প্রগতিসংহার-রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-৩য় অংশ

হাসিমুখে মেনে নেবেন। ওঁরা তো আর ইংরেজ নন, ইংরেজরা বিদেশীদের কাছ থেকেও নিজেদের আদবকায়দার স্খলন সইতে পারেন না, এমন ওঁদের অহংকার। কিন্তু ফরাসীদের তা নয়, বরঞ্চ যদি কিছু অসম্পূর্ণ থাকে সেটা হেসে গ্রহণ করবে। দেখা যাক্‌-না—নীহাররঞ্জনের বিদ্যের দৌড় কতদূর। শুনেছি ও ঘরে বসে বসে ফরাসী পড়ার চর্চা করে।”

নীহাররঞ্জনের বাড়ি চন্দননগরে। প্রথম বয়সে ফরাসী স্কুলে তার বিদ্যাশিক্ষা, সেখানে ওর ভাষার দখল নিয়ে খুব খ্যাতি পেয়েছিল, এ-সব কথা ওর কলকাতার বন্ধু-মহল কেউ জানত না। যা হোক, সে তো কোমর বেঁধে দাঁড়ালো। কী আশ্চর্য, অভিনন্দন যখন পড়ল তার ভাষার ছটায় ফরাসী পণ্ডিত এবং তাঁর দু-একজন অনুচর আশ্চর্য হয়ে গেলেন। তাঁরা বললেন—এ রকম মার্জিত ভাষা ফ্রান্সের বাইরে কখনো শোনেন নি। বললেন, এ ছেলেটির উচিত প্যারিসে গিয়ে ডিগ্রি অর্জন করে আসা। তার পর থেকে ওদের কলেজের অধ্যাপকমণ্ডলীতে ধন্য ধন্য রব উঠল; বললে—কলেজের নাম রক্ষা হল, এমন-কি, কলকাতা ইউনিভার্‌সিটিকেও ছাড়িয়ে গেল খ্যাতিতে।
এর পরে নীহারকে অবজ্ঞা করা কারও সাধ্যের মধ্যে রইল না। ‘নীহারদা’ ‘নীহারদা’ গুঞ্জনধ্বনিতে কলেজ মুখরিত হয়ে উঠল। প্রগতিসংঘের প্রথম নিয়মটা আর টেকে না। পুরুষদের মন ভোলাবার জন্য রঙিন কাপড়-চোপড় পরা ওরা ত্যাগ করেছিল। সব-প্রথমে সে নিয়মটি ভাঙল সুরীতি, রঙ লাগালো তার আঁচলায়। আগেকার বিরুদ্ধ ভাব কাটিয়ে নীহাররঞ্জনের কাছে ঘেঁষতে তার সংকোচ বোধ হতে লাগল, কিন্তু সে সংকোচ বুঝি টেকে না।

দেখলে অন্য মেয়েরা সব তাকে ছাড়িয়ে যাচ্ছে। কেউ-বা ওকে চায়ে নিমন্ত্রণ করছে, কেউ-বা বাঁধানো টেনিসন এক সেট লুকিয়ে ওর ডেস্কের মধ্যে উপহার রেখে যাচ্ছে। কিন্তু সুরীতি পড়ছে পিছিয়ে। একজন মেয়ে নীহারকে যখন নিজের হাতের কাজ-করা সুন্দর একটি টেবিল-ঢাকা দিলে, তখন সুরীতির প্রথম মনে বিঁধল, ভাবল, ‘আমি যদি এই-সব মেয়েলি শিল্পকার্যের চর্চা করতাম’। সে যে কোনোদিন সুঁচের মুখে সুতো পরায় নি, কেবল বই পড়েছে। সেই তার পাণ্ডিত্যের অহংকার আজ তার কাছে খাটো হয়ে যেতে লাগল। ‘কিছু-একটা করতে পারতুম যেটাতে নীহারের চোখ ভুলতে পারত’—সে আর হয় না। অন্য মেয়েরা তাকে নিয়ে কত সহজে সামাজিকতা করে। সুরীতির খুব ইচ্ছে সেও তার মধ্যে ভরতি হতে পারত যদি, কিন্তু কিছুতেই খাপ খায় না। তার ফল হল এই—তার আত্মনিবেদন অন্য মেয়েদের চেয়েও আরও যেন জোর পেয়ে উঠল। সে নীহারের জন্য কোনো অছিলায় নিজের কোনো একটা ক্ষতি করতে পারলে কৃতার্থ হত। একেবারে প্রগতিসংঘের পালের হাওয়া বদলে গেল।

অন্য মেয়েরা ক্রমে নিয়মিতভাবে তাদের পড়াশুনায় লেগে গেল, কিন্তু সুরীতি তা পেরে উঠল না। একদিন ডেস্কের উপর থেকে নীহারের ফাউন্‌টেনপেনটি মেঝের উপর গড়িয়ে পড়েছিল, সর্বাগ্রে সেটা সে তুলে ওকে দিলে। এর চেয়ে অবনতি সুরীতির আর কোনোদিন হয় নি। একদিন নীহার বক্তৃতায় বলেছিল—তার মধ্যে ফরাসী নাট্যকারের কোটেশন ছিল—‘সব সুন্দর জিনিসের একটা অবগুণ্ঠন আছে, তার উপরে পুরুষদৃষ্টির হাওয়া লাগলে তার সৌকুমার্য নষ্ট হয়ে যায়। আমাদের দেশে মেয়েরা যে পারতপক্ষে পুরুষদের কাছে দেখা দিত না, তার প্রধান কারণ এই যে, দেখা দেওয়ার দ্বারা মেয়েদের মূল্য কমে যায়। তাদের কমনীয়তার উপের দাগ পড়তে থাকে।’ অন্য মেয়েরা এই কথা নিয়ে বিরুদ্ধ তর্কে উত্তেজিত হয়ে উঠল। তারা বললে, এমনতরো করে ঢেকেঢুকে কমনীয়তা রক্ষা করবার চেষ্টা করা অত্যন্ত বিড়ম্বনা। সংসারে পুরুষস্পর্শ, কী স্ত্রী, কী পুরুষ, সকলেরই পক্ষে সমান আবশ্যক। আশ্চর্য এই, আর কেউ নয়, স্বয়ং সুরীতি উঠে নীহারের কথার সমর্থন করলে।

এই এক সর্বণের ধাক্কায় তার চালচলন সম্পূর্ণ বদলে যাবার জো হল। এখন সে পরামর্শ নিতে যায় নীহারের কাছে। যখন শেক্‌স্‌পীয়রের নাটক সিনেমাতে দেখানো হয়, তখন তাও কি মেয়েরা কোনো পুরুষ অভিভাবকদের সঙ্গে গিয়ে দেখে আসতে পারে না। নীহার কড়া হুকুম জারি করলে—তাও না। কোনোক্রমে নিয়মের ব্যতিক্রম হলে নিয়ম আর রক্ষা করা যায় না।

প্রত্যেকবারেই সুরীতি ভালো কিছু দেখবার থাকলে সিনেমাতে যেত। এখন তার কী হল! এত বড়ো আত্মত্যাগ তো কল্পনা করা যায় না, এমন-কি আজকালকার দিনে যে সামাজিক নিমন্ত্রণে স্ত্রীপুরুষের এক সঙ্গে খাওয়াদাওয়া চলত, সেখানে সে যাওয়া ছেড়ে দিলে। সনাতনীরা খুব তার প্রশংসা করতে লাগল। প্রগতিসংঘ থেকে সে নিজেই আপনার নাম কাটিয়ে নিলে।

সুরীতি চাকরি নেবে, নীহারের অনুমতি চাইল—স্কুলে পুরুষ ছাত্র খুব ছোটো বয়সের হলেও তাদের পড়ানো চলে কি না।

নীহার বললে, না, তাও চলে না। তার ফল হল সে অর্ধেক মাইনে স্বীকার করে মাস্টারি নিয়ে বললে, তার বাকি বেতন থেকে ছেলেদের আলাদা পড়াবার লোক রাখা হোক। স্কুলের সেক্রেটারিবাবু অবাক।

