গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
নারিয়া হাসল আবার। পাইনের পাতার মতো ওর হাসি। বলল, সে আমার সঙ্গে আসেনি। আমার জন্যও আসেনি। পাহাড়ের গাছপালা নিয়ে পড়াশোনা করতে হিমালয়ে বেরিয়েছে। আপাতত তাই তোমাদের এখানে এসে থাকছে।
আর গান? মনাস্ট্রির পাশের ছোট ঘরে তোমার সামনে বসে যে গান শুনতে দেখি ওকে! অন্য সময়ও দেখেছি।
নারিয়া উঠে পড়ে। বলে, তোমাদের মতো সে-ও হয়তো গান ভালোবাসে। আর কিছু না।
তবু ব্যাপারটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য হয় না সবার। বারমিকের সবাই এটা জেনে ফেলে তবু মন থেকে মানতে চায় না। নারিয়ার কাছাকাছি থাকা মেয়েটি নারিয়ার আসলে কেউ নয়! কোনো সম্পর্ক নেই দুজনের। কিন্তু এই কটা দিন পাশাপাশি থেকেও তো সম্পর্ক তৈরি হতে পারত। পাহাড়ের ঢালের অনেকে যে-সম্পর্কটা ভেবে নিয়েছিল তা আসলে কিছু নয় শেষ পর্যন্ত?
নারিয়া বলল, ওর বর আছে। সে কোথাও একটা কলেজে পড়ায়। ফুল আর পাহাড়ি গাছপালা নিয়ে কাজটা শেষ হলে ও বরের কাছে চলে যাবে।
এরপর আর কথা চলে না কোনো। নারিয়াকে আর কিছু বলে বা বুঝিয়ে কোনো লাভ নেই। সিজো লেপচা উঠে ঘরের দিকে যায়। উমাশংকরের দোকানের পাশে জুলে বসে থাকে অনেকক্ষণ। নিচে ইশ্কুল ছুটির পর পাহাড় বেয়ে উঠে আসা বাচ্চাদের হল্লা শোনা যায়।
তারপর সত্যিই একটা সকালে রওনা হয়ে যায় নারিয়া। ওর যাওয়াটা একই রকম। যেভাবে এসেছিল সেভাবে। আগেভাগে তেমন কিছু জানানো নয়, সকালে উঠে ম্যান্ডোলিন কাঁধে বেরিয়ে চলে যাওয়া। উমাশংকরের দোকানের কাছে এসে চা খেল একবার। তারপর হাঁটতে শুরু করে দিলো।
উমাশংকরের বউ জিজ্ঞাসা করেছিল, আর আসবে না নাকি?
নারিয়ার সেই হাসি। মন চাইলে আবার কখনো আসব। তবে মন কবে চাইবে তার তো কোনো ঠিক নেই। পথের যে-দিকটা রংপোর দিকে চলে গেছে সেদিক বরাবর হাঁটতে থাকল ও। অনেকদূর পর্যন্ত ওকে দেখা যাচ্ছিল। একটা লোক, রোগাটে লম্বা, কাঁধে ম্যান্ডোলিন, হাঁটতে-হাঁটতে যেন পাহাড়ের সবুজের সঙ্গেই মিলে গেল।
পাহাড়ের গায়ে ছোট গ্রামটা চুপ হয়ে থাকল সারাটা দিন।
রাম্মিত আর বাচ্চাদের বন্ধু রয়ে গেল মনাস্ট্রিতে। বিকেলে সামান্য একটু কাজ করল সে লাগোয়া বাগানে গাছের কাছে গিয়ে। মনাস্ট্রির ঘণ্টায় সন্ধে নামল।
দিনসাতেক পর একটা সাফারি গোছের গাড়ি এলো বারমিকে। উমাশংকরের দোকানের কাছে নামল দুজন। কীসব জানতে চাইল। তারপর গাড়ি নিয়ে দাঁড় করাল মনাস্ট্রির বাগানের গায়ে।
মনাস্ট্রির বুড়ি পরে বলেছিল, মেয়েটির সঙ্গে লোক দুজনের কথা হয়েছিল নানারকম। ভাষা আলাদা। বুড়ি এক বর্ণও বোঝেনি। তবে বেশ উঁচু গলায় কথা বলছিল তাদের মধ্যে একজন। যেন মেয়েটিকে শাসাচ্ছিল। মেয়েটি কিছুই প্রায় বলেনি। ওরা যেন জোর খাটাতে এসেছিল মেয়েটিকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। সেভাবেই কথা বলছিল। মেয়েটি যায়নি।
বারমিক এসব শুনল। কেউ কিছু বলল না।
তারপর হয়ে গেল অনেক দিন। অনেক বছর। পাহাড়ের গায়ে ছোট গ্রাম আগের মতোই রয়ে গেছে। বছরে প্রায় তিন-চারমাস সেখানে অবিশ্রান্ত বৃষ্টি হয়। গাছপালা আর পাহাড়ের ঢালেচরে-বেড়ানো গরুরা ভিজতে থাকে তখন। নেমে আসা ঝরনার শব্দ অনেকখানি বেড়ে যায়। বাচ্চাদের ইশ্কুল বন্ধ রাখা হয়।
আবার শীতের সময় কাঁপ-ধরানো বাতাস বইতে থাকে সারাদিন। পাইনের পাতা কেঁপে যায়। আকাশ নীল হয়ে থাকে। বরফের পাহাড় ডাকতে থাকে দূর থেকে। শীত কমলে গ্রামের আশপাশের জঙ্গল আর মোটা বাঁশগাছেরা পাতা ঝরাতে শুরু করে।
বারমিকে গেলে এখনো তার দেখা মেলে। এখন অনেকটাই বয়স হয়ে গেছে। চেহারা সামান্য ভারি। এদিকের লোকজনের মতো জড়ানো পোশাক পরে থাকে সে। স্থানীয় ভাষায় কথা বলে। রাম্মিত বিয়ে করে চলে গেছে সিংথামের দিকে। আগের বাচ্চারাও বড় হয়ে ছড়িয়ে গেছে নানা জায়গায়। তবু নতুন দিনের বাচ্চাদের সঙ্গে ভাব রয়েছে তার। সে মাঝে মাঝে বাচ্চাদের ইশ্কুলে যায়। গ্রামে ঘুরে খবর নেয় সবার। বুড়োবুড়িদের সঙ্গেও সে গল্প করে সময় কাটায়। বিকেল শেষ হলে ঢুকে যায় আবছা আলোর মনাস্ট্রি-লাগোয়া ছোট ঘরটুকুতে।
তার কাছে জানতে চাইলে বলে, পাহাড়ের এই ছোট গ্রামটি ছেড়ে পৃথিবীর আর কোথাও সে যাবে না।
গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।