নিউটন মামা ও কালো ভূত—আলী আসকর

মাত্র ১৮১ রান করতে হবে টাইগারদের। সিংহের পরাজয় দেখার জন্য একাগ্রচিত্তে তাকিয়ে আছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ১৬ কোটি মানুষ। সব টেলিভিশনের সামনে সব বয়সের মানুষ ঠাসাঠাসি করছে। উঁকিঝুঁকি মেরে দেখছে টাইগারদের ব্যাটিং। সবার নি:শ্বাস আটকে যেতে চাইছে গলার কাছাকাছি এসে। মালিঙ্গার বোলিংকে ভয় পায় সবাই। হাত ঘুরিয়ে কী যে মার মারে! নিউটন মামা দিলদার মিয়ার চায়ের দোকানের পাশে এসে দাঁড়াল। দোকানের ভিতর কোথাও এক তিল পরিমাণ জায়গা নেই। কেউ কেউ চায়ের কাপ মুখে নিয়ে বসে আছে। দিলদার মিয়ার চায়ের নামডাক আছে। চায়ের স্বাদ জিহবায় ঘন্টার পর ঘন্টা লেগে থাকে। আজকে স্বাদের কথা যেন সবাই ভুলে গেছে। দিলদার মিয়ার চোখ পড়ল মামার ওপর। ‘আরে, তুমি বাইরে দাঁড়িয়ে কেন নিউটন মিয়া? আজকে খবর আছে সিংহের। মাত্র একশ’ আশিতে আটকে গেছে সিংহরা।

অনেকদিন পর বাগে পাওয়া গেছে। একটা চা দেই ভাগিনা?’ ‘না মামা, চা খাবো না।’ ‘আরে খাও খাও, মহা খুশির দিন আজ। সিংহের তর্জন গর্জনের দিন শেষ।’ দিলদার মিয়া চায়ের কাপে চামচ ঘুরাতে থাকলেন। পিরিচ ছাড়া চায়ের কাপটা মামার দিকে বাড়িয়ে বললেন, ‘খাও ভাগিনা, টাকা পয়সার চিমত্মা করিও না। অনেকদিন পর কেশর বিহীন সিংহরা টাইগারদের কাছে মার খেতে যাচ্ছে। আজকে আমাদের ঈদের দিন। কী বলো ভাগিনা?’ ‘জি মামা।’ ‘ভিতরে এসো। তোমার জন্য জায়গা হয়ে যাবে।’ ‘আমাকে একটু বাজারে যেতে হবে মামা।’ ‘দূর মিয়া, একদিন বাজার না করলে কী হয়? আলু ভর্তা পাইন্না ডাইল করতে বলো। প্রত্যেক দিন মাছ গোশত খেতে হবে, কোন কারণ নাই।’ নিউটন মামা দোকানের ভিতরে এক কোণায় এক ফিটের এক টুকরো জায়গা পেল। গোটা এলাকায় মামার উচ্চ মাপের ইমেজ আছে। মামা ছোটকাল থেকেই ফাটাফাটি রেজাল্ট করে আসছে। এসএসসিতে বোর্ডে তিন নম্বর হয়েছিলো মামা। বিএসসি অনার্সে ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট। এমএসসিতেও একই রেজাল্ট। বিজ্ঞানের থিউরিগুলো মামার মাথায় সব সময় গিজগিজ করে। পৃথিবীর জন্মের পর থেকে কোন বিজ্ঞানী কী আবিষ্কার করেছে প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই মামা বলে দিতে পারে। মামার আসল নাম ইফতেখার আহমেদ হলেও এলাকার সবাই মামাকে নিউটন বলে ডাকে। দিলদার মিয়া মাথা গরম করে বলল, ‘টেলিভিশন বন্ধ করে দেই?’ সমস্বরে সবাই বলে উঠল, ‘না না, দেখা যাক, ঘুরে দাঁড়াতে পারে।’ ‘আউট আমি একেবারেই সহ্য করতে পারিনা। শূন্য রানে টাইগাররা যদি আউট হয় আমিও তো খেলতে পারতাম।’ দিলদার মিয়ার কথায় কেউ কেউ হেসে উঠল। টাইগারদেও নিশ্চিত পারজয় দেখে নিউটন মামা উঠে দাঁড়াল। ব্যাগটা বাম হাতে টেনে নিল। এখন আর সব বলে ছক্কা মারলেও কাজ হবে না। মামা ঘড়ি দেখল। বাজারের দরজাগুলো ঝপ্ঝপাং বন্ধ হয়ে যাচ্ছে বোধহয়। মামা লম্বা লম্বা পা চালাল। বাজারে ঢুকেই মামার মাথা চক্কর খেতে থাকল। নিরানববই ভাগ দোকানই বন্ধ হয়ে গেছে। মাছঅলারা দা ছুরি সাফ করছে। শেষ প্রামেত্ম একটা জায়গায় মামার চোখ আটকে গেল।

