চাঁদের আলো সবসময়ই ঘরের আয়নায় এসে পড়ে, কেন জানি না, আয়নাটার সাথে চাঁদের আলোর যেন এক অদ্ভুত সম্পর্ক তৈরি হয়েছে। রুদ্রাণীর নতুন সংসার, তাই সবকিছুই নতুন হওয়া উচিত—আসবাবপত্র, সাজসজ্জা, এমনকি প্রতিটি ছোটখাটো জিনিসও। রুদ্রাণী অরণ্যকে বিয়ে করেছিল অনেকটা জেদের বশে। ওর পরিবার যখন অন্য জায়গায় বিয়ের কথা পাকাপাকি করে ফেলেছিল, তখনই রুদ্রাণী সেই পাত্রকে একদম পছন্দ করতে পারেনি। পরিবারকে বলেছিল, কিন্তু কিছুই কাজ হয়নি। জোর করেই বিয়ে ঠিক হয়েছিল। ঠিক সেই সময় রুদ্রাণী অরণ্যর কাছে গিয়ে শুধু একটিই কথা বলেছিল—“আমি তোমার সাথে থাকতে চাই।” অরণ্য কিছু বলেনি, চুপচাপ ওকে বিয়ে করে নিয়েছিল।
ভার্সিটিতে পরিচয় হওয়া সেই বন্ধুত্ব থেকেই শুরু হয়েছিল তাদের সম্পর্কের গল্প। অরণ্য ছিল একান্ত নিরব স্বভাবের ছেলে, যার এই চুপচাপ মগ্নতাই রুদ্রাণীর ভালো লেগে গিয়েছিল। বিয়ের পর এখন ওরা একসাথে থাকে। অরণ্য একটি প্রাইভেট কোম্পানিতে চাকরি করে, আর রুদ্রাণী একটি প্রাইমারি স্কুলে শিক্ষকতা করে। দুজনই সারাদিনের ব্যস্ততা শেষে ফিরে আসে তাদের ছোট্ট গৃহে। সংসারের সাজসজ্জা সব রুদ্রাণীর হাতে, কারণ অরণ্য এসব নিয়ে একদমই আগ্রহী নয়।
দুইদিন হলো রুদ্রাণী একটি পুরনো কাঠের ফ্রেমের আয়না এনেছে বাড়িতে। একটা অদ্ভুত দিন ছিল সেদিন—রোজকার সেই একই পথ না ধরে হঠাৎ অন্য পথে হাঁটতে হাঁটতে রুদ্রাণী দেখে রাস্তার পাশে এক বৃদ্ধ লোক বসে আছে আয়না নিয়ে। কারুকাজ করা আয়নাটা প্রথম দেখাতেই ওর খুব পছন্দ হয়, তাই কিছু না ভেবেই কিনে ফেলে। আয়নাটা ও রাখে নিজের বিছানার সামনে। তারপর থেকেই এক অদ্ভুত টান অনুভব করতে থাকে সে আয়নার প্রতি। রাতে চাঁদের আলো আয়নায় পড়লে ওর মনে হয় আয়নাটা যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে।
এক রাতে অরণ্য উঠে দেখে রুদ্রাণী আয়নার সামনে বসে আছে। জিজ্ঞেস করলে বলে—”বাচ্চাদের খেলা দেখছি… জানো, এদের না দেখলে ওরা কান্নাকাটি শুরু করে।” কিন্তু অরণ্য কিছুই দেখতে পায় না আয়নায়। এরপর থেকে প্রতিদিন রাতেই এমন ঘটতে থাকে। অরণ্য ভাবে, হয়তো একাকীত্ব, হয়তো মানসিক চাপ। তাই আয়নাটা ঘর থেকে সরিয়ে ফেলে। সেই রাতেই রুদ্রাণী একেবারে অস্থির হয়ে পড়ে, আয়নার জন্য পাগলের মতো হয়ে যায়। ডাক্তার ডাকা হয়, ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয়—কিন্তু কোনো লাভ হয় না।
এরপর রাতে অরণ্য শুনতে পায় অসংখ্য বাচ্চার কান্না, যেন ওদের ঘরেই বাচ্চারা কাঁদছে, অথচ কোথাও কেউ নেই। এভাবে চলতে চলতে অরণ্য আয়নাটা আবার ঘরে এনে দেয়। রুদ্রাণী স্বাভাবিক হয়ে যায়। আবার আগের মতো আয়নার সামনে বসে থাকা শুরু করে। কিন্তু সুখ বেশিদিন টিকে না—হঠাৎ একদিন এক রোড এক্সিডেন্টে রুদ্রাণী মারা যায়।
রুদ্রাণীর মৃত্যুর পর অরণ্য আবার সেই কান্না শুনতে পায়। ঘরে আয়না থাকুক চায় না সে, তাই আয়নাটাকে ভেঙে ফেলে, কিন্তু কিছুক্ষণ পর দেখে আয়না আবার ঠিক হয়ে গেছে। মাটিচাপা দিয়েও কাজ হয় না—আয়নাটা আবার ঘরের মধ্যেই ফিরে আসে। ধীরে ধীরে অরণ্য পাগলের মতো হয়ে যায়। একদিন আয়নাটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে। রাস্তায় এক মহিলা ওকে ডেকে জিজ্ঞেস করে, আয়নাটা বিক্রি করবে কি না। কিছু না বুঝেই অরণ্য টাকা নেয়, আয়নাটা দিয়ে দেয়।
মহিলার হাতে আয়নাটা যেতেই, প্রথমবারের মতো অরণ্য নিজে আয়নায় দেখতে পায়—এক ঝাঁক হাস্যোজ্জ্বল শিশু, যারা তাকে যেন চিনে রেখেছিল অনেক আগেই…