লেডি এভলিন কোববল্ড
লেডি এভলিন কোববল্ড (জন্মগত নাম মারে; ১৭ জুলাই ১৮৬৭ – ২৫ জানুয়ারি ১৯৬৩):
যিনি জয়নাব কোববল্ড নামেও পরিচিত ছিলেন । লেডি এভলিন কোববল্ড ছিলেন একজন ব্রিটিশ অভিজাত, ভ্রমণকারী এবং ইসলামের প্রতি আকৃষ্ট প্রথম ব্রিটিশ মহিলা, যিনি ১৯৩৩ সালে হজ পালন করেন। তিনি ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৮৬৭ সালে স্কটল্যান্ডে জন্মগ্রহণ করেন। লেডি এভলিনের ইসলাম গ্রহণ এবং তার হজ যাত্রা ব্রিটিশ সমাজে একসময় বিশেষ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। কোববল্ড তার শৈশবের একটি বড় অংশ আলজিয়ার্স এবং কায়রোতে মুসলিম নার্সদের সঙ্গে কাটিয়েছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি নিজেকে মুসলিম হিসেবে মনে করতেন, যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেননি, যতক্ষণ না তিনি পোপের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি মেফেয়ারের একজন অভিজাত সমাজের সদস্য হয়ে ওঠেন। তার শৈশবের শীতকাল উত্তর আফ্রিকায় কাটত, যেখানে তার ইসলামের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়।
ইসলাম গ্রহণ:
লেডি এভলিন ১৯১১ সালে তার আমেরিকান বন্ধু ফ্রান্সেস গর্ডন অ্যালেকজান্ডারের সাথে লিবিয়ান মরুভূমিতে একটি যাত্রা শুরু করেন। তারা ১৯১২ সালে সেই যাত্রার একটি যৌথ বিবরণ প্রকাশ করেন, যার নাম “ওয়ে ফেয়ারার্স ইন দ্য লিবিয়ান ডেজার্ট”। এই যাত্রা তাকে ইসলামের প্রতি আরও গভীর আগ্রহী করে তোলে। তিনি ১৯১৫ সালে ইসলাম গ্রহণ নিশ্চিত করেন এবং আরবি নাম “জয়নাব’’ ধারণ করেন। তিনি মন্তব্য করেন যে, তিনি ইসলামের ধর্মকে মনে করেন “বিশ্বের বহু জটিল সমস্যা সমাধানের জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত এবং মানবজাতির জন্য শান্তি ও সুখ বয়ে আনার ক্ষমতা রাখে।“
মক্কায় হজ:
“Pilgrimage to Mecca” হল লেডি এভলিন কোববল্ডের একটি বিখ্যাত বই, যেখানে তিনি ১৯৩৩ সালে পবিত্র মক্কায় হজ পালনের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। এই বইটি ইসলামের পবিত্র স্থান এবং হজের বিভিন্ন প্রক্রিয়া সম্পর্কে একটি বিস্তারিত বিবরণ প্রদান করে।
লেডি এভলিনের প্রথম স্বামীর মৃত্যু ১৯২৯ সালে হওয়ার পর, তিনি মক্কায় হজ পালনের পরিকল্পনা করতে শুরু করেন। তিনি হাফিজ ওয়াহবা, হিজাজ ও নেইজদের যুক্তরাজ্যে রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যোগাযোগ করেন, যিনি পরে কিং আবদ আল-আজিজের কাছে একটি চিঠি পাঠান।১৯৩৩ সালে, ৬৫ বছর বয়সে, লেডি এভলিন প্রথম মুসলিম মহিলা হিসেবে পরিচিতি পান, যিনি যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করে মক্কায় হজ পালন করেন। ১৯৩৪ সালে, তার ভ্রমণের একটি ব্যক্তিগত বিবরণ প্রকাশিত হয়, যার শিরোনাম “মক্কায় হজ”। মাইকেল ওল্ফের বই “ওয়ান থাউজ্যান্ড রোডস টু মেক্কা”-তে তার কাজের একটি অংশও অন্তর্ভুক্ত রয়েছে।তিনি একজন বন্ধুর সঙ্গে ইতালি সফর করেন এবং পোপের সঙ্গে দেখা করেন, যিনি তাকে জিজ্ঞাসা করেন, তিনি কি ক্যাথলিক। যদিও তিনি বহু বছর ইসলাম নিয়ে ভাবেননি, তবুও তিনি উত্তর দেন যে, তিনি মুসলিম। এরপর তিনি ইসলাম সম্পর্কে আরও জানার সিদ্ধান্ত নেন এবং অবশেষে ধর্মান্তরিত হন।১৯৩৩ সালে, তিনি প্রথমবারের মতো হজ পালনের জন্য সফর করেন। কারণ তার আগে ইউরোপীয়রা যারা মুসলিম ছিলেন না, তারা সৌদি আরবে প্রবেশ করে মক্কায় হজ পালন করেছিলেন এবং ইউরোপে ফিরে এসে তাদের সাহসী অভিযানের বিষয়ে লিখেছিলেন। এই কারণে ইউরোপীয়দের জন্য কিছু বিধিনিষেধ ছিল, তবে লেডি এভলিন, যিনি জয়নাব নাম গ্রহণ করেন, তাকে হজ পালনের অনুমতি দেওয়া হয়।
ডায়রি:
এটি তার ডায়রিতে কাবার প্রথম দর্শনের সময়ের বর্ণনা:
