শহীদের শেষ চিঠি
গাজী আনোয়ার পাশা তুর্কি উচু স্তরের বীর মুজাহিদ। সারাটি জীবন তিনি ইসলামের শত্রুদের বিরুদ্ধে জিহাদে কাটিয়েছেন। অবশেষে বলশোভিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত অবস্থায় শাহাদাতের অমীয় সুধা পান করেছেন। তার প্রিয় স্ত্রী ছিলেন শাহজাদী নাজীয়া সুলতানা। শাহাদাতের মাত্র এক দিন পূর্বে তিনি প্রাণপ্রিয় স্ত্রীর নিকট ঐতিহাসিক চিঠি লিখেন। শাহাজাদী তুর্কি সংবাদপত্রে সে চিঠিটা প্রকাশ ও প্রচার করেন। সেখান থেকে অমুনতি হয়ে ২০শে এপ্রিল ১৯২৩ ইং সালে ভারতীয় পত্র-পত্রিকায় ছাপা হয়। চিঠিটা খুবই গুরত্বপূর্ণ। তিনি লিখেছেন-
আমার জীবন সঙ্গিনী, আয়েশ আনন্দের মূলধন প্রিয় নাজিয়া! আল্লাহ তায়ালা তোমার রক্ষক। তোমার সর্বশেষ চিঠি এই মুহূর্তে আমার সামনে। দৃঢ় বিশ্বাস রেখ, তোমার এই পত্র সর্বদা আমার বুকের উপর থাকবে। তোমার রূপ আমি দেখতে পারছি না, কিন্তু দেখছি তোমার গুণাবলী, চিঠির ছত্রে ছত্রে এবং অক্ষরগুলোতে তোমার আঙ্গুল ও নড়াচড়া করছে, যে আঙ্গুলগুলো কখনও কখনও আমার চুল নিয়ে খেলা করতো। তাবুর এই অন্ধকারে তোমার চিত্র কখনও কখনও আমার নজরে ভেসে আসে। আহ! তুমি লিখেছ, আমি তোমায় ভুলে গেছি। তোমার নজরে আমি বহু দূর-দূরন্তে আগুন আর খুন নিয়ে খেলছি। সামান্যও আমি পরওয়া করছি না যে, একটি মেয়ে আমার বিচ্ছেদে রাতভর অনিদ্রায় তারকা গুনছে।
তুমি বলেছ, “ যুদ্ধের সাথে আমার প্রেম, তলোয়ারের সাথে আমার ভালবাসা”। এসব লেখার সময় তুমি মোটেও ভাবনি যে, তোমার এই শব্দগুলি যেগুলো প্রকৃত প্রেমই লিখতে বাধ্য করেছে। আমার মনকে কিভাবে খুন করে ফেলব, আমি কিভাবে তোমাকে প্রত্যয় এনে দিতে পারি যে, দুনিয়াতে তোমার চেয়ে প্রিয় আর কেউ নেই। আমার সমস্ত ভালোবাসার কেন্দ্রস্থল তুমিই। আমি কখনও কারো সাথে প্রেম করিনি। একমাত্র তোমার সাথে ভালবাসার সম্পর্ক কায়েম করেছি। এই প্রেম আমার মন কেড়ে নিয়েছে, তা সত্বে ও আমি তোমার হতে বিচ্ছিন্ন কেন? এই প্রশ্ন তুমি যথাযথভাবে করতে পার।
শোন! আমি তোমার হতে এই জন্য বিচ্ছিন্ন হইনি যে, আমি ধন সম্পদের লোভী। এই জন্য পৃথক হইনি যে, আল্লাহ তায়ালা আমার উপর জিহাদ ফরজ করেছেন, এই দায়িত্ব আমাকে এখানে টেনে এনেছে। জিহাদ ফী সাবীলিল্লাহর চাইতে বড় কোন ফরজ নেই। এই ফরজ আদায়-ই মানুষকে জান্নাতুল ফিরদাউসের যোগ্য বানিয়ে দেয়।
আলহামদুলিল্লাহ! আমি সে ফরজ আদায়ের শুধু নিয়ত নয় বরং বাস্তবে আঞ্জাম দিচ্ছি। তোমার বিরহ বেদনা আমার অন্তরে প্রতিটি মুহূর্তে করাত চালায়। তবে বিচ্ছেদে আমি অত্যন্ত আনন্দিত। কারণ, তোমার ভালোবাসাই একমাত্র বস্তু যা আমার দৃঢ় সংকল্পের সম্মুখে সবচেয়ে বড় পরীক্ষার কারণ হতে পারে। আল্লাহ তায়ালার হাজারও শোকর, আমি এই কঠিন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ। আল্লাহর প্রেম ও তাঁর হুকুমকে নিজস্ব প্রেম ও স্বীয় সত্তার উপর প্রাধান্য দিয়েছি। এ ব্যাপারে আমি সফল। তোমরাও আনন্দিত হওয়া উচিত, আল্লাহ তায়ালার শুকরিয়া আদায় করা উচিত।