একটা বড় থালায় কিছু কই মাছ লাফালাফি করছে। কই মাছের সাইজও মাঝারি টাইপের। মামা বিক্রেতার কাছে গিয়ে বলল, ‘কত দাম?’ ‘কেজি এক হাজার টাকা।’ ‘পাঁচশ টাকার মাছ এক হাজার টাকা?’ ‘দাম বেশি হলে বাদ দেন।’ ‘আরেকটু কমান?’ ‘দামাদামি নাই।’ অগত্যা নিউটন মামাকে মাছ কিনতে হল। এক কেজিতে দশটা মাছ ধরেছে। শুকনো ব্যাগের ভিতর গুঁতোগুঁতি করছে মাছগুলো। কান মেরে ছিঁড়ে ফেলতে চাইছে ব্যাগ। আজ ঘরে গিয়ে নিশ্চয় বকুনি খাবে নিউটন মামা। মামা মিথ্যে বলে না কখনো। সত্যটা বলার সাথে সাথে শুরু হবে অগ্নুৎপাত সারা ঘরে। মামার আম্মাজান যখন রাগে ……… বিদ্যূৎ চলে গেল হঠাৎ। চারদিকে নিকষ ঘন অন্ধকার। অমাবস্যার কাছাকাছি রাত হওয়াতে আকাশের চাঁদেরও দেখা নেই। হাসান শাহ মাজারের গলিতে নেমে পড়ে নিউটন মামা। মাজারের সাথেই তিন তিনটে বটগাছ। বড় বটগাছটার বয়স একশ বছরের ওপরে। এই বটগাছটা নিয়ে হাজার কাহিনি মানুষের মুখে মুখে। কেউ বিশ্বাস করে, কেউ কথার তুবড়ি ফুটিয়ে উড়িয়ে দেয়। আচমকা ঝপাৎ করে কী যের পড়ল মামার পেছনে। মামা একটু চমকে আড়চোখে পেছনে তাকাল। মানুষের সমান একটা কালো বস্ত্ত মামার পেছনে পেছনে আসছে। মামার শরীরের সবগুলো লোম কাঁটা দিয়ে উঠল। মামা আড়ষ্ট গলায় বলল, ‘কে কে, কে আপনি?’ ‘আঁমিঁ ভূঁত। আঁমিঁ মাঁছ খাঁই। আঁমাঁকেঁ মাঁছ দাঁও।’ মামা ভয় পেয়ে আরো জোরে হাঁটা শুরু করল। ‘জোঁরেঁ হাঁটলেঁ ঘাঁড় মঁটকেঁ দেঁবোঁ। আঁমিঁ সাঁড়েঁ তিঁনশোঁ মাঁনুঁষেঁর ঘাঁড় মঁটকিঁয়েঁছিঁ। ব্যাঁগটাঁ নিঁচেঁ ফেঁলেঁ দাঁও। দাঁও বঁলছিঁ……’ নিউটন মামা এক সেকেন্ড সময় দেরি না করে কষে দৌড় লাগাল। ব্যাগটা কুড়িয়ে নিয়ে মাজারের দিকে চলে গেল কালো বস্ত্তটা। দুই ঘন্টা ধরে মামার কোন হুঁশ জ্ঞান নেই।

দাঁতের সাথে দাঁত খিঁচে গেছে নিউটন মামার। ডাক্তার বসে আছেন মামার পাশে। হুঁশ এলেই ডাক্তারের ছুটি হবে কেবল। রাত একটা বত্রিশ মিনিটে মামা চোখ মেলল। সবার চোখে চোখ ফেলে বার বার তাকাল। মামার পায়ের কয়েক জায়গায় ছিলকে ওঠে লাল লাল হয়ে আছে। ওখানে ওষুধ দিয়েছে ডাক্তার। ওসব ক্ষত থেকে মামা ব্যথা টেথা পাচ্ছে বলে মনে হল না। সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ল মামা। মাজারের কাছাকাছি গিয়ে যেখানে কই মাছের ব্যাগ হাত ফসকে পড়ে গিয়েছিল তার আশপাশে চোখ ফেলে ফেলে বারবার তাকাচ্ছিল। তাহলে কি কই মাছগুলো ভূতেই খেয়ে ফেলল? ভূত কি কাঁটাসহ কই মাছ গিলে ফেলতে পারে? ‘ভূত-পেত্নী কিছু নেই’ বলে মামা এতোদিন ধরে বিজ্ঞানে যা পড়ে আসছে সবগুলো কি মিথ্যে? মামার আফসোসের পরিধিটা আকাশের মতই ক্রমশ বড় হতে থাকল। ফজু মিয়া আসছে লুঙ্গি চেপে ধরে। ফজু মিয়া এক সময় রাতের বেলা ঘরে সিঁধ দিত। রান্না ঘরের থালা বাসন চুরি করে মজা পেত সে। কখনো গয়না জাতীয় কিছু চুরি করত না। জীবনে মাত্র একবারই সে ধরা পড়েছিল। তবে এ গ্রামে না, অন্য গ্রামে। ‘অমন করে কী খুঁজছ ভাতিজা?’ ফজু মিয়া জিগেশ করল। ‘কই মাছ খুঁজছি চাচা।’ ‘বৃষ্টি নাই, আকাশে মেঘের ডাক নাই,তুমি কইমাছ পাবা কোথায়?’ ‘কাল রাতে কইমাছের ব্যাগটা এখানেই পড়ে গিয়েছিল চাচা। ’ ‘ভূতের কবলে পড়ছিলা বুঝি? ’ ‘জি চাচা ’ ‘তাইলে আর দেখাদেখির কাম নাই। তোমাকে মেছো ভূতে পাইছিল ভাতিজা। মেছো ভূতে সব মাছই খাইয়া ফেলে।’ ‘তোমার ব্যাগে কয়টা মাছ ছিল ভাতিজা? ’ ‘দশটা চাচা।’ ‘দশটা না নয়টা?’ ‘একটা একটা করে দশটাই ব্যাগে ভরেছিলাম।’ ‘তোমার কোথায় জানি ভুল হইতাছে ভাতিজা। আমার হিসাবে নয়টাই হবে। চার যোগে পাঁচ, হ্যাঁ হ্যাঁ, নয়টাই।’ ‘আপনি নয়টা দশটা নিয়ে প্রশ্ন করছেন কেন চাচা?’ ‘ওহ্ হো, আসলেই তো। আমারতো দশটার মধ্যেই থাকা উচিত। ব্যাপার হইল কি ভাতিজা মেছো ভূত কখনো জোড়া কিছু খায় না। জোড়া খাওয়ার নিয়ম ওদের সমাজে নাই। এই জন্য বলছি ওই ভূতে তোমার নয়টা মাছই খাইছে। আরো একটা মাছ তুমি খুঁইজা দেখতে পারো। খোদা হাফেজ ভাতিজা নিউটন।’ দুনিয়ার জীব-জগতের রহস্যেও এখনো কুলকিনারা হয় নাই। তাই ফজু মিয়ার কথাগুলো একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করল নিউটন মামা।   নিউটন মামা রিকশায় চড়ে কোথায় যাওয়া যায় এক মুহর্ত ভাবল। ডিসি হিলের দিকে গেলে কেমন হয়? ডিসি হিল চত্বরে তিনদিন ধরে বইমেলা শুরু হয়েছে। এখন বাজে নয়টা বিশ। ডিসি হিলে পৌঁছতে পৌঁছতে এক ঘন্টার বেশি লেগে যাবে। মামা রিকশা থামাল।

