রজার গারোদি

রজার গারোদি (১৭ জুলাই ১৯১৩১৩ জুন ২০১২):

রজার গারোদি ছিলেন একজন ফরাসি দার্শনিক, ফরাসি প্রতিরোধ যোদ্ধা এবং কমিউনিস্ট লেখক। তিনি ১৯৮২ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। ১৯৯৮ সালে, তাকে ফ্রান্সের আইনে হলোকাস্ট অস্বীকার করার অভিযোগে কয়েক বছরের জন্য দণ্ডিত এবং জরিমানা করা হয়েছিল, কারণ তিনি দাবি করেছিলেন যে ছয় মিলিয়ন ইহুদির মৃত্যুর ঘটনা একটি “মিথ”। রজার গারোদি একজন ধর্মনিরপেক্ষ খ্রিস্টান পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে তিনি একজন কমিউনিস্ট ছিলেন এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ফরাসি প্রতিরোধ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেন। তিনি ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ছিলেন এবং ফ্রান্সের জাতীয় পরিষদের একজন সদস্য হিসেবেও কাজ করেন। গারোদি একজন প্রখ্যাত দার্শনিক ছিলেন এবং তিনি বিভিন্ন সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় বিষয়ে লেখালেখি করেছেন। তার বইগুলোতে পশ্চিমা সভ্যতা, মার্কসবাদ, খ্রিস্টান ও ইসলামিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং বিশ্ব শান্তি নিয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা পাওয়া যায়। তিনি তার লেখার মাধ্যমে সমাজের উন্নয়ন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন।

 

ইসলাম গ্রহণ :

প্রায় ১৯৮০ সালের দিকে, গারোদি মুয়াম্মার গাদ্দাফির লেখা দ্য গ্রিন বুক পড়েন এবং লিবিয়া ও ইসলামের প্রতি আগ্রহী হন। তিনি মরুভূমিতে দেশটির নেতা গাদ্দাফির সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎ করেন। এরপর তিনি জেনেভার ইসলামী কেন্দ্র থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে ইসলাম গ্রহণ করেন, যা সে সময় সৌদি আরব দ্বারা পরিচালিত একটি প্রতিষ্ঠান ছিল। রজার গারোদি ১৯৮২ সালে ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের আগে, তিনি ইসলাম ও মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে গভীর আগ্রহী ছিলেন, বিশেষ করে লিবিয়া ও মুয়াম্মার গাদ্দাফির ওপর তার প্রভাব ছিল। ইসলাম গ্রহণের পর গারোদি তার নাম পরিবর্তন করে “রেজা গারোদি” রাখেন, যা ইসলামের প্রতি তার নতুন বিশ্বাসের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়।

 

ইসলামিক জীবনে তার অবদান:

রজার গারোদি ইসলাম গ্রহণের পর বিভিন্ন ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন, যা মুসলিম সমাজ ও দার্শনিক আলোচনার জন্য উল্লেখযোগ্য। গারোদি ইসলামের ওপর বিভিন্ন প্রবন্ধ ও বই লিখেছেন, যেখানে তিনি ইসলামের নৈতিক ও মানবিক দিকগুলির ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার লেখাগুলো মুসলিম দর্শন ও সমাজবিজ্ঞানকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি জায়নিজম এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী মতামত প্রকাশ করেছেন, বিশেষ করে তার বই The Case of Israel এ। এতে তিনি জায়নিজমকে একটি বিচ্ছিন্নতাবাদী ও বৈষম্যবাদী মতাদর্শ হিসেবে চিত্রিত করেছেন। এই সমালোচনা মুসলিম বিশ্বের মধ্যে ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংকটের একটি আলোচনার সুযোগ সৃষ্টি করেছে। গারোদি ইসলামের শান্তি ও মানবতার বার্তা প্রচার করতে সক্রিয় ছিলেন। তিনি বিভিন্ন ইসলামী সম্মেলন, সেমিনার এবং ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বক্তা হিসেবে অংশগ্রহণ করেছেন। ইসলাম ও মানবাধিকার বিষয়ে তিনি সমাজের উন্নয়নের ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন। তার কাজের মাধ্যমে তিনি বিশ্বাস করতেন যে ইসলাম মানবাধিকার, সামাজিক ন্যায় এবং নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার জন্য একটি শক্তিশালী মাধ্যম। গারোদি ইসলামী চিন্তকদের সঙ্গে যুক্ত হয়ে তাদের বিভিন্ন প্রকল্প ও উদ্যোগে সহায়তা করেছেন। তার অভিজ্ঞতা ও দৃষ্টিভঙ্গি মুসলিম সমাজে গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার সূচনা করেছে। তিনি ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও মুক্ত চিন্তার ওপর জোর দিয়েছেন, যা মুসলিম সমাজে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। তার দৃষ্টিভঙ্গি সমাজে বৈচিত্র্য ও পারস্পরিক বোঝাপড়ার গুরুত্বকে তুলে ধরেছে। রজার গারোদি ইসলাম গ্রহণের পর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম তৈরি করেন, যেখানে তিনি ইসলামের সত্যতা, মানবতা এবং সামাজিক ন্যায় প্রতিষ্ঠার জন্য কাজ করেন। তার অবদান আজও মুসলিম সমাজের মধ্যে আলোচিত হয় এবং তাকে একজন গুরুত্বপূর্ণ চিন্তাবিদ হিসেবে স্মরণ করা হয়।

আযজাম তামিমির মতে, তিউনিসিয়ান চিন্তক রাচেদ গননৌচি গারোদিকে ১৯৮০ এর দশকের শুরুতে প্রভাবিত হন, যখন তিনি গারোডির নারীদের বিষয়ে লেখা একটি বইয়ের অনুবাদ পড়েন। এর ফলে, তিনি নারীদের অধিকার ও ইসলামী আন্দোলনে নারীদের অবস্থান নিয়ে একটি প্রবন্ধ রচনা করেন, যা গারোডির কাজের দ্বারা আংশিকভাবে প্রভাবিত ছিল।

 

মৃত্যু:

রজার গারোদি ২০১২ সালের ১৩ জুন, বুধবার, ৯৮ বছর বয়সে মারা যান। তিনি ফ্রান্সের শেনেভিয়ের-সুর-মার্নে, ভ্যাল-দে-মার্নে অঞ্চলে মৃত্যুবরণ করেন।

গারোদির মৃত্যু একটি গুরুত্বপূর্ণ দার্শনিক ও চিন্তাবিদের জীবনের সমাপ্তি ছিল, যিনি ইসলাম ও মানবাধিকার নিয়ে সমৃদ্ধ চিন্তাধারা তৈরি করেছেন। তার মৃত্যুর পর, বিভিন্ন চিন্তাবিদ এবং লেখকরা তার কাজ ও অবদানের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন, এবং তার দর্শন ও মতাদর্শের উপর আলোচনা অব্যাহত রেখেছেন।গারোদি তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ইসলামের প্রচার এবং মানবাধিকার নিয়ে কাজ করতে থাকেন, এবং তার চিন্তাভাবনা আজও মুসলিম সমাজে প্রভাব ফেলে।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।