রংধনু আসরের কাছের ও দূরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, কেমন আছো তোমরা? আশা করি যে যেখানে আছো ভালো ও সুস্থ আছো। তোমরা নিশ্চয়ই ‘লোভে পাপ, পাপে মৃত্যু’ এবং অতি লোভে তাঁতি নষ্ট- এই প্রবাদ দুটি শুনেছো। এই প্রবাদ দুটির মধ্যে লোভের ফল ও এর পরিণতির কথা উল্লেখ করা হয়েছে। তারপরও অনেক মানুষ লোভ-লালসার কাছে নিজেকে বন্দি করে ফেলে। একজন লোভী ব্যক্তি সমাজের জন্য দুঃখ-কষ্টের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। আর এ কারণেই রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তোমরা লোভ থেকে বিরত থাকো, কারণ তোমাদের পূর্ববর্তীদের অনেকেই লোভের কারণে ধ্বংস হয়েছে। রাসূলেখোদা আরো বলেছেন, একজন লোভী ব্যক্তি সাত ধরনের জটিল সমস্যার মুখোমুখি হয়।
সমস্যাগুলো হলো- ১. দুশ্চিন্তাগ্রস্ততা- যা তার দেহের ক্ষতি করে এবং জীবনের জন্যও ক্ষতিকর। ২. বিষণ্নতা- যার শেষ নেই। ৩. ক্লান্তি- যা থেকে মৃত্যুই একমাত্র পরিত্রাণ এবং ওই পরিত্রাণের সঙ্গে সঙ্গে লোভীরা আরও বেশি ক্লান্তিতে পৌঁছে যায়। ৪. ভীতি- যা অহেতুক তার জীবনে অশান্তি সৃষ্টি করে ৫ দুঃখ- যা বিনা প্রয়োজনে তার জীবনে বিশৃঙ্খলা ঘটায় ৬. বিচার- যা আল্লাহর শাস্তি থেকে তাকে রক্ষা করবে না যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহ তাকে ক্ষমা না করেন। এবং ৭. শাস্তি- যা হতে পরিত্রাণ পাওয়ার কোনো উপায় নেই। বন্ধুরা, দেখলে তো লোভের পরিণতি কত্তো ভয়াবহ!। সম্ভবতা এসব কারণেই আমিরুল মুমেনিন হযরত আলী (আ) বলেছেন, লোভ পরিহার কর। কেননা লোভী ব্যক্তি অপমানের হাতে বন্দী। তার এ বন্দীদশা কখনও শেষ হবে না।
তিনি আরো বলেন, লোভ আত্মাকে অপবিত্র করে, ধর্মকে দুর্নীতিগ্রস্ত করে এবং যৌবনকে ধ্বংস করে। অন্যদিকে, ইমাম বাকের (আ.) লোভী ব্যক্তি সম্পর্কে বলেছেন, দুনিয়ার লোভী লোকের উদাহরণ রেশম গুটির মতো। সে যতই তার চারিদিকে রেশম সুতা জড়াতে থাকে ততই নিজে বন্দি হয়ে পড়ে এবং এভাবেই তার মৃত্যু ঘটে। বন্ধুরা! আজকের আসরে লোভ-লালসা সম্পর্কে আমরা দুটি গল্প প্রচার করা হয়েছে। আর গল্প শেষে আছে একটি গান। ১. এক ব্যবসায়ী দুটি গরু নিয়ে ব্যবসার উদ্দেশ্যে রওনা হলো। পথিমধ্যে গরু দুটি একটা কাদার গর্তে পড়ে গিয়ে মরে গেল আর অন্যটা ভীষণভাবে আহত হলো। ব্যবসায়ীও তাকে ফেলে রেখে চলে গেল। আহত গরুটা অনেক চেষ্টা করে ওই কাদার গর্ত থেকে উঠে এল। কাছেই ছিল তৃণবহুল চমৎকার একটা এলাকা।
গরুটা সেখানে গিয়ে আশ্রয় নিল। কয়েকদিনের মধ্যে সে সুস্থ হয়ে গেল। সবুজ এবং তরতাজা ঘাস লতাপাতা খেয়ে বেশ নাদুসনুদুস হয়ে উঠল এবং উচ্চস্বরে ‘হাম্বা’ ডাকতে শুরু করল। সবুজ তৃণবহুল এলাকাটি ছিল একটা সিংহের বিচরণ ক্ষেত্র। সিংহ মানে ওই অঞ্চলের সকল প্রাণীর নেতা। পশু সিংহ এর আগে কখনোই তার বিচরণ ভূমিতে ‘হাম্বা’ ডাক শোনে নি। সে জন্য এই শব্দ শুনে সিংহের মনে ভয় ঢুকে গেল। কিন্তু কিছুই সে প্রকাশ করল না। সিংহের দরবারে দুটি শেয়াল বাস করত। একটির নাম কালিলা অপরটির নাম ছিল দিমনা। দিমনা ছিল বেশ লোভী এবং সুযোগ সন্ধানী। সে সারাক্ষণ সিংহের পাশে থাকতে চাইত এবং চাইত সিংহের উপদেষ্টার পদটি পেতে। সিংহ যে গরুর হাম্বা রব শুনে ভয় পেয়েছে এই শেয়ালটি মানে দিমনা তা টের পেয়ে গেল। দিমনা গরুর শব্দ শুনে বেরিয়ে গিয়ে গরুকেও দেখতে পেল। সে গরুর সাথে আলাপ আলোচনা জমিয়ে তাকে বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করল। বন্ধু বানানোর পর দিমনা গরুকে নিয়ে সিংহের দরবারে হাজির হল।
সিংহের ভয় এবং আতঙ্ককে কাজে লাগিয়ে শেয়াল সিংহের কাছে যাবার সুযোগ পেয়ে গেল। দিমনা সিংহের ভয়ের কারণ জানতে চাইল। তারপর বলল এই সেই গরু যে নতুন এসেছে এই তৃণভূমিতে। ওর হাম্বা ডাক শুনেই তুমি ভয় পেয়েছিলে। তাই ওকে তোমার কাছে নিয়ে এলাম। গরুকে সিংহের ভালোই লাগল। সিংহ তাকে কাছে টেনে নিল এবং ধীরে ধীরে বিভিন্ন বিষয়ে তার সাথে পরামর্শ করে কাজ করতে লাগল। কিন্তু এ বিষয়টা দিমনার মোটেই ভালো লাগল না। সহ্য হচ্ছিল না তার। হিংসা জেগে উঠল তার মনের গহীনে। কারণটা হলো সে ভাবত গরু বুঝি তার স্থানটা দখল করে নিল। তাই সে ভেতরে ভেতরে গরুকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্রে মেতে উঠল। কিন্তু কী করে তা সম্ভব! শেয়াল অবশেষে সিদ্ধান্ত নিল কথায় বার্তায় সিংহের কাছে গরুকে অসহ্য করে তুলবে। গরুর বিরুদ্ধে এভাবে মারাত্মক ষড়যন্ত্র শুরু করে দিল শেয়াল দিমনা। কিন্তু শেয়াল দিমনা কী বলবে তার বিরুদ্ধে।
কিছুই তো বলার মতো খুঁজে পাচ্ছে না। অবশেষে শেয়াল মিথ্যা অপবাদ দিতে শুরু করল গরুর বিরুদ্ধে। প্রায়ই সিংহের কাছে বানিয়ে বানিয়ে গরুর বিরুদ্ধে নালিশ করতে লাগল, অভিযোগ করতে লাগল। মিথ্যা অভিযোগ করতে করতে এক সময় শেয়াল একেবারে প্রকাশ্যে এমনকি অনেক সময় গরুর সামনেই সিংহের কাছে তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তুলতে শুরু করে দিল। সিংহের কান ভারি হতে হতে একেবারে সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে গেল। সিংহের মনের ভেতর গরুর ব্যাপারে এক ধরনের নেতিবাচক চিন্তা জন্ম নিল। সিংহ এতই অসহ্য হয়ে পড়ল যে, একদিন সত্যি সত্যিই গরুকে মেরে ফেলল। দিমনা তো ষড়যন্ত্র করে গরুটাকে মেরে ফেলল। কিন্তু দিমনার বন্ধু কালিলা শুরু থেকেই দিমনার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে জানত। সে কোনোভাবেই মেনে নিতে পারছিল না। দিমনার এ রকম হিংসাত্মক কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করছিল সে কিন্তু দিমনা সেসব কানেই তুলতো না।
এদিকে, নিরীহ গরুটাকে মেরে সিংহ খুব অনুতাপ বোধ করল। খুবই খারাপ লাগছিল তার। কিন্তু দিমনা চেষ্টা করছিল সিংহকে বোঝাতে যে, সে যা করেছে ভুল করে নি ঠিকই করেছে। সিংহকে তার অনুতপ্ত অবস্থা থেকে বের করে আনার চেষ্টা করলো দিমনা। কালিলা তার বন্ধু দিমনার শত্রুতামূলক কাজকর্মের জন্যে ভীষণ ক্ষুব্ধ ছিল এবং দিমনাকে প্রায়ই তিরস্কার করত। সিংহকে গরুর বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তোলা এবং গরুর বিরুদ্ধে ফেতনা ফ্যাসাদ সৃষ্টিকারী কথা লাগানোর কারণে একদিন যে তাকে শাস্তি ভোগ করতে হবে- সে ব্যাপারেও দিমনাকে সবসময় বলত কালিলা। এক রাতে এইসব কথা বলাবলি করছিল কালিলা আর দিমনা। ঘটনাক্রমে ওইরাতে একটা চিতাবাঘ কালিলা আর দিমনার কথাবার্তা ভালো করে শুনে ফেলল। তাড়াতাড়ি করে চিতাবাঘ সেইসব কথা সিংহের মায়ের কাছে গিয়ে বলে দিল।
সিংহের মা তো চিতাবাঘের কথা শুনে একেবারে তেলেবেগুনে ক্ষেপে গেল। সে অন্যায় একদম সহ্য করতে পারত না। গরুর ওপর যে অন্যায় করা হয়েছে সেটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছিল না সিংহের মা। দেরি না করে সে তাই তার ছেলে সিংহের কাছে গেল। সিংহ তার মাকে দেখে খুশি হলো কিন্তু মায়ের চেহারায় বিষণ্ণতার ছাপ দেখে জানতে চাইলো ‘কী হয়েছে’। সিংহের মা তখন সমস্ত ঘটনা ছেলের কাছে খুলে বলল। সিংহ প্রকৃত ঘটনা শুনে যারপরনাই উত্তেজিত হয়ে উঠল। মাও তাকে বলল এই ষড়যন্ত্রের প্রতিশোধ অবশ্যই নিতে হবে, শেয়াল দিমনাকে যথাযথ শাস্তি দিতে হবে। এমন শাস্তি দিতে হবে যাতে আর কেউ কখনো এ রকম ষড়যন্ত্র করার সাহস না পায়। গরুর রক্তমূল্য নিতেই হবে-এরকম কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে মা সিংহকে উদ্বুদ্ধ করল।