 

দশ টাকা ভাড়া মিটিয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করতে থাকল। প্রচন্ড গরম বাসের ভেতর। কোথাও একটু হাওয়া নেই। আশপাশের সব গাছগাছালি মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে আছে। যাত্রীরা ঘামে ভিজে একাকার হয়ে গেছে। মামার শরীর থেকে ঘাম নামে কম। মামা কেন কম ঘামে বিষয়টা কোনদিন তলিয়ে দেখেনি। মামা যা ভেবেছিল অবশ্য তা হয়নি। আন্দরকিল্লা পৌঁছতে মামার দুই ঘন্টা লেগে গেল। মামা মোমিন রোড হয়ে ডিসি হিলের দিকে হাঁটা শুরু করল। ডিসি হিলে পৌঁছে নিউটন মামা বেশ অবাক। মানুষজনের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। বই বিক্রেতারা বই গুছাতে ব্যসত্ম। জনপ্রিয় লেখকদের বইগুলোকে তারা সামনে এনে রাখছে। বইয়ের মলাটগুলো চকচক করছে। মামা বই দেখতে শুরু করলো একপাশ থেকে। নিউটন মামা শিশু- কিশোর স্টলের পাশে এসে দাঁড়াল। ভূতের বইয়ের ছড়াছড়ি গোটা স্টলে। নানা বইয়ের নানান নাম। ভূতে ভূতে লড়াই, ভূত ভূত, ভূতের দেশে একদিন, একটি ভূতের সাতটি ঠ্যাং, ভূত রহস্য, আরো কতো নাম। একটি ভূতের সাতটি ঠ্যাং’ বইটি হাতে নিল মামা। সাতটি পাঅলা একটি অদ্ভুত প্রাণীর ছবি। এই প্রাণীটিকে পৃথিবীর কোন প্রাণীর সাথেই মেলাতে পারল না নিউটন মামা। মামা বিক্রেতার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল, ‘ভূতের সাতটি ঠ্যাং হয় ভাই?’ বিক্রেতা মামার দিকে অন্য চোখে তাকাল। ঠোঁটের ভেতর এক চিলতে হেসে বলল, ‘নিশ্চয় হয়, নাহলে কি লেখক সাতটি ঠ্যাঙের কথা উল্লেখ করতো?’ নিউটন মামা লেখকের নাম দেখলো। গোট গোট করা লেখা ডঃ আফজাল ইকবাল। ড. আফজাল ইকবালের নামটা নিউটন মামার চেনা চেনা মনে হল। মামা বিক্রেতার দিকে দৃষ্টি ফেরাল। ‘ডাঃ আফজাল ইকবাল কি ভূতের সাতটি ঠ্যাং নিজ চোখে দেখেছেন?’ ‘না দেখলে কি উনি লিখতেন?’ ‘কিন্তু সব প্রাণীর পা জোড়া জোড়া হয়। ভূতের বেজোড় হবে কেন? ‘আপনি ড. আফজাল ইকবালের কাছে ফোন করতে পারেন। এই বইতে ডঃ আফজাল ইকবালের ফোন নাম্বার আছে। উনি ভূতের ওপর এক ডজন বই লিখেছেন।’ আসেত্ম আসেত্ম মেলায় লোকজন বাড়ছে।

 

