ললাটের লিখন– রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর– প্রথম অংশ

(বাঁশরী)

ছেলেবেলায় পৃথ্বীশের ডান দিকের কপালে চোট লেগেছিল ভুরুর মাঝখান থেকে উপর পর্যন্ত । সেই আঘাতে ডান চোখটাও সংকুচিত । পৃথ্বীশকে ভালো দেখতে কি না সেই প্রশ্নের উত্তরটা কাটা দাগের অবিচারে সম্পূর্ণ হতে পারল না । অদৃষ্টের এই লাঞ্ছনাকে এত দিন থেকে প্রকাশ্যে পৃথ্বীশ বহন করে আসছে তবুও দাগও যেমন মেলায় নি তেমনি ঘোচে নি তার সংকোচ । নতুন কারো সঙ্গে পরিচয় হবার উপলক্ষে প্রত্যেকবার ধিক্‌কারটা জেগে ওঠে মনে । কিন্তু বিধাতাকে গাল দেবার অধিকার তার নেই । তার রচনার ঐশ্বর্যকে বন্ধুরা স্বীকার করছে প্রচুর প্রশংসায় , শত্রুরা নিন্দাবাক্যের নিরন্তর কটুক্তিতে । লেখার চারি দিকে ভিড় জমছে । দু টাকা আড়াই টাকা দামের বইগুলো ছড়িয়ে পড়ছে ঘরে-ঘরে । সম্পাদকরা তার কলমের প্রসাদ ছুটোছাঁটা যা-ই পায় কিছুই ছাড়ে না । পাঠিকারা বলে , পৃথ্বীশবাবু মেয়েদের মন ও চরিত্র যেমন আশ্চর্য বোঝেন ও বর্ণনা করেন এমন সাধ্য নেই আর কোনো লেখকের । পুরুষ-বন্ধুরা বলে , ওর লেখায় মেয়েদের এত-যে স্তুতিবাদ সে কেবল হতভাগার ভাঙা কপালের দোষে । মুখশ্রী যদি অক্ষুণ্ন হত তা হলে মেয়েদের সম্বন্ধে সত্য কথা বাধত না মুখে । মুখের চেহারা বিপক্ষতা করায় মুখের অত্যুক্তিকে সহায় করেছে মনোহরণের অধ্যবসায় ।

শ্রীমতী বাঁশরি সরকার ব্যারিস্টারি চক্রের মেয়ে — বাপ ব্যারিস্টার , ভাইরা ব্যারিস্টার । দু বার গেছে য়ুরোপে ছুটি উপলক্ষে । সাজে সজ্জায় ভাষায় ভঙ্গিতে আছে আধুনিক যুগের সুনিপুণ উদ্দামতা । রূপসী বলতে যা বোঝায় তা নয় , কিন্তু আকৃতিটা যেন ফ্রেঞ্চ পালিশ দিয়ে ঝকঝকে করা ।

পৃথ্বীশকে বাঁশরি ঘিরে নিয়েছিল আপন দলের মধ্যে । পরিচয়ের আরম্ভকালে মানুষের বাক্যালংকারের সীমা যখন অনির্দিষ্ট থাকে সেইরকম একদা পৃথ্বীশ ওকে বলেছিল , পুরুষের প্রতিভা যদি হয় গাছের ফুল , মেয়েদের প্রভাব আকাশের আলো । কম পড়লে ফুলের রঙ খেলে না । সাহিত্যের ইতিহাস থেকে প্রমাণ অনেক সংগ্রহ করছে । সংগ্রহ করবার প্রেরণা আপন অন্তরের বেদনায় । তার প্রতিভা শতদলের উপর কোনো-না কোনো বীণাপাণিকে সে অনেকবার মনে মনে আসন দিতে চেয়েছে , বীণা না থাকলেও চলে যদি বিলিত জ্যাজনাচের ব্যাঞ্জোও থাকে তার হাতে । ওর যে বাক্‌লীলা মাঝে মাঝে অবসন্ন হয়ে পড়ে তাকে আন্দোলিত করবার প্রবাহ সে চায় কোনো মধুর রসের উৎ স থেকে । খুঁজে খুঁজে বেড়ায় , কখনো মনে করে এ , কখনো মনে করে সে ।

