বোবা গুপ্তচর— নুরুল ইসলাম বাবুল

আমরা নাটক করব। সখটা মনের ভেতর উকিঁঝুকিঁ মারে। অনেকদিন ধরে। কিন্তু করা হয় না। আসল কথা, নাটক করার ব্যাপারে আগামাথা কিছুই আমাদের জানা নাই। ফুটবল খেলায় আমরা চ্যাম্পিয়ন। ক্রিকেটেও মন্দ না। এলাকার উন্নয়ন মূলক কাজে অথবা বিপদগ্রস্থকে সাহায্যের ব্যাপারে আমাদের সুনাম গ্রাম জুড়ে। রাস্তা-ঘাটে চলতে-ফিরতে আমরা নিজেদের প্রশংসা নিজ কানেই শুনেছি। তাই পাঁচজনের ফাইভ স্টার দলটা গড়তে পেরে আমরা ধন্য। দলের লিডার হিরা। আমরা একমনে ওকে লিডার মানি। কারণ ওর উপস্থিত বুদ্ধি প্রখর।
শক্তি আর সাহসও সবার চেয়ে বেশি। তাছাড়া লেখাপড়ার বেলাতে হিরা ক্লাস নাইনের ছাত্র। আমি, নয়ন ও আনু এইটে পড়ি। দলের সবচেয়ে জুনিয়র কাফি এবার সিক্সে। আমাকে ডেপুটি লিডার বানিয়েছে হিরা। ও যেদিন লিডার মনোনীত হল, সেদিন নিজে থেকেই প্রস্তাব করল, কবীর হবে আমাদের ডেপুটি। একথা শুনে নয়নের ঘাড় ফুঁলে উঠল। রেগে গেলে ওর এমনটা হয়। তখন আর কথা বলতে পারে না। দলের ডেপুটি লিডারের পদটা না পাওয়ায় নয়ন ঘাড় ফুলিয়ে অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে রইল। তবে দিন কয়েক পরে ওর সব রাগ মাটি হয়ে গেল। আনু আর কাফি কোন ব্যাপারেই রাগারাগি করে না। আজ সারাদিন গরম ছিল। প্রচন্ড রকমের দাবদাহ।

বিকেল বেলায় সূর্যের সেই তেজ নেই। বরং ঠান্ডা বাতাস বইছে। আমরা বসে আছি ওয়াপদা বাঁধের ঢালুতে। পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধটা অনেক বছর আগে তৈরি করা হয়েছে। আমাদের পাথার এলাকার হাজার হাজার বিঘা কৃষি জমির পরিকল্পিত আবাদের জন্য। কিন্তু সেই পরিকল্পনা বাসত্মবে রূপ নেয়নি। রাউতারা স্লুইট গেট অকেজো হয়ে পরে আছে। গেট থেকে নিমাইচরা পর্যমত্ম বাঁধটার কিছু অংশ বিলিনের পথে। আমাদের গ্রামের পূর্বপাশ দিয়ে চলে যাওয়া ভগ্ন দশা ওয়াপদা বাঁধ এখনোও স্বপ্ন দেখায় পাথারের কৃষকদের। আমরা প্রায়ই এই ওয়াপদা বাঁধের ঢালুতে বসি। বিকেলের আড্ডা ভালোই জমে। পাড়ার, অন্যপাড়ার ছেলেরাও আসে। আজ হিরা আর আনু এখনো আসেনি। ওদের দু’জনের যাওয়ার কথা পাশের গ্রামের নজর”ল ভাইয়ের কাছে। গত ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে নজর”ল ভাই নিজে নাটক লিখে পাড়ার ছেলেদের নিয়ে নাটক করেছে। আমরা সেই নাটক দেখি নাই। শুধু কানে শুনেছি। নাটকের নাম লাল সবুজের পতাকা। যারা দেখেছে তারা বলেছে, খুব ভাল নাটক। আমরা শুনে শুনে, আবার শুনেছি। শুধু তাই নয়, গতপরশু নজর”ল ভাইয়ের পয়লা বৈশাখের ‘পান্তা ভাত’ নাটক দেখতে গিয়েছিলাম। অনুষ্ঠান শেষে হিরা নজরুল ভাইয়ের সাথে আলাপ করেছে। শুধু হিরা নয়, আমরা সবাই মিলে কথা বলেছি। নজরুল ভাই আজ দেখা করতে বলেছেন।
নাটক করার পোকাটা আমাদের ভালো মতোই পেয়ে বসেছে। হিরার ফিরতে দেরি হওয়ায় নিজের কাছেই অস্থির-অস্থির লাগছে। তা প্রকাশ করলাম না। প্রকাশ করল নয়ন, কিরে ডেপুটি, আমাদের লিডারের এত দেরি হচ্ছে কেন? – হয়তো নজরুল ভাই বাড়ি নাই। ওরা অপেক্ষা করছে। – কেন মোবাইলে কথা বলে যায়নি? – তা হয়তো বলেছে। – তাহলে! – মানুষের কত রকম বিপদ-আপদ আছে না। অনেক সময় কথা দিয়েও কথা রাখা যায় না। – তা ঠিক। নয়ন এ কথা বলতে বলতেই কাফি হাত দিয়ে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ ওরা আসছে। এতোক্ষণ কাফি ওদের ফিরে আসার রাস্তার দিকেই তাকিয়ে ছিল। ওরা তখনও পঞ্চাশ হাত দূরে। কাছে আসার তর সইল না। জিজ্ঞেস করলাম, কিরে নজর”ল ভাই কী বলল? লিডার হিরা স্বভাব সুলভ হাসল। কাছে এসে বসতে বসতে বলল, নাটক লিখে দিবেন। তবে… – তবে কী? – না, কিছু না। – কিছু না মানে। পরিষ্কার করে বল। – নজরুল ভাই সময় দিতে পারবেন না। – দু’একদিন এসে ব্যাপারটা বুঝিয়েও দিবেন না? – তা দিবেন। অনুষ্ঠানের দিনেও থাকবেন।

হিরা আর আমার কথা শুনছিল ওরা। অভিনয় করার পোকা আনু হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেল। আমরা জানি, ও এখন ডায়লগ ছাড়বে। ওর এই এক অভ্যেস। মন চাইলেই দাঁড়িয়ে এ্যাকটিং শুরু করে দেয়। বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা….। আনুর এ্যাকটিং শেষ না হতেই টিপ্পনী কাটল নয়ন। -উ. নবাব। তাতে বসে পড়ল আনু। হিরাকে বলল, দেখেছিস। নয়নও কিছু একটা বলবে। এমন সময় হিরা ওকে থামিয়ে দিল। আনুকে বলল, বাদ দে। আসল কথায় আয়। -কী আসল কথা? কাফি জিজ্ঞেস করল। হিরা একটু সময় নিয়ে বলল, নাটকের কথা। শুধু বসে বসে নাটক-করব নাটক-করব বললে তো হবে না। -লিডার কী করতে হবে বল। আনু জোর গলায় বলল। – প্ল্যান করতে হবে, প্রস্ত্ততি নিতে হবে। আমরা যখন নাটক করার প্রস্ত্ততি নিয়ে তুমুল আলোচনায় ব্যস্ত ঠিক তখনই আগমন ঘটল লোকটার। ছিমছাম চেহারার যুবক বয়সের লোকটা দাঁড়াল আমাদের সামনে। ভাবলাম এদিকে কোন আত্মীয়-স্বজনের বাড়িতে এসেছে। প্রথম আসায় বাড়ি-টাড়ি চিনতে পারছে না। জিজ্ঞেস করে নিবে। প্রায়ই তো এমন হয়। পথচারীরা আসতে-যেতে এ-পাড়া ও-পাড়ার রাস্তা কোন দিকে শুনে নেয়। আমরা দেখিয়ে দেই। এ লোকটাকেও হয়তো কোন পাড়ার রাস্তা দেখিয়ে দিতে হবে। কিন্তু না, আমার ভাবনাকে পাশ কাটিয়ে লোকটা বসে পড়ল। আমাদের সামনেই। নয়ন জিজ্ঞেস করল, আপনি কোথা থেকে এসেছেন? লোকটা কোন কথা বলল না। শুধু নয়নের মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। আনু জিজ্ঞেস করল, কাদের বাড়িতে এসেছেন? আরও লোকটা কোন থা না বলে আনুর মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। বেশ কৌতূহলী হলাম আমরা। ভাল করে লক্ষ্য করলাম লোকটাকে। বয়সে তরুণ। ফর্সা-হ্যান্ডসাম চেহারা। হাফ হাতা টি-শার্ট গায়ে। পরনে জিন্সের প্যান্ট। কাঁধে ঝুলানো ব্যাগ। আর্মিদের মতো চুলকাটা। দেখতে অসম্ভব রকমের ভদ্র।

লোকটা এপর্যন্ত কোন কথা বলেনি। আমিই জিজ্ঞেস করলাম, আপনি কথা বলছেন না কেন? লোকটা ব্যাগের সাইড পকেট থকে একটা প্যাড আর কলম বের করল। খচ খচ করে কিছু লিখল। তারপর আমাদের সামনে মেলে ধরল। আমরা লেখাটুকো পড়ে বিস্ময়ে হতবাক। লোকটা লিখেছে, আমি কথা বলতে পারি না। -ইস্! বলে আনু লোকটার প্রতি মায়া হচ্ছে এমনটা প্রকাশ করল। হঠাৎ করে আমার মাথার মধ্যে একটা চিমত্মা ঘোরপাক খেল -যারা কথা বলতে পারে না, তারা তো কানেও শুনতে পায় না। কিন্তু লোকটা তো শুনতে পাচ্ছে বলে মনে হচ্ছে। একটু সন্দেহ প্রবণ হয়েই জিজ্ঞেস করলাম, কতদিন হলো কথা বলতে পারেন না? লোকটা লিখল, বছর খানেক। -কেন, কী হয়েছিল? লোকটা লিখল, আমার সৎ মা আমাকে মেরে ফেলার জন্য ভাতের সাথে বিষ জাতীয় কিছু দিয়েছিল। আমি তা খেয়ে না মরলেও, সেই থেকে কথা বলতে পারি না। আমার সন্দেহ কাটল। এমনটা তো হতেই পারে। -ইস্! বলে আনু আবার দরদ প্রকাশ করল। এবার আমারও একটু মায়া লাগল। লিডার হিরা কিছু একটা ভাবছিল। এবার সে জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী ? লোকটা লিখল, এরশাদুল বারী। নয়ন জিজ্ঞেস করল, বাসা কোথায়? লোকটা লিখল, ঢাকায়। আনু জিজ্ঞেস করল, বাবা কী করেন? লোকটা লিখল, বাবা সাবেক রাষ্ট্রদূত। আমরা আরও একবার চম্কে উঠলাম। রাষ্ট্রদূতের ছেলে! হিরা জিজ্ঞেস করল, এখানে কেন এসেছেন? লোকটা লিখল, সৎ মায়ের হাত থেকে বাঁচার জন্য পালিয়ে বেড়াচ্ছি। এ কথাগুলো লেখার সময় লোকটাকে দুঃখী -দুঃখী মনে হল।

কাফি জিজ্ঞেস করল, এখন কোথায় যাবেন? লোকটা লিখল, জানি না। লোকটাকে কেমন উদাস-উদাস মনে হল। আশ্রয়হীন লোকটার অসহায় চেহারা চোখে-মুখে ফুটে উঠল। আমরা কেউ কিছু বলতে পারছিলাম না। সবাই কেমন লোকটার মতই উদাসীন হয়ে গেলাম। বেশ কিছু সময় নিরবেই কাটল। লোকটা আবার লিখল, মামারা, আমাকে একটু আশ্রয় দিবেন? লোকটা তাই প্রথম আমাদের মামা বলে সম্মোধন করেছে। আমরা মনে হয় খুশিই হলাম। অচেনা বোবা লোক এরশাদুল বারী আমাদের বারী মামা হয়ে গেল। আর এমন একটা অসহায় লোককে আনু নিজ বাড়িতে রাখার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করল। আনুদের ঘর ফ্রি আছে। ওর বাবা-মা লোকটার কথা শুনলে থাকতে দিবেন, এতে আমাদের মনেও সন্দেহ নাই। রাতে কিছু বলিনি। সকাল বেলা খাওয়ার সময় বাবা-মাকে বারী মামার কথা বললাম। ইনিয়ে-বিনিয়ে বারী মামার অসহায়ত্বকে আরও বেশি করে ফুটিয়ে তুললাম। যাতে দু’এক বেলা আমাদের বাড়িতেও মামার খাওয়ার ব্যবস্থা হয়। খাওয়ার সময় বাবা কোন কথাই বললেন না। খাওয়া শেষে বললেন, আশ্রয়হীনকে আশ্রয় দিয়েছ ভালো কথা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাড়িতে মুক্তিযোদ্ধারা থাকতো। খেতো। দিনের পর দিন। মাসের পর মাস। আনুদের বাড়িতেও তাই। এই গ্রামের ভেতর আমরাই মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দিয়েছিলাম। মা বলল, লোকটা কিন্তু একেবারেই অচেনা, অজানা। -তাতে কী হয়েছে মা? – একটু দেখে শুনে চলবি। – মা, তুমি ভেব না, বারী মামা একেবারে অন্যরকম মানুষ। মায়ের মন। কিছু শঙ্কা রয়েই গেল। তাই হয়ত বলল, তবুও বাপ। বাবা বললেন, একদিন নিয়ে আসিস তোদের বারী মামাকে। -আচ্ছা। বলে পড়ার টেবিলে বসলাম। ছোট্ট একটা হোমওয়ার্ক ছিল। তৈরি করে উঠে পড়লাম। ছুটির দিনে অতো লেখাপড়া ভাল্লাগে না। বড়দের জ্বালায় বাঁচাই দায়। তাদের কথাই হল-পড়,পড়, পড়। একদৌড়ে আনুদের বাড়িতে গেলাম। দেখি আগে-ভাগেই হিরা, নয়ন, কাফি এসে হাজির। আমাকে দেখেই কাফি তাড়াতাড়ি করে বলল, কবীর, খবর জানিস। -কীসের খবর।

