রাজকন্যা বানেছা পরী– ষষ্ঠ খন্ড

 

রাত প্রায় একটা বাজে ।অমাবশ্যা । ঘোর অন্ধকার । কোন ঘরে বাতি নেই । পরিষ্কার আকাশ । দু একটি তারা মিটিমিটি জ্বলছে । অহনার ঘুম ভেঙে গেল । বিছানা ছেড়ে উঠে বসল । কোথা থেকে ভেসে আসছে সানাইয়ের সুর । মিষ্টি মধুর । অন্ধকারে হাতড়িয়ে টর্চ খুঁজে বের করল । পাশেই রাতুল ঘুমাচ্ছে । আস্তে করে ডাকল, রাতুল ভাইয়া, রাতুল ভাইয়া।
রাতুল কোন সাড়া দিল না । অহনা রাতুলের পা ধরে আস্তে আস্তে ঝাঁকুনি দিল । রাতুল আড়মোড়া ভেঙে জেগে উঠল । অহনার দিকে তাকিয়ে অবাক চোখে জিজ্ঞেস করল,
কী হয়েছে ? এত রাতে ঘুম ভাঙালি কেন ?
অহনা কণ্ঠস্বর একেবারে খাদে নামিয়ে এনে বলল, এই শোন সানাইয়ের শব্দ । উজাড় বাড়ির
দিক থেকে আসছে ।
রাতুল গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনল । হ্যা, ঠিক তাই ।
অহনা বলল, মনে হয় উজাড় বাড়িতে কারো বিয়ে হচ্ছে । চল যাই । দেখি কী হয়েছে ।
এত রাতে কার বিয়ে হবে ? আমার মাথায় তো কিছুই ঢুকছে আছে না ।
আমার একটি বিষয় সন্দেহ হচ্ছে । চল গিয়ে দেখি ।
তোর মাথা খারাপ হয়েছে ? এত রাতে উজাড় বাড়িতে যাই; আর ছমির শেখের মত আমাকেও —— ।
অহনা ওকে থামিয়ে দিল । বলল, এত কাছে যাব না । আম বাগান পর্যন্ত যাব ।
ঠিক আছে । তাহলে চল ।
দুজনে পা টিপে টিপে ঘর ছেড়ে বের হল । আম বাগানের এক পাশে একটি বিশাল রেইন ট্রি । এই জায়গাটি তাদের বাড়ি থেকে উজাড় বাড়ির সবচেয়ে কাছে । তারা রেইন ট্রির নিচে এসে দাঁড়াল । উজাড় বাড়ির দিকে তাকিয়ে দুজনে বিস্ময়ে বিমুঢ় হয়ে গেল । উজাড় বাড়ির ঠিক মাঝখানে । আচানক ঝলমলে সুরম্য প্রাসাদ । চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা । এমন লাইটিং তারা জীবনে আর দেখেনি । এমন কি ঢাকা শহরেও না । চলছে নাচ, গান, বাদ্য ।
প্রসাদের সামনের দিকের একটি কক্ষে মঞ্চ । মঞ্চের ঠিক মাঝখানে পাশাপাশি দুটি আসন । স্বর্ণ খচিত । উজ্জ্বল আলোয় ঝক ঝক করছে । চারপাশে অনেক লোক । সকলেই ব্যস্ত । যেন কিছুক্ষণ পরেই একটি নাটক মঞ্চস্থ হবে ।
অহনা রাতুলকে কানে কানে বলল, ভাইয়া, আমি যা ভেবেছিলাম তাই ঘটতে যাচ্ছে । রাতুল কিছু বলল না । সে ভয়ে কাঁপছে । অহনার হাত ধরে টানতে টানতে বলল,
আমার এসবে কাজ নেই; চল আমরা এখান থেকে চলে যাই ।
অহনা বলল, তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন ? স্বাভাবিক হও । ভয়ের কোন কারণ নেই । ওরা এদিকে আসবে না ।
ওখানে কী হতে যাচ্ছে ? রাতুল জিজ্ঞেস করল ।
অহনা বলল, আমার ধারনা জামসেদ ভাইকে ওরা তুলে এনেছে । আজ জামশেদ ভাইয়ের সাথে বানেছার বিয়ে । এখন সেই অনুষ্ঠান চলছে । দেখছ না পাশাপাশি দুটি আসন । কিছুক্ষণ পরে এখানে বর-কনে এক সঙ্গে বসবে ।
তাহলে চল জামশেদ বাড়িতে আছে কিনা দেখে আসি ? বলল রাতুল ।
অহনা বলল, উত্তম প্রস্তাব । চল চল । তাড়াতাড়ি চল ।
এক দৌড়ে তারা জামশেদের বাড়িতে চলে আসল । জামসেদ যে ঘরে থাকে; সেই ঘরের দরজা
খোলা । বাতি জ্বলছে । টেবিলে একটা বই । অর্ধ বন্ধ । অহনার আর বুঝতে বাকি থাকল