একটা গল্প লিখেছিল জয়দেবের নামটা নিয়ে তাকে বদনাম দিয়ে । যে কাহিনী গেঁথেছিল তার জন্যে পুরাবৃত্তের কাছে লেখক ঋণী নয় । তাতে আছে কবি জয়দেব শাক্ত ; আর কাঞ্চনপ্রস্থের রাজমহিষী পদ্মাবতী বৈষ্ণব । মহিষীর হুকুমে কবি গান করতেন রাধাকৃষ্ণের লীলা নিয়ে । মহিষী শুনতেন পর্দার আড়ালে । সেই অন্তরালবর্তিনী কল্পমূর্তি জয়দেবের মনকে নিয়ে গিয়েছিল বৃন্দাবনের কুঞ্জছায়ায় । শক্তির মন্ত্র যিনি পেয়েছিলেন গুরুর কাছে তাঁর মনের রসের মন্ত্র ভেসে এল কেশধূপসুগন্ধীবেণীচুম্বিত বসন্ত-বাতাসে । লেখক জয়দেবের স্ত্রী মন্দাকিনীকে বানিয়েছিল মোটা মালমসলার ধুলোকাদা মাখা হাতে । এই অংশে লেখকের অনৈতিহাসিক নিঃসংকোচ প্রগল্‌ভতার প্রশংসা করেছে একদল । মাটি খোঁড়ার কোদালকে সে খনিত্র নামে শুদ্ধি করে নেয় নি বলে ভক্তেরা তাকে খেতাব দিয়েছে নব্যসাহিত্যের পূর্ণচন্দ্র অর্থাৎ কলঙ্কগর্বিত । ছাপা হবার পূর্বেই বাঁশরি গল্পটা শুনেছে আপন চায়ের টেবিলে , নিভৃতে । অন্য নিমন্ত্রিতেরা উঠে গিয়েছিল , ওদের সেই আলাপের আদি পর্বে যশস্বী লেখককে তৃপ্ত করবার জন্যে চাটুবাক্যের অমিতব্যায়কে বাঁশরি আতিথ্যের অঙ্গ বলেই গণ্য করত । পড়া শেষ হতেই বাঁশরি চৌকি থেকে উঠে দাঁড়িয়ে বললে “ মাস্টারপীস , শেলির জীবনী নিয়ে ফরাসী লেখক এরিয়েল নাম দিয়ে যে গল্প লিখেছে তারই সঙ্গে এর কতকটা তুলনা মেলে ; কিন্তু ওঃ । ” পৃথ্বীশের মন উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল । চায়ের পেয়ালা দ্বিতীয়বার ভরতি করে নিয়ে তার মধ্যে চামচ সঞ্চালন করতে করতে বললে , “ দেখুন শ্রীমতী বাঁশরি , আমার একটা থিয়োরি আছে , দেখে নেবেন একদিন , ল্যাবরেটরিতে তার প্রমাণ হবে । যে বিশেষ এনার্জি আছে মেয়েদের জৈবকণায় , যাতে দেহে মনে তাদের মেয়ে করেছে , সেইটেই কোনো সূক্ষ্ম আকারে ব্যাপ্ত সমস্ত পৃথিবীতে । আচ্ছা , শ্রীমতী বাঁশরি , এটা আপনি কখনো কি নিজের মধ্যে অনুভব করেন না ? ”

বাঁশরি একটু ইতস্তত করছিল । পৃথ্বীশ বলে উঠল , “ নিশ্চয়ই করেন এ আমি হলপ করে বলতে পারি । কীরকম সময়ে জানেন —

“At that sweet time when winds are wooing

all vital things that wake to bring

News of birds and blossomings.”

বাঁশরি হাততালি দিয়ে উঠে বললে , “ এতক্ষণে বুঝেছি আপনি কী বলছেন । মনে হয় যেন — ”

পৃথ্বীশ কথাটাকে সম্পূর্ণ করে বললে , “ যেন গোলাপ গাছের মজ্জার ভিতরে যে শক্তি বিনা ভাষায় অন্ধকারে কেঁদে উঠছে , বলছে ফুল হয়ে ফুটব সে আপনারই ভিতরকার প্রাণৌৎসুক্য । বার্গসঁ জানেন না , তিনি যাকে বলেন Elan Vital সেটা স্ত্রী-শক্তি । ”

বাঁশরি পৃথ্বীশের কথাটা একটু বদলিয়ে দিয়ে বললে , “ দেখুন পৃথ্বীশবাবু , নিজেকে ওই-যে ছড়িয়ে জানবার তত্ত্বটা বললেন ওটা মাটিতে তেমন মনে হয় না যেমন হয় জলে । জলের ঘাটে মেয়েদের একটা বিশেষ টান আছে , দেখেন নি কি ?”