লাফাতে লাফাতে মায়ের হাত ধরে ছেলে পিলেরা ঢুকছে। কয়েক মিনিটের মধ্যে শিশু-কিশোররা ঘিরে ফেলল পুরো স্টল। নিউটন মামার বই কেনা দেখে বিক্রেতা চোখ কপালে তুলল। ভূত সংক্রামত্ম সব বই-ই মামা কিনে ফেলেছে। মামার বই কেনা দেখে সবাই আজব চোখে মামার দিখে তাকাচ্ছে। মামা বীরের মতই বইগুলো হাতে নিয়ে রাসত্মায় নেমে পড়ল। আন্দরকিল্লার মোড়ে এসে নিউটন মামার রিকশা থেমে যায়। চারদিকে প্রচন্ড হুড়োহুড়ি। মানুষ দিকবিদিক দৌড়াচ্ছে কোনকিছু চিমত্মা না করে। কাঁদানে গ্যাসের ছোঁয়ায় মামার চোখ দুটো অসম্ভব জ্বলছে। যুদ্ধ ক্ষেত্রের মতো পুলিশ আর কালো র‌্যাব মানুষের পিছে পিছে ছুটছে। মামা বইগুলো নিয়ে একটি হোটেলে ঢুকে পড়ল। নিউটন মামা বইয়ের ওপর হাত দিয়ে এক কোণায় বসে আছে । ঘটনা কী কাউকে জিজ্ঞেস করার সাহস পাচ্ছে না। হোটেলের ভেতরের লোকগুলোর ভয় আতংক কাজ করছে। মামার চোখে মুখেও একটু একটু করে ভয় আতংক কাজ করতে শুরু করেছে । পুলিশ আর র‌্যাব ঢুকে পড়েছে হোটেলের ভেতরে। সবখানে পিন পতন নিরবতা। কোথাও একটুও মুখ চাওয়া-চাওয়ি নেই। দুজন র‌্যাব মামার পাশে এসে দাঁড়াল। কালো র‌্যাব একজন ধমক দিয়ে বলল,‘এগুলো কী’? মামা ক্ষীণ গলায় বলল, ‘বই।’ ‘কী বই?’ ‘ভূতের বই ।’ ‘ভূতের বই ! তুই কী বাচ্চা যে ভূতের বই পড়িস?’ ‘বড়রাও ভুতের বই পড়ে। হূমায়ুন আহমেদও ভূতের বই পড়ত।’ ‘কোন হূমায়ুন আহমেদ?’ ‘বাংলাদেশে হূমায়ুন আহমেদ একজনই। কিছুদিন আগে ক্যান্সারে মারা গেছে।’ ‘ও ব্যাটাতো আমাদের বিরুদ্ধে লিখেছে। বড় লেখক না হলে এতোদিন সে কবরের ভেতরেই থাকত। নিউটন মামা প্রচন্ড ভয়ে আগের জায়গায় জড়োসড়ো হয়ে আছে। শরীরের কোনো কোনো অংশ একটু একটু কাঁপছেও। একজন র‌্যাব মামার বইগুলো খুলে ফেলল। কয়েকটি বই টেবিল থেকে পড়ে গিয়ে ফ্যানের বাতাস পেয়ে সরসর শব্দ করছে। বাইরে র‌্যাব-পুলিশের সংখ্যা আরো বেড়ে গেছে। সবাই টান টান শরীরে এদিক ওদিক ছুটোছুটি করছে। একটা বাসে ঠেলে ঠেলে লোক ঢুকাচ্ছে পুলিশ। বাসে মিশেল কান্নার কণ্ঠস্বর বাতাসে উড়ে উড়ে যাচ্ছে।   নিউটন মামার টেবিলে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে ভূতের বইগুলো। বইয়ের মলাটের ছবিগুলো নানা রকমের। কোন কোন বইয়ের ছবিগুলো গায়ে একেবারেই মাংস ছাড়া। কোন কোনটার বিশাল বিশাল চোখ। পাগুলো মুরগির ঠ্যাং, ছাগলের ঠ্যাংয়ের মত। ভূতের রহস্য বইটিতে কোন ছবি টবি নেই। ড. আফজাল ইকবালের লেখা, বইটি হাতে নিয়ে কিছুক্ষণ নড়াচড়া করল নিউটন মামা। ভূতের রহস্য বইটা পড়া শুরু করল মামা। ভূত নাকি পৃথিবীর কোন প্রাণী না। অন্য কোন গ্রহ থেকে উড়ে এসেছে এই ভূত। শুরুতে এরা বেশ তাজা মোটা ছিল। ডাইনোসরের মতো তাজা মোটা। অন্যগ্রহ থেকে আসার সময় তারা কোন খাদ্য টাদ্য পায়নি, উপোসে উপোসে পাড়ি দিয়েছে এ পথ। পৃথিবীতে এসে এ জন্য এদের শরীরটা এরকম হাড্ডিমার্কা হয়ে গেছে। কয়েক পৃষ্টা পড়ে মামা থামল। ঘড়ির দিকে তাকাল। বাজে মাত্র এগারোটা বত্রিশ মিনিট। মামা চেয়ার থেকে ওঠে জানালার কপাট খুলে দিল। সাথে সাথে কয়েক মুঠো ঠান্ডা