সকালে আড্ডা দিতে নীচে প্রমথর অ্যাপার্টমেণ্টে যেতেই একেনবাবু একগাল হেসে বললেন, “ভালোই হল স্যার, আপনি এসেছেcন। মিস্টার রাজ সিং একটু আগে ফোন করেছিলেন, উনিও আসছেন।”
“রাজ সিং, মানে দ্য গ্রেট ডিটেকঠিভ রাজ সিং?” আমি একটু ঠাট্টা করেই প্রশ্নটা করলাম।”
“হ্যাঁ স্যার। ওঁর হাতে নাকি একটা কমপ্লিকেটেড কেস এসেছে। আমাদের কাছে একটু পরমর্শ চান।”
‘আমাদের’ কথাটা অবশ্য একেনবাবু ব্যবহার করলেন সম্মনার্থে বহুবচন হিসেবে। কারণ, আমি এবং প্রমথ একেনবাবু অ্যাসেট না লায়েবিলিটি, সে সম্পর্কে আমি এখনও খুব একটা শিওর নই! যাই হোক, এই ফাঁকে রাজ সিং সম্পর্কে একটু বলে নিই। উনি হলেন ম্যানহ্যাটানের সবেধন নীলমণি ভারতীয় প্রাইভেট ইনভেস্টিগেটর। সবেধন নীলমণি বলছি এইজন্য যে, যদিও একেনবাবু পেশায় একজন ডিটেকটিভ, এঁবং আপাতত প্রমথর সঙ্গে ম্যানহ্যাটানেই থাকেন, কিন্তু উনি কলকাতায় পুলিশের লোক। ছুটি নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এসেছেন ক্রিমিনোলজি নিয়ে রিসার্চ করতে। নিউ ইয়র্ক পুলিশ মাঝে মধ্যে ওঁর সাহায্য নিলেও, ডিটেকটিভ এজেন্সি চালাবার লাইসেন্স ওঁর নেই। ম্যানহ্যাটানে লাইসেন্সধারী ডিটেকঠিভ বলতে একমাত্র রাজ সিং-ই।
পেশা এক হলেও, চেহারা ও হাবেভাবে রাজ সিং হচ্ছেন একেনবাবুর কনট্রাস্ট। একেনবাবু হলেন পাতলা টিংটিং-এ, বেঁটে দি গ্রেট। শুধু চেহারা নয়, ওঁর কথাবার্তা, পোশাক পরিচ্ছদ সব কিছুই অত্যন্ত আন-ইম্প্রেসিভ! আর রাজ সিং স্যুট-বুট পরা ছ’ফুট লম্বা, চওড়া কাঁধ, ফুরফুরে চুল – চোখে কালো চশমা । দেখলেই মনে হয়, হ্যাঁ, এ না হলে আর নিউ ইয়র্কের গোয়েন্দা! তবে এই রাজ সিং-এর আবার একেনবাবুর ওপর অগাধ ভক্তি! গোলমেলে কোনও সমস্যা এলেই উপদেশ নিতে ছুটে আসেন। আমি আর প্রমথ মাঝ মাঝে একেনবাবুকে বোঝাবার চেষ্টা করি, অ্যাডভাইস শুড নট বি ফ্রি, ফেলো কড়ি মাখো তেল! কিন্তু কে কাকে বোঝায়! খুব চাপাচাপি করলে একেনবাবু বলেন, “কী করি স্যার, ইণ্ডিয়ান ব্রাদার যে!”
আসলে রাজ সিংয়ের চেহারা আর বোলচালই সব। বাইরের গ্ল্যামারটা কেটে যেতেই ধরা পড়ে যে, হি ইজ নট ওভার-বার্ডনড উইথ ব্রেন – মস্তিষ্কে ঘিলুটা একটু কমই আছে। তবে করে তো খাচ্ছে! আর বোকাসোকা বলেই আমার ধারণা, একেনবাবু ওঁকে খানিকটা স্নেহ করেন।
রাজ সিংয়ের অফিস যদিও ম্যানহ্যাটনে, উনি থাকেন নিউ ইয়র্কের পূর্ব প্রান্তে, লং আইল্যাণ্ডে। তাই এলেন প্রায় এক ঘন্টা বাদে। মুখ দেখে বুঝলাম ভারি চিন্তিত। সঙ্গে একটা ভিডিও টেপ এনেছিলেন। সেটা টেবিলের ওপর রেখে ঘোষণা করলেন, “লাইফ ইজ টাফ!”
প্রমথ যথারীতি ইয়ার্কি করল। বলল, “কী সিংজি, মনে হচ্ছে আপনি একটা গ্রেট ভিডিও মিস্ট্রি নিয়ে হিমশিম খাচ্ছেন?”
রাজ সিং প্রাইভেট ই্নভেস্টিগেটর হলেও বড় কোনও ব্যাপারে ওঁর ডাকে পড়ে না। নর্মালি উনি যে সব কেস পান, সেগুলো নিতান্তই সাদামাঠা। যেমন, কাউকে ফলো করে – সে কী করছে না করছে তার রিপোর্ট দেওয়া, ডিভোর্স কেসে স্বামী বা স্ত্রীর কোনও পরকীয়া ব্যাপার আছে কিনা খোঁজখবর নেওয়া, ইন্সিওরেন্সের দাবিদাওয়া নিযে তদন্ত করা, এইসব। প্রমথর ‘গ্রেট ভিডিও মিস্ট্রি’ কথাটার মধ্যে যে একটা খোঁচা ছিল, সেটা বলাই বাহুল্য। রাজ সিং কিন্তু কথাটা গায়ে মাখলেন না। একেনবাবুকে বললেন, “মিস্টার সেন, আই অ্যাম ইন ট্র্যাবল, মাই রেপুটেশন ইজ অ্যাট স্টেক।”
প্রমথ ফিসফিসিয়ে বাংলায় আমাকে বলল, “শুনছিস, রেপুটেশন ইজ অ্যাট স্টেক! করিস তো দারোয়ানগিরি!”
“চুপ কর, ছোটলোক!” আমি চাপা স্বরে প্রমথকে ধমক লাগালাম।
একেনবাবু এদিকে অমায়িকভাবে বললেন, “কী যে বলেন স্যার, কে আপনার রেপুটেশন কেড়ে নেবে।”
“না, মিস্টার সেন। ব্যাপারটা খুবই সিরিয়াস। আই গট দ্য বিগেস্ট ব্রেক অব মাই কেরিযার অ্যাণ্ড আই অ্যাম সিমপ্লি রুইনিং ইট! সিটি সেণ্ট্রা্ল ব্যাঙ্ক আমাকে বিরাট একটা ক্রাইম সলভ করতে ডেকেছে। ইট ইজ এ টু-উইক কনট্রাক্ট – আউট অব উইচ ওয়ান উইক ইজ অলরেডি গন, অ্যাণ্ড আই অ্যাম নো হোয়ের নিয়ার দ্য সলিউশন। দ্য ওয়ার্স্ট অব অল, প্রত্যেকদিন আমার চোখের সামনে দ্য ক্রাইম ইজ গেটিং কমিটেড।”
“দাঁড়ান স্যার, দাঁড়ান। আগে এককাপ চা খান।” টি পট থেকে চা ঢালতে ঢালতে একেনবাবু বললেন, “তারপর একটু গুছিয়ে সহজ করে ব্যাপারটা বলুন।”
রাজ সিংয়ের কাছ থেকে যেটা উদ্ধার করা গেল, সেটা হচ্ছে –
গত সপ্তাহে রাজ সিং হঠাৎ একটা ফোন কল পান সিটি সেণ্ট্রাল ব্যাঙ্কের ফর্টি সেকেণ্ড স্ট্রিট ব্র্যাঞ্চের ভাইস প্রেসিডেন্ট মিস্টার ক্লিফোর্ড জনসনের কাছ থেকে। মিস্টার জনসন ওঁকে বলেন যে, উনি সন্দেহ করছেন ওঁর অফিসের এক টেলার কোনও একটা লোকাল ক্রাইম গ্রুপের সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েছে। আর এ-ব্যাপারে উনি রাজ সিংয়ের সাহায্য চান। মিস্টার জনসন এর বেশি ফোনে কিছু বলতে চাননি। ঠিক হয় যে, পরদিন ন’টার সময় রাজ সিং, মিস্টার জনসনের অফিসে গিয়ে দেখা করবেন।
পরদিন ন’টায় যখন রাজ সিং জনসনের অফিসে গিয়ে পৌঁছোন, তখন দেখেন মিস্টার জনসন ছাড়াও ব্যাঙ্কের সিকিউরিটির হেড জ্যাক সাইপ্রাস ওঁর জন্য অপেক্ষা করছেন। অফিসের দরজাটা বন্ধ করে মিস্টার জনসন বললেন, “ব্যাপারটা একটু সেন্সিটিভ। তাই ফোনে আপনাকে বিশেষ কিছু বলতে চাইনি। জ্যাক এটা নিয়ে প্রায় এক মাস হল ইনভেস্টিগেট করছে। কিন্তু ওর ওপর সিটি সেণ্ট্রালের সবকটা ব্রাঞ্চের সিকিউরিটির দায়িত্ব। ওর পক্ষে ফুল টাইম এসে দেওয়া সম্ভব নয়। ফর দিস রিজন, আই ওয়াণ্ট ইউ টু কমপ্লিট দ্য ইনভেস্টিগেশন।”
রাজ সিং জিজ্ঞেস করলেন, “প্রবলেমটা কি?”