না কী ঘটেছে ! যা অনুমান করেছিল তাই ।
রাতুল বলল, তোর ধারণাই ঠিক ।
অহনা বলল, না ঠিক নাও হতে পারে । বাথরুমেও যেতে পারে । কতক্ষণ অপেক্ষা করা যাক।
ঠিক আছে । বলল রাতুল ।
এরপর দুজনে মিলে আশেপাশে জামশেদকে খুঁজল । এমন কি বাথরুম এবং বাড়ির পেছনের জংগলও বাদ দেয়নি । কোথাও খুঁজে পাওয়া গেল না । তাদের অনুমান সত্যি ধরে নিয়ে দুজনে তাড়াতাড়ি উজাড় বাড়ির দিকে হাঁটা দিল । পথে কয়েকটি শিয়ালের সাথে দেখা হল । তারা নির্ভীক পথ হেঁটে যাচ্ছে । কোনদিকে পরওয়া নেই । আশেপাশে কারো বাড়িতে কুকুরের ঘেউ ঘেউ শোনা গেল । মনে হয় কুকুর গুলি শেয়ালকে দেখতে পেয়েছে । কিছুক্ষণের মধ্যেই তারা উজাড় বাড়ির পাশের আমবাগানে এসে উপস্থিত হল । পা টিপেটিপে রেইন ট্রির নিচে গেল । দুজন এক সাথে উজাড় দিকে দিকে দৃষ্টি দিয়ে ভূত দেখার মত চমকে উঠল । মঞ্চের মাঝ খানে পাতা আসন দুটিতে জামশেদ আর বানেছা পরী পাশাপাশি বসে আছে । তারা উভয়েই বর কনের পোশাকে সজ্জিত । কী অপরূপ লাগছে দেখতে!জামশেদকে একটুও ভীত ও শঙ্কিত মনে হল না । বেশ স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বসে আছে । মাঝে মাঝে বানেছা পরীর সাথে কথা বলছে । মুচকি মুচকি হাসছে । অন্যান্য জিন পরীরা দ্রুত বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা করে যাচ্ছে।
রাতুল আর অহনা এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে; যেন বন্ধুর বিয়েতে নিমন্ত্রণ খাচ্ছে । আর বড় বড় মশারা তাদের রক্ত খেয়ে মোটা তাজা হচ্ছে । সেদিকে কারো খেয়াল নেই । মন্ত্র মুগ্ধের মত দেখে যাচ্ছে । কারো মুখে কোন কথা নেই । যেন ভাষা হারিয়ে ফেলেছে । রাত তিনটার দিকে বিয়ে শেষ হল । সাথে সাথে ধপ করে নিবে গেল আলোকসজ্জা । গভীর অন্ধকার নেমে এল উজাড় বাড়িতে । আবার যেমন ছিল তেমনি হয়ে গেল। কিছুই যেন হয়নি সেখানে।
রাতুল আর অহনা ধীর পদক্ষেপে ঘরে ফিরে আসল । সব কিছু তাদের কাছে কেমন যেন স্বপ্নের মত মনে হচ্ছে । বিশ্বাস করতে মন চাইছে না । কিন্তু এ যে বাস্তব ! স্বচক্ষে দেখা। স্বকর্ণে শোনা । সারারাত আর তাদের ঘুম আসল না । কেবলই মনের পর্দায় ভেসে উঠছে জামশেদের হাসি মাখা মুখ আর বানেছা পরীর লাজরাঙা মুখ।

পরদিন সকাল বেলা । বিছানায় শুয়ে শুয়ে রাতুল আর অহনা হট্টগোল শুনতে পেল । লোকেরা সব দল বেঁধে তাদের বাড়িতে জড়ো হচ্ছে । রাতুলের দাদা মাওলানা মনির উদ্দিন সাহেবকে সবাই খোঁজাখুঁজি করছে । রাতুল আর অহনা আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে আসল। লোকজনের কাছে শুনতে পেল, জামশেদকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না । তারা কিছুই বলল না। এখনও রাতের দৃশ্য তাদের চোখে জ্বলজ্বল করছে । এ দিকে জামশদের মায়ের কান্নায় আকাশ বাতাস বিগলিত হচ্ছে । এদিকে হুজুর নামাজে দাঁড়িয়েছেন । কিছুক্ষণ পরে হয়ত এখানে তাশরীফ আনবেন।

গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

দুঃখিত!