রক্তাক্ত শৈশব”—শুচিস্মিতা দাস

ছোট্ট চারাগাছ টা ধীরে ধীরে ডাল পালা ছড়িয়ে বেড়ে উঠছে। পাতা গুলো সবুজ, আরও সবুজ হয়ে উঠছে দিনে দিনে। আমার শিশু সন্তানও সেইভাবেই একটু একটু করে বড়ো হয়ে উঠছে। প্রথমে বসতে শিখলো সে, তারপর দাঁড়াতে শিখলো। দেখতে দেখতে হাঁটতেও শিখে গেল একদিন। আমার ছোট্ট ছেলে যত বড় হল আমার মাথার মধ্যে একটাই চিন্তা সারাক্ষণ ঘুরপাক খেতে লাগল। এবারে শহরের কোন নামজাদা স্কুলে আমার সন্তান কে ভর্তি করতেই হবে। সেই মুহূর্ত থেকেই বর্তমান এই কঠিন পৃথিবীর সঙ্গে আমার ছোট্ট শিশুটির শুরু হল এক প্রবল লড়াই। তখনও ভাল করে মুখে কথা ফোটেনি তার, কিন্তু তারই মধ্যে তাকে শিখে ফেলতে হবে অনেক অনেক rhymes আর ABCD।

ভাল স্কুলে অ্যাডমিশন টেস্টে সুযোগের জন্যে ওকে যে শিখতেই হবে সব কিছু। হাজার হাজার অন্য শিশুদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় ওকে যে জিততেই হবে। আমার সোনামনির ছোট্ট ছোট্ট হাতে তখন থেকেই শুরু হয়ে গেল লেখালেখি। লিখতেই হবে তোমাকে সোনা নাহলে যে তুমি অনেক পিছিয়ে পড়বে। সেই মুহূর্ত থেকেই আরও শত শত শিশুর মধ্যে আমি আমার ছোট্ট সন্তান কে ঠেলে দিলাম কঠিন এই পৃথিবীর এক নির্মম প্রতিযোগিতার মধ্যে। যদি এই কঠিন প্রতিযোগিতায় আমার ফুলের মত সন্তান জিততে পারে তাহলেই তো সে পারবে এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে নাহলেই অনেক পেছিয়ে যাবে সে। এরপর ভগবানের অশেষ কৃপাতেই শহরের অন্যতম নামজাদা স্কুলে আমার সোনামনি ভর্তি হয়ে গেল। যাক বাবা একটা বাধা তো টপকানো গেল। এবারে পড়াশোনাটা একটু বেশি করে করাতে পারলেই কেল্লা ফতে। যেমন করেই হোক ক্লাশে ফার্স্ট করতেই হবে আমার সন্তান কে। প্রত্যেক পরীক্ষাতে যেভাবেই হোক A1 পাওয়াতেই হবে ছেলেকে।

প্রত্যেক সপ্তাহে weekly test। সেখানে যেন সবকটাতে A1 পায় সেদিকে বিশেষ লক্ষ্য রাখতেই হবে আমাকে। তাই সারাক্ষণ ছেলের কানের সামনে বলে চলেছি, “ তোমাকে কিন্তু ভাল নম্বর পেতেই হবে সোনা। নাহলেই কিন্তু তুমি তোমার বন্ধু দের থেকে অনেক অনেক পেছিয়ে যাবে সোনা”। যেমন করেই হোক আমার ছেলের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রতিযোগিতার বীজ টা বপন করে দিতে হবে। আমার ছোট্ট ছেলে তার ছোট্ট মাথায় কি বুঝল সেই জানে। তবে এটুকু বুঝে গেল যে তাকে যেমন করেই হোক সব পরীক্ষাতে A1 পেয়েই বাড়ি আসতে হবে। নাহলেই মাম্মা খুব রেগে যাবে আর জোরে জোরে মারবে তাকে। এখন উদয় অস্ত তার শুধু পড়াশোনার চাপ। কখন দিন হয় কখন রাত হয় আমার সোনামনি জানতেও পারেনা।

খেলাধূলো করার তো মোটেই সময় নেই তার হাতে। ততক্ষণে নতুন chapter গুলোতে একটু চোখ বুলিয়ে নিতে বলেছে মাম্মা। “মাম্মা আমি একটু ছবি আঁকবো এখন”? “না না ছবি টবি এঁকে সময় নষ্ট করোনা সোনা…তুমি বরং science এর ছবি গুলো একটু প্রাক্টিস করে নাও ওই গুলো পরীক্ষায় আসবে এবারে”। এরপর weekly test এর পেপার নিয়ে সে যখন বাড়ি এসে তার মাম্মাকে বলে, “ জানো মাম্মা আমি God এর কাছে pray করছিলাম আমি যেন A1 পাই। নাহলেই তো তুমি আমাকে মারবে”। A1 পেয়ে আমার সোনামনি হাসি মুখে বাড়ি ঢোকে তখন। মাম্মাও তখন তার সোনামনি A1 পেয়েছে বলে জড়িয়ে ধরে অনেক অনেক আদরে ভরিয়ে দেয়। আর যেদিন ছোট্ট সোনার কপালে A1 জোটে না সেদিন বড় ভয়ে ভয়ে বাড়ি ঢোকে সে। আজকে মাম্মা যে তাকে ভীষন মারবে। তার কাছে মাম্মার ভালবাসাটা এখন শুধু A1 পাবার ওপরেই যে টিকে আছে।

সে তার ছোট্ট মাথায় এটুকু বুঝে গেছে শুধুমাত্র A1 পেলেই মাম্মার আদর পাওয়া যাবে আর সেটা নাহলেই মাম্মার মার আর বকুনি জুটবে তার কপালে। মা শিশুর সম্পর্কটাই এখন শুধু পরীক্ষার নম্বরের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে। এখন মাঝে মাঝে আমি ভাবি আমি কি মা হিসাবে দিনে দিনে একটা কসাই হয়ে উঠছি?? আমার মা বাবা তো কখন আমার সঙ্গে এমন নির্মম ব্যবহার করেননি। তবে আমি কেন আমার সন্তানের প্রতি এমন নির্মম ব্যবহার করে চলেছি? মাঝে মাঝে বুকের ভিতর এক মারাত্ত্বক বেদনা অনুভব করি। নিজেকে ধিক্কার জানাই। নিজের ওপরে ভীষন এক বিদ্বেষ অনুভব করি আমি।

কেন আমি আমার সন্তান যাকে আমি আমার প্রাণের থেকেও বেশি ভালবাসি তার ওপরে এমন নিষ্ঠুর হয়ে উঠছি? সারাক্ষণ নিজেকে প্রশ্ন করে চলেছি, আমি যা করছি তা কি ঠিক করছি? আমি কি আমার সন্তানের শৈশব কে নিজের হাতে খুন করে ফেলছি? রক্তাক্ত ক্ষত বিক্ষত আমি নিজেকে যখন এই প্রশ্ন করি তখনই আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে বর্তমান এই কঠিন পৃথিবীর নিষ্ঠুর নির্মম চিত্রটা। চতুর্দিকে এই ভয়ানক প্রতিযোগিতার মাঝে আমার সন্তান যদি সত্যি অনেক অনেক পেছিয়ে পড়ে তাহলে কি হবে ওর ভবিষ্যত? আমি যখন এই পৃথিবীতে থাকবনা আমার সন্তান যদি তখন মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে না পারে কে দেখবে তখন আমার নয়নের মণি কে? কার কাছে সাহায্য ভিক্ষা করবে তখন সে? নিজেকে তখন আবার বোঝাই, না কোন ভুল করছিনা আমি। ঠিক করছি আমি।

এমন করেই আমার সন্তান কে আজকের এই নির্মম পৃথিবীতে বড় করে তুলতে হবে যাতে সে আমার অবর্তমানে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারে। এমন ভাবেই শিক্ষা দিতে হবে আমাকে। আমাকে ভাল মা হয়ে উঠতেই হবে। আমিও তো এই চরম প্রতিযোগিতার এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। আমি হেরে যাবনা। জিততেই হবে আমাকে। জেতাতেই হবে আমাকে আমার ছোট্ট সোনামনি কে।

আরো পড়তে পারেন...

ভিক্ষুক

সবুজ গ্রাম। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মেঘনা। বাংলাদেশের অন্যতম নদীগুলোর মধ্যে মেঘনা একটি বৃহৎ…

জননী —- হাসান আজিজুল হক

কয়েক বছর আগে আমাদের ফ্ল্যাটবাড়িতে যে মেয়েটি কাজ খুঁজতে আসে, তার রূপ দেখে আমি স্তম্ভিত…

গল্পঃ গোলাপ ফুলের গল্প

আমার মায়ের শখ বাগান করা। প্রতিদিন নিয়মমতো বাগানের ফুলগাছগুলোর তিনি যেভাবে যত্ন নিতেন তাতে মাঝে…