সিংহ উপায়ন্তর না দেখে একটা পরামর্শ বৈঠকের আয়োজন করলো। তার পরামর্শরা, দরবারের সভাসদরা, উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা- সকলেই ওই বিশেষ বৈঠকে উপস্থিত হলো। দিমনার বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উত্থাপিত হলো সেইসব অভিযোগের পক্ষে যথাযথ দলিল প্রমাণও হাজির করা হল। চারদিক থেকে যখন দিমনার বিরুদ্ধে একের পর এক তার অন্যায়ের প্রমাণাদি পেশ করা হলো, পশুরাজ সিংহ তখন বাধ্য হলো দিমনার বিরুদ্ধে মৃত্যুদণ্ডের আদেশ দিতে। দিমনার মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণার পর কালিলা একবার দিমনার দিকে তাকাল। মনে মনে বলল আগেই বলেছিলাম এসব করো না। পাপের শাস্তি একদিন না একদিন ভোগ করতেই হবে, শুনলে না। দিমনাও কালিলার দিকে অপলক চোখে তাকিয়ে থেকে মনে মনে কালিলার কথায় সায় দিল। অবশেষে দিমনার মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হলো।
কিন্তু তাতে কী হবে- গরু তো আর ফিরে পেল না তার প্রাণ। —– ২. অনেক দিন আগের কথা। একটি ছোট গ্রামে বাস করত এক বৃদ্ধ চাষী। তার ছিল কিছু কৃষি জমি। এ জমিতে সে গমের চাষ করত এবং গম থেকে তৈরি রুটি খেয়ে জীবনধারণ করত। প্রতিবছর তার জমিতে প্রচুর গম হতো। কৃষক তার উৎপাদিত গম বড় বড় বস্তায় ভরে ঘরের এক কোনায় রেখে দিত। একদিন দুটি ইঁদুর এই গম দেখতে পেল এবং সঙ্গে সঙ্গেই তারা একটা পরিকল্পনা আঁটলো। তারা ঘরের দেয়ালে একটি গর্ত করল। কৃষক বাইরে চলে গেলেই ইঁদুর দুটি গর্ত থেকে বেরিয়ে আসত এবং বস্তা ছিদ্র করে গম বের করে নিজেদের গর্তে নিয়ে যেত। এভাবে দিন যেতে থাকল এবং একসময় অনেক গম তাদের গর্তে জমা হলো। একদিন এক ইঁদুর অপর ইঁদুরকে বলল : ‘শোনো বন্ধু! আমরা অনেক গম জমা করেছি।
কৃষক জানার আগেই আমাদের গম নেয়া বন্ধ করা উচিত। আর তা না হলে আমরা বিপদে পড়ে যেতে পারি।’ দ্বিতীয় ইঁদুরটি বলল : ‘তুমি এসব কি বলছ? আমরা কখনো এমন সুযোগ আর পাব না। কৃষক জানার আগেই চল আমরা আরো গম মজুত করি। ভয় পাওয়ার কিছু নেই।’ প্রথম ইঁদুরটি বলল : ‘আমি আর তোমার সঙ্গে আসতে চাই না। কারণ, আমি আমার জীবনকে বিপদের মুখে ঠেলে দিতে চাই না।’ জবাবে দ্বিতীয় ইঁদুর বলল : ‘তুমি আস্ত একটা ভীতু। আগামীকাল থেকে আমি একাই এখানে আসব এবং গম নিয়ে গর্ত ভর্তি করব। তোমার মতো একজন ভীতু বন্ধুর আমার প্রয়োজন নেই।’ পরের দিন থেকে লোভী ইঁদুরটি তার নিজের জন্য আরো গম সংগ্রহ শুরু করল।
একদিন কৃষক মনে মনে সিদ্ধান্ত নিল যে, তার গমের বস্তাগুলো পরীক্ষা করে দেখবে। গমের বস্তার কাছে গিয়ে কৃষক দেখতে পেল সবগুলো বস্তাতেই শুধু ছিদ্র আর ছিদ্র। এতে তার খুব রাগ হলো। সে ইঁদুর ধরার জন্য একটি ফাঁদ বস্তার কাছে পেতে রাখল। লোভী ইঁদুরটি যখন গম নিতে বস্তার কাছে এল অমনি সেই ফাঁদে আটকা পড়ে গেল। তারপর কৃষকের হাতে জীবন গেল লোভী ইঁদুরের।