-জববর একখান খবর। -কী, বল না। এবারে কাফি বলার আগেই নয়ন বলল, মোল্লা পাড়ার হাজী বাড়িতে নাকি আজ নাটকের শুটিং হবে। ঢাকা থেকে লোক এসেছে। টেলিভিশনের নাটক বানাবে। -তাই নাকি। চল যাই দেখে আসি। আনু বলল, বারী মামাকেও নিয়ে আসি। বারী মামা যেতে রাজী হল না। নতুন জায়গায় নাকি রাতে ভাল ঘুম হয়নি। এখন খেয়ে-দেয়ে ঘুমাবে। আমরা জোর করলাম না। ছুটলাম মোল্লা পাড়ার দিকে। আরও অনেক লোক যাচ্ছে । এর আগে এ এলাকায় কোন শুটিং-ফুটিং হয়নি। এই প্রথম। প্রায় দৌড়েই পৌঁছালাম মোল্লা পাড়ার হাজী বাড়ি। বহু লোকের ভিড়। চারিদিকে ঘিরে আছে এলাকার লোকজন। আমরাও দাঁড়ালাম। লিডার হিরা বলল, দেখ একটা লোককে খুঁটির সাথে পিঠমোড়া করে বেঁধে রেখেছে। পাশ থেকে একজন বলল, ওটা হল তারক মুচি। আনু জিজ্ঞেস করল, কী করেছে ও? পাশের আরেকজন বলল, বিষ দিয়ে গরু মেরেছে। বিষ খাইয়ে গরু মারার অপরাধে তারক মুচির বিচার বসেছে। গ্রামের মোড়লরা বসে আছে চেয়ারে। গ্রামবাসী চারিদিকে দাঁড়িয়ে। এই হলো নাটকের দৃশ্য। ক্যামেরাম্যান এদিক-সেদিক মুভ করছে। থ্রি, টু, ওয়ান, জিরো জিরো-এ্যাকশন। শুরু হল শুটিং। একটু পরেই পাশ থেকে একজন লোক চেঁচিয়ে উঠল, কাট্। ওমনি বন্ধ হলো ক্যামেরা। বন্ধ হলো সংলাপ। ক্যামেরাম্যানের সাথে কিছু কথা বলল লোকটা। মনে হয়, এই নাটকের পরিচালক উনি। আমরা চিনি না। পাশ থেকে কেউ একজন বলল, উনি পরিচালক আব্দুল আজিজ টিপু। পরিচালক টিপু অভিনেতাদের কি কি যেন বুঝিয়ে দিলেন। পরক্ষণেই আবার শুরু হলো শুটিং। থ্রি, টু,ওয়ান, জিরো-জিরো-এ্যাকশন। কাট্। থ্রি, টু,ওয়ান, জিরো-জিরো-এ্যাকশন। কা্ট। চলতেই থাকল। একফাঁকে আমরা জেনে নিলাম নাটকের নাম-তারক। লেখকও সাথে আছেন। আমরা তার সান্নিধ্য পেতে চেষ্টা করলাম। আমাদের আনু আবার পরিচালকের পিছু পিছু ঘুরছে। যদি একটা চান্স হয় ভবিষ্যতে এই আশায়। লেখককে খুঁজে পেলাম। আমার ছোট কাকুর মতো মাথায় অল্প-অল্প চুল। ছোট কাকুকে আমরা চান্দু কাকা বলি। কাকা অবশ্য মাথায় চুল না থাকায় গর্বই করেন। গলা উঁচিয়ে বলেন, জানিস ভাস্তেরা, বুদ্ধিজিবিদের মাথায় চুল থাকে না। একদিন ছোট কাকুর এ কথার প্রমাণ করার জন্য বইতে শহিদ বুদ্ধিজিবিদের ছবি খুঁজে বের করলাম। কথাটা হান্ডেড পার্সেন্ট মিলল না। তারক নাটকের লেখক আবদুল মান্নান সরকার। আমরা তাঁর সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম, আমাদের পাথার এলাকা নিয়ে অনেক ভাবেন তিনি। এখানেই তাঁর জন্ম। বড়ও হয়েছেন পাথারে।

এখানকার মানুষের জীবন-যাত্রা নিয়ে তিনি বই লেখেন। আমরা আমাদের নাটক করার সখের কথা বললাম। শুনে তিনি বেশ খুশি হলেন। আগামীতে কোন কাজ শুরু করলে আমাদের সুযোগ দেওয়ার কথা বললেন। আমরা খুশিতে-আনন্দে আটখান হয়ে পড়লাম। শুটিং শেষে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মনে হল জীবনে আজ অনেক বড় অর্জন হল। যা কোনদিন দেখা হয় নাই। তা আজ দেখা হল। বিকেল বেলায় ওয়াপদার ঢালুতে একত্রিত হলাম। ফাইভ স্টারের পাঁচজন ছাড়াও বারী মামা আছেন। শেখ পাড়ার শিবলু ও তুহিন, দক্ষিণপাড়ার তুষার, মিলন ও মিশুক এসেছে। ওরাও আমাদের সাথে নাটক করবে। আমরা আলাপ আলোচনা শুরু করলাম। শিবলু, তুহিন, তুষার, মিলন, মিশুক ছাড়াও দু’একজন প্রয়োজন পড়লে অন্য পাড়ার আগ্রহী ছেলেদের নেওয়া হবে। লিডার হিরা জানালো, নজরুল ভাই কাল-পরশুর মধ্যে নাটকের স্ক্রিপ্ট পাঠাবেন। সিদ্ধান্ত হল আমরা গ্রীম্মের ছুটির আগেই রিহার্সেল শুরু করব। ছুটির মধ্যে ফুল মহড়া চলবে। তারপর সময়-সুযোগ মতো ফাইনাল অনুষ্ঠান করা হবে।
সবকিছু শুনে বারী মামা আমাদের সাথে একমত প্রকাশ করল। পকেট থেকে প্যাড-কলম বের করে লিখল, আমিও স্কুল-কলেজে নাটক করেছি। আমরা বাড়ি মামার কথায় উৎসাহিত হলাম। এবার তাহলে সত্যি সত্যি নাটক করা হচ্ছে। আনু যেন খুশিতে ভুষি। হঠাৎ করে হুররে বলে লাফ মেরে উঠল আনু। নয়ন তাতে রেগে ঘাড় ফুলিয়ে রইল। আনুর ওতে যায় আসে না। আনু শুরু করল ডায়লগ। একটু আগে দেখে আসা নাটকের ডায়লগ্ গড়গড় করে বলে যাচ্ছে। যেন সব মুখস্থ ওর। আনুর সংলাপ শুনতে ভালই লাগছিল। হঠাৎ থেমে গেল ও। বারী মামা হাত তালি দেওয়া শুরু করল। সাথে সাথে আমরাও। অন্যপাড়া থেকে আসা ছেলেরাও। নয়নও। তাতে আনু যেন নিজেকে গর্বিত মনে করল। ওর বুকটা যেন ফুলে উঠল। মাথাটা যেন আরও উঁচু হয়ে গেল। সুযোগ বুঝে কাফি আনুর সামনে হাত পেতে বলল, টাকা দে, বাদাম কিনে আনি। মনে ফূর্তি থাকলে আনুর এ বিষয়ে কাপর্ণ্য থাকে না। এখন কাফি সেই সুযোগটাই নিল। আনু পকেট ঝেড়ে দশ টাকা-পাঁচ টাকা-দুই টাকার নোট মিলিয়ে ১৭ টাকা বের করে দিল। কাফি এক দৌড়ে জববার কাকার টং দোকান থেকে ঝালাসহ বাদাম ভাজা নিয়ে এল। জমে উঠল বিকেলের আড্ডা। গ্রামের পশ্চিম পাশ দিয়ে বয়ে গেছে বহমান নদী। নদীটা পার হলেই ডানে পড়ে শ্মশান ঘাট। বাম পাশে বাজার। বাজারের পশ্চিম মাথায় আমাদের প্রিয় স্কুল।

টানা তিনদিন পর আজ স্কুল খুলছে। সবাই নদী পার হওয়ার জন্য খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে আছি। ইতোমধ্যে গ্রাম জুড়ে বারী মামার আগমনের খবর প্রচার হয়ে গেছে। খেয়া নৌকার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে থাকা তালুকদার সাহেব জিজ্ঞেস করলেন বারী মামার কথা। আমাদের লিডার হিরা বিস্তারিত বলল। প্রশ্ন করা এবং বারী মামার লিখে লিখে উত্তর দেওয়ার কথাও বলল। সব শুনে তালুকদার সাহেব অবশ্য কিছু বললেন না। শুধু খানিকক্ষণ চোখ বুজে রইলেন। তারপর ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। আমরা সেদিকে দৃষ্টি দিলাম না। নৌকা পার হতে হতে আরও দু’একবার বারী মামা সম্পর্কে আমাদের বলতে হল। স্কুলে পৌঁছা মাত্রই অন্য ছেলেরা ঘিরে ধরল। বারী মামাকে নিয়ে প্রশ্ন করতে লাগল। আমরা ওদের পাত্তাই দিলাম না। প্রথমেই বাংলা ক্লাস। আবুজার গাফ্ফারী স্যারের। গাফ্ফারী স্যার খুব রসিক আর রোমান্টিক। মাঝে মাঝে এমন সব কথা বলেন, হাসতে হাসতে পেটে খিল লেগে যায়। কবিতাও লেখেন স্যার। মাঝে মধ্যে পড়ে শোনান। গোয়েন্দা কাহিনী পড়েন প্রচুর। আমাকে সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা কাহিনী পড়তে দিয়েছেলেন। ক্লাসের ঘন্টা পড়ল। সিনেমার নায়কের ঢংয়ে হেঁটে হেঁটে ক্লাসে ঢুকলেন আবুজার স্যার। আমরা দাঁড়িয়ে সালাম দিলাম। স্যার সবাইকে বসতে বললেন। প্রতিদিন বসতে বলেই রোল কল করেন স্যার। আজ তা করলেন না। এক এক করে ক্লাসের সবার দিকে তাকাচ্ছেন।

এক সময় আমার চোখের সাথে চোখে পড়ে গেল। স্যারের মুখটা উজ্জ্বল দেখাল। মনে হল আমাকেই খুঁজছিলেন। পরমুহূর্তেই মনে হল না আমাকে টার্গেট নয়। বাদ বাকীদের মধ্যে কাউকে খুঁজছেন। সবাইকে এক নজর দেখে নিলেন স্যার। তারপর ঝড়ের গতিতে বলে উঠলেন, কবীর তুই দাঁড়া। আমি হক চকিয়ে গেলাম। স্যারের কথামতো দাঁড়ালাম। স্যার আগের চেয়ে গতি কমিয়ে বললেন, তোরাই কি একটা বোবা লোককে আশ্রয় দিয়েছিস। – জ্বী স্যার। – লোকটার নাম কী? – এরশাদুল বারী? – বাড়ি কোথায়? – ঢাকা। – বাবা-মা, আত্মীয়-স্বজন নাই? – আমরা অতো জানি না, শুধু জানি তার সৎ মা তাকে মেরে ফেলতে চায়। – কীভাবে জানলি? – লোকটা জানিয়েছে।

– বোবা লোকের কাছ থেকে তোরা কেমন করে জানলি? – আমরা প্রশ্ন করি লোকটা লিখে লিখে উত্তর দেয়। – বোবারা কী কানে শুনতে পায়? – সে জন্মগত বোবা নয় স্যার। – তাহলে? – তার সৎ মা তাকে মেরে ফেলার জন্য রাসায়নিক কিছু খাইয়েছিল। ভাগ্যিস বেঁচে গেছে। তবে কথা বলতে পারে না। – এ ঘটনা কতটা সত্য? – আমি জানি না স্যার। লোকটাই আমাদের লিখে জানিয়েছে। – হু । বলে স্যার কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। আমরা লক্ষ্য করলাম স্যারের কপালে ভাঁজ পড়ল। আবার প্রশ্ন শুর” করলেন স্যার। – লোকটা কোথায়-কোথায় ঘোরাফেরা করে? – বিকেলে আমাদের সাথেই আড্ডা দেয়। – সকালে? – আমরা তখন স্কুলে থাকি। তিনি হয়তো ঘরেই থাকেন। – রাতে কী বের হন? – স্যার আসলে লোকটা আনুদের বাড়িতে থাকে। ওদের ঘর ফ্রি আছে তো, তাই। স্যার সারা ক্লাসে চোখ ঘুরিয়ে আনুকে খুঁজে বের করলেন। আমার মতো আনুকেও দাঁড়াতে বললেন। আনু দাঁড়ালে স্যার জিজ্ঞেস করলেন, তুই কী লোকটার সাথেই থাকিস? – না, স্যার। – তাহলে? – বারী মামা একাই একরুমে থাকেন। আমি পাশের রুমে থাকি। স্যার হাসলেন। হেসে হেসে বললেন, লোকটাকে মামা বানিয়ে ফেলেছিস। তা তোদের মামা রাত-বিরাতে ঘুমিয়ে কাটান, না ঘোরাফেরা করেন? – আমি জানি না, স্যার। হু-। বলে থেমে গেলেন স্যার। চেয়ারে বসে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর রোল কল শুরু করলেন।

ক্লাস করে স্যার আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ছুটির পরে দেখা করে যাবি। আমি মাথা নেড়ে বললাম, জ্বী স্যার। তৃতীয় ঘণ্টায় সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাস। হামিদুল স্যারের সামাজিক বিজ্ঞান ক্লাস শেষে টিফিনের ঘণ্টা পড়ল। স্যার বেরিয়ে গেলে আমরা হৈচৈ করতে করতে বের হব, ঠিক তখনই দরজার সামনে এসে দাঁড়ালেন স্বাস্থ্য আপা। দেড় সপ্তাহে দুইদিন আমাদের স্কুলে এসেছিলেন স্বাস্থ্য আপা। প্রথমদিন স্বাস্থ্য আপার সাথে আরও একটা লোক ছিল। স্কুলের স্যারদের বলে-কয়ে টিফিনের সময়ে দশ মিনিট স্বাস্থ্য বিষয়ক বক্তব্য দিয়ে চলে গিয়েছিলেন। একটা লিফলেটও বিলি করেছিলেন। ‘শিশু-কিশোর স্বাস্থ্য প্রকল্প’ নামে একটা সংস্থার কর্মী তারা। আমরা স্বাস্থ্য বিষয়ক নানা তথ্য সম্মলিত লিফলেটসহ এক প্যাকেট করে বিস্কুটও পেলাম। দ্বিতীয় দিন স্বাস্থ্য আপা একাই এসেছিলেন। পুরো টিফিনের সময়টা হল রুমে স্বাস্থ্য আপার বক্তব্য চলল। বক্তব্য বলতে গল্প বলা। গল্প বলে-বলে আমাদের স্বাস্থ্য বিষয়ক জ্ঞান দেওয়া। স্বাস্থ্য আপার চেহারা খান মাশাল্লাহ। দেখলেই প্রাণ জুড়িয়ে যায়। কথা বলে চমৎকার। শুনে শুনে আমরা মুগ্ধ হই। আমরা তার নাম জানি না। স্বাস্থ্য সম্পর্কে ক্লাস নেয় বলে আমরাই নাম দিয়েছি- স্বাস্থ্য আপা।

