ভয়

অনেক রাত এখন। ১২টার মত হবে। ট্রেনটা চলছে। ঝিক ঝিক্, ঝিক ঝিক্। ট্রেন চলার একটানা শব্দ নেশা দরিয়ে দেয়। রাজীবের প্রায় ঘুম চলে এল। অনেকদিন পর সে ঢাকার বাইরে যাচ্ছে। এক ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কাজ করে সে। কোম্পানির প্রয়োজনেই ঢাকার বাইরে আসা। চট্টগ্রামে কোম্পানির এক নতুন অফিস খোলা হবে। ঐ জন্য সেখানকার বিভিন্ন গ্রামে ঘোরাঘুরি করতে হবে। লোকজনকে জানাতে হবে কোম্পানির বিষয়ে। বিরক্তিকর কাজ! লোকজনের কাছে যাও, তাদের তেল মারো, জঘন্য অবস্থা! কিন্তু কি আর করা? কোম্পানির এম্প্লয়ি সে, উপায় তো নেই। রাজীব ভাবছে চাকরীটা ছেড়ে দেবে। কিন্তু আরেকটা চাকরী না পাওয়া পর্যন্ত এটা তো ছাড়া যাবে না।

রাজীব আড়-মোড়া ভাঙলো। ঘরিতে সময় দেখে একটু চিন্তিত হল সে। লোকজন স্টেশনে থাকবে তো? ও যে গ্রামে যাচ্ছে তার নামটা বড় অদ্ভূত, ‘পরিনগর’। গ্রামে ওর থাকার জন্য একটা বাংলোর ব্যবস্থা আছে। মনোজ নামে এক দারোয়ান আছে ও বাড়ির। ওই রাজীবকে স্টেশন থেকে নিয়ে যাবে। একটা সিগারেট ধরাল রাজীব। হালকা শীত শীত লাগছে। ট্রেনের হুইসেলের শব্দ শোনা যাচ্ছে। রাজীব জানালা দিয়ে বাইরে তাকালো। স্টেশন দেখা যাচ্ছে একটা। এটাই বোধহয় পরিনগর্, নাকি? হ্যা, বোর্ড দেখা যাচ্ছে। শরীরে গোটাকয়েক ঝাকুনি দিয়ে ঘুম ঘুম ভাবটা কাটালো সে।

স্টেশনে তেমন লোকজন নেই, বাইরে কোন গাড়িও দেখা যাচ্ছে না। দুই-একটা রিক্সা যাও আছে, সব শালারা ভাং খেয়ে চিৎ হয়ে আছে। ‘রেকলেস !’ মনে মনে গাল দেয় সে। হঠাৎ আওয়াজ শুনে চমকে উঠল সে। ‘ভাই সাহেব্, কই যাইবেন্?’ পিছনে ফিরে দেখে লুঙ্গি আর শার্ট পরা এক লোক। ‘ভাই সাহেব্, জবাব দিলেন না তো, কই যাইবেন্?’ ‘জ্বি, আমি রাজীব চৌধুরি, লাইফ ইন্সুরেন্স কোর্পোরেশন থেকে এসেছি।’ ‘সালাম সাহেব, আমি মনোজ্।’ ‘ওহ ! আপনি ই সেই লোক্? ঠিক আসে, চলুন্। কিন্তু গাড়ি-ঘোড়া তো কিছুই দেখছি না। যাব কিভাবে?’ ‘চিন্তা নিয়েননা। বেশি দুরে না বাড়িটা। হাইটা গেলে আধ ঘন্টা লাগবো। চলেন, আর দেরি কইরেন না।’ ‘ঠিক আছে, চলুন।’

‘সাহেব একটা কথা…’ ‘কি কথা?’ ‘আমরা যে রাস্তায় যাইতেছি সেইটা ভালো রাস্তা না..’ ‘রাস্তা কি অনেক ভাঙা?’ ‘না…’ ‘তাহলে রাস্তা ভালো না মানে কি?’ ‘মানে আপনার বোঝা লাগবে না। শুধু একটা কথা, কনো শব্দ শুনলে ভুলেও সেই দিকে তাকাইবেন না।’ মনোজের কন্ঠ শুনে রাজীবের শিরদাড়া বেয়ে এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। কি যেন ছিল ওই কন্ঠে ! রাজীব আর কিছু না বলে হাটতে থাকে। নিঝুম রাত। রাস্তার দুই পাশের গাছগুলো যেন তাকিয়ে আছে তার দিকে! টেনশন হচ্ছে রাজীবের্, আর টেনশন হলেই ওর সিগারেটের নেশা জাগে। সিগারেট ধরালো সে।

আরে! কোথায় গেলো লোকটা? আজব তো! রাজীব চারপাশে তাকালো। হঠাৎ চাপা হিস হিস শব্দে কে যেন বলে উঠলো, ‘সিগারেট নিভান! জলদি!’ রাজীব ভয় পেয়ে গেল। সিগারেটটা নিভিয়ে ফেলল। মনোজ রাগী কন্ঠে বলে উঠলো, ‘পথে আর সিগারেট ধরাইবেন না।’ চারিদিক নিশ্চুপ। ওরা হাটতে থাকে। সামনেই একটা মন্দির দেখা যাচ্ছে। হঠাৎ নানা ধরণের শব্দ আসতে লাগলো ওর কানে। চাপা আর্তনাদ্, হাসি, কান্নার শব্দ। রাজীবের গলা শুকিয়ে গেলো। নিচু স্বরে সে মনোজকে বলল, ‘এগুলো কিসের শব্দ?’