“আমরা মসৃণ মার্বেলে পা ফেলছি পবিত্র স্থানের দিকে, আল্লাহর ঘর, সেই মহান কালো ঘনক, যা সহজ মর্যাদায় উঁচু হয়ে আছে, যেটি লক্ষ লক্ষ মানুষের জীবন উৎসর্গের লক্ষ্য এবং তার চেয়ে অনেক বেশি মানুষ যে এটি দেখে স্বর্গ পেয়েছে… ‘তাওয়াফ’ একটি প্রতীক, কবির ভাষায় বলতে গেলে, একটি প্রেমিকের প্রেমিকার বাড়ির চারপাশে ঘুরে বেড়ানোর প্রতীক, সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণ করে এবং প্রিয়জনের জন্য সকল স্বার্থ ত্যাগ করে। এটি সেই আত্মসমর্পণের আত্মায় যে তীর্থযাত্রী ‘তাওয়াফ’ করে।”
১৯৩৪ সালে প্রকাশিত তার বই “মক্কায় হজ”স্কটিশ মহিলার প্রথম হজের বিবরণ এবং তার ডায়রি হজের সময়কার একটি সফরের সর্বাধিক প্রাচীন রেকর্ড, যখন তিনি মিনায় থেকে আরাফাত পর্যন্ত গাড়িতে গিয়েছিলেন। তিনি সারা জীবন ব্যাপকভাবে ভ্রমণ করেছেন এবং আরেকটি বইও লিখেছেন, “কেনিয়া: ল্যান্ড অব ইলিউশন”।
তিনি আরবি ভাষায় সাবলীলভাবে কথা বলতেন এবং লিখতেন।
লেখা:
“ইসলাম,” লেডি এভলিন পরে লিখেছিলেন, “সাধারণ জ্ঞান ধর্ম।” লেডি এভলিনের জীবন, তার ইসলাম গ্রহণ এবং মক্কায় হজের গল্পগুলো তার ডায়রিতে রেকর্ড করা আছে, যা সম্প্রতি পুনঃপ্রকাশিত হয়েছে।
তার প্রপৌত্র মেজর ফিলিপ হোপ-কোব্বল্ড তার সম্পর্কে বলেন, “তিনি একজন খুব প্রাণবন্ত, অদ্ভুত অ্যাঙ্গলো-স্কট মুসলিম ছিলেন, যিনি কাজ করতে এবং মানুষকে ভালোবাসতেন।”
অবদান:
লেডি এভলিন কোববল্ড ইসলামের প্রতি তার অবদানের জন্য স্মরণীয়। তিনি ১৯১৫ সালে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন, যা ব্রিটিশ সমাজে ইসলামের প্রতি একটি নতুন দৃষ্টিভঙ্গি তৈরি করে। ১৯৩৩ সালে মক্কায় হজ পালন করেন, এবং তিনি প্রথম মুসলিম মহিলা হিসেবে পরিচিত হন, যিনি যুক্তরাজ্যে জন্মগ্রহণ করে এই পবিত্র যাত্রা সম্পন্ন করেন। তার ডায়রি এবং বই “মক্কায় হজ“ ইসলাম ও মুসলিম সংস্কৃতির প্রতি তার গভীর আবেগ এবং বিশ্বাসের প্রকাশ। তার লেখাগুলো ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও আধ্যাত্মিকতার একটি প্রামাণিক দলিল হিসেবে কাজ করে। লেডি এভলিন মুসলিম সমাজের সঙ্গে একটি ব্রিজ হিসেবে কাজ করেছেন, তিনি ইউরোপের এবং পশ্চিমা সমাজের জন্য ইসলামের সৌন্দর্য এবং শান্তির বার্তা প্রচার করেছেন। তিনি নারীদের জন্য ইসলামের আধিকারিক ভূমিকা ও ধর্মীয় স্বাধীনতার ব্যাপারে সচেতনতা বৃদ্ধি করেন, যা মুসলিম মহিলাদের জন্য একটি অনুপ্রেরণা। লেডি এভলিনের জীবন ও কাজ ইসলামের জন্য একটি মূল্যবান অবদান এবং তিনি মুসলিম সমাজে এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।
মৃত্যু:
লেডি এভলিন ১৯৬৩ সালে ইনভারনেসে মারা যান এবং তিনি যে স্থানে দাফনের নির্দেশনা দিয়েছিলেন, সেই পশ্চিম রসের গ্লেনক্যারন এস্টেটের একটি নির্জন পাহাড়ে তাকে দাফন করা হয়। স্কটল্যান্ডে তার জানাজা পড়ানোর জন্য কোনও মুসলিম ছিল না, তাই তারা শাহ জাহান মসজিদ, ওকিং-এর সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং ইমাম তুষারে গাড়ি চালিয়ে তার জানাজা পড়ানোর জন্য সেখানে আসেন।। তিনি তার কবরের উপর মক্কার দিকে মুখ করে পাহাড়ে দাফন হতে চেয়েছিলেন এবং তার কবরের জন্য নিম্নলিখিত লেখাটি উল্লেখ করেছিলেন:”আল্লাহু নূরুস-সামাওয়াতি ওয়াল আরদ”(“আল্লাহ আকাশ ও পৃথিবীর আলো”)।
২০২২ সালে তার কবর পরিদর্শন করেন কনভার্ট ইসলাম ফাউন্ডেশন-এর একজন তীর্থযাত্রীদল, যা ইসলাম গ্রহণকারীদের জন্য একটি ব্রিটিশ সংগঠন। তারা গ্লেন কারন থেকে গ্লিয়ান ফিওধাইগ পর্যন্ত ২০ কিলোমিটার (১২ মাইল) যাত্রা করেন। ২০১৯ সালের উপন্যাস “বার্ড সামন্স” লেখিকা লেইলা আবৌলেলার দ্বারা লেডি এভলিনের কবর খুঁজে বের করার জন্য তিনজন মুসলিম নারীর তীর্থযাত্রা বর্ণনা করেছে।