পুরো টিফিনের সময় কেন, ছুটির ঘন্টা পর্যন্তও স্বাস্থ্য আপা বক্তব্য দিলে আমাদের আপত্তি থাকার কথা নয়। প্রথমত আমরা কেউ টিফিন আনি না। বাজারের বিস্কুট, কেক, সিংঙারা বড়জোড় মংলার দোকানের ছানার জিলাপি এর কোন একটাতেই টিফিন সেরে নেই। স্বাস্থ্য আপা এলে সেই ঝামেলা নেই। সবাইকে এক প্যাকেট করে বিস্কুট খেতে দেন। আমাদের বাজারের বিস্কুটগুলোর সাথে স্বাস্থ্য আপার বিস্কুটের মিল পড়ে না। বিস্কুট বিলি করার সময় আপা বলেন, এগুলো অতি প্রোটিন সমৃদ্ধ বিস্কুট। দ্বিতীয়ত স্বাস্থ্য আপা পুরো সময় পার করে দিলে বিজ্ঞান স্যারের মার আর মওলানা স্যারের কান ধরে দাঁড়িয়ে থাকার শাস্তি থেকে রেহাই পাওয়া যাবে। আজও স্বাস্থ্য আপা এসেছেন। আমাদের সবার চোখে-মুখে ঝিলিক দিয়ে উঠল। স্বাস্থ্য আপা মানে গল্প বলা। গল্প শুনে শুনে স্বাস্থ্য জ্ঞান অর্জন করা। শুধু কি তাই। এক প্যাকেট করে বিস্কুট। স্বাস্থ্য আপার ভাষায় অতি প্রোট্রিন সমৃদ্ধ বিস্কুট। আমাদের দৃষ্টি বিস্কুটের দিকেই বেশি। তাই দেরি না করে, আমরা হৈ হৈ করতে করতে হল রুমে ঢুকে গেলাম। ফাইভ স্টারের পাঁচজন প্রথম বেঞ্চেই বসলাম। স্বাস্থ্য আপা গল্প বলা শুরু করলেন। অদ্ভূত-অদ্ভূত হাসির গল্প। গল্পের ভেতর দিয়ে স্বাস্থ্য বিষয়ক কথা। আমরা গো-গ্রাসে কথাগুলো গিলতে লাগলাম। কথার ভেতর দিয়ে স্যানেটরী ল্যাট্রিনের কথা উঠল। স্বাস্থ্য আপা বললেন, কাদের বাড়িতে খোলা পায়খানা আছে হাত তোল। কেউ হাত তুলল না। আমরা জানি অনেকের বাড়িতেই এখানো স্যানিটরী ল্যাট্রিন নাই। তবুও লজ্জায় কেউ হাত তুলল না।

কাফি আস্তে করে বলল, আপা হাত তুলতে লজ্জা পাচ্ছে। স্বাস্থ্য আপা হয়তো ব্যাপারটা বুঝলেন। বললেন, ঠিক আছে হাত তুলতে হবে না। তবে খোলা পায়খানা খুবই ক্ষতিকর। তোমরা বাবা-মাকে বুঝিয়ে বলবে। এরপর স্বাস্থ্য আপা জিজ্ঞেস করলেন, বলতো, পায়খানা থেকে এসে কী করতে হয়? একজন দাঁড়িয়ে বলল, আপা মাটির সাথে হাত ঢলতে হয়। হলরুমে হাসির রোল পড়ে গেল। আরেকজন বলল, আপা ছাই দিয়ে হাত ধুতে হয়। আনু দাঁড়িয়ে বলল, না আপা, সাবান দিয়ে ভাল করে হাত ধুতে হয়। আনুর কথায় মুচকি হেসে স্বাস্থ্য আপা বললেন, রাইট। থ্যাংক ইউ ভেরি মাচ। আমরা আনুর জন্য ডাবল হাত তালি দিলাম। তাতে আনু নিজেকে গর্বিত মনে করল। ওর বুকটা যেন ফুলে উঠল। মাথাটা যেন আরও উঁচু হয়ে গেল। নয়ন ওর গর্বিত উঁচু হওয়া মাথাটা দেখে রেগে গেল। রাগে নয়নের ঘাড় ফুলে উঠল। লিডার হিরা হাসতে হাসতে বলল, আনু তোর বিস্কুটের অর্ধেক প্যাকেট দিতে হবে কিন্তু। আনুর মনে ফূর্তি থাকায় বিনাবাক্যে রাজী হয়ে গেল। কাফি আর আমি আবারও হাত তালি দিতে গিয়ে স্বাস্থ্য আপার ইশারায় থেকে গেলাম।   দু’দিন হল নাটকের রিহার্সেল শুরু হয়েছে। নজরুল ভাই প্রথম দিন এসে পুরো ব্যাপার বুঝিয়ে দিয়ে গেছেন। বিকেল বেলায় ওয়াপদা বাঁধের ঢালুতে বসেই আমাদের রিহার্সেল চলে। নাটকের মহড়ায় অংশ নিলেও দু’দিন স্কুলে যাই নি। তৃতীয় দিন বাবা জিজ্ঞেস করায় শরীর খারাপের কথা বললাম। তাতে মা বলল,শরীর খারাপ করলে ঘরে শুয়ে থাকবি, দেখছি তো সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াস। আমি কিছু না বলে বিছানায় শুয়ে পড়লাম। যেন সত্যি সত্যি আমার অসুখ-বিসুখ হয়েছে। আমার যে কিছুই হয়নি মা বুঝতে পারলেন। জোর গলায় বললেন, আর ভান করতে হবে না, চল ভাত খাবি। আসলে আমার মিশন বারী মামাকে নিয়ে। গত দুই দিন বারী মামার সাথে সময় কাটিয়েছি। ঘুরে বেরিয়েছি। নিজে খুব বোকা আর সহজ-সরল সেজে বারী মামার মন জয় করার চেষ্টা করছি। ছুটির পরে দেখা করতে গেলে আবুজার স্যার বারী মামা সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছিলেন, তার কোনটাই মিলাতে পারছি না। সকালে খাওয়া শেষ করে মা-বাবা যখন সংসারের কাজ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, আমি তখন এক চম্পটে আনুদের বাড়ি পৌঁছালাম।

আমাকে দেখে আনুর বাবা বললেন, কবীর, বাবা স্কুলে যাও নি? অসুখ-অসুখ ভাব করে জবাব দিলাম, চাচা শরীরের মধ্যে ভাল লাগছে না। অসুস্থ বোধ হচ্ছে। আনুর বাবা অত্যন্ত সহজ-সরল আর ধর্ম ভীরু মানুষ। কথায় কথায় আল্লাহ্ মাফ করুন, আল্লাহ মাফ করুন বলেন। আমার মাথায় হাত রেখে বললেন, দোয়া করি তুমি সুস্থ হয়ে ওঠো। বারী মামাকে নিয়ে আম তলায় বসলাম। গত দুই দিনে অনেক ভাব বিনিময় হয়েছে। আমার প্রতি পূর্ণ আস্থা আর বিশ্বাস জন্মানোর চেষ্টা করেছি। আজ বারী মামার মনটা খুব ভাল মনে হচ্ছে। হয়তো আমার সঙ্গ পাওয়ায় ভারী আনন্দিত। কয়েক দিনের মধ্যে আজ সেভও করেছেন মামা। আমি বোকা-বোকা ভাব করে বললাম, মামা সম্ভবত আপনি কথা বলতে পারেন। বারী মামা আমার চোখের দিকে তাকালেন। আমিও নির্বোধের মতো তাকিয়ে রইলাম। মামা খচখচ করে আমার কথার জবাব লিখল, অসম্ভব। আমি আগের মতো করেই বললাম, আমার মনে হয় আপনি কথা বলতে পারেন। বারী মামা লিখল, মনে হওয়া সঠিক নয়। – মামা আপনি কথা বলেন। – আমি কথা বলতে পারি না। – মামা, আমাকে বিশ্বাস করেন না? – অনেক বিশ্বাস করি। – তাহলে কথা বলেন। – আমি কথা বলতে পারি না। – মামা, আমি কাউকে বলব না। মনের ভাব প্রকাশের জন্য আমার সাথে আপনার কথা বলা প্রয়োজন। বারী মামা আগের মতোই লিখল, আমি কথা বলতে পারি না। মনে মনে ভেবে নিলাম, আমাকে বারী মামার রহস্য জানতেই হবে। বারী মামা জানিয়েছিল সে খুব ভাল স্টুডেন্ট। কিন্তু গত কাল আমার সাধারণ কয়েকটা প্রশ্নের উত্তর লিখতে ভুল করেছিল। সেই থেকে আমার কৌতূহলটা মোড় নিয়ে সন্দেহের দিকে এগুচ্ছে। বারী মামা তাকিয়েছিল অবারিত মাঠের দিকে। ওয়াপদা বাঁধের ঢালুতে কিংবা এই আম তলায় বসে পূর্বদিকে তাকালে যতদূর চোখ যায়, শুধু ধান ক্ষেত। এখন ইরি ধানের একটু-একটু করে রং আসতে শুরু করেছে। শ্যালো মেশিনের সেচ দিয়ে হাজার হাজার বিঘা জমিতে ধানের চাষ হয়। বারী মামা গভীর মনোযোগ দিয়ে ধান ক্ষেত অথবা ছোট ছোট শ্যালো মেশিনের ঘরগুলো দেখছিল। আমার মনে হলো অবাক হচ্ছে শতাধিক শ্যালো মেশিনের ঘরগুলো দেখে। – মামা, আপনি একজন রাষ্ট্রদূতের ছেলে। আমার কথা বারী মামা শুনতে পেলেন কিনা বুঝতে পারলাম না। কথাটা আমি আবার বললাম। বারী মামা এবার মাথা ঘুরিয়ে মুখ নিচু করে আওয়াজ করলেন, হু।

– মামা, আপনারা অনেক ক্ষমতাবান। – হু। – আমাদের গ্রামে অনেক বেকার ছেলে ঘুরে বেড়ায়। আপনি যদি যোগাযোগ করেন, নিশ্চয়ই তাদের চাকরীর ব্যবস্থা করতে পারবেন। বারী মামা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। আমি আবার বললাম, আপনি শুধু যোগাযোগ করে দিবেন। যত টাকা লাগে আপনার হাতে তুলে দেওয়া যাবে। বারী মামা আগের মতোই তাকিয়ে রইলেন। আমি একটু উঁচু স্বরে বললাম, মামা কিছুই বলছেন না যে? বারী মামা মনে হয় একটু ভাবলেন। প্যাডের পাতা উল্টিয়ে লিখতে গিয়ে থেমে গেলেন। আমার দিকে তাকালেন। আবারও লিখতে গিয়ে থেমে গেলেন। বিকাল পাঁচটা থেকে রিহার্সেল শুরু হলো। তিন দিন আমার স্কুলে না-যাওয়া নিয়ে কোন কথা উঠল না। আজও নজরুল ভাই এসেছেন। হিরা নাটক নির্দেশনার ব্যাপারটা বুঝে নিচ্ছে। আমরাও একেক জন একেকটা দায়িত্ব সম্পর্কে জেনে নিচ্ছি। প্রায় পৌনে এক ঘণ্টার নাটক। টানা রিহার্সেল চলল। নজরুল ভাইয়ের উপস্থিতিতে দুইবার করে মহড়া শেষ করলাম। নজরুল ভাইকে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে একটু এগিয়ে দিলাম। তারপর নিজেদেও মধ্যে কিছু কথাবার্তা সেরে নেওয়ার জন্য বাঁধের ঢালুতে গিয়ে বসলাম। কাফি বলল, কিরে, বারী মামাকে তো দেখছি না। একসাথে সবাই বলে উঠলাম , তাই তো। আসলে নাটক নিয়ে আজ এতোই মেতে ছিলাম যে, বারী মামার কথা কারোও খেয়াল হয় নি।

-কিরে আনু, বারী মামাকে নিয়ে আসিস নি ? জিজ্ঞেস করল লিডার হিরা। -আসলে……..। আনুকে সরিয়ে দিল অয়ন। আসলে কী। নাটকের নেশায় ওর কি বারী মামার কথা মনে আছে। – ঘটনা তা না। বলল আনু। আমরা কোরাস করে বলে উঠলাম, তাহলে ? – মামাকে খুঁজে পেলাম না। আমরা আবার কোরাস করে বললাম, বলিস কী ! – সত্যি। ঘরে দেখলাম নাই। বাইরে এদিক-সেদিক খুঁজলাম পেলাম না। এসেই তোদের বলব, কিমত্মু ভুলে গেছি। আমরা তাড়াতাড়ি করে উঠে পড়লাম। প্রথমে আম তলায় খুঁজলাম। পরে গত তিন দিনে মামাকে নিয়ে যেখানে যেখানে ঘুরেছি সবখানে গেলাম। কিমত্মু বারী মামাকে পাওয়া গেল না। অবশেষে সন্ধ্যার দিকে দূরে মাঠের মধ্য থেকে একজনকে আসতে দেখে আমরা এগিয়ে গেলাম। ঐ তো বারী মামাই তো। বারী মামা আমাদের দেখে কেমন যেন থতমত খেয়ে উঠল। কিমত্মু বাইরে ততটা প্রকাশ পেল না। আমি ভাল করে খেয়াল করলাম, কিছু একটা লুকা””ছলেন বারী মামা।   গত তিনদিন ধরে তুমুল ভাবে নাটকের রিহার্সেল হয়েছে।

আমরা যাকে বলি- উঠে পড়ে লেগেছিলাম। নজরুল ভাই প্রথমে খুব একটা সময় দিতে চাননি। কিন্তু গত তিনদিনই তিনি একটানা রিহার্সেল করিয়েছেন। ‘শিশু কিশোর স্বাস্থ্য প্রকল্প’র উদ্যোগে আমাদের নাটক মঞ্চস্থ হবে। তাও আমাদেরই প্রিয় স্কুল মাঠে। এটা কি চাট্টিখানি কথা। স্বাস্থ্য আপার আহবানে আমরা সাড়া দিয়েছিলাম। কেমনে কেমনে যেন উনি আমাদের নাকট করার কথা জেনেছিলেন। জেনেই আমাদের সাথে কথা বললেন। যাবতীয় খরচ আপাদের সংস্থার। আমরা শুধু অভিনয় করব। প্রস্তাবটা আমাদের যারপর নাই ভাল লাগল। নজরুল ভাই শুনেও খুশি হলেন। তাই গ্রীম্মের ছুটির আগেই আমাদের নাটক মঞ্চস্থ করার সুযোগ হয়ে গেল। আজ স্কুল ছুটির দিন ছিল। কিন্তু স্যারদের ম্যানেজ করে স্কুলের সব ছাত্র-ছাত্রী হাজির করিয়েছেন স্বাস্থ্য আপা। বেশ কয়েকজন স্যারও উপস্থিত হয়েছেন। স্কুল মাঠের পশ্চিম পাশে তৈরি করা হয়েছে মঞ্চ। এই মঞ্চেই আজ আমাদের নাটকের ফাইনাল অভিনয় হয়ে যাবে। আমাদের স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী ছাড়াও স্বাস্থ্য আপা আরও যেসব স্কুলে স্বাস্থ্য জ্ঞান দেন, ওসব স্কুল থেকেও বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী এসেছে। আশে-পাশের অনেক লোকজন এসেছেন। আমরা গর্বে বুক ফুলিয়ে নাটকের প্রস্ত্ততি নিচ্ছি। নজরুল ভাই আমাদের শেষ মুহূর্তের জন্য তৈরি করে দিচ্ছেন। সাথে বারী মামাও আছেন। আজ স্বাস্থ্য আপার সাথে আরও একজন লোক এসেছেন।

তিনি মঞ্চে বসে আছেন। একটু পরে হেডস্যার ও মেম্বর চাচাকেও মঞ্চে ডাকা হল। অনেকক্ষণধরে বক্তৃতা চলছে। আমাদের হেডস্যার খুব সুন্দর সুন্দর কথা বলেছেন। স্বাস্থ্য আপার সাথের লোকটা বেশ সময় ধরে বক্তৃতা দিয়ে চলেছেন। বাইরের দর্শকদের মধ্যে কেউ একজন ‘শিশু-কিশোর স্বাস্থ্য প্রকল্প’র হেড অফিসের ঠিকানা জানতে চাইলেন। লোকটা ঢাকায় একটা এলাকার নাম বললেন। তিনি আরও বললেন, এই এলাকাতেই একটা শাখা অফিস খোলা হবে। বক্তব্যের পালা শেষে স্বাস্থ্য আপা নিজেই মাইক্রোফোন নিলেন। উপস্থিত ছাত্র-ছাত্রীর উদ্দেশে বললেন, তোমাদের জন্য একটা সু-খবর আছে। আমরা ড্রেসিং রুম থেকে সু-খবরটা শোনার জন্য কান পেতে রইলাম। আনু যেন একটু এগিয়েই গেল। নজরুল ভাইয়ের নিষেধে আমরা গেলাম না। আনুও পিছিয়ে এল। স্বাস্থ্য আপা বললেন, তোমাদেরকে স্বাস্থ্য বিষয়ক উন্নত ট্রেনিং দেওয়া হবে। সাথে থাকবে আনন্দ ভ্রমণের ব্যবস্থা। যাবতীয় খরচ আমাদের। ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে থেকে অনেকেই হৈ দিয়ে উঠল। স্বাস্থ্য আপা আবার বললেন, তোমরা কে কে আগ্রহী? অনেক ছাত্র-ছাত্রী হাত তুলল। আমরা পেছনের ড্রেসিং রুমে থাকায় হাত তুলতে পারলাম না। নয়ন বলল, সুযোগটা হাত ছাড়া হয়ে যাবে নাতো। আনু হাতে তালি মেরে বলল, দূর আমাদের বাদ দেয় কে। কাফি আনুকে স্পর্শ করে বলল, ঠিকই তো, আমরা না হলে স্বাস্থ্য আপার এই আয়োজন হতো ? আমারও ঠিক তেমনিই মনে হল। আমাদের বাদ দিয়ে স্বাস্থ্য আপা কিছু করবেন না। লিডার হিরা শুধু মুচকি মুচকি হেসে যাচ্ছে। স্বাস্থ্য আপা এবারে বললেন, তোমরা দেখছি অনেকেই আগ্রহী। কিন্তু আমরা প্রথম ব্যাচে পনের জন নেব। বিশেষ ব্যবস্থায় বাছাই করে দল গঠন করা হবে।

তোমরা মনে মনে তৈরি থেকো। পর্যায়ক্রমে সবাই সুযোগ পাবে। দর্শকদের মধ্যে একটু গুঞ্জন উঠল। স্বাস্থ্য আপার কানেও গেল দু’একটি কথা। তিনি শেষবারের মতো বললেন, ইচ্ছে করলে তোমরা একজন করে অভিভাবককে সাথে নিতে পারবে। দর্শকদের মধ্যকর গুঞ্জনটা থেমে গেল। নাটক মঞ্চস্থ হল। ফাটাফাটি হিট। দর্শক হাততালি দিতে দিতে আমাদের আনন্দের বন্যায় ভাসিয়ে নিয়ে গেল। আমাদের অভিনয় দেখে স্বয়ং হেডস্যারও প্রশংসা করলেন। আমরা হিরো বনে গেলাম। সবাই যখন খুশিতে হৈ-চৈ করছে আমি তখন বারী মামাকে খুঁজতে চেষ্টা করলাম। খুঁজে খুঁজে ডেসিং রুমের এক কোনায় পাওয়া গেল। বারী মামা বসে আছে। পাশে স্বাস্থ্য আপাও। মনে হল জটিল কোন বিষয় নিয়ে আলাপ হচ্ছে। হয়তো অনেকক্ষণ ধরেই চলছে। আমরা নাটক করা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় খেয়াল করিনি। আমাকে দেখে স্বাস্থ্য আপা কাগজপত্র নাড়াচাড়া করতে লাগল। বারী মামা বোবা হয়ে চুপ করে বসে রইল। আমি কিছু না বোঝার ভান করে বারী মামার দিকে এগিয়ে গেলাম।   বারী মামাকে নিয়ে আমার কৌতূহল তার সন্দেহ চরম পর্যায়ে। গতকাল স্বাস্থ্য আপার সাথে তার কী কথা হচ্ছিল? তারা কি পুর্বপরিচিত! তেমনটাই মনে হচিছল? আসলে কে এই বারী মামা? কি সম্পর্ক স্বাস্থ্য আপার সাথে? প্রশ্নগুলো আমার মাথা গুলিয়ে দিচ্ছিল। না, আর একা একা নয়। শেয়ার করতে হবে। বসতে হবে ফাইফ স্টার দলের সবাইকে নিয়ে। এসব ভাবনায় আজ ক্লাসে মন বসল না। ভাবনাগুলো মনের ভেতর ইতিউতি করে। স্যারদের কোন কথাই কানে ঢুকল না।

আবুজার স্যার অবশ্য বাংলা ক্লাসে জিজ্ঞেস করেছিলেন, কিরে, কী খবর তোদের বারী মামার? স্যারের সে প্রশ্নের জবাব দেইনি। শুনেও, না শোনার ভান করেছি। নয়নও আনুও চুপচাপ থেকেছে। স্যার ও নিয়ে আর ঘাটাঘাটি করেননি। সকাল বেলা স্কুলে আসার সময় আনুদের বাড়ি হয়ে এসেছি। আনুর তৈরি হতে একটু দেরি হ””ছল। আমি এই ফাঁকে বারী মামাকে জানিয়ে এসেছি। আজ বিকেলে অনেক দূরের মাঠে বেড়াতে যাব। শুধু আমরা দু’জন। বারী মামা রাজি হয়েছেন। স্যারদের কী যেন এক মিটিং থাকায় ছয় পিরিয়ড হয়েই স্কুল ছুটি হয়ে গেল। প্রতিদিনের চেয়ে একটু বেশি আনন্দ নিয়েই বের হলাম। যাক, দুটো ক্লাসের কষ্ট থেকে তো বাঁচা গেল। লিডার হিরা আগেই বেরিয়ে ছিল। আমি, আনু আর নয়ন এক সাথে বের হলাম। একটু পরে কাফি বের হল। হিরা একটু ফাঁকে ডেকে নিয়ে বলল, আজ সন্ধ্যার পর জরুরী মিটিং করতে হবে। – কেন বস? জিজ্ঞেস করল কাফি। – কথা আছে। বিকেলে অন্য পাড়ার ছেলেরাও থাকে। তাই মিটিং করতে হবে ওরা উঠে যাবার পর। আনু বলল, তাহলে আমরা বিকেলে কি বসব না? – না, এলোমেলো ঘোরাফেরা করব। যার যেমন ইচ্ছে। সন্ধ্যার সময় যখন অন্য ছেলেরা উঠে যায়, তার পরই আমরা একত্রিত হব। হিরার প্ল্যান আন্দাজ করতে পারলাম না। মনে হয় বারী মামাকে নিয়েই জরুরী মিটিং ডেকেছে লিডার। সে থাক গে। আপাতত বিকেলটাতে ফ্রি হওয়ায় খুশিই হলাম।

বারী মামাকে নিয়ে বের হওয়া যাবে। বারী মামা একটু আগেই আমতলা এসে বসেছিলেন। আমি আসতেই মামা উঠে পড়লেন। হাতে একটা পলিথিনের ছোট্ট ব্যাগ ভর্তি বাদাম ভাজা। রাস্তার দোকান থেকে হয়তো কিনেছেন। আমি বাদামের ব্যাগটা হাতে নিয়ে আগে আগে হাটতে লাগলাম। বারী মামাকে নিয়ে হাঁটতে-হাঁটতে মধ্য মাঠে চলে এসেছি। বিকেল বেলায় মাঠে লোকজন নেই। একদম ফাঁকা। সরু একটা রাস্তার উপর নরম দূর্বা ঘাসের মধ্যে বসে পড়লাম। রাস্তা ধরে আসতে- আসতে আমার মনে হয়েছে, এই বুঝি বারী মামা কথা বলে উঠবেন। কিন্ত না, কোন কথা বলেন নি। আমি নিজে থেকেই তাকে গ্রামের বেকার ছেলেদের চাকুরীর ব্যবস্থা করতে বলেছি। বিনিময়ে লাখ-লাখ টাকা পাওয়া যাবে, তাও বলেছি। তবু বারী মামা মুখ খোলেন নি। দু’এক বার শুধু খ্যাক্ করে কেঁশে উঠেছেন। বসার পরও অনেকক্ষণ কাটল, কোন কথা নাই। দুই জনে আপন মনে বাদাম ভাজা চিবাতে লাগলাম। আরও কিছু সময় পরে বারী মামা গা ঝাকি দিয়ে উঠলেন। ঠিক হাঁচি দিলেন না, হাঁচি দেওয়ার মতো করে শব্দ করলেন। আচমকা বারী মামার গা ঝাকি দেওয়া আর কর্কশ আওয়াজে আমি যেন ভয়ই পেলাম। আমার কৌতূহল সন্দেহ সবকিছু পেছনে ফেলে বারী মামা কথা বলে উঠলেন। কবীর, আমি কথা বলতে পারি। আমি যেন চমকে উঠলাম। একজন বোবা মানুষ কথা বলছে! ভয়ে শরীর হিম হতে থাকল। বারী মামা হয়তো বুঝতে পারলেন। আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ভয় পেয়ো না। আমি তোমাকে নেতা বানিয়ে দেব। -বারী মামা আপনি কে? – সব জানতে পারবে? – আপনি কেন এসেছেন? -বললাম সব জানতে পারবে। – প্লিজ, বারী মামা বলুন না আপনি কে? – আমি ক্যাপ্টেন মিনহাজুল আবেদীন।

– কিন্তু আপনি এখানে কেন এসেছেন? – এখানকার চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস, নারী ও শিশু পাচার এসবের খোঁজ খবর নেওয়া আমার কাজ। – আপনি গোয়েন্দার লোক? বারী মামা, না, ক্যাপ্টেন মিনহাজুল আবেদীন মৃদু হেসে বললেন, এইতো বুঝতে পেরেছো। আমি কাঁপা-কাঁপা স্বরে কিছু একটা বলতে যাব। কিন্তু মামা আমাকে থামিয়ে দিলেন। তিনি নিজেই বললেন কাউকে কিছু বলবে না। আমি তোমাকে নেতা বানিয়ে দিয়ে যাব। -মামা সেটা কেমনে? বারী মামা উচ্চ স্বরে হেসে বললেন, আরে তুমি তো জান না আশেপাশের সবগুলো থানার দারোগা আমার কথামতো কাজ করে। কালই তোমাকে সাথে করে থানায় যাব। পরিচয় করে দিয়ে আসব। দেখবে দারোগা বাবুরা তোমাকে অনার করবে। তা দেখে এলাকার লোকজন তোমার কথা শুনবে। ব্যাস তুমি তখন নেতা। – মামা সবাই আপনাকে চেনে? আমি একেবারে বোকার মতো বলে ফেললাম কথাগুলো। বারী মামা বলল, আরে চেনে মনে, প্রায়ই মোবাইলে কথা হয়। – আপনার মোবাইল আছে? আগের মতোই বোকা-বোকা কন্ঠে বললাম। – অবশ্যই। নিরাপত্তার জন্য রিভালভারও আছে। আমি বারী মামার কাছে আবদার করলাম, আমাকে রিভলভার দেখাতে হবে। বারী মামা কিছু সময় চিন্তা করে বললেন, ঠিক আছে একসময় আনুদের ওখানে এসো। সারা বিকেল ধরে কথাবার্তা হল। এলাকার অনেক কিছু সম্পর্ক জানতে চাইলেন। আমি কিছু রেখে-ঢেকে বলাম। সন্ধ্যা নামছিল। মামাকে আনুদের বাড়িতে রেখে ফাইফ স্টার দলের মিটিংয়ে যোগ দিলাম। – বারী মামা সম্পর্কে তোদের কি ধারণা? সবার উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ল লিডার হিরা। আনু বলল, একেবারে ফেরেস্তার মত মানুষ। নম্র্, ভদ্র….. নয়ন ওকে থামিয়ে দিয়ে বলল, আমার একটু-একটু সন্দেহ হয়। কাফি বলল, আমারও। আমি কিছু বললাম না। আনু নয়ন ও কাফির কথার প্রতিবাদ করে উঠল। ওর গলার আওয়াজ জোরে হওয়ায় হিরা ওকে থামিয়ে দিল। তারপর ফিসফিস করে বলল, সন্দেহের কারণ বল। নয়ন গুছিয়ে – গাছিয়ে কোন্ বিষয়ে সন্দেহ এবং তার কারণ দাঁড় করতে পারল না।

কাফি অবশ্য কিছু একটা বলতে চাচ্ছিল। কিন্তু আনু প্রথমে উচ্চ কন্ঠে বলতে গিয়ে হিরার নিষেধ স্মরণ করে আসেত্ম আসেত্ম বলল, তোদের মিছে মিছি সন্দেহ। নয়ন বাম হাতের তালুর উপর ডান হাত দিয়ে থাপ্পর মেরে বলল, আমাদের মানে, জববার চাচার টং দোকানে লোকজন বলা-কওয়া করতে শুনেছি। কাফি ওকে সাপোর্ট করল। আমিও শুনেছি। হিরা বলল, তোরা থাম। গ্রামের দু’চারজন যা বলাবলি করছে ওটা কোন ব্যাপার নয়। আনু, নয়ন ,কাফি কোরাস করে বলল, তাহলে! -ব্যাপারটা আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। আমার মনে হয় … আনু, নয়ন, কাফি আবার কোরাস করে বলল, কী মনে হয়? -মনে হয়, কবীর অনেকটা এগিয়েছে। হিরার এ কথায় আমি অপ্রস্ত্তত হয়ে গেলাম। ওরা সবাই আমার দিকে ঝুঁকে পড়েছে। জানতে চায় কিসের, কতদূর এগিয়েছি। মনে মনে হিরার বুদ্ধির তারিফ করতে হল। আমি আগে থেকে ওকে কিছু জানাই নি। কিন্তু ও ঠিকই ধরে ফেলেছে, আমি বারী মামার রহস্য বের করার চেষ্টা করছি। এই না হলে কি দলের লিডার হওয়া যায়! আর লুকিয়ে রাখা চলবে না।

ফাইভ স্টারের সবাইকে বিষয়টা জানাতে হবে। বারী মামার ঘোরাফেরা, স্বাস্থ্য আপার সাথে রহস্যময় আলাপের কথা, এমনকি আজ বিকেলে মামার নতুন পরিচয়, সব বলতে হবে। আমি বলতেই যাব। এমন সময় হিরা শক্ত গলায় বলে উঠল কে ওখানে ..কে? আমরা ওদিকে তাকাতেই দেখি একটা ছায়ামূর্তি দ্রুত সরে যাচ্ছে। আমরা পিছুপিছু দৌড়ালাম।   বেশ কয়েকবার ঘুরালেন। তারপরও বারী মামা রিভলভারটা দেখালেন না। এ-কথা সে-কথা বলে ফিরিয়ে দেন। ফিরিয়ে দেওয়ার অজুহাত আমার মন:পূত হলো না। থানায় নিয়ে দারোগাবাবুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিবেন, সেটাও করলেন না। বারী মামার ক্যাপ্টেন মিনহাজুল আবেদীন পরিচয়টাও আমার কাছে ঘোলাটে মনে হচ্ছে। আজ থেকে স্কুলে গ্রীস্মকালীন ছুটি শুরু হলো। খেলাপড়ার একদম চাপ নাই। সারা বিকেল টইটই করে ঘুরে সন্ধ্যায় আবারও মিটিংয়ে বসলাম। বারী মামা আমাদের এড়িয়ে চলছে। বলতে গেলে আমরাও তাকে দূর থেকে ফলো করছি। গত সন্ধ্যার ছায়ামূর্তিটা যে বারী মামা ছিল, সেই সন্দেহটা আরও পরিষ্কার হলো। আনুই খোলাসা করে বলল, জানিস গতকাল আমরা যখন দৌড়ে হাফসে গেলাম, বাড়িতে গিয়ে দেখি বারী মামাও হাফাচ্ছে। মনে হলো আমাদের চেয়ে বেশি জোরে দৌঁড়িয়েছেন। -ঐ ছায়ামূর্তিটা বারী মামাই ছিল। জোর গলায় বলল নয়ন। কাফি বলল, রাইট। হিরা বলল, আসলে বারী মামা কোন কুচক্রী গ্রুপের সাথে জড়িত। আমি বললাম, বারী মামা কথাও বলতে পারে। আমার কথায় ফাইভ স্টার দলের মিটিংয়ে যেন আকাশ থেকে বাজ পড়ল।