সুরীতির মনের টান ক্রমশ দুঃসহ হয়ে উঠতে লাগল। এক সময়ে কোনোরকম করে আভাস দিয়েছিল, তাদের বিয়ে হতে পারে কি না। একদিন যে সমাজের নিয়মকে সুরীতি মানত না, সেই সমাজের নিয়ম অনুসারে শুনতে পেল ওদের বিয়ে হতে পারে না কোনোমতেই। অথচ এই পুরুষের আনুগত্য রক্ষা করে চিরকাল মাথা নিচু করে চলতে পারে তাতে অপরাধ নেই, কেননা বিধাতার সেই বিধান।

প্রায়ই সে শুনতে পায়—নীহারের অবস্থা ভালো নয়, পড়বার বই তাকে ধার করে পড়তে হয়। তখন সুরীতি নিজের জলপানি থেকে ওকে যথেষ্ট সাহায্য করতে লাগল। নীহারের তাতে কোনো লজ্জা ছিল না। মেয়েদের কাছ থেকে পুরুষদের যেন অর্ঘ্য নেবার অধিকার আছে। অথচ তার বিদ্যার অভিমানের অন্ত ছিল না। একবার একটি কলেজে বাংলা অধ্যাপকের পদ খালি ছিল। সুরীতির অনুরোধে নীহারকে সে পদে গ্রহণ করবার প্রস্তাবে অনুকূল আলোচনা চলছিল। তাতে নীহারের নাম নিয়ে কমিটিতে এই আলোচনায় তার অহংকারে ঘা লাগল।

সুরীতি নীহারকে বললে, “এ তোমার অন্যায় অভিমান। স্বয়ং ভাইসরয় নিযুক্ত করবার সময়েও কাউন্সিলের মেম্বারদের মধ্যে তা নিয়ে কথাবার্তা চলে।”

নীহার বললে, “তা হতে পারে, কিন্তু আমাকে যেখানে গ্রহণ করবে সেখানে বিনা তর্কেই গ্রহণ করবে। এ না হলে আমার মান বাঁচবে না। আমি বাংলা ভাষায় এম. এ তে সর্ব-প্রথম পদবী পেয়েছি। আমি অমন করে কমিটি থেকে ঝাঁট দিয়ে নেওয়া পদ নিতে পারব না।”

এ পদ যদি নিত তা হলে সুরীতির কাছ থেকে অর্থসাহায্যের প্রয়োজন চলে যেত নীহারের। পদকে সে অগ্রাহ্য করলে, কিন্তু এই প্রয়োজনকে না। সুরীতির জলখাবার প্রায় বন্ধ হয়ে গেল। বাড়ির লোকে ওর ব্যবহারে এবং চেহারায় অত্যন্ত উদ্‌বিগ্ন হয়ে উঠল।

ছেলেবেলা থেকেই ওর শরীর ভালো নয়, তার উপরে এই কষ্ট করা—এ তপস্যা কার জন্য সে কথা যখন তারা ধরতে পারলে তখন তারা নীহারকে গিয়ে বললে, “হয় তুমি একে বিবাহ করো, নয় এর সঙ্গ ত্যাগ করো।”

নীহার বললে, “বিবাহ করা তো চলবেই না—আর ত্যাগের কথা আমাকে বলছেন কেন, সঙ্গ ইচ্ছে করলেই তো তিনি ত্যাগ করতে পারেন, আমার তাতে কিছুমাত্র আপত্তি নেই।”

সুরীতি সে কথা জানত। সে জানত নীহারের কাছে তার কোনো মূল্যই নেই, নিজের সুবিধাটুকু ছাড়া। সেই সুবিধাটুকু বন্ধ হলে তাকে অনায়াসে পথের কুকুরের মতো খেদিয়ে দিতে পারে। এ জেনেও যত রকমে পারে সুবিধে দিয়ে, বই কিনে দিয়ে, নতুন খদ্দরের থান তাকে উপহার দিয়ে, যেমন করে পারে তাকে এই সুবিধার স্বার্থবন্ধনে বেঁধে রাখলে। অন্য গতি ছিল না ব’লে এই অসম্মান সুরীতি স্বীকার করে নিলে।

