পুরাতন কথার আলোচনায়…বিপদ হইয়াছে এইখানে। অথচ প্রয়োজন ছিল না। এই সুদীর্ঘ বর্ষ পরে আমি হইলে বলিতাম, কত ভুলই ত সংসারে আছে, থাকিলই বা আর একটা। কি এমন ক্ষতি! কিন্তু আমার ও অপরের ক্ষতিবোধের হিসাব ত এক নয়।
…এখানে একটা গল্প মনে পড়িয়াছে। গল্পটা এই—
“কয়েক বৎসরের কথা, একবার হাবড়ায় ‘শরৎচন্দ্র’ সম্বন্ধীয় একটি সভার একজন বক্তা বোধ হয় সুরেন্দ্রনাথের ঐ লেখাটি পড়িয়াই (‘কল্লোল’ মাঘ, ১৩৩২) বক্তৃতায় বলিয়াছিলেন, টিলাকুঠির মাঠে (ভাগলপুর) এই সভা বসিত এবং সুরেন্দ্র, গিরীন্দ্র…বিভূতিভূষণ তাঁহার পদতলে বসিয়া সাহিত্য-সাধনা করিত। এই সভার একজন শ্রোতা (তাঁর নাম ৺বিনয়কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়, শারীরিক বলের জন্য আদমপুর ক্লাবে এই বিনয়বাবুকে সকলেই জানিত। তিনি গৃহশিক্ষকরূপে ভাগলপুরে বহুদিন বাস করায়…সবই জানিতেন।) উত্তেজিত হইয়া আমাদের এ-খবর দেন এবং প্রতিবাদ করিতে বলেন। বিভূতিবাবু তাঁহাকে বহু কষ্টে প্রকৃতিস্থ করিয়া বুঝান যে…অপরের মুখের শোনা-কথা লেখায় প্রতিবাদ চলে না। আপনি মুখে যাহা বলিয়াছেন সেই পর্যন্তই ভাল।”
বিভূতিবাবু তাঁহার ভূতপূর্ব গৃহশিক্ষক বিনয়কুমারকে যদি সত্যই ‘প্রকৃতিস্থ’ করিতে সক্ষম হইয়া থাকেন ত একটা বিস্ময়কর ব্যাপার করিয়াছিলেন তাহা মানিবই। কারণ, চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এক ঘণ্টাও তাঁহাকেও ‘প্রকৃতিস্থ’ করা সহজ বস্তু ছিল না। “পদতলে বসিয়া সাহিত্য-সাধনা করিত”, সভায় এই গ্লানিকর উক্তি শুনিয়া ভূতপূর্ব গৃহশিক্ষক বিনয়কুমার নিজে উত্তেজিত হইয়া প্রতিবাদ করিয়াছেন এবং অপরকে উত্তেজিত হইতে প্ররোচিত করিয়াছেন। কিন্তু ঘটনাটা আমার কাছে একেবারে নূতন। ১৩৩২ সনে আমি হাবড়াতেই ছিলাম অথচ আমার সম্বন্ধে এরূপ একটা সভা হওয়ার কথা আমি আদৌ বিদিত নই। সভা সত্যিই হইয়া থাকিলে এবং নিজে উপস্থিত থাকিলে এমন একটা কথা আমার নিজের পক্ষে যত বড় গৌরবের সামগ্রীই হোক অসত্য বলিয়া নিশ্চয়ই প্রতিবাদ করিতাম এবং বিনয়েরও উত্তেজিত হইয়া উঠার প্রয়োজন হইত না। তাহা নিঃসন্দেহে বলিতে পারি।
…মানুষ স্বভাবতঃ অনেকটা যে কল্পনাপ্রবণ তাহা সত্য এবং কল্পনারও যে উপযোগিতা আছে তাহাও সত্য, কিন্তু যথাস্থানে। ভূতপূর্ব গৃহশিক্ষক বিনয়কুমার পরবর্তীকালে ছিলেন Statesman কাগজের Reporter. বার বার ঘটনাস্থলে উপস্থিত না থাকিয়াও খরতর কল্পনার সাহায্যে report দাখিল করার জন্য তাঁহার চাকরি গিয়াছিল এবং কাগজের সম্পাদককেও লাঞ্ছিত হইতে হইয়াছিল।
আজ বিনয় পরলোকগত। মৃত ব্যক্তিকে লইয়া এই সকল কথা লিখিতে আমার ক্লেশবোধ হয়।…
কিন্তু ইহা বাহ্য। আসলে…উত্ত্যক্ত করিয়াছে কতকগুলি অতি কৌতূহলী লোকের অশিষ্ট…ও অমার্জনীয় জিজ্ঞাসাবাদ। তাহারা প্রশ্ন করিয়াছে, আমার কাছে…সাহিত্য-ব্যাপারে কে কতটা ঋণী। লোকেরা এ-প্রশ্ন আমাকেও যে না করিয়াছে তাহা নয়। কিন্তু যে-কেহ জিজ্ঞাসা করিয়াছে তাহাকেই অকপটে এই সত্য কথাটাই চিরদিন বলিয়াছি যে…আমার কাছে লেশমাত্র কেহ ঋণী নয়। একস্থানে এক সময়ে ছেলে-বয়েসে সাহিত্যচর্চা করিতে থাকিলে লোক পরস্পরকে উৎসাহ দিয়াই থাকে, ভালো লাগিলে ভালো বলিয়া বন্ধুজনেরা অভিনন্দিত করিয়াই থাকে, তাহাকে ঋণ বলিয়া অভিহিত করিতে গেলে মানুষের ঋণের কোথাও আর সীমা থাকে না। যেমন সুরেন, গিরীন, উপেন, তেমনি বিভূতি…প্রভৃতি। লেখা পড়িয়া ভালো লাগিলে ভালো বলিয়াছি—কোথাও তেমন ভালো না লাগিলে ছিঁড়িয়া ফেলিয়া আবার লিখিতে অনুরোধ করিয়াছি।…কোনদিন সংশোধন করি নাই।…এতকাল পরে এই সকল কথা ব্যক্ত করার উদ্দেশ্য আমার শুধু এই যে, এ সম্বন্ধে আমার বক্তব্য যেন লিপিবদ্ধ হইয়া থাকিতে পারে।…
এইবার আমার নিজের সম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলিয়া এ-আলোচনা শেষ করিতে চাই। ছেলেবেলার লেখা কয়েকটা বই আমার নানা কারণে হারাইয়া গেছে। সবগুলার নাম আমার মনে নাই। শুধু…দু’খানা বইয়ের নষ্ট হওয়ার বিবরণ জানি। একখানা, ‘অভিমান’, মস্ত মোটা খাতায় স্পষ্ট করিয়া লেখা,—অনেক বন্ধুবান্ধবের হাতে হাতে ফিরিয়া অবশেষে গিয়া পড়িল বাল্যকালের সহপাঠী কেদার সিংহের হাতে। কেদার অনেকদিন ধরিয়া অনেক কথা বলিলেন, কিন্তু ফিরিয়া পাওয়া আর গেল না। এখন তিনি এক ঘোরতর তান্ত্রিক সাধুবাবা। বইখানা কি করলেন তিনিই জানেন—কিন্তু চাহিতে ভরসা হয় না—তাঁর সিঁদুর মাখানো মস্ত ত্রিশূলটার ভয় করি। এখন তিনি নাগালের বাহিরে—মহাপুরুষ—ঘোরতর তান্ত্রিক সাধুবাবা।
দ্বিতীয় বই ‘শুভদা’। প্রথম যুগের লেখা ওটা ছিল আমার শেষ বই, অর্থাৎ ‘বড়দিদি’, ‘চন্দ্রনাথ’, ‘দেবদাস’ প্রভৃতির পরে।
গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভাকাংখী এবং সম্মানিত আবেদনকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।