যেন কারও কানে ঢোকেনি কথাটা। বিস্মিত কণ্ঠে ওরা বলে উঠল, কি বল্লি! আমি চারিদিকে তাকালাম। গতকালের ছায়ামূর্তিটা আজও দাঁড়িয়ে আছে কিনা, দেখে নিলাম। না, নেই। আগের মতোই বললাম, বারী মামা কথা বলতে পারে। কৌতূহল আর উদ্দীপনায় কাঁপছিল ওরা। আমি বারী মামার সমস্ত বিষয় খুলে বললাম। আমার সন্দেহ সম্পর্কেও বললাম। চুরি-ডাকাতি, সন্ত্রাস, নারীও শিশু পাচার – আসলে এগুলোর সাথে তিনি জড়িত। আমার ধারণা স্বাস্থ্য আপাও বারী মামার পার্টনার। আড়ালে হয়তো আরও অনেক লোক রয়েছে। এরা আমাদের এলাকায় বড় একটা অঘটন ঘটিয়ে ফেলবে। আমার কথা বলার সময়, লিডার হিরাকে খুব সতর্ক থাকতে দেখলাম। সতর্ক থাকার কারণও আছে। বারী মামা নিশ্চয়ই আমাদের খোঁজ করছেন। বুদ্ধি করে আজ মিটিংয়ের স্থান পরিবর্তন করেছে হিরা। তবু সাবধান থাকতে দোষ নাই। –           এখন আমাদের একটা কিছু করতে হবে। বলল কাফি। –           আমিও তাই ভাবছি। কাফির কথার পিঠে বলল আনু। –           হিরা বলল, অবশ্যই। আজ রাত থেকেই আমাদের গোয়েন্দা গিরি শুরু করতে হবে। আমি হিরাকে সাপোর্ট করলাম। কোন অঘটন ঘটে গেলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। তখন বারী মামাকে তো কেউ পাবে না। এলাকাবাসী আমাদেরকে এর জন্য দায়ী করবে।

তাই এখন থেকেই আমাদের সতর্ক পাহারায় থাকতে হবে। নয়ন রেগে-মেগে আগুন। এখুনি আনুদের বাড়িতে গিয়ে বেঁধে ফেলতে চায় বারী নামের মুখোশ ধারী শয়তানটাকে। হিরা নয়নকে থামিয়ে মিটিং শেষ করল। আমরা রাতের খাবার খেতে যার-যার বাড়ি গেলাম। আনুর আববাকে বিকেলেই বলেছিলাম, রাতে আনু আমাদের বাড়িতে খাবে। তাই আনু আমার সাথেই আছে। মিটিংয়ে সিদ্ধান্ত হয়েছে, যত দ্রুত সম্ভব খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়ব। তারপর বাড়ির সবাই শুয়ে পড়লে বেরিয়ে এসে একত্রিত হব। নয়ন বাদে সবাই জড়ো হলাম। বাঁধের ঢালুতে বসে নয়নের জন্য অপেক্ষা করছি। ও হয়তো বের হতে পারছে না। হয়তো প্রচন্ড গরমে নয়নের আববা এখনও শুতে যায় নি। হিরা কী যেন বলতে গিয়ে থেমে গেল। আনু ফিসফিস করে বলল, লিডার থামলি কেন? -নয়ন আসুক। বলতে বলতে পায়ের শব্দ শোনা গেল। আমরা ভাবলাম নয়ন। কিন্তু না অন্য কেউ। আমাদের পাশ দিয়ে নি:শব্দে চলে গেল। আমরা তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলাম। কাফি সন্দেহ প্রকাশ করল। ওর কাছে নাকি বারী মামার মতো লেগেছে। আনু বলল, আরে না অন্য লোক। গলায় গামছা আছে। আনুর কথা শেষ হতেই নয়ন এসে হাজির। নয়ন বসার আগেই উঠে পড়লাম সবাই। হিরা নয়নের অনুপস্থিতির কারণে যে কথা বলতে গিয়ে থেমে গিয়েছিল, দাঁড়িয়ে থেকেই তা বলতে শুরু করল। হিরার প্ল্যান আর কথামতো আমরা আনুদের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। রাত তেমন গভীর হয় নাই। দশটা কী সাড়ে দশটা বাজে। তবে গ্রামের কাক-পক্ষীও মনে হয় জেগে নাই। সবাই ঘুমিয়ে গেছে। আমরা যতটা নি:শব্দে হাঁটা যায়, তার চেয়ে সর্তক ভাবে আনুদের বাড়িতে পৌঁছালাম। আনুদের যে ঘরটাতে বারী মামা থাকেন, তার ঠিক পেছনে গিয়ে জড়ো হলাম।ওপাশটায় একটা জানালা। উপরের অংশ খোলা, ভেতরে জিরো ভোল্টের হালকা আলো দেখা যাচ্ছে। জানালা দিয়ে সামান্য একটু আগে বাইরে এসে পড়েছে।

নয়ন উঁচু হয়ে খোলা জানালা দিয়ে উঁকি মারল। তিরিশ সেকেন্ড ধরে ভেতরটা দেখে নিল নয়ন। তারপর আমরা ওর মুখের কাছে কান লাগালাম। নয়ন ফিসফিস করে বলল, বারী মামা ঘরে নেই। নয়নের কথায় লিডার হিরা নিজেই জানালায় উকি দিয়ে নয়নের সাথে একাত্ত্বতা প্রকাশ করল। সেই সাথে হিরা জানাল ঘরের দরজাটা আধা খোলা রয়েছে। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। হিরা আমাকে লক্ষ্য করে বলল, তুই আস্তে আস্তে সামনের দিকে দেখে আয়। আমি পা টিপে টিপে আনুদের উঠোনে পৌঁছালাম। উঠোনের সামনের দিকটায় সারি-সারি নারিকেল গাছ। একটা গাছের আড়ালে গিয়ে দাঁড়াতেই চমকে উঠলাম। মনে হল আমার ঘাড়ের কাছে নিশ্বাস পড়ল। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। ভয়ে চিৎকার দেব। কিন্তু তার আগেই পাশ থেকে ফিসফিস করে বলল, ভয় পাস না, আমি হিরা। হাত দিয়ে মুখ থেকে থু-থু নিলাম। একটুখানি বুকে লাগালাম। আমি এদিকে আসার পরপরই সবাই চলে এসেছে। নারিকেল গাছগুলোর আড়ালে দাঁড়িয়ে আছে। না, আশেপাশে কেউ নাই। আমরা ভাবনায় পড়ে গেলাম। বারী শয়তানটা গেল কোথায়? আমি সামনে।

হিরা পেছনে আমার ঘরের সাথে ওর মুখ ঠেকাল। উঠোনের দক্ষিণ কোনে ঝিঙে আর কুমড়ো গাছের মাঁচা। ওদিকটায় গাঢ় অন্ধকার। হঠাৎ মাঁচার এককোণ থেকে কথা বলার আওয়াজ শোনা গেল। আনু, কাফি, নয়ন কিছুটা পেছনে আছে ওদিকটার পাহারায়। হিরা আমার ঘাড়ে চিমটি কাটল। আমি ওর হাতে হাত রেখে বুঝালাম আমিও টের পেয়েছি। মোবাইলের স্কিনে আলো জ্বলে উঠল। সাথে সাথে শব্দ শোনা গেল। হয়তো লাইনটা কেটে যাওয়ায় বিরক্ত হয়েছে। তাই উঁহ্ শব্দ করে উঠল। আমরা একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি। পাশ থেকে সরে গিয়ে হিরা ওদের তিনজনকে সর্তক করে দিয়ে এল। একটু পরে আবার আলো জ্বলে উঠল। অন্য পাশ থেকে কল করেছে। এপাশ থেকে রিসিভ করা হলো। এবার স্পষ্ট শুনা গেল ওপাশের কথাগুলো। বলল, বস নেটওয়ার্ক সমস্যা। তারপর অনেকক্ষণ ধরে এপাশ থেকে কোন কথা বলছে না। হয়তো অন্য পাশ থেকেই একটানা কথা বলে যা””ছ আরেক জন। আমরা খুব বেশি দূরে নয়। একটু একটু করে সবচেয়ে কাছের নারিকেল গাছের গোড়ায় চলে এসেছি। একেবারে লেপ্টে আছি গাছের সাথে। স্পষ্ট বারী শয়তানটার গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। তবে কথা বলার মধ্যে খুব সাবধানতা লক্ষ্য করছি। বস, বিচ্ছুগুলো এখনো ফেরে নি। এপাশ থেকে বলল বারী।

 

কিছুক্ষণ নীরব হয়ে শুনল অন্য পাশের কথা। তারপর আবার বলল, না না ওরা ভীষণ চালাক আর সাহসী। ওদের বাড়ি ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। তা না হলে কর্মীরা ধরা খেয়ে যেতে পারে।… না না, বস ওরা আমাকে সন্দেহ করছে। দু’দিন হলো মিটিং-ফিটিং করছে। যে-কোন মুহূর্তে আটকে ফেলতে পারে।… জ্বি, জ্বি আজ রাতেই। উত্তেজনায় আমার গা কেঁপে উঠল। হিরা ঘাড়ে চাপ দিয়ে জানাল শান্ত থাকতে। বারী শয়তানটা আবারও বলতে লাগল, জ্বি বস, বিচ্ছুগুলো বাড়ি এলেই আমি জানাব। আর হ্যাঁ, নৌকাটা কি আম বাগানের পাশের ফাঁকা জায়গাটাতেই থাকবে? …জ্বি আচ্ছা, আমি সময় মতো পৌঁছে যাব। আমরা দু’জন খুব সাবধানে পিছু হটে এলাম। আনুকে সোজা ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়তে বলল হিরা। যাওয়ার সময় একটু কেশে-মেশে শব্দ করে যেতে বলল। যাতে করে শয়তানটা বুঝতে পারে আমরা যার-যার বাড়ি ফিরে গেছি। আনুকে জেগে থেকে পেছনের জানালাটা খুলে রাখতে বলা হলো। আনু সোজা ওর ঘরে গিয়ে খট করে দরজা লাগিয়ে দিল। -বস বিচ্ছগুলো বাড়ি ফিরেছে। বারী শয়তানটা মোবাইলে স্পষ্ট বলে দিল। আমরা ঘাপটি মেরে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম। গুপ্তচর বারী ঘরে ঢুকেই দরজা আটকে ফেলল। নয়নের বাড়ি পাশেই। একটা তালা এনে আস্তে করে ছিটকিনিতে লাগিয়ে দিল নয়ন।   আনু রইল পাহারায়। নয়ন ও শিবলুকে বাড়িতে পাঠাল হিরা। কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে ওরা ফিরে আসবে। আমি আর হিরা বাঁধের ঢালুতে বসলাম। গোপন মিটিংয়ের জন্য জায়গাটি নিরাপদ। আমাদের জর”রী মিটিংয়ে বসতে হলো। -কিছু আন্দাজ করতে পারছিস কবীর? প্রশ্ন করল লিভার হিরা। -কোন ব্যাপারে? -বারী শয়তান তার সহযোগীদের নিয়ে কী অন্যায় করতে যাচ্ছে? -আমি কিছু বুঝতে পারছি না। তবে বড ধরনের কোন ক্ষতি হয়তো করবে। -এটা ঠিক, বড় একটা অঘটন ঘটাবে শয়তানগুলো। আমার ভেতরে একটা আত্মবিশ্বাস আছে-আমরা পারব। যে অন্যায়ই তারা করতে যাক না আমরা ঠেকাতে পারব। সেই আত্মবিশ্বাস থেকেই দৃঢ় কন্ঠে বললাম, আমরা এটা কিছুতেই হতে দেব না। -অবশ্যই। হিরার অবশ্যই বলার দৃঢ়তা আরও বেশি কঠিন শোনাল। কিছুক্ষণের মধ্যে নয়ন এলো। এসেই একটা ব্যাগ এগিয়ে দিল হিরার দিকে। যা যা আনতে বলা হয়েছে সব কিছুই ঠিকঠাক এনেছে। হিরা এক নজর দেখে নিয়ে ধন্যবাদ জানাল। নয়ন প্যান্টের পকেট থেকে একটা মোড়ানো প্যাকেট বের করল।

 

তারপর সবার সামনে রাখতে রাখতে বলল, এবার আরও একটা ধন্যবাদ দে হিরা। -এখানে কী রে? বলতে বলতে প্যাকেটটা হাতে নিলাম। – রুটি আর গুড়। সাথে সাথেই জবাব দিল নয়ন। – খুব ভালো করেছিস। একটু হেসেই যেন বলল লিডার। -ধন্যবাদ দিলি না তো। বলল নয়ন। – নয়নের কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে আমি বললাম, ধন্যবাদ। নইলে নয়ন রেগে যেতে পারে। রেগে গেলে ওর ঘাড় ফুলে উঠবে। তখন ও আর কথা বলতে পারবে না। তাতে আমাদের প্ল্যান মাঠে মারা যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিবে। এসব কথা হয়তো লিডার হিরাও ভেবে আমার সাথেই সুর মিলিয়ে বলল, অসংখ্য ধন্যবাদ। শিবলু ফিরে এলো হাপাঁতে-হাপাঁতে। মনে হ””ছ তালুকদার বাড়ির কুকুরটার তাড়া খেয়েছে ও । এসেই ধপাস করে বসে পড়ল। একেবারে ধপ্পাস করে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, কী হয়েছে? কয়েক মিনিট কোন কথাই বলতে পারল না শিবলু। কেবল তো-তো করতে লাগল। আমরা উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়লাম। একটু স্থির হওয়ার জন্য সময় দিলাম শিবলুকে। লিডার নয়নকে লক্ষ্য করে বললো, তোর পোটলা খোল, রুটি-গুড় খাই। নয়ন লিডারের কথা মত মোড়ানো প্যাকেটটা খুলে ফেলল। আমরা আনন্দের সাথে রুটি-গুড় মুখে ঢোকাতে লাগলাম। খাওয়া-দাওয়া হচ্ছিল বেশ মজা করেই। হঠাৎ শিবলু যেন স্বাভাবিক হলো। অল্প একটু রুটি মুখে পুড়তে পুড়তে বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। -সর্বনাশ! আমরা একসাথে বলে উঠলাম। আমাদের উৎকণ্ঠা বেড়ে গেল! গলায় রুটি-গুড় ঠেকে রইল। লিডার হিরা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে শিবলুর গা ঘেঁষে বসতে বসতে বলল, কী হয়েছে খুলে বল। আমি ও নয়ন এক সাথে বলে উঠলাম, বল-বল। শিবলু খুবই নার্ভাস কণ্ঠে বলল, স্বাস্থ্য আপা আজ যেসব ছেলে-মেয়েদের দিনব্যাপী ট্রেনিং করার কথা বলে নিয়ে গিয়েছিল। তারা কেউ ফিরে আসেনি। স্বাস্থ্য আপাকেও কেউ খুঁজে পাচ্ছে না। – কে বলল তোকে? আমি জিজ্ঞেস করলাম। – আমাদের পাড়ার লোকজন বলাবলি করছে। মহিলাটা নাকি শিশু পাচার গ্রুপের সদস্য। মনে পড়ল স্কুলে নাটক মঞ্চস্থ হওয়ার দিনে স্বাস্থ্য আপার সাথে বারী শয়তানের ফিসফাস আলাপ। হিরা মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বলল, সেদিন তো ওরা বলেছিল, ট্রেনিংয়ে অভিভাবকদের সাথে নিবে। অভিভাবক সাথে থাকলে তো এমনটা হওয়ার কথা না। -হয়তো ওরা কৌশলে অভিভাবকদের রেখে গেছে। বলল নয়ন। -হতে পারে। মাথা চুলকাতে-চুলকাতে বলল লিডার। শিবলু বলল, পার্শ্ববর্তী সেলুপুর হাইস্কুলে দুপুর পর্যন্ত সেমিনারের কথা বলে ছেলে-মেয়েদের নিয়ে গেছে। স্বাস্থ্য আপা নাকি একাই নিয়ে গেছে ওদের।