এক সময়ে মফস্বলে বেশি মাইনের প্রিন্সিপালের পদ পেয়েছিল। তখন তার কেবল এই মনের ভিতরে বাজত, ‘আমি তো খুব আরামে আছি, কিন্তু তিনি তো ওখানে গরিবের মতো পড়ে থাকেন—এ আমি সহ্য করব কী করে’। অবশেষে একদিন বিনা কারণে কাজ ছেড়ে দিয়ে কলকাতায় অল্প বেতনে এক শিক্ষয়িত্রীর পদ নিলে। সেই বেতনের বারো-আনা যেত নীহাররঞ্জনের পেট ভরাতে, তার শখের জিনিস কিনে দিতে। এই ক্ষতিতেই ছিল তার আনন্দ। সে জানত মন ভোলাবার কোনো বিদ্যে তার জানাই ছিল না। এই কারণেই তার ত্যাগ এমন অপরিমিত হয়ে উঠল। এই ত্যাগেই সে অন্য মেয়েদের ছাড়িয়ে যেতে চাইছিল। তা ছাড়া আজকাল উল‍্‍টো প্রগতির কথা সে ক্রমাগত শুনে আসছে যে, মেয়েরা পুরুষের জন্য ত্যাগ করবে আপনাকে এইটাই হচ্ছে বিধাতার বিধান। পুরুষের জন্য যে মেয়ে আপনাকে না উৎসর্গ করে সে মেয়েই নয়। এই-সমস্ত মত তাকে পেয়ে বসল।

কলকাতায় যে বাসা সে ভাড়া করল খুব অল্প ভাড়ায়—স্যাঁৎসেতে, রোগের আড্ডা। তার ছাদে বের হবার জো নেই, কলতলায় কেবলই জল গড়িয়ে পড়ছে। তার উপরে যা কখনো জীবনে করে নি তাই করতে হল—নিজের হাতে রান্না করতে আরম্ভ করল। অনেক বিদ্যে তার জানা ছিল, কিন্তু রান্নার বিদ্যে সে কখনো শেখে নি। যে অখ্যাদ্য অপথ্য তৈরি হত, তা দিয়ে জোর করে পেট ভরাত। কিন্তু স্বাস্থ্য একেবারে ভেঙে পড়ল। মাঝে মাঝে কাজ কামাই করতে বাধ্য হল ডাক্তারের সার্টিফিকেট নিয়ে। এত ঘন ঘন ফাঁক পড়ত কাজে যে অধ্যক্ষরা তাকে আর ছুটি মঞ্জুর করতে পারলেন না। তখন ধরা পড়ল ভিতরে ভিতরে তাকে ক্ষয়রোগে ধরেছে। বাসা থেকে তাকে সরানো দরকার, আত্মীয়-স্বজনরা মিলে তাঁকে একটা প্রাইভেট হাসপাতালে ভরতি করে দিলে। কেউ জানত না কিছু টাকা তার গোপনে সঞ্চিত ছিল, সেই টাকা থেকেই তার বরাদ্দ-মতন দেয় নীহারের কাছে গিয়ে পৌঁছত। নীহার সব অবস্থাই জানত, তবু তার প্রাপ্য ব’লে এই টাকা সে অনায়াসে হাত পেতে নিতে লাগল। অথচ একদিন হাসপাতালে সুরীতিকে দেখতে যাবার অবকাশ সে পেত না। সুরীতি উৎসুক হয়ে থাকত জানলার দিকে কান পেতে, কিন্তু কোনো পরিচিত পায়ের ধ্বনি কোনোদিন কানে এল না। অবশেষে একদিন তার টাকার থলি নিঃশেষে শেষ হয়ে গেল আর সেই সঙ্গে তার চরম আত্মনিবেদন।

গল্পের প্রথম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন

"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

দুঃখিত!