বাতাস মামার ঘরটায় ঢুকে পড়ল। এট টুকু পড়ে মামার মাথায় দুই হাজার ভূত একসাথে কিলবিল করতে থাকল। ভূতগুলো কোন গ্রহ থেকে এসেছে লেখক তা উল্লেখ করেননি। আকাশের বায়ুর সত্মরগুলো কীভাবে পার হয়েছে তার কিয়দংশও উল্লেখ নেই। তবে বিষয়টা যে একেবারেই ঘটতে পারে না মামা তাও মানতে নারাজ। এই বিশ্বে প্রতিদিন অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে চলেছে। আকাশটা নাকি প্রতিদিন ক্রমশ বড় হয়ে যাচ্ছে। যে অংশে আকাশ বড় হচ্ছে সেই অংশে তারাকারাজিও সৃষ্টি হচ্ছে? গ্রহ উপগ্রহও সৃষ্টি হচ্ছে? পরের আকাশের অংশ কি এই আকাশের চেয়েও বড় হবে? বড় হলে কতো বড়? মামা হিসাব করে কোন কূলকিনারা করতে পারে না। কারুর পাযের শব্দ কানে পেয়ে মামা ওদিকে মুখ করে রাখে। রিজিয়া খানম। নিউটন মামার মা। এ ঘরের একমাত্র কর্তাজন। রিজিয়া খানম আসেত্মত্ম ধীরে নিউটন মামার কাছে এসে টেবিল ছুঁয়ে দাঁড়াল। টেবিলে ছড়ানো বইগুলোর দিকে তীব্র দৃষ্টি ফেলল। মামার দিকে চোখ ঘুরিয়ে বলল, ‘কী হচ্ছে এসব?’ ‘গবেষণা করছি।’ ‘কীসের গবেষণা?’ ‘ভূতের।’ ‘ভূতের! ভূতকে নিয়ে কেউ কী গবেষণা করে?’ ‘ড. আফজাল ইকবাল করেন।’ ‘ড. আফজাল ইকবাল কে?’ ‘একজন বিখ্যাত লেখক। তাঁর ডজন ডজন বই বাজারে আছে।’ ‘তুই কি ড. আফজাল হতে চাস?’ ‘না।’ ‘তাহলে কী হতে চাস?’ ‘আমি ভূতের একটা সিদ্ধামেত্ম পৌঁছাতে চাই। ভূত পৃথিবীর কোন প্রাণী না। এরা অন্য কোন গ্রহ থেকে এসেছে।’ ‘কে বলেছে একথা?’ ‘ড. আফজাল ইকবাল।’ ‘ভূত যে গ্রহ থেকে এসেছে সে গ্রহে কী পানি আছে?’ ‘বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন কোন কোন গ্রহে পানি আছে।’ ‘মাছ আছে?’ ‘মাছ আছে বলে বিজ্ঞানীরা কোন সিদ্ধামেত্ম পৌঁছেনি।’ ‘তাহলে ভূতে মাছ খাবে কেন? দুইদিন আগে তোর দশটি কইমাছ খেয়ে ফেললো না?’ ‘গবেষণাটা তো তুমি শুরু করতে দিলে না। বকর বকর শুরু করে দিলে।’ ‘গবেষণা পরে করিস। এখন উঠবি।’ ‘উঠবো কেন? দুনিয়ার যত গবেষণা রাতেই তো হয়। আইনস্টাইন রাতে ঘুমাতো না। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর ভান করতো।’ ‘আয়, উঠ। তোর ভাইয়া ফোন করবে। তোর সাথে না তার অনেক কথা।’ ‘ভাইয়াটার বুঝি আর কোন কাম নেই? সপ্তাহ দুইবা তিনবার ফোন করার দরকার কী? পয়সা যায় না? ’ নিউটন মামা বই উল্টে উঠে পড়ল। মায়ের পেছনে পেছনে হাঁটা শুরা করল। নিউটন মামার বড়ভাই ফোন করার কথা ছিল বারোটা পনের মিনিটে। এখন বাজে বারোটা দশ। টাইমের ব্যাপারে বড়ভাই তার এই গুণটা ছিল কড়া গন্ডায়। সেই কারণেই বড়ভাই ধেই ধেই করে অনেক পয়সার মালিক হয়ে গেছে। রিং বেজে উঠলে রিজিয়া খানম ফোন ধরলেন। ফোন ধরেই নিউটন মামাকে ইশারা করলেন। নিউটন মামা বলল, ‘আইমান কেমন আছে?’ ‘আইমানকে দেবে?’ ‘আইমান এখন স্কুলে।’ ‘ওকে কাছে পেলে আমি গাছে বেঁধে রাখবো।’ ‘ও কী করেছে আবার?’ ‘ওর কারণেই তো আমি সবার মামা হয়ে গেলাম। সবাই এখন আমাকে নিউটন মামা ডাকে। ছেলেরাও ডাকে, বুড়োরাও ডাকে। কেউ নিউটন মামা ডাকলে আমার গায়ে লাগে না?’ ‘ঠিক আছে, ও আসুক, ওর কানটা শক্ত করে মলে দেবো।