 

কিন্তু সন্ধ্যা নাগাদ কেউ ফিরে না আসায় সবার বাবা-মা খোঁজাখুঁজি করছে। পরে সেলুপুর হাইস্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে ফোন করে জানা গেছে সেখানে কোন প্রোগামই ছিল না। এতে সবার সন্দেহ ছেলে-মেয়েরা পাচারকারীদের হাতে পড়েছে। কেউ বলছে দশ জন, কেউ বলছে পনেরো জনকে পাওয়া যাচ্ছে না। সেদিন অনুষ্ঠানের বক্তব্যে পনেরো সংখ্যাটি কানে বেজে উঠল। শিবলুর মতোই হাপাঁতে-হাপাঁতে এলো আনু। এসেই ধপাস করে বসে পড়ল। একেবারে ধপ্পাস করে বসে পড়ল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, কী রে, কী হয়েছে? কয়েক মিনিট কোন কথাই বলতে পারল না আনু। কেবল তো-তো করতে লাগল। আমাদের উৎকণ্ঠা আরও বেড়ে গেল। কিছুটা স্থির হলো আনু। কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, সর্বনাশ হয়ে গেছে। আমরা সবাই ওর দিকে ঝুঁকে পড়ে কোরাস করলাম-সর্বনাশ। লিডার হিরা নিজের জায়গা ছেড়ে উঠে এসে আনুর গা ঘেঁষে বসতে বসতে বলল, কী হয়েছে খুলে বল। আমি, নয়ন, শিবলু একসাথে বলে উঠলাম, বল-বল। আনু আবারও কাঁপা গলায় বলল, বারী শয়তানটা পালিয়ে গেছে। আমরা একসাথে বলে উঠলাম, পালিয়ে গেছে! -তুই পাহারায় থাকতেও পালিয়ে গেল? বলল হিরা। -পেছনের জানালার গ্রীল খুলে পালিয়ে গেছে। মনে হলো শয়তানটা আগেই গ্রীলটা খুলে রেখেছিল। তাছাড়া একটু হলেও শব্দে হতো। কিন্তু নি:শব্দে পালিয়েছে শয়তানটা। স্বাস্থ্য আপা আর কুচক্রী এরশাদুল বারী একই সূত্রে গাঁথা। বারী সয়তানটার মোবাইল ফোনে কথাবার্তা অনুযায়ী আমরা আম বাগানে পৌঁছে গেলাম। বাগানের ঠিক পেছনে এক অন্ধকার জায়গায় ঘাপটি মেরে বসলাম। আমার ও হিরার ধারনা বারী ও তার লোকজন বাগানের মধ্যে অথবা আশেপাশেই আছেন। বাগানটা ভূতুড়ে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় বহু নিরীহ মানুষকে এই বাগানের মধ্যে হত্যা করেছে পাক-বাহিনী। বাবার মুখে গল্প শুনেছিলাম- একদিন হঠাৎ করে গ্রামে মিলিটারী এলো।

 

প্রাণ ভয়ে ছুটোছুটি করে পালাল সবাই। যে যে-দিক পারে পালিয়ে গেল। স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র ও জনবল তেমন না থাকায় প্রতিরোধ গড়তে পারল না। পালাল তাঁরাও। গ্রাম জুড়ে বুনো শুয়োরের মতো ঘুরল পাক-বাহিনী। তাদের পথ দেখাল আমাদের গ্রামেরই দু’তিনজন রাজাকার। জনমানবশুন্য ছিল সব ঘরবাড়ি। প্রথমে লুটপাট করল, তারপর আগুন ধরিয়ে দিল বাড়ি-ঘরে। দাউ-দাউ করে জ্বলে উঠল আগুন। বড়-বড় গাছ ছাপিয়ে অনেক উঁচুতে উঠে গেল সেই আগুনের রক্তিম শিখা। পুড়ল ঘর বাড়ি। দোকানপাট। গাছপালা। গরু-মহিষ-ছাগল-হাঁস-মুরগী। ধানের গোলা। পুতুলের বাক্স। খেলনাপাতি….. সব-সব, পুড়ে ছাই হলো। তারপর আগুন নিভে গেল। তখন বিকেল। পুড়ে ছারখার হওয়া ঘরবাড়ির দিকে তাকিয়ে কাঁদল সবাই। কাঁদল হাউমাউ করে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাঁদল ছোটরা। সহায়-সম্বলহীন জয়গন বুড়ী এ জগতে যার কেউ নাই। একটি মাত্র নাড়ার ঘর পুড়ে যাওয়ায় বুড়ী বিলাপ করে চলল, হারামীরা আমার ঘর পোড়াইলি, তোগরে আল্লা দোজোখের আগুনে পোড়াবি। আল্লা তোগরে বেস্ত দিবি লয়…। আর এই আম বাগানের মাঠে লাইনে দাঁড় করিয়ে সেদিন হত্যা করা হয়েছিল অনেকগুলো নিরীহ মানুষ। না, নিহিতদের মধ্যে এই গ্রামের কেউ ছিল না। সকলেই ছিল নদী দিয়ে যাওয়া নৌকার যাত্রী আর মাঝি। নিথর, বিভৎস লাশগুলোর সৎকার করেছিল গ্রামের লোকজন। শতশত মানুষের ঘরহারা এতো-এতো মৃত্যুর আজাহারি আর চোখের জলের বিনিময়ে এসেছিল স্বাধীনতা। তখন প্রতিশোধের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিল কেউ কেউ । এক মধ্য দুপুরে সেই পথ দেখানো রাজাকারদের ধরে এনে এই বাগানে হত্যা করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রেখেছিল মুক্তিযোদ্ধারা। সেদিন রাজাকারদের আর্তচিৎকার শুনে এগিয়ে আসেনি কেউ। বরং মনে মনে খুশি হয়েছে সবাই। এতোটা বছর পরেও মাঝে মাঝে নিঝুম রাতে রাজাকারদের সেই আর্তচিৎকার নাকি শোনা যায়। সবাই বলাবলি করে রাজাকাররা মরে ভূত হয়ে গেছে। এই ভূতুরে বাগানে তাই দিনে এলেও সন্ধ্যার পরে কেউ আসে না। বারী শয়তানকে নিয়ে বেড়াতে বেড়াতে একদিন এখানেও এসেছিলাম। বাগানের ব্যাপারটা আমরা সবাই জেনেও আজ ভয়হীন। শুধু জঙ্গুলে মশার উৎপাতে আমরা অস্থির হয়ে উঠলাম।

 

ইঞ্জিন চালিত নৌকার শব্দ শুনতে পা””ছলাম। নৌকাটা বাগানের ঘাটে ভিড়ল। হিরা আমার হাতে চিমটি কাটল। আমরা উত্তেজনায় কাঁপতে লাগলাম। নৌকা থেকে মৃদু আলোর একটা টর্চ লাইট জ্বলে উঠল। জ্বলেই নিভে গেল। আবার জ্বলে উঠল। আমরা বাগানের যেদিকটায় আছি, সেখান থেকে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। কেউ একজন বাগানের অপর প্রান্ত থেকে বেরিয়ে গেল। আবছা দেখা গেল। একটু ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে মৃদু আলোর একটা টর্চ পরপর দুবার জ্বালাল লোকটা। আমরা নি:শব্দে এক পা-দু’পা এগিয়ে গেলাম। নৌকা থেকে দু’জন লোক নেমে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার কাছে গেল। আস্তে আস্তে কথা বলছে ওরা। নয়ন, শিবলু আর আনুকে বসিয়ে রেখে আমরা ওদিকটায় যাচ্ছিলাম। হঠাৎ তীব্র আলোর একটা লাইট জ্বলে ওঠায় থেমে গেলাম। ঘাটের নৌকা থেকে লাইটটা জ্বালিয়ে পুরো বাগান আলোকময় করে ফেলেছে। আমরা শুয়ে পড়লাম। একেবারে ঘাসের সাথে মিশে গেলাম। অল্প একটু সময়। তারপর নিভে গেল। ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে থাকা একজন চাপা স্বরে বলে উঠল, সমস্যা নেই বস। আলোটা না জ্বালানোই ভালো। দশ মিনিটের মধ্যে সব ওকে হয়ে যাবে। আমরা স্পষ্ট বুঝতে পারলাম কথাটা বারী শয়তানের। নৌকা থেকে আরও একজন নেমে এলো। এসেই ধমকের সুরে বলতে লাগল, কী ব্যাপার মাল এখনো পৌঁছায় নি কেন? কথাগুলো বারির উদ্দেশ্যেই বলা হচ্ছিল। শয়তানটা কোন জবাব না দিয়ে আমতা-আমতা করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাত-আটজন লোক মাঠের দিক থেকে উঠে এলো। প্রত্যেকের মাথায় ভারী বস্তা। সরাসরি নৌকায় উঠে গেল লোকগুলো। পুরো নৌকায় ছই দেওয়া। ছইয়ের ভেতর বস্ত্তগুলো রেখে লোকগুলো দ্রুত আবার মাঠের দিকে চলে গেল।

 

ফাঁকা জায়গায় বারী ও তার সহযোগিরা দাঁড়িয়ে রইল। আমরা পেছন দিকে সরে এসে আগের জায়গায় চলে এলাম। দেখি শিবুল, আনু, নয়ন সেখানে নেই। আশেপাশে কোথাও নেই। বাগানের ভেতর দিয়েই আমরা নদীর কিনারে পৌঁছালাম। হিরাকে বসিয়ে রাখলাম পাড়ে। নি:শব্দে পানিতে নেমে গেলাম। লম্বা একটা ডুব দিয়ে পৌঁছে গেলাম নৌকার কাছে। নৌকার পেছন দিক দিয়ে অতি ধিরে একটু উঁচু হয়ে দেখলাম নৌকায় কেউ নেই। আস্তে আস্তে উঠে পড়লাম। ছইয়ের ভেতর ঢুকে অনায়াসে মাচালের নিচে চলে গেলাম। মাচালের উপরে বস্তা নিচে আমি। ফোঁটা-ফোঁটা কী যেন পড়ছে! রক্ত নাকি! বস্তায় কি জবাই করা মানুষের লাশ? হাত দিয়ে অনুভব করার চেষ্টা করলাম। না অন্ধকারে কিছুই বোঝা গেল না। শরীর শিউরে উঠতে লাগল। একটু পরেই লোকগুলো আবার বস্তা মাথায় করে নৌকায় উঠে এলো। বস্তা নামানোর শব্দে বোঝা গেল লাশ নয় বস্তায় লোহা-লক্কর। নিশ্চয়ই শ্যালো-মেশিনের দামী-দামী যন্ত্রাংশ। এখন বুঝতে পারছি বারী শয়তানটা কেন বারবার মাঠের শ্যালো ঘরগুলো দেখতে চাইতো। শত-শত শ্যালো মাঠে। হাজার-হাজার বিঘা ইরি-বোরো ধানের চাষাবাদ। শয়তানগুলো চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে লক্ষ লক্ষ টাকার পাটর্স। সকাল থেকেই বন্ধ থাকবে শ্যালোগুলো। নষ্ট হবে ধানের ক্ষেত। হুড়মুড় করে নৌকায় উঠে এলো নৌকাগুলো। এই বুঝি ধরা পড়ে গেলাম। নৌকার খোল থেকে বেড়িয়ে ছইয়ের ভেতর দিয়েই নদীতে নামলাম। কেউ একজন একটু-আধটু শব্দ শুনে বলে উঠল, কী পড়ে গেল রে? কেউ একজন মৃদু আলোর লাইট জ্বালাল। আমি একেবারে নৌকার গা ঘেঁষে রইলাম। মাঝি নৌকা ছাড়ার প্রস্ত্ততি নিচ্ছে। আমি লম্বা একটা ডুব দিলাম।   হিরা, নয়ন, আনু আর শিবলু আমার জন্যে অপেক্ষা করছিল খুবই উৎকন্ঠা নিয়ে। আমি ভেজা শরীরে পাড়ে উঠতেই শিবলু ব্যাগ থেকে কিছু শুকনো কাপড় বের করে দিল। কাপড় পড়তে পড়তে লিডার হিরাকে সবকিছু জানালাম। ঘাটে ডিঙ্গি নৌকা বাঁধা রয়েছে। হিরা সবাইকে লক্ষ্য করে বলল, জলদি উঠে পড়। নৌকায় উঠতে উঠতে বুঝলাম নয়ন, আনু আর শিবলু এ জন্যেই বাগান ত্যাগ করেছিল। আমির চাচার নৌকাটা ওরাই নিযে এসেছে। ইতোমধ্যে ভটভট শব্দ করে নৌকা ছেড়ে দিয়েছে চোরা কারবারির দল।

