শেষ কথা– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– তৃতীয় অংশ

কিন্তু বাঙালি মেয়ে এই যেন প্রথম দেখলুম, ঠিক যে-জায়গায় তাকে সম্পূর্ণ দেখা যেতে পারে, এই নিভৃত বনের মধ্যে সে নানা পরিচিত-অপরিচিতের বাস্তবের সঙ্গে জড়িয়ে মিশিয়ে নেই; দেখে মনে হয় না, সে বেণী দুলিয়ে ডায়োসিশনে পড়তে যায়, কিংবা বেথুন কলেজের ডিগ্রিধারিণী, কিংবা বালিগঞ্জের টেনিসপার্টিতে উচ্চ কলহাস্যে চা পরিবেশন করে। অনেকদিন আগে ছেলেবেলায় হরু ঠাকুর কিংবা রাম বসুর যে গান শুনে তার পরে ভুলে গিয়েছিলুম, যে-গান আজ রেডিয়োতে বাজে না, গ্রামোফোনে পাড়া মুখরিত করে না, জানি নে কেন মনে হল সেই গানের সহজ রাগিণীতে ঐ বাঙালি মেয়েটির রূপের ভূমিকা— মনে রইল সই মনের বেদনা। এই গানের সুরে যে-একটি করুণ ছবি আছে, সে আজ রূপ নিয়ে আমার চোখে স্পষ্ট ফুটে উঠল। এও সম্ভব হল। কোন্‌ প্রবল ভূমিকম্পে পৃথিবীর-যে তলায় লুকোনো আগ্নেয় সামগ্রী উপরে উঠে পড়ে, জিয়লজি শাস্ত্রে তা পড়েছি, নিজের মধ্যে দেখলুম সেই নীচের তলায় অন্ধকারের তপ্তবিগলিত জিনিসকে হঠাৎ উপরের আলোতে। কঠোর বিজ্ঞানী নবীনমাধবের অটল অন্তঃস্তরে এই উলটপালট আমি কোনোদিন আশা করতে পারি নি।

বুঝতে পারছি, যখন আমি রোজ বিকেলবেলায় এই পথ দিয়ে আমার কাজে ফিরেছি, ও আমাকে দেখেছে, অন্যমনস্ক আমি ওকে দেখি নি। বিলেতে যাবার পর থেকে নিজের চেহারার উপর একটা গর্ব জন্মেছে। ও, হাউ হ্যাণ্ডসম— এই প্রশস্তি কানাকানিতে আমার অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু বিলেতফেরত আমার কোনো কোনো বন্ধুর কাছে শুনেছি, বাঙালি মেয়ের রুচি আলাদা, তারা মোলায়েম মেয়েলি রূপই পুরুষের রূপে খোঁজে। চলিত কথা হচ্ছে— কার্তিকের মতো চেহারা। বাঙালি কার্তিক আর যাই হোক, কোনো পুরুষে দেবসেনাপতি নয়। প্যারিসে একজন বান্ধবীর মুখে শুনেছি, বিলিতি সাদা রঙ রঙের অভাব; ওরিয়েন্টালের দেহে গরম আকাশ যে রঙ এঁকে দেয় সে সত্যিকার রঙ, সে ছায়ার রঙ, ঐ রঙই আমাদের ভালো লাগে; এ কথাটা বঙ্গোপসাগরের ধারে বোধ হয় খাটে না। এতদিন এ-সব আলোচনা আমার মনেই ওঠে নি। কয়েকদিন ধরে আমাকে ভাবিয়েছে। রোদে-পোড়া আমার রঙ, লম্বা আমার প্রাণসার দেহ, শক্ত আমার বাহু, দ্রুত আমার গতি, শুনেছি দৃষ্টি আমার তীক্ষ্ম, নাক চিবুক কপাল নিয়ে সুস্পষ্ট জোরালো আমার চেহারা। এপ্‌স্টাইন পাথরে আমার মূর্তি গড়তে চেয়েছিল, সময় দিতে পারি নি। কিন্তু বাঙালিকে আমি মায়ের খোকা বলে জানি, আর মায়েরা তাদের কোলের ধনকে মোমে-গড়া পুতুলের মতো দেখতেই ভালোবাসে। এ-সব কথা মনের মধ্যে ঘুলিয়ে উঠে আমাকে রাগিয়ে তুলছিল। আগেভাগেই কল্পনায় ঝগড়া করছিলুম অচিরার সঙ্গে, বলছিলুম, ‘তুমি যাকে বলো সুন্দর সে বিসর্জনের দেবতা, তোমাদের স্তব যদি বা পায় সে, টেঁকে না বেশিদিন।’ বলছিলুম, ‘আমি বড়ো বড়ো দেশের স্বয়ংবরসভার মালা উপেক্ষা করে এসেছি, আর তুমি আমাকে উপেক্ষা করবে?’ গায়ে প’ড়ে এই বানানো ঝগড়া এমনি ছেলেমানুষি যে, একদিন হেসে উঠেছি আপন উষ্মায়। এ দিকে বিজ্ঞানীর যুক্তি কাজ করছে ভিতরে ভিতরে। মনকে জানাই, এটাও একটা মস্ত কথা, আমার যাতায়াতের পথের ধারে ও বসে থাকে— একান্ত নিভৃতই যদি ওর প্রার্থনীয় হত, তা হলে ঠাঁই বদল করত। প্রথম প্রথম আমি ওকে আড়ে আড়ে দেখেছি, যেন দেখি নি এই ভান করে। ইদানীং মাঝে মাঝে স্পষ্ট চোখাচোখি হয়েছে— যতদূর আমার বিশ্বাস, সেটাতে চার চোখের অপঘাত বলে ওর মনে হয় নি।

এর চেয়েও বিশেষ একটা পরীক্ষা হয়ে গেছে। এর আগে দিনের বেলায় মাটিপাথরের কাজ সাঙ্গ করে দিনের শেষে ঐ পঞ্চবটীর পথ দিয়ে একবারমাত্র যেতেম বাসার দিকে। সম্প্রতি যাতায়াতের পুনরাবৃত্তি হতে আরম্ভ হয়েছে। এই ঘটনাটা যে জিয়লজি সম্পর্কিত নয়, সে কথা বোঝবার মতো বয়স হয়েছে অচিরার, আমারও সাহস ক্রমশ বেড়ে চলল যখন দেখলুম, এই সুস্পষ্ট ভাবের আভাসেও তরুণীকে স্থানচ্যুত করতে পারল না। এক-একদিন হঠাৎ পিছন ফিরে দেখেছি, অচিরা আমার তিরোগমনের দিকে চেয়ে আছে, আমি ফিরতেই তাড়াতাড়ি ডায়ারির দিকে চোখ নামিয়ে নিয়েছে। সন্দেহ হল, ওর ডায়ারি লেখার ধারায় আগেকার মতো বেগ নেই। আমার বিজ্ঞানী বুদ্ধিতে মনোরহস্যের আলোচনা জেগে উঠল।

বুঝেছি সে কোনো এক পুরুষের জন্যে তপস্যার ব্রত নিয়েছে, তার নাম ভবতোষ, সে ছাপরায় অ্যাসিস্টেন্ট ম্যাজেস্ট্রেটি করছে বিলেত থেকে ফিরে এসেই। তার পূর্বে দেশে থাকতে এদের দুজনের প্রণয় ছিল গভীর, কাজ নেবার মুখেই একটা আকস্মিক বিপ্লব ঘটেছে। ব্যাপারটা কী, খবর নিতে হবে। শক্ত হল না, কেননা পাটনা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার কেম‍্‍ব্রিজের সতীর্থ আছে বঙ্কিম।

ডাকে চিঠি লিখে পাঠালুম, ‘বেহার সিভিল সার্ভিসে আছে ভবতোষ। কন্যাকর্তাদের মহলে জনশ্রুতি শোনা যায়, লোকটি সৎপাত্র। আমার কোনো বন্ধু আমাকে তাঁর মেয়ের জন্যে ঐ লোকটিকে প্রাজাপতিক ফাঁদে ফেলতে সাহায্য করতে অনুরোধ করেছেন। রাস্তা পরিষ্কার আছে কি না, আদ্যন্ত খবর নিয়ে তুমি যদি আমাকে জানাও, কৃতজ্ঞ হব। লোকটির মতিগতি কী রকম তাও জানতে চাই।’

উত্তর এল, ‘রাস্তা বন্ধ। আর মতিগতি সম্বন্ধে এখনো যদি কৌতূহল বাকি থাকে, তবে শোনো।—’