পৃথ্বীশ চমকে উঠে বলে উঠল , “ আপনি আমাকে ভাবালেন । কথাটা এতদিন মনে আসে নি । স্ত্রী-পুরুষে দ্বৈততত্ত্ব আমার কাছে স্পষ্ট হল একমুহূর্তে । আর কিছু নয় , জল ও স্থল । মাটি ও বাতাসে যে অংশ জলীয় সেই অংশেই নারী ওই জলেই তো ধরণীর অনুপ্রেণনা । ”

সেই দিন পৃথ্বীশ চঞ্চল হয়ে উঠে প্রথম বাঁশরির হাত চেপে ধরেছিল , বলেছিল , “ ক্ষমা করবেন আমাকে , স্পষ্ট বুঝেছি পুরুষ তেমনি করেই নারীকে চায় , মরুভূমি যেমন করে চায় জলকে অন্তর্গূঢ় সৃষ্টিশক্তিকে মুক্তি দেবার জন্যে । ” কিছুক্ষণ বাদে আস্তে আস্তে বাঁশরি হাত ছাড়িয়ে নিলে । পৃথ্বীশ বললে , “ দোহাই আপনার , আমাকে ব্যর্থতার হাত হতে বাঁচাবেন । এ আমার কেবল ব্যক্তিগত আবেদন নয় , আমি বলছি সমস্ত বাংলার সাহিত্যের হয়ে । আমি ইঁদারার মতো , জল দানের গভীর সঞ্চয় আছে আমার চিত্তে , কিন্তু তুমি নারী , জলের ঘট তোমার মাথায় । ” সেই দিন ওর সম্ভাষণ ‘ আপনি ‘ হতে হঠাৎ ‘ তুমি ‘ তে এসে পৌঁছল , ইঙ্গিতেও আপত্তি উঠল না কোথাও ।

বাঁশরিকে চিনত না বলেই সেদিন পৃথ্বীশ এতবড়ো প্রহসনের অবতারণা করতে পেরেছিল । বাঁশরি মখমলের খাপের থেকে নিজের ধারা[ লো] হাসি তখনো বের করে নি , হতভাগ্য তাই এমন নিঃশঙ্ক ছিল । ও ঠিক করে রেখেছিল আধুনিক কালচার্‌ড মেয়েরা চকোলেট ভালোবাসে আর ভালোবাসে কড়িমধ্যমে ভাবুকতা ।

এর পর থেকে এই বিখ্যাত ঔপন্যাসিকের প্রতিভায় প্রাণ সঞ্চার করবার একমাত্র দায়িত্ব নিলে বাঁশরি । হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলে পুরুষ-বন্ধুরা , মেয়ে-বন্ধুরা ওর সজীব সম্পত্তিটিকে নিয়ে ঠিক লোভ করে নি ঈর্ষা করেছিল । ইংরেজ অ্যাটর্নি আপিসের শিক্ষানবিশ সুধাংশু একদিন পৃথ্বীশের রিফু-করা মুখ নিয়ে কিছু বিদ্রূপ করেছিল , বাঁশরি বললে , “ দেখো মল্লিক ওর মুখ দেখতে আমার পজিটিভলি ভালো লাগে । ”

‘ ভালো লাগে ‘, সুধাংশু হো হো করে হেসে উঠল । বললে , “ মডার্‌ন আর্ট বুঝতে আমাদের সময় লাগবে । ”

বাঁশরি বললে , “ বিধাতার তুলিতে সাহস আছে , যাকে তিনি ভালো-দেখতে করতে চান তাকে সুন্দর করা দরকার মনে করেন না । তাঁর মিষ্টান্ন তিনি ছড়ান ইতর লোকদেরই পাতে । ”

সুধাংশু বললে , “ গাল খেলুম তোমার কাছে , এটা সইতে চেষ্টা করব । কিন্তু ভাগ্যে সৃষ্টিকর্তা স্বয়ং দেন নি গাল । ” বলে সে ঘোড়দৌড় দেখতে চলে গেল । বাঁশরিকে সঙ্গে নিয়ে যাবে প্ল্যান ছিল মনে , সেটা ত্যাগ করলে ।

 

পার্টি জমেছে বাগানে , সুষমার বাপ গিরিশ সেনের বাড়িতে । বাগানের দক্ষিণ দিকে তিনটে ঝাউগাছ চক্র করে দাঁড়িয়ে , তার তলায় কাঠের আসন , সেই আসনে বসে আছে পৃথ্বীশ ।