আমরা ডিঙ্গি নৌকা নিয়ে ওদের পিছু নিলাম। পাঁচজন সমানে বৈঠা বাইতে শুরু করলাম। নদীর স্রোতও আমদের পক্ষে আছে। তাই অনেকটা দূরত্ব বজায় রেখে আমরা মোটামুটি সমান তালেই এগুতে লাগলাম। ঘন্টা খানেক এভাবে যেতে যেতে আমরা ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। একটানা বৈঠা বাইতে বাইতে আমাদের হাত যেন অবশ হয়ে গেল। একে অপরের পায়ের ওপরে গায়ের ওপরে মাথা রেখে শুয়ে পড়লাম। স্রোতের টানে ডিঙ্গি চলতেই লাগল। নয়ন শুয়ে থেকেই হালটা ধরে রাখল। মাঝরাত পেরিয়ে গেছে। মেঘমুক্ত আকাশে অসংখ্য তারা জ্বলজ্বল করছে। কি চমৎকার দেখতে! পাশ থেকে আনু সবার উদ্দেশ্যে ধাঁধাঁ ছুঁড়ে দিল, এক থাল সুপারি, গুনতে পারে কোন ব্যাপারী? নয়ন তাচ্ছিল্যের সুরে বলল, এটা কোন ব্যাপার হলো, আনু বলল ব্যাপার না,বল দেখি উত্তরটা। নয়ন যেন একটু রেগেই গেল। সেরকম করেই বলল, তাতে মনে করছিস আমি পারব না। – পারলে তো এতোক্ষণ বলতি। বলল আনু। নয়ন কোন কথাই বলল না। এবার হয়তো সিরিয়াসলি রেগে গেছে নয়ন। রেগে গেলে ওর ঘাড় ফুলে ওঠে। তখন আর কথা বলতে পারে না। অন্ধকারে নয়নের ফোলা ঘাড়-টার দেখা গেল না। লিডার হিরা পরিস্থিতি সামলে নিতে আনুকে লক্ষ্য করে বলল, তোর ধাঁধাঁটার মানে- আকাশের তারা-একথা নয়ন কেন ওর ছোট্ট ভাইটাও বলতে পারবে। হিরার এ কথায় মুখ খুলল নয়ন। আহ্লাদে গদগদ হয়ে বলল, ওকি মানুষ চেনে নাকি। আনু এ বিষয়ে আর কিছু না বলে ওর প্রিয় সংলাপ জুড়ে দিল-বাংলা, বিহার, উড়িষ্যার নবাব সিরাজউদ্দৌলা….। ইতোমধ্যে ওদের নৌকা নদীর বড় বাঁকটা পেছনে রেখে আমাদের দৃষ্টি সীমার বাইরে চলে গেছে। ইঞ্চিনের শব্দটুকোও শোনো যাচ্ছে না। আমরা বৈঠা হাতে নিয়ে জোরে-জোরে টানতে শুরু করলাম।

একটানে পেরিয়ে এলাম নদীর বড় বাঁক। সামনে কিছুই দেখা যা””ছ না। ইঞ্জিনের শব্দ-টব্দও শোনা যাচ্ছে না। হয়তো ওরা অনেক দূরে চলে গেছে। আমরা কি ওদের নাগাল পাব? এর চেয়ে ঘাটে থাকতেই গ্রামের লোকজন ডেকে ওদের ধরিয়ে দিলেই ভালো হতো। প্রস্তাবটা দলের ক্ষুদে সদস্য শিবলু পেশ করেছিল। কিন্তু লিডার হিরা তাতে রাজি হয়নি। রাজি হয়নি দুটো কারণে। এক. চোরা কারবারিদের পিছু নিলে ওদের আস্তানার খোঁজ পাওয়া যাবে, তাতে নিখোঁজ হওয়া ছেলে-মেয়েদের সন্ধান পাওয়া যেতে পারে। দুই. গোয়েন্দাগিরির সূবর্ণ সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাবে। লিডার হিরার সাথে আমিও একমত। দলের অন্যরাও দ্বিমত প্রকাশ করেনি। -সবাই বৈঠা রাখ। চাপা স্বরে চেঁচিয়ে বলল নয়ন। আমরা মূহুর্তে স্থির হয়ে গেলাম। মূহূর্তেই বুঝে ফেললাম নয়নের চেঁচিয়ে ওঠার কারণ। সামনেই মাঝ নদীতে ওদের নৌকা। পেছনে ইঞ্চিনের কাছে একটু আলো দেখা যাচ্ছে। ঘটর-মটর শব্দও হচ্ছে। কেউ একজন ধমক দিয়ে বলছে তাড়াতাড়ি কর। নিশ্চয় ইঞ্চিন নষ্ট হয়েছে। আমরা খুব দূরে নয়। লিডার হিরার কথা মতো নদীর কিনারে কাশবনের মধ্যে ডিঙ্গিটা ঢুকিয়ে দিয়ে নিজেদের আড়াল করে ফেললাম। ঠিক তারপর-পরই হাই পাওয়ারের লাইটের আলো পড়ল নদীর মাঝ বরারব। অল্পের জন্যে আমরা রেহাই পেলাম। প্রায় ঘন্টা খানেক সময় পার হলো। ইতোমধ্যে নৌকা থেকে কিছুবার্তা হওয়ায় ভেসে-ভেসে আমাদের কানে পৌঁছেছে। বন্দরে স্টিমার প্রস্ত্তত, বেশি চিল্লা-পাল্লা করলে ঘুমের ইনজেকশন পুশ কর, আগামীকাল দুপুরের আগে ঢাকায় পৌঁছাতে হবে, সব ঠিক-ঠাক করতে সময় লাগবে, রাতেই বর্ডার পার…ইত্যাদি কথাবার্তা অস্পষ্ট ভাবে শোনা গেল। এই মূহুর্তে শালা গালির সাথে সাথে দু’চারটা চড় থাপ্পড়ের শব্দ পেলাম। আমরা ধরে নিলাম নৌকার মাঝির উপরই অত্যাচার চলছে। ইঞ্চিন নষ্ট হওয়াই তার অপরাধ। সময় অপচয় হওয়াতে শয়তানদের মাথা গরম হয়ে উঠেছে। না জানি মেরেও ফেলতে পারে। কিন্তু সে আশংঙ্কা দূর হলো। ভটভট শব্দে করে চালু হয়ে গেল ইঞ্চিন। ওদের নৌকা চলতে শুরু করল। আমরা কাশবনের ভেতরেই রইলাম। একটু আগে অস্পট ভাবে শোনা কথাগুলোর ব্যাখ্যা করলাম প্রত্যেকে। শিবলু বলল, বন্দরে স্টিমার প্রস্ত্তত মানে সামনের নদী বন্দরে ওদের জন্যে অপেক্ষা করছে বড় স্টিমার, যাতে করে ওরা নিরাপদে ঢাকা পৌঁছাবে। নয়ন বলল, বেশি চিল্লা-পাল্লা করলে ঘুমের ইনজেকশন পুশ কর এটা নিখোঁজ হওয়া ছাত্র-ছাত্রীদের উদ্দেশ্যই বলা। স্টিমারটাতেই হয়তো ওদের আটকে রাখা হয়েছে।

 

আনু বলল, রাতেই বর্ডার পার- মানে আগামীকাল রাতেই ওরা ছেলে-মেয়েদের বিদেশে পাঠিয়ে দেবে। লিডার হিরা বলল, ধর, বৈঠা ধর। জোরসে চালা। আমরা বর্ষা মাসে পাথারের থৈথৈ জলে ডিঙ্গি বাইচ দেই। আমাদের ফাইফ স্টার দলের ডিঙ্গি কখনো হেরেছে বলে মনে পড়ে না। সে কথা মনে করে নিচু স্বরে আলী-আলী করে বৈঠা চালাতে লাগলাম। নদী বন্দর বেশি দূরে নয়। ওদের নৌকা পৌঁছানোর মিনিট বিশেক পরেই আমরা পৌঁছে গেলাম। বন্দরে অসংখ্য স্টিমার ভিড়ানো। ছোট-বড়-মাঝারি। কোনটা বোঝাই। কোনটা খালি। ওরা ঠিক কোনটার কাছে নৌকা ভিড়িয়েছে তা বোঝা যাচ্ছে না। নৌকাটা অন্তত দেখা যাবে। কিন্তু তারও হদিস নাই। আমরা দিশেহারার মতো খুঁজতে লাগলাম। না, বন্দরের কোন স্টিমারের সাথেই কোন নৌকা ভেড়ানো নাই। তাহলে কি এরই মধ্যে     বস্তাগুলো নামিয়ে নৌকা নিয়ে মাঝি বিদায় নিয়েছে? হতেও পারে। আমরা হতাশ হলাম। আমি আস্তে করে দাঁড়িয়ে এদিক-সেদিক দৃষ্টি ফেললাম অন্ধকারে কত দূরে আর দৃষ্টি যায়। তবুও বন্দর ঘাট থেকে বেশ খানিকটা দূরে একটা স্টিমারের মতো মনে হলো। লিডার হিরাও দেখল। দেখেই বলল, ওদিকে ডিঙ্গি চালা। আমি লিডারকে এবার একটু সবুর করে পরিকল্পনা করার কথা বললাম। লিডার বলল, ও নিয়ে তোদের ভাবতে হবে না, সব ঠিক-ঠাক আছে। হিরার এ কথায় ভরসা পাওয়া যায়। কারণ এর আগে যত রিস্কি কাজেই গেছি, হিরা যদি বলতো সব ঠিক-ঠাক আছে তবে কোন ঝামেলাই হয়নি। আমরা অনায়সে সাকসেসফুল হয়ে এসেছি। ওর স্বভাবই এমন, আগে কিছুই বলবে না, কিন্তু সময় মতো সব ফিট করে ফেলবে। আমরা সর্তকতার সাথে ডিঙ্গি বাইতে শুরু করলাম। যতই এগুচ্ছি দূরবর্তী স্টিমারটা স্পস্ট হয়ে উঠেছে। হঠাৎ অল্প সময়ের মধ্যেই ভটভট করে একটা নৌকা এসে আমাদের ডিঙ্গিটার পেছনেই থেমে গেল। ছই তোলা নৌকা। থামতে-থামতেই যেন আমাদের ডিঙ্গিটার ওপরে উঠে যাওয়ার অবস্থা হয়ে গেল। কিন্তু না, মাঝির দক্ষতার বলে ডিঙ্গির একেবারে পাশ ঘেঁষে নৌকা স্থির হয়ে গেল। আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই আমাদের দিকে তাক করা পিস্তলের ওপর আলো ফেলে কেউ একজন হুকুম করল, সবগুলো নৌকায় ওঠ। নইলে এসপার-ওসপার হয়ে যাবি কিন্তু। ভালো করে লক্ষ্য করে দেখলাম বারী শয়তান। আরও কয়েকজন। আমরা শয়তানগুলোর হাতে ধরা পড়ে গেলাম।

 

নৌকায় ওঠানোর পর আমাদের চোখ বেঁধে ফেলা হলো। একজন কর্কশ কণ্ঠধারী বলল, বিচ্ছুগুলো আসলেই দু:সাহসী। অন্য একজন চিকন কণ্ঠে বলল, এবার বুঝবে মজা। নয়ন একটু চেঁচামেচি করতেছিল। কেউ একজন ঠাস্ করে থাপ্পড় বসিয়ে দিল নয়নের গালে। নয়ন ফোঁপাতে লাগল। কর্কশ কণ্ঠধারী লোকটা এবার ধমম দিয়ে বলল, খবরদার কোন শব্দ করবি না। ভটভট শব্দ করে নৌকার ইঞ্চিন চলছিল। আমরা টু শব্দটা পর্যন্ত করলাম না। কিছুক্ষণ পর ইঞ্চিন থেমে গেল। আমাদের ওঠানো হলো স্টিমারে। আমরা চোখে দেখতে না পারলেও আন্দাজ করে বুঝে নিলাম। বিকট শব্দ করে চালু হলো ইঞ্চিন। আমাদের হাত-পা বাঁধা। চোখ-মুখ আটকানো। বয়সে ছোট শিবলু ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ওকে সান্ত্বনা দিতেও পারছি না। সেই কখন থেকে শুধু কাঁদছে। কিছুক্ষণ পর হাত নাড়া-চাড়া করতে গিয়ে দেখি আমার হাতের বাঁধন আলগা হয়ে পড়েছে। একটু ঘষাঘষি করতেই সম্পুর্ণ ভাবে খুলে গেল। হাত দুটো মুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই দ্রুত চোখ খুললাম। তাকিয়ে দেখি দু’পাশে গাদি করা বস্তা, মাঝখানে আমাদের বসিয়ে রেখেছে। আমরা চারজন আছি। লিডার হিরাকে দেখছি না। মহাচিন্তায় পড়ে গেলাম। ফিসফিস করে শিবলুকে শান্ত হতে বললাম। আনু ও নয়ন ঘুমিয়ে আছে। ওদের ডাকলাম না। বস্তার ওপরে ভারী ত্রিফল। ভোরের আলো মোটা ত্রিফল ভেদ করে অন্ধকার দূর করেছে বেশ আগেই। বস্তাগুলো থরে-থরে সাজানো। অল্প একটু জায়গার মধ্যে আমরা চারজন শুয়ে-বসে আছি। এদিক-ওদিক ভালো করে লক্ষ্য করলাম।

 

একপাশ দিয়ে আসা-যাওয়ার রাস্তায় পড়ে আছে হিরা। একেবারে মরার মতো পড়ে আছে ও। তাড়াতাড়ি করে হাত-পা, চোখ-মুখ আলগা করে দিলাম। হিরা নড়ে-চড়ে আমার দিকে তাকাল। আনু, নয়ন ও শিবলুর কথা জিজ্ঞেস করল। আমরা ফিসফিস করে কথা বলছি। হিরা মাঝে-মাঝে মাথা চুলকাচ্ছে। এতে নাকি ওর মাথায় নতুন-নতুন প্ল্যান তৈরি হয়। মাথা চুলকাতে-চুলতেই হিরা বলল, তুই একটু ও পাশটা ঘুরে আয়। খুব সাবধানে যাস। আমি একপা-দু’পা করে এগিয়ে যেতেই দেখি স্কুলের নিখোঁজ হওয়া ছেলে-মেয়েরা। থরে থরে সাজানো বস্তার মাঝখানে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আরও একটু এগিয়ে গেলাম। গুনে দেখলাম দশজন ছেলে-মেয়ে অকাতরে ঘুমাচ্ছে। নিশ্চয়ই ঘুমের ইনজেকশন দেওয়া হয়েছে ওদের। আমাদের সহপাঠী তুহিন, সোয়ান, বিপ্লব। ক্লাস সেভেনের মনির, সাইম, রাখি, উর্মি। ক্লাস নাইনের শিলা, দোলা, শাহিন। সবাই চেনা আমার। একই স্কুলের ছাত্র-ছাত্রী।
এপাশটা ঘুরে আরও একটু এগিয়ে দেখি রাস্তার চিপায় বেশ কিছু অচেনা ছেলে-মেয়ে এলোপাথারী হয়ে পড়ে আছে। সবাই বেঘোরে ঘুমা””ছ। অন্য কোন স্কুল থেকে হয়তো ওদের আনা হয়েছে। আমি ঘুরে এসে হিরাকে সবকিছু বললাম। হিরা বলল, আমি ওপাশে কান্নার আওয়াজ শুনেই এমনটা ধারণা করেছিলাম। একটু থেমে হিরা আরও কিছু বলতে যাবে ঠিক তখনই খটখট পায়ের শব্দ শোনা গেল। তাড়াতাড়ি করে হিরার চোখ-মুখ বেঁধে হাত পেছনে দিয়ে আগের মতো শুইয়ে দিলাম। আমি আগের জায়গায় এসে কাত হয়ে পড়ে রইলাম। খটখট আওয়াজ করা লোকটা এক নজর দেখেই চলে গেল। আমি পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম-বারী। আরও কিছুক্ষণ পরে খটখট শব্দ করে এলো দুইজন। তাদের একজন মহিলা। আমি পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম স্বাস্থ্য আপা। -ঘুম থেকে জাগলেই ওদের নাস্তা দিতে হবে। বলল স্বাস্থ্য আপা। -জ্বী আচ্ছা। বলল পাশেরজন। স্বাস্থ্য আপার মুখে নাস্তার কথা শুনে স্কুলের টিফিন-পিরিয়ডের কথা মনে পড়ল। আর মনে পড়ল স্বাস্থ্য আপার প্রোট্রিন সমৃদ্ধ বিস্কুটের কথা। হারামী মহিলা! কেমন করে ভুলিয়ে-ভালিয়ে এতোগুলো ছেলে-মেয়েকে ধরে নিয়ে যাচ্ছে। পাক্কা হারামজাদা। খটখট করে চলে গেলে একজন। একটু পরে গেল মহিলাটা। আমি একটু নড়ে-চড়ে উঠলাম। শিবলুর উহ্-আহ্ শব্দ শুনে ওর কাছে গেলাম। চোখ-মুখ হাত-পা আলগা করে দিলাম। শিবলু ভ্যাঁ করে কেঁদে উঠতেই আমি হাত দিয়ে ওর মুখ চেপে ধরলাম। ও থেমে গেল। পানি দে বলে আব্দার করে বসল। স্বাস্থ্য আপার হাতে একটা হাফ লিটার পানির বোতল ছিল।

