প্রাচীনকালে একটি নদীর দুইধারে দুই দেশ ছিল। অনাদি কাল থেকে দুই দেশের রাজার মধ্যে বন্ধুত্ব থাকায় উভয় দেশের প্রজাদের মধ্যেও ভাল সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল। দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা বাণিজ্য চলত। এক দেশ বিপদ-আপদের সম্মুখীন হলে অন্য দেশ সাহায্যের জন্যে এগিয়ে আসতো। উভয় দেশের যাতায়াতের সুবিধার জন্য নদীর উপর একটি সাঁকো ছিল। এইভাবে চলছিল বহুকাল ধরে। তারপর কোন এক কারনে উভয় দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের ফাটল ধরে। উভয় দেশের সম্পর্ক খারাপ হয়ে যায়। দুই দেশের মধ্যে যুদ্ধ না বাধলেও যার দিকে সাঁকোর যে অংশ ছিল সে তা ভেঙে ফেলল। ফলে সাঁকোর উপর দিয়ে যানবাহনের যাতায়াত বন্ধ হয়ে গেল। তবে নৌকা করে লোকের যাতায়াত তখনো বজায় ছিল।
যাতায়াতের পথ ভেঙে ফেলায় সেই সুন্দর সাঁকোর দিকে তাকিয়ে বহু প্রজা দীর্ঘনিশ্বাস ফেলত। এর আরও কিছুকাল পরে দুই দেশের রাজারা মারা গেল। তাদের ছেলেরা হল রাজা। নদীর বাঁ দিকে ছিল রাজা শান্তিসেন আর ডানদিকে ছিল রাজা সুরসেন। দুজনেই বিবেকবান এবং বুদ্ধিমান। ওদের আমলে প্রজারা মোটামুটি সুখেই কাটিয়েছিল। গুপ্তচরদের মাধ্যমে সুরসেন একটি বিষয় জানতে পারল সেটি হল তার প্রজাদের মধ্যে কয়েকজন মনে মনে শান্তিসেনকে পছন্দ করে। এমন কি নিজেদের মধ্যে তাকে প্র্রশংসাও করে। শান্তিসেন নাকি মস্তবড় দাতা। সুরসেন ভাবল, আমিও দানধর্ম করি। আমার কথা কি একইভাবে শান্তিসেনের দেশের লোক বলাবলি করে? এ ধরনের নানা কথা ভেবে সে আরও বেশি করে দানধর্ম করতে লাগল।
হঠাৎ সুরসেন বেশি করে দানধর্ম করায় তার সুনাম হওয়ার পরিবর্তে দুর্নাম হল। লোকে বলাবলি করল, “সুরসেন রাতারাতি বেশি করে দান করে শান্তিসেনকে খাটো করা চেষ্টা করছে। এইভাবে কাউকে ছোট করা যায়না।” গুপ্তচরদের মাধ্যমে এই কথা কানে যেতেই সুরসেন ভীষণ রেগে গেল। শান্তিসেনের উপর তার এত ঈর্ষা হল যে রাত্রে তার ভাল ঘুম হত না। শেষে সুরসেন ঠিক করলেন, ছদ্মবেশে শান্তিসেনের রাজ্যে গিয়ে শান্তিসেন কী করে তা নিজের চোখে দেখবেন। তারপর সুরসেন মন্ত্রীদের উপর কাজকর্মের ভার দিয়ে সাধারন পোশাকে নৌকা পেরিয়ে শন্তিসেনের দেশে ঢুকল। একটা ধর্মশালায় থেকে কান খাড়া করে সুরসেন শান্তিসেনের প্রজাদের কথা শুনতে লাগল। শুধু আশ্রমে নয়, ঘুরে বেড়িয়েও সে প্রজাদের কথা শুনতে লাগল।
