বেশ কয়েক মাইল হেঁটে পূর্ব বিহারের এক প্রত্যন্ত গ্রামে পৌঁছল উত্তীয়। তাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে পার্টির কৃষক-কমরেড সুদামা। বাংলা থেকে বিহার আসার সময় উচ্চতর নেতৃত্ব বলে দিয়েছে সে যেন কোনওভাবেই স্টেশন চত্ত্বর থেকে সিগারেট বা বিড়ি না কেনে, চা না খায়। গলা শুকিয়ে কাঠ। জলের বোতলটাও শেষ হওয়ার মুখে। মূল শহর থেকে গ্রাম অনেক দূর। সকাল থেকে হাঁটা শুরু হয়েছে, এখন সূর্য অল্প ঢলে পড়েছে পশ্চিমে। তীব্র দহনে জ্বলে-পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে পৃথিবী। রাস্তায় একটা কুকুরও নেই। উত্তীয়র গায়ের জামা ঘামে লেপটে আছে, গাল আর থুঁতনি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে নোনতা তরল। জ্যৈষ্ঠের রোদে ঝিমঝিম করছে মাথা। সুদামা অবশ্য এসবে বেশ অভ্যস্ত। কোনও একটা ভোজপুরি ছবির গান গুনগুন করতে করতে চলেছে। উত্তীয় আর পারছিল না। পায়ে চটি থাকা সত্ত্বেও মনে হচ্ছে তপ্ত চাটুর ওপর হাঁটছে।
একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে ও ডাকল সুদামাকে, “কমরেড, ঔর কিতনি দূর যানা পড়েগা?” “বাস পহুঁচ গয়ে…আট-নও মীল কে কুছ আস-পাস…” সুদামার নির্বিকার উত্তর। গাছের নিচে বসে পড়ল উত্তীয়। এখনও আট মাইল! ওরা প্রায় বিশ মাইল হেঁটে এসেছে এক নাগাড়ে। এর পরে আরও…উফ! গাছের ছায়া লম্বা হতে হতে মিলিয়ে গেছে অন্ধকারে। দুপুরের লু থেমে ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে। বাবলার ঝোপগুলোকে দেখতে লাগছে হাত-পা ছড়ানো অশরীরীর মত। সন্ধ্যে সাড়ে-সাতটা নাগাদ উত্তীয়রা পৌঁছল নির্দিষ্ট গ্রামে – দরিদ্র কিষানদের বসতি, প্রায় অধিকাংশই হরিজন। পাশ দিয়ে তির তির করে বয়ে চলেছে এক চিলতে নদী। মিশকালো অন্ধকারের মধ্যেও উত্তীয় ঠাহর করতে পারল যে এই অঞ্চল এখনও একশো বছর আগের অবস্থায় পড়ে আছে। বিংশ শতকের শেষ ধাপে পৌঁছেও এমন গ্রাম রয়েছে ভারতবর্ষের বুকে! টিমটিমে কুপির পাশে হাড় বার করা বৃদ্ধ, শিশুর কান্নার আওয়াজ, সব মিলে অদ্ভুত মন খারাপ করা পরিবেশ। একটা ছোট ঝুপড়ির সামনে এসে দাঁড়াল দুজন। মাটিতে চাটাই পেতে কয়েকজন বসে কথাবার্তা বলছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন মধ্যবয়সী লোক এগিয়ে এলো। উত্তীয়কে উদ্দেশ্য করে বলল, “কমরেড, আনে মে কোই তকলীফ তো নহী হুই? জলদি মুঁহ-হাত সাফ কর লীজিয়ে। চায়ে তো পীয়েঙ্গে?” ততক্ষণে সুদামা হাতে করে একটা মাটির পাত্রে জল নিয়ে এসেছে। মুখ-হাত ধুতে ধুতে উত্তীয় ভাবল, এই গ্রামেও লোকে চা খায়! ঘরগুলোর অবস্থা তো চোখে দেখা যায় না। চায়ের পয়সা পায় কোথায়? চাটাইয়ে বসতে বসতে মধ্যবয়সী লোকটা উত্তীয়র হাতে একটা গামছা দিল – “ইসকি জরুরত পড়েগী আপকো।” তারপর একটু হেসে নিজের পরিচয় দিল, “মেরা নাম হ্যায় বংশীলাল।
পিছলে আঠঠারা সাল সে ইসি গাঁও মে হুঁ।” বাকিদের সাথে একে একে পরিচয় করিয়ে দিল বংশীলাল। মাও-চিন্তা প্রচার টিমের কয়েকজন কর্মীর সাথেও আলাপ হল। একটা অল্পবয়সী মেয়ে কানভাঙা টিনের কাপে “চা” এনে দিল। বংশীলাল বলল, “মাফ করনা কমরেড, শক্কর নহী হ্যায়, ইসলিয়ে আজ নমক সে হী কাম চলানা পড়েগা।” চায়ের সাথে একটা বিড়িও মিলল। নাহ, বিড়ি ঠিক নয়, একে বলে চুট্টা। কয়েক টানের বেশি দেওয়া যায় না। বুক জ্বলে যায়। একটু হেসে বিড়ি জ্বালিয়ে উত্তীয় চায়ে চুমুক দিল। এটা চা! ভাত রান্নার ফ্যানের সাথে একটু নুন মিশিয়ে দিলে যা হয়, এও তাই। চুপচাপ খেয়ে নিল উত্তীয়। সে তো আর চা খেতে আসেনি, সংগঠনের কাজে এসেছে। লোকাল কলেজের কিছু ছেলে-মেয়ে আসবে তার সাথে দেখা করতে আর কয়েক দিনের মধ্যেই। ছাত্র-সংগ্রাম কমিটির অভিজ্ঞতা বিনিময় করাই উদ্দেশ্য। তা ছাড়া সংগ্রামী রেডগার্ডের হিন্দি পাবলিকেশন ইউনিটও বানাতে হবে। মাস দুয়েকের ভিতর সব শেষ করে ফিরে যেতে হবে বাংলায়। বংশীলাল এবং অন্যান্যদের সাথে কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলার পর খাওয়ার ডাক পড়ল। মকাই দানার ভাত, শাক-জাতীয় কিছু একটার টক টক তরকারি আর নুন। ক্ষিদের মুখে এই খাওয়াই অমৃত মনে হল।
পরিশ্রমে ক্লান্ত উত্তীয় শুয়ে পড়ল খেয়ে উঠে। পা দুটো যেন কেউ কেটে নিয়েছে – কোনও সাড় নেই। খুব বেশি হলে সাড়ে-ন’টা বাজে। এরই মধ্যে গোটা গ্রামটায় মধ্যরাতের আমেজ। ঝুপড়ির দরজার কাছে একটা চাটাইয়ের ওপর শুয়ে আকাশের দিকে তাকাল উত্তীয়। আগেরদিনের অমাবস্যা কাটিয়ে আজ উঁকি দিয়েছে এক ফালি চাঁদ। গল্পের দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ পড়তে এখানে ক্লিক করুন