শেয়াল ও যাঁতাচালক

এটি একটি পুরনো গল্প, যার মধ্যে শেয়াল এবং যাঁতাচালকের মজার কাহিনী রয়েছে। গল্পটির মূল উদ্দেশ্য হলো কৌশল, বুদ্ধিমত্তা, এবং চালাকির মাধ্যমে একের পর এক সমস্যার সমাধান করা।

অনেক অনেক দিন আগের কথা। এক লোকের একটি যাঁতাকল ছিল। সবাই তাদের গম নিয়ে এসে যাঁতাকল চালককে দিত এবং যাঁতাকলের মালিক গমগুলো যাঁতায় পিষে আটা তৈরি করে দিত। তার পারিশ্রমিক ঐ আটা থেকেই নিত সে। যাঁতাচালক ঘরের এক কোণে তার পারিশ্রমিকের আটাগুলো জমাতো। কিন্তু অদ্ভুত ব্যাপার হলো, সকালে যখনই সে যাঁতাকলের কাছে আসতো, দেখতো আটার নামগন্ধও নেই। কলচালক মনে মনে বলতো, কী ব্যাপার! ঘরের দরোজা তো বন্ধই আছে, তাহলে আটা গেল কোথায়? আর তো কোনো পথও নেই। তাহলে আমার আটাগুলো নেয়টা কে?

যাঁতাচালক সিদ্ধান্ত নেয় কলঘরে রাতের বেলা থাকবে এবং ঘটনার রহস্য আবিষ্কার করবে। যেই কথা সেই কাজ। রাতে সে থেকে গেল এবং দেখলো যেদিক দিয়ে পানি আসে সেদিক দিয়ে একটি শেয়াল এসে সোজা আটার স্তুপে গিয়ে আটা খেতে শুরু করে দিল। একেবারে পেট ভরে খেলো। খেয়েদেয়ে যেটুকু আটা বাকি ছিল, সেটুকু গুটিয়ে নিয়ে চলে গেল। যাঁতাচালক মনে মনে বলল, আটা চোরের খোঁজ তাহলে পাওয়া গেল। বলা হয় না, “দশদিন চোরের, একদিন গৃহস্থের!” তাই ঘটলো। পরের রাতেই শেয়ালকে ধরে ফেললো। শেয়াল তো চিৎকার চ্যাঁচামেচি শুরু করে দিল। যাঁতাচালক বলল, কী পেয়েছিস, দুষ্টু শেয়াল! তোর চামড়া তুলে বাজারে বিক্রি করে আমার আটার ক্ষতিপূরণ করব।

শেয়াল চিৎকার করতে করতেই বলল, আমার কথাটা একটু শোন! ধরে নিলাম তুমি তাই করবে, আমার চামড়া বিক্রি করবে, কিন্তু তাতে কয় টাকাই বা হবে তোমার! বরং তুমি আমাকে ছেড়ে দাও, দেখো আমি তোমার জন্যে কী করি! অন্তত আমার চামড়ার চেয়ে ভালো কিছু তো অবশ্যই পাবে তুমি। যদি না পাও, তখন আমার চামড়া তুলে বিক্রি কর।

শেয়ালের কথা বিশ্বাস করে যাঁতাচালক ছেড়ে দিল তাকে। শেয়াল চলে গেল। কয়েকদিন পর সে ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়ের টুকরো, জুতোর ফিতা, লাগামের টুকরো ইত্যাদি জাতীয় আরো যা যা ছিল, সব এনে জমা করল যাঁতাঘরের এক কোণে। যাঁতাচালক এসব দেখে শেয়ালকে বলল, কী সব ছাইপাঁশ এনে জমাচ্ছো? শেয়াল বলল, তুমি চুপ কর!