প্রবাদ আছে, দূরের পাহাড় মসৃণ। কিন্তু দেখা গেল শান্তিসেনের বেলায সেটা খাটে না।তার প্রজারাও তাকে সত্যি সত্যি ভালবাসে। ঘুরতে ঘুরতে, অনেক খুঁজেও সুরসেন এমন একজনকেও পেল না যে তার প্রশংসা করে। এইভাবে অনেকদিন ঘরে সুরসেনের ইচ্ছে করল নিজে গিয়ে শান্তিসেনকে পরীক্ষা করার। সে গেল শান্তিসেনের রাজপ্রাসাদে। যে-সময় রাজা সুরসেন গেল, সেই সময় রাজা সিংহাসনে বসে ছিল। তবে কোন একজন প্রজা দেখা করতে এসেছে শুনেই শান্তিসেন তার সঙ্গে দেখা করতে সাগ্রহ এগিয়ে এল। সুরসেন লক্ষ্য করল, শান্তিসেনের গায়ে সাধারন পোশাক। তার আচার আচরণও অতি সাধারন। এসেই বলল, ‘বলুন, কিভাবে আপনাকে সাহায্য করতে পারি?’ সুরসেন বলল, ‘মহারাজ আমিও রাজবংশজাত। আমিও একসময় একটি দেশের রাজা ছিলাম।
বিশেষ কারনে আমি আমার সিংহাসন হারিয়েছি। শুনেছি আপনি নাকি মস্তবড় দানশীল। তা আপনি কি আপনার রাজত্বের অরে্কটা আমাকে দান করবেন?’ শান্তিসেন হেসে বলল, “আপনি যে মহারাজা সুরসেন তা আমি জানি।’ যে প্রহরীরা ছিল তারা তরবারি বের বরল। কারন তাদের চোখে এই সুরসেন হল শত্রু রাজা। তৎক্ষণাৎ শান্তিসেন ওদের তরবারি নামাতে বলে সুরসেনকে বললেন, “সুরসেন, আপনার একটি দেশ আছে। সিংহাসনও আছে। তবে তাতে আপনার চাহিদা মিটল না। তাই আপনি আমার গোটা রাজত্বই নিয়ে নিন। আমি সানন্দে দিয়ে দেব। আমি সাধারন মানুষের মত সাধারন ভাবেই বেঁচে থাকতে চাই।” রাজা শান্তিসেনের এই উদারতায় ও সরলতায় রাজা সুরসেন মুগ্ধ হল। শান্তিসেন যে শুধুু নামেই নয়, কাজেও শান্তিকামী সুরসেনের যে-কথায় আর কোন সন্দেহ রইল না।
তাই–সঙ্গে সঙ্গে সুরসেন শান্তিসেনের কাছে ক্ষমা চয়ে বলল, “আমাদের দুই দেশের মধ্যে যে সাঁকোটা ভেঙে গেছে সেটা সারিয়ে তোলাই এখন আমাদের প্রথম এবং প্রধান কাজ।” বেতাল এই কাহিনী শুনিয়ে বলল, “রাজা শান্তিসেন কত বড় দানবীর যে অর্ধেক রাজত্ব চাইলে পুরাটাই দিতে চেয়েছিল? দিতে যখন চেয়েছিল সুরসেন নিয়ে নিতেই তো পারত। রাজত্ব নিয়ে শান্তিসেনকে যাতে সবাই ভুলে যায় তার ব্যবস্থা করতে পারত। তা না করে সে ক্ষমা চাইল কে? আমার এই প্রশ্নের জবাব জানা সত্ত্বের যদি তুমি না দাও তাহলে তোমার মাথা ফেটে একেবারে চৌচির হয়ে যাবে।” জবাবে রাজা বিক্রমাদিত্য বললেন, “সুরসেন শান্তিসেনের অর্ধেক রাজত্ব নেওয়ার উদ্দেশ্যে আসেননি। শান্তিসেন যে কতবড় দাতা তা পরীক্ষা করাই ছিল তাঁর উদ্দেশ্য।
ঝোঁকের মাথায় শান্তিসেন যা বললেন তাতে সুরসেন দুই দেশের রাজাও হতে পারতেন। আবার হাতের মুঠোয় পেয়ে সুরসেনকে মেরে ফেলে শান্তিসেনও উভয় দেশের রাজা হতে পারতেন। এই ঘটনার ফলে পরস্পর পরস্পরকে গভীরভাবে চিনতে পারলেন। তাই উভয় দেশের মধ্যে সাঁকো আবার তৈরী করার উদ্যোগ দেখা দিল। এইভাবে রাজা বিক্রমাদিত্য মুখ খোলার সঙ্গে সঙ্গে বেতাল শব নিয়ে ফিরে গেল সেই গাছে।