নীল নদে ভাসমান মূসা (আঃ)
অদৃশ্য হতে নির্দেশ পেয়ে মূসা (আঃ) এর জননী তাঁকে একটি মজবুত, কাঠের সিন্দুকে ভরে নীল নদে ভাসিয়ে দেন। এ সংকটজনক পরিস্থিতিতে মূসা (আঃ) এর মাতা সিন্দুক কোথায় পাবেন এবং নতুন করে তৈরী করতে গেলে আশংকা ছিল গোপনীয়তা প্রকাশ হয়ে পড়ার।
ফলে এ খবর ফেরআউনের লোকদের কর্ণগোচর হত এবং তারা নবজাত শিশুকে হত্যা করত- এমন একটি প্রশ্ন মনে জাগা স্বাভাবিক। মূসা (আঃ) এর মাতার সিন্দুক তৈরী সম্পর্কে কথিত আছে, মূসা (আঃ) কে সিন্দুকে পুরে নীল নদে ভাসিয়ে দেয়ার নির্দেশ পেয়ে মূসা (আঃ) এর মাতা কাঠমিস্ত্রীর খোঁজে লেগে যান।
সে মুহুর্তে হযরত জিবরাঈল (আঃ) তাঁর মায়ের সম্মুখে উপস্থিত হন। তিনি মানবরূপী জিবরাঈল (আঃ) কে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি কি ভাই কাষ্ট দিয়ে সিন্দুক বানাতে পর। তিনি সম্মতি জানালে মূসা জননী অবিলম্বে তাঁকে স্বগৃহে নিয়ে সিন্দুক তৈরির কাজে লাগিয়ে দেন। সিন্দুক তৈরী হয়ে গেলে খুব ভালভাবে তাঁকে দুধ পান করিয়ে রেশমের কাপড়ে জড়িয়ে সিন্দুকে শোয়ায়ে রেখে তালাবদ্ধ করে নীল নদে ভাসিয়ে দেন।
মূসার মা কাঠমিস্ত্রীরূপী হযরত জিবরাইল (আঃ) কে স্বগৃহে এন যে সিন্দুক তৈরি করে তাতে ভরে নবজাত শিশু পুত্রকে নীল নদে ভাসিয়ে দিয়েছেন- এ সম্পর্কে মাত্র একজন প্রতিবেশিনীর জানা ছিল। এ মহিলা ঘটনা ফাস না করতে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানান। ঘটনা প্রকাশ না করার প্রতিশ্রুতিও মহিলা দেয়।
কিন্তু তার এ গোপনীয়তা প্রকাশ করে ফেরআউন কর্তৃক পুরষ্কৃত হবার ইচ্ছা জাগে। তাই সে বিষয়টা বলার জন্য একে একে সাত বার গমন করে, কিন্তু যখনই সে ফেরআউনের সম্মুখে গিয়ে কথা বলার চেষ্টা করত তখনই বোবা হয়ে যেত, উদ্দেশ্য ব্যক্ত করতে পারত না।
সেখান থেকে ফিরে আসলে ভাল হয়ে যেত। এ অলৌকিকতা দেখে অবশেষে মহিলা মূসা (আঃ) সংক্রান্ত গোপনীয়তা প্রকাশ করার কুমনোবৃত্তি পরিহার করে খালেছ ভাবে তওবা করে এবং এক অদ্বিতীয় আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে। এবং এ গোপন রহস্যও সে আর কারো নিকট প্রকাশ করেনি। অবশেষে মূসার মাতা স্বীয় নবজাত পুত্রকে সিন্দুকে ভরে নদীতে ভাসিয়ে দেন।
স্বীয় সন্তানের অমঙ্গল চিন্তায় মূসার মাতা খুবই প্যারেশান। ওদিকে ইবলীস বসে নেই সে তার অন্তরে কুমন্ত্রণা সৃষ্টির প্রয়াসি হয়ে মূসার মাতাকে বলল, হে ইমরান পত্নি! এ তুমি কেমন বোকার ন্যায় কাজ করলে! তোমার প্রাণপ্রিয় সন্তান তোমার কোলে থাকলে ফেরআউনের লোক হত্যা করলেও তুমি আপন হস্তে সন্তানকে দাফন কাফন দিতে পারতে। তার নিষ্প্রাণ দেহ দেখে
হলেও মনকে সান্ত্বনা দিতে পারতে। এখন যা করলে, এ অবস্থায় সে যদি মারাও যায়, তবুও তো তুমি কিছুই জানতে পারবে না। তাছাড়া সামুদ্রিক কোন প্রাণী যদি তোমার শিশু পুত্রকে খেয়ে ফেলে তখন কি হবে! কি করে তুমি নিজেকে সান্ত্বনা দিবে!
