হাসির ছলে, কিন্তু আজ সে কী গম্ভীর। আমার একটা কথা আন্দাজে মনে হল, ভবতোষ ওকে বুঝিয়েছিল যে, সে যে ভারতসরকারের উচ্চ গগনের জ্যোতির্লোক থেকে বধূ এনেছে, তারও লক্ষ্য খুব উচ্চ এবং নিঃস্বার্থ। ব্রিটিশ রাষ্ট্রশাসনের ভাণ্ডার হতেই সে শক্তি সংগ্রহ করতে পারবে দেশের কাজে লাগাতে। এত সহজ নয় অচিরাকে ছলনা করা। সে যে ভোলে নি, তার প্রমাণ রয়ে গেছে সেই দ্বিখণ্ডিত চিঠির খামটা থেকেই।

অচিরা আবার বললে , “দেবযানী কচকে কী অভিসম্পাত দিয়েছিল জানেন, নবীনবাবু? ”

“না।”

“বলেছিল, ‘তোমার জ্ঞানসাধনার ধন তুমি নিজে ব্যবহার করতে পারবে না, অন্যকে দান করতে পারবে’। আমার কাছে কথাটা আশ্চর্য বোধ হয়। যদি এই অভিসম্পাত আজ দিত কেউ য়ুরোপকে, তা হলে সে বেঁচে যেত। বিশ্বের জিনিসকে নিজের জিনিসের মতো ব্যবহার করেই ওরা লোভের তাড়ায় মরছে। সত্যি কি না বলো, দাদু।”

“খুব সত্যি। কিন্তু আশ্চর্য এই, এত কথা তুমি কী করে ভাবলে।”

“নিজগুণে একটুও নয়। ঠিক এইরকম কথা তোমার কাছে অনেকবার শুনেছি। তোমার একটা মহদ্‌গুণ আছে, ভোলানাথ তুমি, কখন্‌ কী বল, সমস্ত ভুলে যাও। চোরাই মালের উপর নিজের ছাপ লাগিয়ে দিতে ভয় থাকে না।”

আমি বললুম, “চুরিবিদ্যা বড়ো বিদ্যা। বিদ্যায় বল, রাষ্ট্রেই বল, বড়ো বড়ো সম্রাট বড়ো বড়ো চোর। আসল কথা, তারাই ছিঁচকে চোর ছাপ মারবার পূর্বেই যারা ধরা পড়ে।”

অচিরা বললে, “ওঁর কত ছাত্র ওঁর মুখের কথা খাতায় টুকে নিয়ে বই লিখে নাম করেছে। উনি তাদের লেখা পড়ে আশ্চর্য হয়ে প্রশংসা করেন। জানতেই পারেন না, নিজের প্রশংসা নিজেই করছেন। আমার ভাগ্যে এ প্রশংসা প্রায়ই জোটে; নবীনবাবুকে জিজ্ঞাসা করলেই উনি কবুল করবেন, আমার ওরিজিন্যালিটির কথা খাতায় লিখতে শুরু করেছেন, যে-খাতায় তাম্রপ্রস্তরযুগের নোট রাখেন। মনে আছে দাদু, অনেকদিনের কথা, যখন কলেজে ছিলে, আমাকে কচ ও দেবযানীর কবিতা শুনিয়েছিলে? সেইদিন থেকে আমি পুরুষের উচ্চ গৌরব মনে-মনে মেনেছি, কক্‌খনো মুখে স্বীকার করি নে।”

“কিন্তু দিদি, আমার কোনো কথায় আমি মেয়েদের গৌরবের লাঘব করি নি।”

“তুমি করবে? তুমি যে মেয়েদের অন্ধ ভক্ত, তোমার মুখের স্তবগান শুনে মনে-মনে হাসি। মেয়েরা নির্লজ্জ হয়ে সব মেনে নেয়। সস্তায় প্রশংসা আত্মসাৎ করা ওদের অভ্যেস হয়ে গেছে।”

সেদিন এই যে কথাবার্তা হয়ে গেল, এ নেহাত হাস্যালাপ নয়। এর মধ্যে ছিল যুদ্ধের সূচনা। অচিরার স্বভাবের দুটো দিক ছিল, আর তার ছিল দুটো আশ্রয়। এক ছিল তাদের নিজেদের বাড়ি, আর ছিল সেই পঞ্চবটী। ওর সঙ্গে যখন আমার বেশ সহজ সম্বন্ধ হয়ে এসেছে, তখন স্থির করেছিলুম, ঐ পঞ্চবটীর নিভৃতে হাসিকৌতুকের ছলে আমার জীবনের সদ্যসংকটের কথা কোনো রকম করে তুলব এবং নিষ্পত্তির দিকে নিয়ে যাব। কিন্তু ওখানে পথ বন্ধ। আমাদের পরিচয়ের প্রথম দিনে প্রথম কথা যেমন মুখে আসছিল না, তেমনি এখানে যে-অচিরা আছে তার কাছে প্রথম কথা নেই। মোকাবিলায় ওর চরম মনের কথায় পৌঁছবার কোনো উপায় খুঁজে পাই নে।

গল্পের সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!