 

এখন তোর খবর বল। তোকে নাকি সেদিন ভূতে পেয়েছিল?’ ‘হ্যা।’ ‘ভূত কি নিজের চোখে দেখেছিলি?’ ‘হ্যাঁ।’ ‘তারপর পালালি, তাই না?’ মামা চুপ করে থাকে। ‘ভূতের চেহারা দেখতে পেয়েছিলি?’ ‘কালো কাপড়ে মুখ-হাত ঢাকা ছিল।’ ‘ও আচ্ছা।’ ‘আমেরিকাতে ভূত আছে ভাইয়া?’ ‘আছে শুনেছি। এখানেও অনেকে ভূত বিশ্বাস করে। ভূতকে ভয় করে।’ ‘বলো কী?’ ‘দুনিয়ায় আমেরিকানরা হচ্ছে ভীতুর জাতি। ঝুনঝুনি সাপকে ওরা ওদের ঈশ্বরের চেয়ে বেশি ভয় পায়। ওদের টাকা অস্ত্র আছে বলে অন্যদেশগুলো ওদেরকে মান্যি করে। আচ্ছা যাক সেই কথা। কাল হাসান শাহ মাজারের চারপাশে লাইট লাগিয়ে দিবি। ভূতেরা লাইটের আলো সহ্য করতে পারে না। বাদুড়ের মতো। তোর কি খরচের টাকা লাগবে?’ ‘হুুঁ।’ ‘কতো টাকা?’ ‘দশ বিশ হাজার।’ ‘দশ বিশ হাজার দিয়ে কী করবি?’ ‘বই কিনবো।’ ‘বই কিনবি? কী বই কিনবি?’ ‘ভূতের বই।’ ‘ভূতের বই! দশ বিশ হাজার টাকার কেউ ভূতের বই কিনে?’ ‘টাকা না পাঠালে পাঠাবে না, এতো প্রশ্ন করছো কেন?’ ‘আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে, বিশ হাজারই পাঠাবো। ফোন মাকে দে।’ নিউটন মামা খোশ মেজাজে নিজের র”মে চলে গেল। চেয়ার টেনে নিল নিঃশব্দে। এবং পড়া শুরু করলো ‘ভূতের সাত ঠ্যাং’ বইটি।   ঘুম থেকে ওঠে যেন ঘুম পাচ্ছে নিউটন মামার। কাল ঘুমোতে ঘুমোতে প্রায় তিনটা বেজে গিয়েছিল। ‘ভূতের সাত ঠ্যাং’ বইটা পড়তে গিয়ে বারবার কপালটা টেবিলের সাথে ঝুঁকে ঝুঁকে যাচ্ছিল। মামা কখনো এতো রাত জেগে বই পড়েনি। গড়ে তিন ঘন্টা লেখাপড়া করে এসএসসিতে ফাটাফাটি রেজাল্ট করেছিল। ব্রাশে টুখপেষ্ট মেখে দাঁত মাজল মামা। ফেসওয়াশ দিয়ে সারা মুখটা ধুয়ে ফেলল পানি মেরে। তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছে একটা বড়সড় নি:শবাস ফেলল। এই সময়ে দিলদার মিয়ার দোকানে ধুম বেচাকেনা হয়। বসার জায়গা থাকে না। পরটার জন্য লাইন দেয় ছেলেমেয়েরা। দুই দুইজন কারিগর সকাল বেলা পরটা র”টি বানায়। মাঝেমধ্যে ওদের কাজে সাহায্য করে দিলদার মিয়া। নিউটন মামাকে দেখে দিলদার মিয়া পরটা ভাজা বন্ধ করে দিল। বড় বড় চোখে একদৃষ্টিতে তাকাল। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকল। দিলদার মিয়া বলল, ‘এতোদিন পর এলে নিউটন মামা ? তোমাকে ভূতে পাওয়ার পর থেকে আর তো এলেই না। ভূত যেমন আছে, ভূত তাড়ানোর মন্ত্রও আছে। বালা মুসিবাত সবখানে আছে। তোমার হুঁশ চলে যাওয়ার পর আমিই তো ডাক্তার ডেকে এনেছিলাম। দোকানের জন্য সেদিন চলে আসতে হয়েছিল। নাহলে সারারাত তোমার পাশেই থাকতাম।’ ‘অনেক ধন্যবাদ মামা।’ ‘ভেতরে এসে বসো। ভাজি গরম পরটা খাও।’ ‘নাসত্মা করার জন্য এসেছি মামা।’ ‘আমার কী ভাগ্য আজ, সকাল সকাল তোমাকে পেয়ে গেছি।’ মামাকে দোকানে ঢুকতে দেখে ছাত্র টাইপের একটি ছেলে বাইরে চলে গেল। মামা খালি জায়গাটায় জুতমত করে বসল। বামপাশে চোখ যেতেই ফজু মিয়ার চোখাচোখি হল। ফজু মিয়া একটু নড়েচড়ে বলল, ‘তুমি তো অনেক শুকাইয়া গেছ ভাতিজা।’ ‘শুকিয়ে গেছি?’ ‘নিজের শরীর নিজে কেউ দেখতে পায় না ভাতিজা। আয়নার সামনে দাঁড়ালেই বুঝতে পারবা তুমি আগের চেয়ে অনেক শুকাইয়া গেছ। আচ্ছা থাক সেকথা। কই মাছটা কি পাইছিলা ভাতিজা?’ ‘না, পাইনি।’ ‘কই মাছেরে আল্লাহ কেন লম্বা প্রাণ দিছে বুঝি না ভাতিজা। ইলিশ মাছ ডাঙায় ওঠার আগে মইরা যায়। মানুষের সমান কাতলা মাছের প্রাণও একটুক্ষণ ধপাস ধপাস কইরা শেষ। দুনিয়ায় দুই জাতের প্রাণীর হায়াত লম্বা লম্বা হয়। এক কই মাছ, অন্যরা দেশের রাজা- বাদশারা। দুনিয়ার কোন রাজা-বাদশারাই যৌবন কালে মরে নাই। কী বলো দিলদার মিয়া?’ ‘তোমার শুধু অকর্ম প্যঁাচাল। খিদে আছে বলেই নিউটন নাসত্মা খেতে এসেছে। খাও ভাগিনা, খাও।’ কথার ফাঁকে ফাঁকে নাসত্মাটা শেষ করে ফেলেছে নিউটন মামা। পকেট থেকে টিস্যু বের করে মামা মুখ মুছল, হাত মুছল। পকেটে হাত দিতেই দিলদার মিয়া বলল, ‘পকেটে হাত দিও না ভাগিনা্, পয়সা দিলে আমি রাগ করব।’ ‘ওমা, নাসত্মা খেলে পয়সা দিতে হবে না?’ ‘ না, আজ দিতে হবে না।’ ‘ কাল টিটু ভাইয়া ফোন করেছিল’ ‘ টিটু মিয়া ফোন করেছিল?’ ‘ জি মামা।’ ‘ আমাদের কথা কিছু বলেছে?’ ‘ মাজারের আশেপাশে লাইট লাগানোর কথা বলেছে। ও জায়গাটা সবসময় অন্ধকার অন্ধকার থাকে। ভূতেরা নাকি লাইটের আলোতে দেখতে পায় না। বাদুড় প্রাণীর মতো। বাদুড়েরাও দিনের আলোয় দেখতে পায় না। মোট কত টাকা লাগে বললে হবে।’ ফজু মিয়া একটু নড়েচড়ে উঠল। সাদা মুখটা হঠাৎ কালো হয়ে গেল। দিলদার মিয়ার দিকে চোখের তাবৎ আলো ফেলে বলল, ‘এই লাইটগুলো কি আসত্ম থাকবে? যতবার লাগাইবা ততবার হাওয়া হইয়া যাইবো।

 

পোলাপানরা যেভাবে চুরি টুরি শুরু করেছে….’ দিলদার মিয়া একগাল হেসে বলল, ‘লাইটগুলো এমন জায়গায় ফিটিং করবো, তুমি কেন চোরের দাদাও হাজার চেষ্টা করে ছোঁয়াছুঁয়ি করতে পারবে না।’   তিনদিন ধরে ফোন করে ড. আফজল ইকবালের সাথে কোন যোগাযোগ করতে পারছে না নিউটন মামা। রিং বাজে, কিন্তু ওপাশ থেকে কেউ ফোন উঠায় না। রিং বাজতে থাকে। বাজতে থাকে। বাজতেই থাকে। মামার ধৈর্য হিমালয়ের মতো। মামা যে কাজে নামে সে কাজের একটা গতি না হওয়া পর্যমত্ম অশামিত্মগুলো মাথার ভেতর উড়তে থাকে। বড় বড় লোকদের সাক্ষাৎ পেতে অনেক ঝামেলা, মামা সেটা জানে। তাই বলে হাল ছাড়া কেন? এতোদূর এসে থেমে যাওয়া মানে ‘ব্যর্থ’ মানুষ হিসেবে ইতিহাসের খাতায় নাম লেখানো। মামা কি ‘ব্যর্থ’ মানুষ হিসেবে বেঁচে থাকবে এ দুনিয়ায়? মামার মাথায় প্রশ্ন দৌড়ে কাতারে কাতারে। নিউটন মামার মাথায় হঠাৎ একটা শৈল মাছের মতো বুদ্ধি লাফ দিল। মামা ফোনের পাশে বসে থাকল। চারদিকে নিসত্মব্ধ পরিবেশ। ঘড়ির কাঁটা একটা তেত্রিশ মিনিটে পা দিয়েছে। মামা কাঁপা হাতে ফোন টিপল। ফোন উঠাল কেউ। মামার বুকটা ধড়ফড় করতে থাকল। ‘তোমার নাম কী?’ মামা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘নিউটন।’ ‘নিউটন তো অনেক আগেই মারা গেছে।’ ‘আমি ইফতেখার আহমেদ নিউটন।’ ‘তুমি আমাকে দুইশ তেত্রিশ বার ফোন করেছ। তোমার অনেক ধৈর্য। এই ধৈর্য ধরে রাখলে তুমি বিজ্ঞানী নিউটনও হয়ে যেতে পার। এবার বলো ফোন কী জন্য?’ ‘আপনার একটু সাক্ষাৎ চাই।’ ‘তুমি কি সাংবাদিকতা করো? আমি সাংবাদিকদের সাক্ষাৎ দেইনা।’ ‘না না, আমি সাংবাদিক টাংবাদিক না, আমি মাত্রই মাস্টার্স শেষ করেছি।’ ‘এখন বলো কী জন্যে সাক্ষাৎ?’ ‘আমার খুব ইচ্ছে আপনাকে কাছ থেকে দেখার। যে মানুষটি ভূতের ওপর এতোগুলো বই লিখেছে তাকে না দেখে মরে গেলে মৃত্যুরই সার্থকতা থাকবে না।’ ‘তোমার ভেতর ভূতের মতোই অনেক আবেগ। দুনিয়ার প্রাণী জগতের মধ্যে ভূতের আবেগ সব চেয়েবেশি। তুমি কখন আসতে চাও?’ ‘কাল অথবা আপনি যখন বলবেন।’ ‘তুমি কেথায় থাকো?’ ‘বোয়ালখালী।’

 