মনোজ ধমকে উঠলো চাপা স্বরে, ‘চুপ! চুপ কইরা থাহেন!’ ওরা হাটতে থাকে। মন্দির অতিক্রম করতেই শব্দগুল কমে আসতে লাগল। রাজীব ভাবল শব্দের কারণ মনোজকে আবার জিগ্গেস করবে। কিন্তু কি জান ভেবে আর জিগ্গেস করল না। রাজীব হঠাৎ পাথরের মত জমে গেল। ওর মনে হতে লাগল কে বা কারা যেন ওদের পিছে হাটছে। রাজীব অনেক কষ্টে পিছনে তাকাবার ইচ্ছাটাকে দমন করলো। হাটতেই থাকল সে। পুরো পথ জোছনালোকিত। কিন্তু চাঁদটাকে কেন যেন বড় বিষণ্ন মনে হচ্ছে। জোছনার আলোটাও কেমন যেন মরা-মরা।

এসব ভাবতে ভাবতে সে অন্যমনষ্ক হয়ে পড়ছিলো। হঠাৎ সে দাড়িয়ে পড়তে বাধ্য হল। মনোজ আবার কোথায় গেল? ‘আমি এইহানে।’ চাপা স্বরের আওয়াজ। আওয়াজটা ওর অন্তরে যেন কাঁপুনি ধরিয়ে দিল! ‘আপনি পানিতে কি করছেন্?’ রাস্তার পাশে এক জলাশয়ে হাটু পানিতে দারিয়ে আছে সে। ‘এইহানে আহেন।’ ‘এখানে আসেন মানে! আমি কি পানিতে নামবো নাকি?’ ‘হ, যাইতে চাইলে পানিতেই নামতে হইব।’ ‘মানে কি! আপনার মাথা ঠিক আসে?’

‘কথা বাড়াইবেন না। জলদি আহেন্। নাইলে বিপদ হইব।’ অগত্যা বাধ্য হয়ে জলাশয়ে নামতেই হল তাকে। মনোজের কাছে আসতেই সে বলে উঠল, ‘পানিতে তাকাইবেন না। সামনে তাকায়া চলেন। যত জলদি পারেন চলেন। থামলেই বিপদ!’ ‘কিসের বিপদ?’ জানতে চাইল রাজীব। মনোজ উত্তর না দিয়ে সামনের দিকে হাটতে থাকলো। অপর পাড়ের দিকে যাচ্ছে তারা। হঠাৎ রাজীবের পায়ে কি যেন ঠেকল।

মনোজের কথা ভুলে গিয়ে সে পানিতে তাকালো। দেখল জোছনা আলোয় ওর পায়ের কাছে এক মড়ার খুলি চিক চিক করছে। অন্তরটা কেঁপে উঠলো ওর। মনোজকে ডাকবে বলে মাথা তুলল। কিন্তু মনোজ কোথায়? আরে! এটা কোন জায়গা? জলাশয়টাত এমন ছিল না! রাজীব ভয়ে কেঁপে উঠল। সে সোজা দ্রুত হাটতে শুরু করলো। কোথা থেকে যেন এক বিকট হাসির আওয়াজ ভেসে এলো। কলজেটা শুকিয়ে গেল ওর্। রাজীব থামল না। ছুটতে চেষ্টা করল।

হঠাৎ কি যেন ওর পা টেনে ধরল। সে প্রাণপণ চেষ্টা করল ছুটতে কিন্তু পারলো না। পানিতে পড়ে গেল সে। কোন রকমে হাচ্ঁড়ে-পাচ্ঁডে এগুতে চেষ্টা করল। কিছু দূর এগুতেই ওর হাতটাও কে যেন টেনে ধরল। চিৎকার করে উঠলো রাজীব। পানিতে হাবু-ডুবু খেতে লাগল। কোথাও যেন এক শিয়াল ডেকে উঠল করুণ স্বরে। সে দেখল ক্রমেই চাঁদটা মেঘে ঢেকে যাচ্ছে।

হঠাৎ কে যেন বলে উঠল, ‘ভাই সাহেব, আমার হাতটা ধরেন—‘ রাজীব দেখল একটা শীর্ণ হাত এগিয়ে আসছে তার দিকে। রাজীব প্রাণপণে চেষ্টা করল হাতটা ধরতে। কিন্তু পারলো না। হাতটা ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছে। হঠাৎ কি যেন ওর গলা পেঁচিয়ে ধরল। বাঁধন ক্রমেই শক্ত হচ্ছে। শ্বাস নিতে পারছে না সে। বুক ভারী হয়ে আসছে ওর। ক্রমেই পানিতে ডুবে যাচ্ছে সে। চাঁদ পুরোপুরি ঢেকে যাচ্ছে মেঘে। ”না ——–!!!!!” চিৎকার করে উঠলো রাজীব।

সর্বাংগ ঘামে ভেজা। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিছানার পাশে রাখা গ্লাস থেকে ঢক – ঢক করে পানি খেল সে। ‘ওহ্! কি ভয়াবহ দুঃস্বপ্ন!’ বলে উঠলো সে। ঘড়িতে সময় দেখলো। রাত চারটা বাজে। বাথরুমে গিয়ে মুখ ধুতে শুরু করল সে। হঠাৎ তার গলার দিকে চোখ পরল। অবাক হয়ে গেল সে। গলায় কিসের যেন পেঁচিয়ে ধরার দাগ। নিজের হাত আর পায়ের দিকে তাকালো সে। একই রকম দাগ দেখতে পেলো। ভয় পেয়ে গেলো সে। আজ তো ওর পরিনগর যাবার কথা। কি ঘটতে চলেছে আজ——–??

জ্বীনের বাদশা

একটি রিকশা ভ্রমন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *