পুঁই মাচা-৬ষ্ঠ অংশ–বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় এর গল্প

অন্নপূর্ণ বড় গামলাটা হইতে একটুখানি গোলা তুলিয়া লইয়া হাতের আঙুল পাঁচটি দ্বারা একটি বিশেষ মুদ্রা রচনা করিয়া সেটুকু রাধার প্রসারিত হাতের উপর দিলেন। মেজোমেয়ে পুটি অমনি ডান হাতখানা কাপড়ে তাড়াতাড়ি মুছিয়া লইয়া, মার সামনে পাতিয়া বলিল-মা, আমায় একটু.
ক্ষেত্তি শুচিবক্সে নারিকেল কুরিতে কুরিতে লুন্ধনেত্রে মধ্যে মধ্যে এদিকে চাহিতেছিল, এ-সময় খাইতে চাওয়ায় মা পাছে বকে, সেই ভয়ে চুপ করিয়া রহিল।
অন্নপূর্ণ বলিলেন-দেখি, নিয়ে আয় ক্ষেত্তি ঐ নারকেল মালাটা, ওতে তোর জন্যে একটু রাখি …ক্ষেত্তি ক্ষিপ্ত হস্তে নারিকেলের উপরের মালাখানা, যাহাতে ফুটা নাই, সেখানা সরাইয়া দিল, অন্নপূর্ণ তাহতে একটু বেশি করিয়া গোলা ঢালিয়া দিলেন।
মেজোমেয়ে পুঁটি বলিল—জেঠাইমারা অনেকখানি দুধ নিয়েছে, রাঙাদিদি ক্ষীর তৈরি করছিল, ওদের অনেক রকম হবে।
ক্ষেত্তি মুখ তুলিয়া বলিল-এ-বেলা আবার হবে নাকি? ওরা তো ও-বেলা ব্ৰাহ্মণ নেমতন্ন করেছিল সুৱেশ কাকাকে আর ও-পাড়ার তিনুর বাবাকে । ওবেলা তো পায়েশ, ঝোল-পুলি, মুগতক্তি এইসব হয়েছে।
পুঁটি জিজ্ঞাসা করিল-হ্যামা, ক্ষীর নইলে নাকি পাটিসাপটা হয় না? বেদি বলছিল, ক্ষীরের পূর না হলে কি আর পাটিসাপটা হয়? আমি বললাম, কেন আমার মা তো শুধু নারকেলের ছাই দিয়ে করে, সে তো কেমন লাগে!
অন্নপূর্ণ বেগুনের বোটায় একটুখানি তেল লইয়া খোলায় মাখাইতে মাখাইতে প্রশ্নের সদুত্তর খুঁজিতে লাগিলেন।
ক্ষেত্তি বলিল-খেদির ওইসব কথা! খেদির মা তো ভারি পিঠে করে কিনা? ক্ষীরের পূৱ দিয়ে ঘিয়ে ভাজলেই কি আর পিঠে হল সেদিন জামাই এলে ওদের বাড়ি দেখতে গেলুম কিনা, তাই খুড়ীমা দুখানা পাটিসাপটা খেতে দিলে। ওমা কেমন একটা ধরা-ধরা গন্ধ। আর মা’র পিঠেতে কখনো কোনো গন্ধ পাওয়া যায়। পাটিসাপটায় ক্ষীর দিলে ছাই খেতে হয়।
বেপরোয়াভাবে উপরোক্ত উক্তি শেষ করিয়া ক্ষেন্তি মা’র চোখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিল-মা, নারকেল-কোৱা একটু নেৰ?
অন্নপূর্ণ বলিলেন-নে, কিন্তু এখানে বসে খাসনে। মুখ থেকে পড়বে না কী হবে, যা ঐদিকে যা।
ক্ষেস্তি নারিকেলের মাথায় একথাবা কোরা তুলিয়া লইয়া একটু দুরে গিয়া খাইতে লাগিল। মুখ যদি মনের দর্পণস্বরূপ হয়, তবে ক্ষেত্তির মুখ দেখিয়া সন্দেহের কোনো কারণ থাকিতে পারিত না যে, সে অত্যন্ত মানসিক তৃপ্তি অনুভব করিতেছে।
ঘণ্টাখানেক পরে অন্নপূর্ণ বলিলেন–ওৱে, তোরা সব এক-এক টুকরো পাতা পেতে বোস তো দেখি। গরম গরম দিই। ক্ষেত্তি, জল দেওয়া ভাত আছে ও-বেলার, বার করে নিয়ে আয়।
ক্ষেত্তির নিকট অন্নপূর্ণার এ-প্রস্তাব-যে খুব মনঃপূত হইল না, তা তার মুখ দেখিয়া বোঝা গেল। পুঁটি বলিল-মা, বড়দি পিঠেই থাক। ভালোবাসে। ভাত বরং থাকুক, আমরা কাল সকালে খাব।
খানকয়েক খাইবার পরেই ছোটমেয়ে রাধা আর খাইতে চাহিল না। সে নাকি অধিক মিষ্টি খাইতে পারে না। সকলের খাওয়া শেষ হইয়া গেলেও ক্ষেত্তি তখনও থাইতেছে! সে মুখ বুজিয়া শান্তভাবে খায়, বড় একটা কথা কহে না। অন্নপূর্ণ দেখিলেন, সে কম করিয়াও আঠারো-উনিশখানা খাইয়াছে। জিজ্ঞাসা করিলেন-ক্ষেত্তি আর নিবি?…ক্ষেত্তি খাইতে খাইতে শান্তভাবে সম্মতিসূচক ঘাড় নাড়িল। অন্নপূর্ণ তাহাকে আরও খানকয়েক দিলেন। ক্ষেত্তির মুখচোখ ঈষৎ উজ্জ্বল দেখাইল, হাসিভরা চোখে মা’র দিকে চাহিয়া বলিল—বেশ খেতে হয়েছে, মা। ঐ যে তুমি কেমন ফেনিয়ে নেও, ওতেই কিন্তু…সে পুনরায় খাইতে লাগিল ।

অন্নপূর্ণ হাতা, যুক্তি, চুলী তুলিতে তুলিতে সস্নেহে তার একটু শান্ত নিরীহ একটু অধিক মাত্রায় ভোজনপটু মেয়েটির দিকে চাহিয়া রহিলেন। মনে-মনে ভাবিলেন-ক্ষেত্তি আমার যার ঘরে যাবে, তাদের অনেক সুখ দেবে। এমন ভালোমানুষ, কাজকর্মে বকো, মারো, গাল দাও, টু-শব্দটি মুখে নেই, উচু কথা কখনো কেউ শোনেনি…
বৈশাখ মাসের প্রথমে সহায়হরির এক দূর-সম্পৰ্কীয় আত্মীয় ঘটকালিতে ক্ষেত্তির বিবাহ হইয়া গেল। দ্বিতীয়পক্ষে বিবাহ করিলেও পাত্রটির বয়স চল্লিশের খুব বেশি কোনোমতেই হইবে না। তবুও প্রথম এখানে অন্নপূর্ণ আদৌ ইচ্ছুক ছিলেন না। কিন্তু পাত্রটি সঙ্গতিপন্ন, শহর অঞ্চলে বাড়ি, সিলেট চুন ও ইটের ব্যবসায়ে দু-পয়সা নাকি করিয়াছে—এরকম পাত্র হঠাৎ মেলাও বড় দুরগতনা কিনা।
জামাইএর বয়স আক্তু বেশি, প্রথমে অন্নপুরনা একটু সংকোচ বোধ করিতেছিলেন, পরে পাছে ক্ষেত্তির মনে কষ্ট হয়, এইজন্য দিলেন-চোখের জলে তাহার গলা বন্ধ হইয়া আসিল, কিন্তু বলিতে পারিলেন না।

পুঁইমাচা সপ্তম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।

সম্পর্কিত পোস্ট

দুঃখিত!