 

ঢকঢক করে দু’ঢোক পানি গিলে বোতলটা ঠেলে দিয়েছিল মহিলাটা। আমার পাশেই পড়েছিল ওটা। কিছুটা পানি তাতে ছিল। আমি শিবলুদের হাত দিয়ে খাইয়ে দিলাম। শান্তির নি:শ্বাস ফেলল শিবলু। আনু আর নয়ন তখনও ঘুমাছিল। আমি লিডার হিরার কাছে এগিয়ে গেলাম। ওর বাঁধনগুলো খুলে ফেললাম। হাত আলগা হওয়ার সাথেল সাথেই লিডার মাথা চুলকাতে লাগল। – আমরা সবাইতো জালে আটকে গেলাম রে হিরা। হতাশার সুরে বললাম। -তাতে কী? বলল লিডার। – তাতে কিছু না। দুর্বল কন্ঠে বললাম। -ভয় পাচিছস? আমার বুকে হাত রেখে বলল হিরা। মনটা একটু-আধটু দুর্বাল থাকলেও হিরার সাহসী উচ্চারণ শুনে যেন শক্তি ফিরে পেলাম। কললাম, একটুও না। -আমরা নদী পথে, না কী সমুদ্র পথে যাচ্ছি? জিজ্ঞেস করল হিরা। -আমি নিশ্চিত এটা নদী পথ। -কী করে নিশ্চিত হলি? -আমাদের বন্দর থেকে এই পথে একবার নানার সাথে আমি লঞ্চে ঢাকায় গিয়েছিলাম। -ও আচ্ছা। -কান পেতে থাকলে অনেক নৌযান আসা-যাওয়ার শব্দ শুনতে পাবি। -আমি তো শুনেছি। ভোঁ-ভোঁ করে স্পিডবোটও যাওয়া-আসা করছে। -রাইট। আমি নানার সাথে লঞ্চের রেলিং ধরে সেদিন কয়টা স্পিডবোট এলো-গেল তো গুনার চেষ্টা করেছিলাম। হিরা এক হাত দিয়ে আরেক হাতে থাপ্পড় মারল।
খুব আস্তে, যেন শব্দ না হয়। তারপর আমার বুকে টোকা মেরে বলল, নো চিন্তা। একটু থেমে হিরা আবার বলল, এখন একটা কাজ করতে হবে। -কী? হিরার পেছনে বস্তার নিচে একটা চিকন ছোট-খাট টায়ার পড়েছিল। হিরা ওটা দেখিয়ে বলল, টায়ারটা বের করতে হবে। দু’জন অনেকক্ষণ টানাটানি করলাম। কিন্তু কিছুতেই টায়ার বের হলো না। একটু নড়ানোও গেল না। খট-খট পায়ের শব্দ শুনে আমরা আগের পজিশনে পড়ে রইলাম। এবার একজন- দু’জন নয়, পাঁচ-ছয়জন এক সাথে এসেছে। স্টিমারের কেবিনে শয়তানগুলোর আড্ডা। একবার ওদিকে ঢু- মেরে দেখে এসেছি। বুঝতে পারে নি কেউ। -বিচ্ছুগুলোর ঘুম ভাঙ্গেনি। কর্কশ কণ্ঠে বলল একজন। -থাক, ঘুমাক। জাগলেই বিপদ। চিল্লা-পাল্লা করবে। বলল আরেকজন। – আর ঘন্টা তিনেক ভালোয়-ভালোয় গেলেই হয়। বলল অন্য একজন। খটখট করে চলে গেল লোকগুলো। আমি পিটপিট করে তাকিয়ে দেখলাম। ওরা চলে যেতেই উঁহ্-উঁহ্ আওয়াজ করল হিরা। নয়ন আর আনু জেগে উঠল। শিবলু পানি খেয়ে আবার ঘুমিয়েছে। ওকে ডাকলাম না। আমরা চারজন মিলে বস্তার নিচ থেকে টেনে টেনে টায়ারটা বের করলাম। গাদি করা বস্তা বেয়ে উঠে ত্রিফলের কিছুটা অংশ আলগা করলাম। নয়ন হিরাকে কাঁধে তুলল।

 

আমি হিরার হাতে টায়ারটা ধরিয়ে দিতেই ও খুব দ্রুত ত্রিফলের আলগা অংশ দিয়ে নদীতে লাফিয়ে পড়ল। আমরা সরতেই পারলাম না। খটখট করে পাঁচ-ছয়জন এসে আমাদের ঘাড় ধরে ফেলল। -কী করছিস তোরা? বলল একজন। -নদীতে ঝাঁপ দিবি নাকি? বলল আরেকজন। কর্কশ কণ্ঠের লোকটা হুকুম করল, সবগুলোর হাত-পা চোখ-মুখ বেঁধে ফেলে রাখ। খুব টাইট করে বেঁধে আমাদের উপুড় করে রাখল। চিকন কন্ঠের একজন বলল, একটু নড়া-চড়া করলে এই অবস্থায় নদীতে ফেলে দেব। আমরা নিশ্চুপ হয়ে রইলাম। মনে মনে আশ্বস্ত হলাম হিরা যে নদীতে ঝাঁপ দিয়েছে এটা ওরা বুঝে উঠতে পারেনি। হয়তো ভেবেছে আমরা ঝাঁপ দেওয়ার চেষ্টা করছি। আমরা যে পাঁচজন সেটাও ওদের মনে নেই। প্রায় ঘন্টা দু’য়েক এভাবে পড়ে রইলাম। হাত-পায়ের রক্ত চলাচল যেন বন্ধ হয়ে আসছে। পেটেও প্রচন্ড ক্ষুধা। প্রাণ-পাখি উড়ে যেতে চাইছে। হঠাৎ খটখট আওয়াজ করে লোকগুলো এলো। এসেই হুকুম করল একজন, খুলে দে, খুলে দে সব বাঁধন। আরেকজন বলল, তাড়াতাড়ি কর…তাড়াতাড়ি। মুক্ত হয়ে শিবলু ভ্যাঁ-ভ্যা কাঁদতে লাগল। আমি ভাবলাম এখুনি কষে একটা থাপ্পড় খাবে শিবলু। কিন্তু না, কর্কশ কন্ঠের লোকটাই ওর কাছে গিয়ে মাথায় হাত ভুলিয়ে বলল, কেঁদো না। আমি অবাক হলাম। আরও অবাক করে দিল বারী। আমাদের কাছে এসে বসে পড়ল। নাম ধরে-ধরে বলল, তোমাদের কিন্তু কোন ভয় নেই। আমি আছি না। চলো তোমাদের খাবার ব্যবস্থা করি। স্টিমারের বড় কেবিনে সুন্দর ভাবে বসিয়ে রাখা হয়েছে ছেলে-মেয়েদের। প্রত্যেকের হাতে খাবারের প্যাকেট। পানির বোতল। আমাদের দেখে ছেলে-মেয়েরা খুশি হলো। স্বাস্থ্য আপা কাছে বসিয়ে খাবার প্যাকেট হাতে দিল। তারপর শুরু করল তার জাদুকরী বক্তব্য। এটা-সেটা বলার পর একটু থামল। পরে বলল, তোমাদের যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তাহলে বলবে স্বাস্থ্য বিষয়ক ট্রেনিং করতে যাচ্ছি। অনেকেই ঘাড় নেড়ে বলল, জ্বী আচ্ছা। আমি বাইরে তাকিয়ে দেখি বারী শয়তানটা বারবার মুখের ঘাম মুছছে। অন্য লোকগুলোর মুখ ফ্যাকাসে হয়ে গেছে। স্বাস্থ্য আপা আমাদের সাথে কথা বলছে আর ঢোক গিলছে। একটু পরেই আমাদের এতো আদর-আপ্যায়ন আর ওদের টেনশনের ব্যাপার খোলাসা হয়ে গেল। তিন-চারটা স্পিডবোট বোঝাই পুলিশ ঘিরে ধরেছে স্টিমারটা। ফাঁকা গুলি ছুঁড়ছে। চলন্ত স্টিমারেই কমান্ডো স্টাইলে উঠে পড়ল পুলিশ। বন্ধুক উঁচিয়ে চালককে স্টিমার থামাতে বলল। একে একে ধরা পড়ল সবগুলো। নদীতে ঝাঁপ দিতে গিয়েও ধরা পড়ল এরশাদুল বারী। আমাদের ট্রেনিংয়ের কথা বলতে গিয়ে পুলিশের ধমক খেয়ে কেঁদেই ফেলল স্বাস্থ্য আপা। পিঠ-মোড়া করে বেঁধে ফেলল সবাইকে। হিরাকে দেখছি না। ও কি নদীতে ডুবে মরল নাকি। এমন চিন্তা করতে করতেই দেখি অন্য একটা স্পিডবোট থেকে পুলিশ অফিসারদের সাথে স্টিমাররে উঠে আসাছে হিরা। হিরাকে আড়চোখে দেখল বারী। মুখখানা এমন করল যেন স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে, হিরাই নদীতে লাফিয়ে পড়ে তাদের ধরিয়ে দিল। পুলিশ অফিসার স্টিমার চালু করে থানা ঘাটের দিকে নেওয়ার নির্দেশ দিলেন।

 

হিরা আমার কানে-কানে বলল, জানিস নদীতে ভাসতে ভাসতে প্রায় আধা-মরা হয়ে গিয়েছিলাম। লঞ্চ, নৌকা, স্পিডবোট কিছুই ছিল না। তারপর দেখি একটা স্পিডবোট আসছে। টায়ারে ভর দিয়ে হাত উঁচিয়ে সাহায্য চাইতেই আমাকে তুলে নিল। দেখি টহল পুলিশের বোট। যার-পর নাই খুশি হলাম। প্ল্যান সাকসেসফুল! মনে-মনে এসব বলেই পুলিশকে ঘটনা বললাম। ব্যস্। এখন ব্যাটারা যাবে কোথায়। আমি হিরাকে চোখের ভাষায় ধন্যবাদ জানালাম। পুলিশ অফিসার হিরাকে বলল, তোমার ফাইফ স্টারের আর সদস্যরা কোথায়? হিরা আমার দিকে তাকাল। আমি সবাইকে ডেকে হিরার পাশে গিয়ে দাঁড়ালাম। হিরা অফিসারের দিকে তাকিয়ে বলল, স্যার। পুলিশ অফিসার আমাদের কাছে এসে মাথায় হাত ভুলালেন। বললেন, তোমাদের সাহসিকতা আর বুদ্ধির জোরে আজ রক্ষা পেল এতোগুলো ছেলে-মেয়ে। ধরা পড়ল মালামালসহ চোরা-কারবারির দল। বারী-শয়তানটা আমাদের দিকে কটাক্ষ চোখে তাকিয়ে রইল। থানায় নিয়ে আটকে ফেলল ওদের। সাংবাদিক এলো। একের পর এক ছবি তুলতে লাগল আমাদের। সাক্ষাৎকার নেওয়া হলো অধিনায়ক হিরার। আমরা আনন্দে বুক ফুলিয়ে রইলাম। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা পুলিশের গাড়িতে বাড়ি পৌঁছালাম। থানায়-থানায় যোগাযোগের কারণে ঘটনা আগেই জেনেছিল গ্রামের লোকজন। আমরা পৌঁছাতেই গ্রামবাসী যেন উৎসবে মেতে উঠল।

 

পরেরদিন খবরের কাগজে আমাদের ছবি ছাপা হলো। এ-গ্রাম সে গ্রাম থেকে লোকজন দেখতে এলো। গ্রামের কবি হাবিবুর রহমান ‘ফাইভ-স্টার দলের কবিতা’ শিরোনামে কাব্য লিখে হাটে-বাজারে দেদারছে বিক্রি করছে। আজ সকাল বেলা স্কুলে যাব। পাঁচজনই একসাথে বেরিয়েছি। খেয়া নৌকায় উঠলাম। তালুকদার সাহেব আমাদের দিকে তাকালেন। আমরা আড়চোখে দেখলাম। শিবলু সালাম দিল। তালুকদার সাহেব সালামের জবাব দিয়ে মুচকি হাসলেন। তারপর আমাদের লক্ষ্য করে বললেন, এতো রিক্স নেওয়া ভালো নয়। তালুকদারের কথার জবাব দিল নয়ন।

বলল, নো রিক্স নো গেইন। তালুকদার সাহেব চোখ বন্ধ করে রইলেন। স্কুলে বন্ধু- বান্ধব ছোট-বড় সকলের কাছে আমাদের অভিষানের গল্প বলে বলে ক্লান্ত হয়ে পড়লাম। স্কুল ছুটির পরে ডাকলেন আবু জার স্যার। আমরা কাছে গিয়ে দাঁড়াতেই বললেন, ফাইভ-স্টার দল না! আমরা মাথা উঁচু-নিচু করে বললাম, জ্বী স্যার। হেডস্যারসহ স্কুলের সকল শিক্ষক উপস্থিত ছিলেন। প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আরও একবার বলতে হলো ঘটনাটা। শুনতে-শুনতে সবাই নিশ্চুপ হয়ে গেলেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে আছেন একদৃষ্টিতে। আবু জার স্যার বললেন, তোরা পারিস বটে! তোদের স্যালুট। হেডস্যার বুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন। আমরা আনন্দে আত্মহারা হয়ে পড়লাম। গর্বে আমাদের বুক ফুলে উঠল।

আরো পড়তে পারেন...

সুবর্ণগোলক—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কৈলাসশিখরে, নবমুকুলশোভিত দেবদারুতলায় শার্দ্দুলচর্ম্মাসনে বসিয়া হরপার্ব্বতী পাশা খেলিতেছিলেন। বাজি একটি স্বর্ণগোলক। মহাদেবের খেলায় দোষ এই-আড়ি…

বসন্ত এবং বিরহ—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

রামী। সখি, ঋতুরাজ বসন্ত আসিয়া ধরাতলে উদয় হইয়াছেন। আইস, আমরা বসন্ত বর্ণনা করি। বিশেষ আমরা…

গর্দ্দভ– বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

হে গর্দ্দভ! আমার প্রদত্ত, এই নবীন সকল ভোজন করুন।১ , আমি বহুযত্নে, গোবৎসাদির অগম্য প্রান্তর…