এর বহুদিন পর ঐ শহরে বাইরে থেকে এক ব্যবসায়ী এল। শেয়াল তখন যাঁতাচালককে বলল, তুমি এই চার বস্তা আটা নিয়ে ব্যবসায়ীকে দিয়ে বলো এগুলো আমাদের এক শেয়াল মশাই তোমার জন্যে পাঠিয়েছে। আর বলেছে শাল, গাউন, হ্যাট এবং মখমলের কিছু রাজকীয় পোশাক তার জন্যে আনতে। গোঁ গোঁ করতে করতে যাঁতাচালক শেষ পর্যন্ত তাই করল। ব্যবসায়ী আটার বস্তাগুলো নিয়ে গেল আর কয়েকদিন পরেই শেয়ালের জন্যে জিনিসগুলো নিয়ে এল।

শেয়াল সেগুলো পরে রওনা দিল রাজপ্রাসাদের দিকে। শেয়াল প্রাসাদের দরজায় গিয়ে একটা বিশেষ চেইন বাজালো। এই বিশেষ শব্দটি রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাবের জন্যে বাজানো হয়। যাই হোক, প্রাসাদরক্ষীরা বাদশাকে গিয়ে বলল, একটা শেয়াল এসেছে রাজকন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। রাজা বলল, নিয়ে আসো তাকে। শেয়াল এল। রাজা জিজ্ঞেস করল, তুই আসলে কী চাস? শেয়াল বলল, আমার মালিক তোমার কন্যার প্রেমে পড়েছে। সে আমাকে পাঠিয়েছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। রাজা বলল, ঠিক আছে। কিন্তু আমি তো তোমার আরবাবকে দেখি নাই। শেয়াল বলল, আচ্ছা, আমি তাহলে নিয়ে আসি।

এই বলে শেয়াল চলে গেল। শেয়াল তার মনিবের নাম ঠিক করল ‘তুযালি বেগ।’ যাঁতাচালকের কাছে এসেই ডাকতে শুরু করল, তুযালি বেগ! এই তুযালি বেগ! চল! এই টুকরো কাপড় চোপড়গুলো নিয়ে চলো। আমরা বাদশার দরবারে যাব। যাঁতাচালক বলল, কাকে তুযালি বেগ ডাকছ! আমি কোথায় আর রাজপ্রাসাদ কোথায়…তোমার মাথা কি ঠিক আছে? শেয়াল বলল, কথা না বলে তাড়াতাড়ি চল!

যাঁতাচালক এবার তুযালি বেগ হয়ে সত্যি সত্যিই ছেঁড়াখোঁড়া কাপড়ের টুকরোগুলো নিয়ে প্রাসাদের দিকে চলল। পথে পড়লো বিরাট একটা নদী। শেয়াল কাপড়ের টুকরোগুলোসহ তুযালি বেগকেও নদীতে ফেলে দিল। যাঁতাচালক চিৎকার করতে করতে বলল, আমাকে বাঁচাও! তুই তো তোর ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করেছিস শেষ পর্যন্ত, এবার আমাকে বাঁচা। শেয়াল তুযালি বেগকে পানি থেকে উঠিয়ে কাঁদতে কাঁদতে দৌড়ে গেল প্রাসাদে। রাজা জিজ্ঞেস করল, কী হয়েছে?

শেয়াল বলল, কী আর হবে! চল্লিশটা কাফেলা তোমার জন্যে তোহফা নিয়ে আসছিল। একটা গাধার পা কেঁপে উঠলো আর নদীতে পড়ে গেল। ওর পেছনে বাকি গাধারাও পড়ে গেল নদীতে। আমার মনিব ঘোড়ায় চড়ে আসছিল সে পর্যন্ত নদীতে পড়ে ভিজে গেল। অনেক কষ্টে তাকে পানি থেকে উঠালাম ঠিকই কিন্তু উপহার সামগ্রীগুলো সব নদীতে পড়ে গেল। রাজা বলল, আমি বাদশা! চিন্তা করো না। আমার একটা পোশাক নিয়ে তোমার মনিবকে দাও। সেগুলো পরেই সে আসুক।

এই ফাঁকে বাদশা লোক পাঠালো প্রকৃত ঘটনা জানার জন্যে। তারা নদীতে কাপড়ের টুকরোগুলো দেখে ভাবলো ঘটনা ঠিক এবং সেটাই বাদশাকে বলল।

শেয়াল তার মনিবকে রাজপোশাক দিয়ে বলল, এই তুযালি বেগ! প্রাসাদে ঢুকে কিন্তু জোরে সালাম দেবে। তারপর গিয়ে বসবে বাদশার পাশে। বসে এদিক ওদিক সবার দিকে তাকাবে। ত