মূসার মাতা ইবলীসের কুমন্ত্রণার ফলে মনে মনে এসব ভাবনাই ভেবে চলেছেন। ওদিকে মূসা (আঃ)-কে নিয়ে সিন্দুক নীল নদে ভেসে চলেছে। মূসার মাতা মেয়ে মারইয়াম বিনতে এমরানকে সাবধানে সিন্দুকের গতির প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য নির্দেশ দেন।
মারইয়াম নদীর পাড় ধরে হেঁটে যাচ্ছেন আর সিন্দুকের প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখছেন। সিন্দুকটি ফেরআউনের প্রাসাদের নিকট এসে ধীরে ধীরে পাড়ে ভিড়তে থাকে। সিন্দুকটি কূলে ভেড়ার পর নদীর ঢেউ তা উপরে উঠিয়ে দেয়। মূসার মাতা নিজের মেয়েকে সিন্দুকের গতিবিধির প্রতি সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য নিয়োগের কথা পবিত্র কোরআনে উল্লিখিত হয়েছে। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন-
অর্থঃ আর তিনি মূসার বোনকে, মূসার সন্ধান লও, অতঃপর সে মূসাকে দূর হতে দেখতে পেল, অথচ এ সম্পর্কে তারা অবহিত ছিল না।
অনেকের মতে ফেরআউন পত্নী আছিয়া বনী ইসরাঈল বংশোদ্ভূত ছিলেন। আর কেউ কেউ বলেন, বনী ইসরাঈল বংশের এবং তিনি হযরত মূসা (আঃ) -এর পিতৃব্য বোনও ছিলেন। তাই তিনি শিশু মূসা (আঃ) কে দেখে চিনে ফেলেন, এবং ফেরআউনকে বলেন, এ শিশু আমাদের চক্ষুর শীতলতার কারণ হবে এবং বড় হয়ে সে আমাদের উপকারেও আসতে পারে, অথবা আমরা তাকে পুত্ররূপে বরণ করব।
কাজেই শিশুটিকে হত্যা করবেন না। এ শিশুকে প্রতিপালনে ভবিষ্যত ফেরআউনের পরিণতি কি হবে এ সম্পর্কে তারা ছিল সম্পূর্ণ অজ্ঞ। শিশু মূসাকে হত্যা না করার জন্য ফেরআউনকে প্রভাবিত করার এক অলৌকিক ঘটনা আল্লাহ তাআলা সৃষ্টি করেছিলেন। তা হচ্ছে, ফেরআউনের প্রাসাদে কুষ্ঠা রোগাক্রান্ত একটি মেয়ে ছিল। সিন্দুক থেকে বের করার পর থেকে মূসা (আঃ) অনবরত শুধু কাঁদছিলেন। ফলে তাঁর চোখ থেকে অশ্রু মুখ থেকে কফ, থুথু ও শ্লেষ্মা বের হচ্ছিল।
এ অবস্থা দেখে মেয়েটি তাড়াতাড়ি তাকে কোলে তুলে নেয়। আল্লাহর অনুগ্রহে মূসা (আঃ) এর মুখের লালা মেয়েটের দেহে লাগার সাথে সাথে তার কুষ্ঠ রোগ আরোগ্য হয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে আছিয়া ফেরাউনকে বলল-দেখ, শিশুটি কেমন কল্যাণকর। তার মুখের থুথু লাগতেই মেয়েটির কুষ্ঠ রোগ ভাল হয়ে গেছে। এ দৃশ্য দর্শনে ফেরআউন শিশুটিকে হত্যা হতে বিরত থাকে।