মালিকুসসালেহ

আলমালিক আলসালিহ:

সুলতান মালিকুসসালেহ (আরবি: الملك الصالح, ALA-LC: Sultan al-Malik al-Ṣāliḥ; আচেহনিস: মালিক উল সালেহ, মালিকুস সালেহ) একজন আচেহনিস যিনি ১২৬৭ সালে সামুদ্রা পাসাই নামক প্রথম মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তার আসল নাম ছিল মারা সিলু (বা মেরা সিলু বা মেহরা সিলু)। কিংবদন্তি অনুসারে, তিনি একবার একটি ইঁদুরকে ক্যাটের আকারের মতো দেখতে পান, এবং সেটিকে ধরেন ও খান। এই ঘটনার পর তিনি স্থানটিকে সামুদ্রা নামকরণ করেন, যা সংস্কৃত ভাষায় “সমুদ্র” অর্থে ব্যবহৃত হয়।মারা সিলু পরবর্তীতে ইসলাম গ্রহণ করেন এবং তাকে ইসলামী নাম আল-মালিক আল-সালিহ দেওয়া হয়। তিনি পার্শ্ববর্তী পেরলাক (পেউরুলাক) রাজ্যের রাজকন্যার সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তাদের দুই পুত্র সন্তান হয়। হিকায়াত রাজা-রাজা পাসাই অনুসারে, তিনি স্বপ্নে ইসলামের মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে দেখেন এবং এর মাধ্যমে ইসলাম গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।আরেকটি সূত্রে উল্লেখ করা হয়েছে যে, আচেহর এক প্রিন্স মালিক সাগর পাড়ি দিয়ে বেরুয়াস (গঙ্গা নগর) পৌঁছে সেখানে একটি সুলতানাত প্রতিষ্ঠা করেন। এই সব ঘটনাবলি মালিকুসসালেহের গুরুত্ব ও অবদানের প্রমাণ দেয়, যার ফলে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের বিস্তার ঘটে।

 

ইসলাম গ্রহণ এবং তার পরবর্তী সময়:

মালিকুসসালেহের ইসলাম গ্রহণ সম্পর্কে একটি জনপ্রিয় কিংবদন্তি রয়েছে। বলা হয় যে, তার আসল নাম ছিল ‘’মারা সিলু’’। তিনি একদিন স্বপ্নে মহানবী মুহাম্মদ (সা.)-কে দেখেন, এবং সেই স্বপ্নের প্রভাবেই তিনি ইসলাম গ্রহণ করেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তার নাম পরিবর্তন করে ‘’মালিকুসসালেহ’’ রাখেন, যার অর্থ “ধার্মিক শাসক”। এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি ইসলামের আদর্শ ও মূল্যবোধকে গ্রহণ করেন এবং নিজের সুলতানাতে ইসলামের প্রচার শুরু করেন। তার শাসনামলে সামুদ্রা পাসাই সুলতানাত ইন্দোনেশিয়ার প্রথম ইসলামিক সুলতানাতে পরিণত হয়, যা পরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

ইসলাম গ্রহণের পর মালিকুসসালেহ তার জীবন ও শাসন ব্যবস্থায় উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনেন। তিনি সামুদ্রা পাসাই সুলতানাতকে ইসলামের আদর্শ অনুসারে পরিচালিত করতে শুরু করেন। ইসলামিক আইন (শরিয়া) প্রবর্তন করেন এবং সুলতানাতের প্রতিটি দিক ইসলামী শিক্ষার আলোকে পরিচালিত হয়। তিনি সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ইসলামের নীতিমালা ও মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করেন। ইসলাম গ্রহণের পর মালিকুসসালেহ আধ্যাত্মিক জীবনযাপনে আরও মনোনিবেশ করেন। তিনি ইসলামের মূল শিক্ষাগুলো অনুসরণ করে ন্যায়বিচার, সততা, এবং ধর্মীয় দায়িত্ব পালনকে গুরুত্ব দেন। ইসলাম গ্রহণের পর তিনি তার সুলতানাতে ইসলামী আইন (শরিয়া) প্রবর্তন করেন। তার নেতৃত্বে সাম্রাজ্যে ন্যায়বিচার ও সামাজিক শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হয়, যা ইসলামের নীতিগুলোর আলোকে পরিচালিত হতো। মালিকুসসালেহ তার সাম্রাজ্যের ভিতরে ও বাইরে ইসলাম প্রচারের জন্য কাজ করেন। তার শাসনামলে সামুদ্রা পাসাই সুলতানাত ইসলামী শিক্ষা ও সংস্কৃতির কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। তার উদ্যোগে মাদ্রাসা ও ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠিত হয়, যেখানে কুরআন, হাদিস, এবং ইসলামিক আইন শেখানো হতো। ইসলাম গ্রহণের পর মালিকুসসালেহ তার শাসনামলে ন্যায়বিচার এবং মানবিক মূল্যবোধের উপর গুরুত্ব দেন। তিনি শাসকদের প্রতি জনসাধারণের ন্যায্য অধিকার রক্ষার জন্য কাজ করেন এবং সুলতানাতে শান্তি ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখেন।

 

ইসলামিক জীবনে তার অবদান:

মালিকুসসালেহের ইসলামিক জীবনে অবদান উল্লেখযোগ্য এবং গভীরভাবে সমাজের বিভিন্ন দিককে প্রভাবিত করেছে। তার সুলতানাতের প্রতিষ্ঠা ও পরিচালনার মাধ্যমে ইসলাম, সংস্কৃতি এবং শিক্ষা বিস্তারে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মালিকুসসালেহের নেতৃত্বে সামুদ্রা পাসাই সুলতানাত ইন্দোনেশিয়ায় ইসলামের প্রথম বৃহৎ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। তার প্রচেষ্টায় ইসলাম দ্রুত আচেহ অঞ্চলে এবং আশেপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তিনি ইসলাম প্রচারের জন্য মিশনারিদের পাঠান এবং স্থানীয় জনগণের মাঝে ইসলামিক শিক্ষার প্রচার করেন। মালিকুসসালেহ মাদ্রাসা এবং ইসলামিক শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে শিক্ষার ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। তিনি স্থানীয় এবং বিদেশী মুসলিম শিক্ষকদের নিয়োগ দেন, যাতে ইসলামী জ্ঞান ও শিক্ষা সাধারণ মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। তিনি সামুদ্রা পাসাইকে একটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্য কেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন। তার শাসনামলে সামুদ্রা পাসাই ইন্দোনেশিয়া ও অন্যান্য মুসলিম দেশের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হয়ে ওঠে। এই বাণিজ্যিক সম্পর্ক ইসলামের প্রসারেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে। মালিকুসসালেহ তার শাসনামলে সমাজের সব শ্রেণীর মানুষের কল্যাণে কাজ করেন। তিনি দরিদ্র ও অসহায় মানুষের জন্য বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্প গ্রহণ করেন, যা সমাজে ইসলামী মানবিক মূল্যবোধের প্রতিফলন ঘটায়। মালিকুসসালেহ তার শাসনামলে ধর্মীয় সহিষ্ণুতা ও শান্তির প্রতি গুরুত্ব দেন। তিনি বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন এবং সবার প্রতি ন্যায়বিচার ও সদাচার প্রদর্শন করেন।

মালিকুসসালেহের ইসলামিক জীবনের অবদান শুধুমাত্র তার সুলতানাতের ইতিহাসেই নয়, বরং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য একটি দৃষ্টান্ত হিসেবে প্রযোজ্য। তার নেতৃত্বের মাধ্যমে ইসলামের মৌলিক নীতিগুলি সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়, যা পরবর্তীতে ইসলামিক সংস্কৃতি ও সমাজের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। ইসলাম ও মুসলিম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় তার অবদান ইসলামিক সংস্কৃতি ও শাসনব্যবস্থার বিকাশের ভিত্তি স্থাপন করে, যা তার মৃত্যুর পরেও দীর্ঘকাল ধরে চলতে থাকে।

মৃত্যু:

সুলতান মালিকুসসালেহের মৃত্যুর ব্যাপারে কিছু ঐতিহাসিক অস্পষ্টতা রয়েছে, তবে সাধারণভাবে মনে করা হয় যে তিনি প্রায় ১২৯৭ সালে মারা যান। তার মৃত্যু সামুদ্রা পাসাই সুলতানাত এর জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ যুগের সমাপ্তি চিহ্নিত করে, যা তিনি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি একজন ধার্মিক শাসক হিসেবে স্মরণীয়, যিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইসলামের বিস্তারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। তার মৃত্যুর পর, তার দুই পুত্র তাকে অনুসরণ করে সুলতানাতের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন এবং ইসলামের প্রচার ও সামুদ্রা পাসাই সুলতানাতের প্রভাব বজায় রাখতে কাজ করেন। যদিও তার কবরস্থানের সঠিক স্থান নির্ধারণ করা সম্ভব নয়, তবে মনে করা হয় যে তিনি আচেহ অঞ্চলে সমাহিত হয়েছেন, যা তার প্রতিষ্ঠিত সুলতানাতের কেন্দ্রবিন্দু ছিল।

You may also like...

দুঃখিত, কপি করবেন না।