তোমার স্বামী এত মজবুত ঈমানের অধিকারী যে, আল্লাহর মুহাব্বাতের উপর তোমার প্রেম ভালবাসাকে কুরবান করতে পারে। তোমাদের উপর সশস্ত্র জিহাদ ফরজ নয়। তবে তোমরাও জিহাদের ফরজ থেকে ব্যতিক্রম নও। নর হোক কিংবা নারী; কোন মুসলমানই জিহাদের হুকুমের বাহিরে নয়। তোমার জিহাদ হল ব্যক্তি স্বার্থ ও নিজস্ব প্রেম ত্যাগ বা আপন স্বামীর সাথে প্রকৃত ভালোবাসা প্রাধান্য দেয়া, আপন স্বামীর সাথে প্রকৃত ভালোবাসার সম্পর্ক আরো সুদৃঢ় করা। দেখ, কখন এ দোয়া কর না, যেন তোমার স্বামী জিহাদ থেকে সহীহ সালামতে কোন মতে ফিরে তোমার প্রেমের আশ্রয় নিতে পারে। এই দোয়া ব্যক্তিস্বার্থ কেন্দ্রিক। এটা আল্লাহ তায়ালার নিকট পছন্দনীয় নয়। তুমি দোয়া কর আল্লাহ তায়ালা যেন তোমার স্বামীর জিহাদকে কবুল করে নেন। তাঁকে সফলতার সাথে ফিরিয়ে আনেন অথবা শাহাদাতের পেয়ালা তাঁর মুখে নসীব করেন, মনে রেখ, এই ঠোঁট কখনও শরাব স্পর্শ করে অপবিত্র হয়নি, বরং সর্বদা তেলোয়াত ও যিকরে এলাহিতে সোচ্চার ছিল।
আহ! সে মুহূর্তটি কতই না মুবারক, যখন আল্লাহর রাহে সে মস্তকটি দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে, যে মস্তকটিকে তুমি রূপসী বলে আখ্যায়িত করতে। আনোয়ারের সব চেয়ে বড় আকাঙ্ক্ষা, সে যেন শহীদ হতে পারে, খালেদ বিন ওয়ালীদের সাথে যেন তাঁর হাশর হয়। দুনিয়া কয়েক দিনের। এটি ক্ষণস্থায়ী। মৃত্যু নিশ্চিত। তাহলে মৃত্যুর আবার ভয় কিসের? মৃত্যু যখন অবশ্যম্ভাবী, তাহলে বিছানায় গিয়ে মরবো কেন? শাহাদাতের মউত মৃত্যু নয়, অনন্ত জীবন। নাজীয়া! আমার ওসিয়ত শুনে নাও। আমি যদি শহীদ হয়ে যাই, তাহলে আমার ভাই নূরী পাশার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে যাবে। তোমার পর নূরীই আমার সবচেয়ে প্রিয়, আমি চাই আমার পরকাল সফরের পর সে যেন জীবন ভর তোমার সেবা করে যায়। আমার দ্বিতীয় ওসিয়ত হলো, তোমার যতগুলো সন্তান হবে, সবাইকে আমার জীবন সম্পর্কে অবহিত করবে। তাদের সবাইকে ইসলাম ও দেশের সেবার উদ্দেশ্যে ময়দানে রণাঙ্গনে পাঠাবে। তুমি যদি তা না কর, তাহলে জান্নাতে আমি তোমার প্রতি রুষ্ট হবো। তৃতীয় ওসিয়ত হল, তুমি সর্বদা মোস্তফা কামাল পাশার শুভ কামনা করবে, সর্বপ্রকার সম্ভাব্য সহযোগিতা তাঁর করবে। কারণ, বর্তমানে দেশের মুক্তি আল্লাহ তায়ালা তাঁর হাতে রেখেছেন। (মোস্তফা কামাল এ চিঠি লেখার সময় একজন মুজাহিদ ছিলেন, ইসলাম বিরোধী কোন পদক্ষেপই এ পর্যন্ত তিনি নেননি,) পরবর্তীতে যা নিয়েছিলেন।
প্রিয়তমা!
এখানেই ইতি টানছি। জানি না আমার কেন মনে হয়, এই চিঠির পর আর কখনও তোমার নিকট পত্র লিখতে পারবো না। বিচিত্র কিছু নয় যে, আগামীকালই আমি শহীদ হয়ে যাব। দেখ, ধৈর্যধারণ করবে। আমার শাহাদাতে পেরেশান না হয়ে আনন্দিত হবে। কারণ, আল্লাহর পথে শাহাদাত তোমার গর্বের বিষয়।
নাজীয়া! এবার ইতি! কল্পনার জগতে তোমার গলা জড়িয়ে আলিঙ্গন করছি। ইনশাআল্লাহ, জান্নাতে একত্রিত হবো। আর কখনো বিচ্ছিন্ন হবে না তোমার আনোয়ার। (তুরাকানে আহবারঃ আঃ মজিদ আতিকি, ১২৭-১৩০) শাহাদাতের পর তাঁকে তাঁর স্ত্রী জান্নাতের হুর গেলমানের মাঝে আনন্দিত অবস্থায় দেখেছিল। শহীদ মৃত নয়।