এই দলের এরকম পার্টিতে পৃথ্বীশের এই প্রথম প্রবেশ । অনেক ভেবেছিল নিজের সাজ নিয়ে । যে এন্ডির চাদরটা পরেছে এখানে এসে হঠাৎ দেখতে পেলে তার এক কোণে মস্ত একটা কালির দাগ । চারি দিকে ফিটফাটের ফ্যাশন , তারি মাঝখানে কালিটা যেন চেঁচিয়ে উঠছে । অভ্যাগত শৌখিনদের মধ্যে ধুতিপরা মানুষও আছে কিন্তু চাদর কারো গায়েই নেই । পৃথ্বীশ নিজেকে বেখাপ বলে অনুভব করলে , স্বস্তি পেলে না মনে । কোণে বসে বসে দেখলে কেউ বা আলাপ করছে বাগানে বেড়াতে বেড়াতে , কেউ বা খেলছে টেনিস , কেউ বা টেবিলে সাজানো আহার্য ভোগ করছে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে । উঠে দাঁড়ানো বা চলে বেড়ানো ওর পক্ষে অসাধ্য হল । রাগ হচ্ছে বাঁশরির ‘পরে । চক্রান্ত করে সেই ওকে এখানে এনে হাজির করেছে । আনবার একটা কারণও ঘটেছিল । সেটি বলি । ‘ বেমানান ‘ নাম দিয়ে কিছুদিন আগেই পৃথ্বীশ একটা ছোটগল্প লিখেছিল । বিষয়টা এই —

দেওঘরে নলিনাক্ষের মস্ত দো-মহলাবাড়ি । পুজোর ছুটিতে এক মহলে আশ্রয় নিয়েছে নবকান্ত মুখুজ্জেরা । তাদের মেয়েরা নিষ্ঠাবতী , মুখ্যভাবে দেবদর্শনে পুর্ণ এবং গৌণভাবে ইঁদারার জলে ক্ষুধাবৃদ্ধি এই দুটোই তাদের মনে প্রবল । বৈঠকখানা ঘর থেকে কার্পেট উঠিয়ে দিয়েছে , সেখানেও শুচিতা বিস্তারের জন্যে চলছে জল-ঢালাঢালি । এ দিকে অন্য মহলে মোরগ মাংস-লোলুপ নলিনাক্ষের দলদল । এই দলের একজন এম.এস্‌সি. পরীক্ষার্থী অপর দলের কোনো পূজাপরায়ণা কুমারীকে হৃদয় সমর্পণ করেছিল , তারই ট্র্যাজেডি এবং কমেডি খুব জোরালো রসালো ভাষায় বর্ণনা করেছে পৃথ্বীশ । এক পক্ষের পাঠক বাহবা দিয়েছিল প্রচন্ড জোরে , বলা বাহুল্য বাঁশরি সে পক্ষের নয় ।

বাঁশরি বললে , “ দেখো পৃথ্বীশবাবু , তুমি যে ছুরি চালিয়েছ ওটা যাত্রার দলের ছুরি , কাঠের উপরে রাঙতা মাখানো , ওতে যারা ভোলে তারা পাড়াগেঁয়ে অজ্‌বুগ তাদের জন্য সাহিত্য নয় । ”

পৃথ্বীশ হেসে উড়িয়ে দেবার জন্য বললে , “ কাজ হয়েছে দেখছি , বিঁধছে বুকে । ”

“ আমাকে বেঁধে নি , বিঁধেছে তোমার খ্যাতির ভাগ্যকে । বানিয়ে গাল দেয় পাঁচালির দল , হাটের-আসরে লোক হাসাবার জন্যে , তুমি কি সেই দলের লিখিয়ে নাকি ? তা হলে দন্ডবৎ । ”

পৃথ্বীশ গালটাকে অগ্রসর হয়ে মেনে নেবার জন্যে বললে , “ ভাষায় বলে খুরে দন্ডবৎ । এত দিনে খুর ধরা পড়ল বুঝি । ”

“ ধরা পড়ত না , যদি-না সিংহের থাবা চালাবার ভান করতে । একটা কথা জিজ্ঞাসা করি , মশায় , যাকে নলিনাক্ষের দল বলে এত ইনিয়ে বিনিয়ে কলম চালিয়েছ তাকে তুমি সত্য করে জান কি ?”

পৃথ্বীশ বললে , “ লেখার জন্যে জানবার দরকার করে না , বানিয়ে বলবার বিধিদত্ত অধিকার আছে লেখকের , আদালতের সাক্ষীর নেই । ”

গল্পের দ্বিতীয় অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!