‘কলেজে পড়বার সময় আমি ছাত্র ছিলুম ডাক্তার অনিলকুমার সরকারের— অ্যাল্‌ফাবেটের অনেকগুলি অক্ষর জোড়া তাঁর নাম। যেমন তাঁর অসাধারণ পাণ্ডিত্য, তেমনি ছেলেমানুষের মতো তাঁর সরলতা। একমাত্র সংসারের আলো তাঁর নাতনিটিকে যদি দেখো, তা হলে মনে হবে সাধনায় খুশি হয়ে সরস্বতী কেবল যে আবির্ভূত হয়েছেন তাঁর বুদ্ধিলোকে তা নয়, রূপ নিয়ে এসেছেন তাঁর কোলে। ঐ শয়তান ভবতোষ ঢুকল ওঁর স্বর্গলোকে। বুদ্ধি তার তীক্ষ্ম, বচন তার অনর্গল। প্রথমে ভুললেন অধ্যাপক, তার পরে ভুলল তাঁর নাতনি। ওদের অসহ্য অন্তরঙ্গতা দেখে আমাদের হাত নিস্‌‌‌‌‌‌‌‌‌‍‍‍পিস্ করত। কিছু বলবার পথ ছিল না, বিবাহসম্বন্ধ পাকাপাকি স্থির হয়ে গিয়েছিল, কেবল অপেক্ষা ছিল বিলেত গিয়ে সিভিল সার্ভিসে উত্তীর্ণ হয়ে আসার। তার পাথেয় আর খরচ জুগিয়েছেন অধ্যাপক। লোকটার সর্দির ধাত ছিল। বধির ভগবানের কাছে আমরা দুবেলা প্রার্থনা করেছি, বিবাহের পূর্বে লোকটা যেন ন্যুমোনিয়া হয়ে মরে। কিন্তু মরে নি। পাস করেছে। করেই ইণ্ডিয়া গবর্মেণ্টের উচ্চপদস্থ একজন মুরুব্বির মেয়েকে বিয়ে করেছে। লজ্জায় ক্ষোভে নিজের কাজ ছেড়ে দিয়ে মর্মাহত মেয়েটিকে নিয়ে অধ্যাপক কোথায় যে অন্তর্ধান করেছেন, তার খবর রেখে যান নি।’

চিঠিখানা পড়লুম। দৃঢ় সংকল্প করলুম, এই মেয়েটিকে তার লজ্জা থেকে অবসাদ থেকে উদ্ধার করব।

ইতিমধ্যে অচিরার সঙ্গে কোনোরকম করে একটা কথা আরম্ভ করবার জন্যে মন ছট্‌ফট্‌ করতে লাগল। যদি বিজ্ঞানী না হয়ে হতুম সাহিত্যরসিক, কিংবা বাঙাল না হয়ে যদি হতুম পশ্চিমবঙ্গের আধুনিক, তা হলে নিশ্চয় মুখে কথা বাধত না। কিন্তু বাঙালি মেয়েকে ভয় করি, চিনি নে ব’লে বোধ হয়। একটা ধারণা ছিল, হিন্দুনারী অজানা পরপুরুষমাত্রের কাছে একান্তই অনধিগম্য। খামকা কথা কইতে যাই যদি, তা হলে ওর রক্তে লাগবে অশুচিতা। সংস্কার জিনিসটা এমনি অন্ধ। এখানে কাজে যোগ দেবার পূর্বে কিছুদিন তো কলকাতায় কাটিয়ে এসেছি— আত্মীয়বন্ধুমহলে দেখে এলুম সিনেমামঞ্চপথবর্তিনী রঙমাখানো বাঙালি মেয়ে, যারা জাতবান্ধবী, তাদের— থাক্‌ তাদের কথা। কিন্তু অচিরার কোনো পরিচয় না পেয়েই মনে হল, ও আর-এক জাতের— এ কালের বাইরে আছে দাঁড়িয়ে নির্মল আত্মমর্যাদায়, স্পর্শভীরু মেয়ে। মনে-মনে কেবলই ভাবছি, প্রথম একটি কথা শুরু করব কী করে।

এই সময়ে কাছাকাছি দুই-একটা ডাকাতি হয়ে গিয়েছিল। মনে হল এই উপলক্ষে অচিরাকে বলি, ‘রাজাকে ব’লে আপনার জন্যে পাহারার বন্দোবস্ত করে দিই।’ ইংরেজ মেয়ে হলে হয়তো এই গায়েপড়া আনুকূল্যকে স্পর্ধা মনে করত, মাথা বাঁকিয়ে বলত, ‘সে ভাবনা আমার’; কিন্তু এই বাঙালির মেয়ে যে কী ভাবে কথাটা নেবে, আমার সে অভিজ্ঞতা নেই। দীর্ঘকাল বাংলার বাইরে থেকে আমার মনের অভ্যাস অনেকখানি জড়িয়ে গেছে বিলিতি সংস্কারে।

গল্পের চতুর্থ অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!