বিখ্যাত বুজুর্গ জয়নুল আবেদীন (রহঃ)
হযরত হিসাম বিন আব্দুল মালেক বলেন, একবার আমি তাওয়াফের প্রচন্ড ভীড়ের কারণে বহু চেষ্টা করা সত্ত্বেও হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করতে পারলাম না। এমন সময় কাবা চত্বরে প্রখ্যাত বুজুর্গ হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন তাশরীফ আনলেন। সাথে সাথে তাওয়াফকারীরা তাঁর জন্য পথ ছেড়ে দিল। তিনি আরামের সাথে তাওয়াফ শেষ করে হাজরে আসওয়াদ চুম্বন করার পর তথা হতে প্রস্থান করলেন, লোকেরা আমার নিকট তাঁর পরিচয় জিজ্ঞেস করল। ঐ সময় এক কবি হযরত জয়নুল আবেদীনের নাম উল্লেখ করে তাঁর বহু গুণাগুণ আলোচনা পূর্বক কয়েকটি কবিতা পাঠ করল।
কথিত আছে, ঈমান জয়নুল আবেদীন দৈনিক এক হাজার রাকাত নামায আদায় করতেন। তাছাড়া তিনি ভ্রমণ অবস্থায়ও কোন দিন তাহাজ্জুতের নামায ত্যাগ করেননি। নামাযের জন্য অযূ করতে বসলেই তাঁর চেহারার রং পরিবর্তন হয়ে যেত। একবার কেউ তাকে জিজ্ঞেস করল, নামাযের মধ্যে আপনার এরুপ অবস্থা হওয়ার কারণ কি? উত্তরে তিনি বললেন, তুমি কি জান না যে, নামাযের সময় আমি কার সামনে দাঁড়াই। তাঁর অভ্যাস ছিল, ঝড়তুফান শুরু হওয়ার সাথে সাথে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলতেন।
একবার তাঁর ঘরে আগুন লাগল। তখন তিনি সিজদার অবস্থায় ছিলেন। আশেপাশে লোকেরা চিৎকার করে তাকে আগুনের কথা জানাল। কিন্তু মনে হল যেন তিনি কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। এমন সময় দেখা গেল আগুন নিজে নিজেই নিভে যাচ্ছে। নামায শেষে লোকেরা তাকে এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন, আখেরাতের ভয়াবহ আগুনের চিন্তায় আমি দুনিয়ার আগুন ভুলে গিয়েছিলাম। হযরত ঈমাম জয়নুল আবেদীন এরুপ দোয়া করতেন, হে পরওয়ারদেগার! আমার ভেতর খারাপ হলেও আমার বাহ্যিক যেন ভাল থাকে। মানুষের নজরে যেন আমি ভাল থাকি।
তিনি বললেন, অনেকে আল্লাহ পাকের ভয়ে ইবাদত করে থাকে, এ ধরণের ইবাদত হল অনুগত গোলামের আচারণের মত। আবার কেউ ইবাদত করে নিছক ছওয়াবের আশায়। এজাতীয় ইবাদত অনেকটা ব্যবসার মত। আবার কেউ ইবাদত করেন নেয়ামতের কৃতজ্ঞতার প্রকাশার্থে। এটা যেন আজাদ বান্দাদের আচরণ। হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীন অযূর সময় কারো সাহায্য গ্রহণ করা পছন্দ করতেন না। রাতে ঘুমাবার পূর্বেই তিনি অযূর পানি সংগ্রহ করে রেখে দিতেন। তাহাজ্জুদের সময় উঠে প্রথমে মেসওয়াক করতেন। পরে অযূ করে নামাযে দাঁড়াতেন। দিনের বেলায় কোন আজিফা অসমাপ্ত থাকলে রাতে তা পূরণ করতেন। তিনি বলতেন, দুনিয়াতে মানুষ কেমন করে অহংকার করে তা আমি বুঝতে পারি না, মাত্র কয়েকদিন পূর্বেই সে ছিল এক ফোঁটা নাপাক পানি।
আবার মৃত্যুর সাথে সাথে নাপাক মুরদা হয়ে পড়ে থাকবে। তিনি আরো বলতেন, কি আশ্চর্যের বিষয়, মানুষ দুনিয়ার অস্থায়ী নিবাসের জন্য পরিশ্রম করছে অথচ চিরস্থায়ী নিবাস পরকালের জন্য আমল বা পরিশ্রম করছে না।
মদিনার বহু গরিব পরিবার এমন ছিল যারা নিয়মিত সাহায্য পেত। কিন্তু তাঁরা তা জানত না যে, ঐ সাহায্য কোথা হতে আসছে। হযরত ঈমাম জয়নুল আবেদীনের মৃত্যুর পর দেখা গেল যে, মদিনার বহু পরিবারের সাহায্য বন্ধ হয়ে গেল। পরে জানা গেল ইমাম জয়নুল আবেদীন মদীনার দুস্থ পরিবারে রাতের অন্ধকারে সাহায্যে পৌঁছাতেন। অথচ লোকসমাজে তিনি একজন বখীল হিসাবে পরিচিত ছিলেন। তাঁর ইন্তেকালের পর এমন একশটি পরিবারের সন্ধান পাওয়া গেল, যারা সরাসরি হযরত ইমাম জয়নুল আবেদীনের ব্যক্তিগত সাহায্যের উপর নির্ভরশীল ছিল।
একদা এক ব্যক্তি হযরত জয়নুল আবেদীনকে কিছু গালমন্দ করল। ইমাম সাথে সাথে বললেন, আমি যদি এমনই হই যেমন তুমি বর্ণনা করলে, তবে আল্লাহ পাকের নিকট আমি ক্ষমা প্রার্থনা করছি। আর যদি তেমন না হই, তবে আমি মনে করব, ইতোপূর্বে হয়তো এমন ছিলাম। আল্লাহ পাক আমাকে ক্ষমা করেছেন। ঐ ব্যক্তি সাথে সাথে হযরত ইমামের নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করে তাঁর কপালে চুম্বন পূর্বক বলল, আপনি কখনো মন্দ লোক নন। আপনি আমার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করুন। হযরত ইমাম বললেন, আল্লাহ তোমাকে মাফ করুন।
একবার হযরত ইমামের খাদেমের হাত থেকে গরম তরকারীর পেয়ালা তাঁর শিশু সন্তানের উপর পড়ে গেল। সাথে সাথে শিশুর কচিদেহ ঝলসে গিয়ে ঘটনাস্থলেই সে মৃত্যুবরণ করল,
খাদেমের এ অপরাধের জন্য উপস্থিত সবাই তাঁর উপর বড় ধরনের কোন শাস্তির অপেক্ষা করছিল। কিন্তু হযরত ইমাম সবাইকে অবাক করে দিয়ে খাদেমকে বললেন, তুমি ইচ্ছা করেই এরুপ করনি অথচ তোমার হাতেই আমার সন্তান নিহত হয়েছে বিধায়” মনিবের সন্তান হত্যার অপরাধ” কল্পনায় সর্বদা তোমার মন দগ্ধ হতে থাকবে। আমার সামনে তোমার সংকোচবোধ হবে। অথচ এ দুর্ঘটনায় তোমার কোন হাত ছিল না। সুতরাং এ মুহুর্তে তোমাকে আমি আজাদ করে দিলাম। গোলামকে আজাদ করার পর তিনি নিতান্ত স্বাভাবিক অবস্থায় নিহত সন্তানের কাফন দাফন সম্পন্ন করলেন।