যতটা সুন্দর দেখাচ্ছে, ততটাই বাহাদুর মনে হবে! তুযালি বেগ পোশাক পরে রওনা হলো প্রাসাদের দিকে। প্রাসাদে ঢুকতেই সে শেয়ালের পরামর্শ ভুলে গেল। প্রাসাদের মাঝখানে দাঁড়িয়ে চারদিকে ওপরে নীচে সব দেখতে লাগলো। বাদশা শেয়ালকে বলল, কী খবর! তোমার মনিব এতো সূক্ষ্মভাবে সবকিছু দেখছে, যেন এর আগে আর কখনো এসব দেখেনি। শেয়াল বলল, আসলে ব্যাপারটা তা না, তুযালি বেগ আপনার পুরোনো পোশাক পরেছে কী না, সেজন্যে, সঙ্কোচবোধ করছে। বাদশা সাথে সাথে বেগের জন্যে নতুন পোশাক বানানোর আদেশ দিল এবং তাদের থাকার ব্যবস্থা করতে বলল।

শেয়াল আর তার আরবাব ভালোভাবেই কদিন কাটালো প্রাসাদে। একদিন সে বাদশাকে বলল, আমরা তো জনাব এখানে থাকা খাওয়ার জন্যে আসি নি, এসেছি তোমার কন্যার বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে। এখন বিয়ে দিলে বলো, নৈলে আমরা চলে যাই। পথে আমার মনিবের প্রচুর মাল-সামানা রেখে এসেছি, জানিনা সেগুলোর কী অবস্থা। বাদশা অনেক চিন্তাভাবনা করে শেষ পর্যন্ত বিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিল। বিয়েও হয়ে গেল। বাদশা চল্লিশজন গোলাম, চল্লিশজন চাকরানী, চল্লিশটা উট, চল্লিশটা গাধা এবং চল্লিশটা ঘোড়ার পিঠ ভর্তি উপঢৌকন দিল কন্যার সাথে। এগুলো নিয়ে তো তুযালি বেগ পড়েছে বিপাকে। কোথায় নিয়ে রাখবে এসব। রাজকন্যাকেই বা কোথায় নিয়ে উঠাবে।

শেয়াল বলল, তুমি ভেব না। তুমি পুরো কাফেলা নিয়ে অমুক জায়গা আসো। আমি গেলাম। এই বলেই শেয়াল চলে গেল পাহাড়ের উঁচুতে চমৎকার একটি প্রাসাদে। সেখানে ছিল সাতটি বিশাল হাতি। শেয়াল হাতিদেরকে গিয়ে বলল, নীচের দিকে তাকাও! দেখছ না ধুলো উড়ছে? হাতীরা বলল; হ্যা! তাইতো। শেয়াল বলল, রাজকন্যার কঠিন এক অসুখ হয়েছে। ডাক্তার বলেছে কন্যার সারা শরীরে হাতীর তেল মাখতে হবে। সে কারণেই তারা এদিকে আসছে তোমাদের তেল বের করার জন্যে। হাতীরা একথা শুনেই ধড়মড় করে প্রাসাদ ছেড়ে পালিয়ে গেল।

শেয়াল প্রাসাদটাকে সুন্দর করে সাজাল। ততক্ষণে ত

তুযালি বেগ তার স্ত্রীসহ প্রাসাদে এসে হাজির হলো। প্রাসাদের চারদিকে তাকিয়ে বলল, এটা তো দেখছি বাদশার প্রাসাদের চেয়েও সুন্দর। এই সুন্দর প্রাসাদেই তারা জীবন যাপন করতে লাগল।

এভাবে শেয়াল তার মনিবকে রাজবাড়ির ভিতরে প্রতিষ্ঠিত করতে সফল হলো। তার চাতুরি এবং কৌশলগুলোর মাধ্যমে যাঁতাচালক তুযালি বেগ এক রাজপরিবারের অংশ হয়ে গেল। রাজকন্যার সাথে বিয়ের মাধ্যমে শেয়াল তার দুষ্টুমিতে জয়ী হলো এবং তাদের জীবন এক নতুন ধাপে প্রবাহিত হলো।

এ গল্পটি আমাদের শেখায়, কখনো কখনো ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা এবং কৌশল প্রয়োগ করে কঠিন পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা যায়। শেয়ালের এই গল্পে তার তত্পরতা, দুষ্টুমী এবং বুদ্ধিমত্তা তাকে সফলতা এনে দেয়।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *