
রংধনু আসরের শিশু-কিশোর বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই কবি কালিদাস রায় তার ‘মাতৃভক্তি’ কবিতাটি পড়েছো। এ কবিতায় কবি বিখ্যাত সাধক বায়েজিদ বোস্তামীর মাতৃভক্তির এক বিষ্ময়কর কাহিনী তুলে ধরেছেন। তবে শুধু ওই ঘটনাটিই নয়, পৃথিবীতে এ ধরনের অনেক ঘটনা ঘটেছে এবং যতদিন পৃথিবী টিকে আছে ততদিন এ ধরনের ঘটনা ঘটতেই থাকবে। কেবল মানুষের মধ্যেই নয়, মা-বাবার প্রতি সন্তান এবং সন্তানের প্রতি মা-বাবার ভালবাসা পশু-পাখির মধ্যেও তা দেখা যায়। আজকের আসরে আমরা এ সম্পর্কেই একটি গল্প শোনাবো। আর গল্প শেষে থাকবে এক ছোট্ট বন্ধুর সাক্ষাৎকার।
সে অনেক দিন আগের কথা। এক হ্রদের ধারে বাস করত একটা গাভী ও তার ছোট্ট বাছুর। বাছুরটি ছিল গাভীর চোখের মণি। আর বাছুরের কাছে তার মা ছিল নিজের প্রাণের চেয়েও প্রিয়। বনের মাঝে সুখে-শান্তিতেই কাটছিল তাদের দিন।
কিন্তু একদিন হঠাৎ করে ঘটে গেল এক ভয়ানক ঘটনা। সন্ধ্যা বেলায় গাভী তার বাছুরকে বাড়িতে রেখে হ্রদের ধারে গেল ঘাস খেতে। কিছুক্ষণ পর এক বাঘ এসে হাজির হলো তার সামনে। গাভী বাঘকে দেখে ভয়ে চমকে উঠল। কী যে করা দরকার কিছুর তার মনে এলো না, শুধু মনে পড়ল তার বাছুরটির কথা। আর সে-কথা মনে হতেই বুকটা যেন একেবারে ভেঙে গেল।
কিন্তু বাঘকে তা বুঝতে দিল না। মনে সাহস এসে সে বাঘকে বলল,
গাভী: মহামান্য বাঘরাজ! আমাকে খাওয়ার জন্য ব্যস্ত হবেন না। বাড়িতে আমার ছোট্ট একটা মেয়ে আছে। বেচারা আমার দুধ খাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। আমাকে আপনি একটিবারের জন্য বাড়িতে যাওয়ার অনুমতি দিন। আমি তাই দুধ খাইয়ে ঠিক সকালে আপনার সামনে হাজির হব। তখন আপনি আমাকে খেয়ে নেবেন।
গাভীর করুণ চেহারা আর কথা বলার ধরন দেখে বাঘের দয়া হল। বাঘ বলল,
বাঘ: তোমার কথা যদি সত্যি হয় এবং তুমি যদি আবার এখানে ফিরে আস, তাহলে তোমার মেয়েকে দুধ দেয়ার জন্য আমি তোমাকে বাড়ি যাওয়ার অনুমতি দিচ্ছি। কিন্তু খবরদার! সময়মতো ফিরে না এলে আমি তোমার বাড়ি গিয়ে মা-মেয়ে দু’জনকেই খেয়ে আসব। কথাটা মনে থাকে যেন।
গাভী: নিশ্চয়ই হুজুর! আমার একটুও ভুল হবে না। আপনি অত্যন্ত মহৎ আর দয়ালু বলেই আমাকে মেয়ের কাছে যেতে দিচ্ছেন।
গাভী: আমি আপনার দয়ার কথা কী করে ভুলি হুজুর?
বাঘ: ঠিক আছে, তাহলে যাও তাড়াতাড়ি। সকালে আমার সামনে হাজির হতে যেন দেরি না হয়, কথাটা ভাল করে মনে রেখ।
বাঘের কথায় হাঁফ ছেড়ে বাঁচল গাভী। বাঘকে বারবার ধন্যবাদ জানিয়ে রওনা দিল বাড়ির দিকে। বাড়িতে পৌঁছেই কান্নাভেজা গলায় চিৎকার করে মেয়েকে ডাকল।
গাভী: বাছা আমার, শিগগির কাছে এসো। প্রাণভরে দুধ খেয়ে নাও এক্ষুনি। কাল সকাল থেকে আমাকে তুমি আর কোনোদিন দেখতে পাবে না।
বাছুর হতভম্ব হয়ে গেল মায়ের কথা শুনে। সে বলল,
বাছুর: তুমি এ রকমভাবে কথা বলছ কেন মা? এ ধরনের কথা তো তোমার মুখ থেকে আগে কখনো শুনিনি!
মেয়ের কথা শুনে মায়ের দু’চোখ অশ্রুতে ভরে গেল। এরপর সে বাঘকে দেয়ার প্রতিশ্রুতির কথা বলল। গাভীর কথা শুনে বাছুরও ভীষণ কষ্ট পেল। সে বলল,
বাছুর: তুমি কিছুতেই মরতে পার না মা। মরতে যদি হয়, তোমার বদলে আমিই মরব। কাল সকালেই আমি বাঘের কাছে যাবো। বাঘকে বলব- তোমার পরিবর্তে যেন আমাকে খায়।
মেয়ের মুখে এসব কথা শুনে মা’র একদিকে খুব কষ্ট হল, আবার আনন্দও হলো। মেয়ের জন্য গর্বে তার বুক ভরে গেল। তবে বাছরকে কিছুতেই বাঘের কাছে যেতে দিতে রাজি হলো না।
গাভী: না না, এ কিছুতেই হতে পারে না, বাছা। আমি তোমাকে কিছুতেই মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি না। তুমি এখনো অনেক ছোট, তোমার সামনে পড়ে আছে উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ।
গাভী ও বাছুরের মধ্যে এসব কথা চলতে চলতে পুবের আকাশ লাল হয়ে উঠল। একটু পরেই শুরু হবে আরেকটি নতুন দিন। বাছুরটি হঠাৎ লাফ দিয়ে উঠে বাঘের কাছে যাওয়ার জন্য দিল এক দৌড়। তার মা-ও ছুটতে লাগল তার পিছু পিছু। গাভীর আগেই বাছুর পৌঁছে গেল বাঘের কাছে।
বাঘকে উদ্দেশ্য করে চিৎকার করে বলল,
বাছুর: বাঘ মহারাজ! আপনি আমার মাকে খাবেন না। মায়ের বদলে আমাকে খান। আমার গোশত খুব কচি, দারুণ সুস্বাদু লাগবে। তাড়াতাড়ি করুন। আমি আমার মায়ের জন্য একটা ভাল কাজ করতে চাই।
এ সময় গাভীও পৌঁছে গেল বাঘের কাছে। সে চিৎকার করে বলল,
গাভী: না হুজুর না, আমার মেয়েকে খাবেন না। ও এক্কেবারে শিশু। শরীরে তেমন গোশতও নেই। ওর গোশতে আপনার পেট ভরবে না। আপনি প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আমাকেই খান।
গরু ও বাছুর কেউই মরতে ভয় পাচ্ছে না দেখে বাঘ আশ্চর্য হয়ে গেল। কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করার পর বাঘ মনে মনে বলল,
বাঘ: সবাই-ই তো মরতে ভয় পায়। কিন্তু এরা ভয় পাচ্ছে না কেন! নিশ্চয়ই এটা মা ও মেয়ের খাঁটি ভালবাসা। আর এ জন্যই ওরা দু’জনেই দু’জনের জন্য জীবন দিতে প্রস্তুত। যাই হোক, আমার পেটের জন্য এই ভালবাসা তো ধ্বংস করতে পারি না।
এই কথা ভেবে বাঘ গরু-বাছুরকে না খাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। গরু ও বাছুরের উদ্দেশ্যে বাঘ বলল,
বাঘ: এই যে বাছারা! তোমরা এখন আমার মুখে শিকার। আমি ইচ্ছে করলে তোমাদের দু’জনকেই খেতে পারি। কিন্তু আমি ঠিক করেছি তোমাদের কাউকেই আমি খাব না। একে অপরের প্রতি তোমাদের এ মহত্ব আমাকে মুগ্ধ করেছে। তাই আমি তোমাদের ছেড়ে দিচ্ছি। যাও, তোমরা নির্ভয়ে বাড়ি চলে যাও।
এই কথা বলে বাঘ বনের ভেতর চলে গেল। গাভী আর বাছুর তো মহাখুশী। বুক ভরা আনন্দ নিয়ে তারা ফিরে গেল বাড়িতে।