বোয়ালখালী কোথায়?’ ‘চট্টগ্রামে।’ ‘বোয়ালখালীতে কী বোয়াল মাছ পাওয়া যায়?’ ‘জি, পাওয়া যায়, তবে সংখ্যায় কম।’ ‘তুমি আমার ঠিকানা জানো?’ ‘জি জি, আপনার ঠিকানা আমার সংগ্রহ হয়ে গেছে।’ ‘দুপুর দুটোর পর আমাকে পাবে। মঙ্গলবার। মনে থাকবে তো?’ ‘জি জি, থাকবে। অবশ্যই থাকবে।’ নিউটন মামা রিসিভারটা আলতো করে রেখে দিল। পেছনে তাকাতেই ভূত দেখার মতো চমকে উঠল। মামা বলল, ‘মা তুমি?’ ‘কার সাথে কথা বলছিলি?’ ‘ড. আফজল সাহেবের সাথে।’ ‘তুই ড. আফজল সাহেবের বাড়ি যাবি?’ ‘হ্যাঁ, মঙ্গলবার।’ ‘মঙ্গলবার তো আমরা এক জায়গায় যাচ্ছি।’ ‘কোথায়?’ ‘মেয়ে দেখতে।’ ‘আমি মেয়ে দেখতে যাবো কেন?’ ‘তোর বিয়ের মেয়ে কি অন্যজন দেখবে?’ ‘আমার বিয়ে?’ ‘হ্যাঁ, তোর বিয়ে।’ হো হো করে হেসে উঠলো নিউটন মামা। হাসির শব্দে গোটা ঘরটা গম গম করতে থাকল। হাসিটা কষ্টে সামলে নিউটন মামা বলল, ‘তোমাকেও দেখছি ভূতে পেয়েছে মামণি।’   বাস থেকে নেমে মামা থামল। এদিক ওদিক কয়েকবার তাকাল। বড় রাসত্মা থেকে পূর্ব দিকে নেমে গেছে পিচ করা একটি মাঝারি রাসত্মা। পাশেই বাংলালিংকের বিশাল সাইনবোর্ড। সাইনবোর্ডে ঙ্কিকেট খেলোয়াডের ছবি। সব ছবিগুলোয় ছক্কা মারার উছল হাসি। মামা সিএনজি টেক্সি জাতীয় এরকম কিছু খুঁজতে থাকল। কিন্তু কোথাও সিএনজি টেক্সি লক্ষ করা যাচ্ছে না। মামা একটু হতাশ হলো। টুংটুাং শব্দ করে একটা রিকশা এসে মামার পাশে এসে দাঁড়াল। রিকশাঅলা মামার মুখে একটুক্ষণ তাকিয়ে বলল, ‘কোথায় যাবেন স্যার?’ ‘ভূতকা পাড়ায় ।’ ‘সেটা তো অনেকদূর স্যার। ভূতের হাট থেকে আরো দুইমাইল। ওদিকে রাসত্মাগুলো একেবারে এলেবেলে। বড়জোর আমি ভূতের হাট পর্যমত্ম আপনাকে পৌঁছে দিতে পারি।’ নিউটন মামা রিকশায় উঠে পড়ল। রিকশা চলতে থাকল তার নিজের গতিতে। মামা গলায় জোর এনে বলল, ‘এই হাটের নাম ভূতের হাট হলো কেন ভাই?’ ‘এই এলাকায় একসময় ভূত ছাড়া কেউ ছিল না। ভূতের ভয়ে কাক পাখিরাও কা কা করতো না। বর্ষাকালে ব্যাঙের ডাকও শোনা যেত না।

 

ছমছম থমথম অবস্থা ছিল। প্রত্যেক মংগলবার ভূতের হাটে সব ভূতেরা জড়ো হতো। ভূতের কর্তা ভাষণ দিত। কর্তার ভাষণ ভূতেরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করতো।’ ‘এগুলো কতো দিনের আগের কথা?’ ‘একশ দুইশ তিনশ বছর হবে হয়তো। বেশিও হতে পারে। আপনি ভূতকাপাড়ায় কোথায় যাচ্ছেন?’ ‘ ড. আফজাল ইকবালের কাছে।’ ‘উনি আপনার সাথে দেখা করবেন?’ ‘কেন করবেন না।’ ‘উনি প্রেসিডেন্ট প্রধানমন্ত্রীকেও সাক্ষাৎ দেন না। অনেক বড় মাপের মানুষ।’ ‘ড. আফজাল ইকবালকে কখনো দেখেছেন? ’ ‘দেখি নাই। উনার নামডাকের কথা শুনেছি। উনি ঘর থেকে বের”ন না। ভূতকাপাড়া এলাকা বলতে গেলে পুরোটাই উনার। বিরাট বড় লোক মানুষ। বই লিখে কোটি কোটি টাকা পান।’ রিকশাঅলার পা দুটো থেমে গেল। মামা জায়গাটার চারপাশে তাকাল। রিকশাঅলা রিকশা থেকে নেমে বলল, ‘এটা হল ভূতের হাট। তবে মঙ্গল শনি হাট বন্ধ থাকে।’ মামা একশ টাকার একটা নোট রিকশাঅলার হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘কতো দূর হাঁটতে হবে ভাই? ’ ‘সেটা আপনার হাঁটার ওপর। জোরে হাঁটলে আধঘন্টা লাগতে পারে। সামনে রাসত্মা খারাপ। আপনি বিদেশি মানুষ। আপনার কষ্ট হবে বলে নিজের কাছের খারাপ লাগছে। ভাড়া কত নেব ভাই?’ ‘ফেরত দিতে হবে না।’ ‘চল্লিশ টাকা ভাড়া।’ ‘বলছি তো ফেরত দিতে হবে না।’ হাত ঘড়িটা দেখলো নিউটন মামা। এখন বারোটা দশ। হাতে অনেক সময়। দুটোয় পৌঁছলে হবে। মামা হাঁটা শুরু করলো পা ফেলে ফেলে। কোথাও একটা মানুষও মামার চোখে পড়ছে না। দূরে কোথাও কোথাও লম্বা লম্বা তালগাছ চোখে পড়ছে মামার। পথের দু‘পাশে অচেনা গাছগাছালির নিশ্ছিদ্র ঝোপ জংগল। খালি জমিগুলোতে পানি আর পানি। কোন কোন জমিতে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে চিকন চিকন ঘাস। মামার মাথার ওপর প্রচন্ড রকম রোদ ঢালছে সূর্যটা। আজকেই বোধহয় সূর্যের তাপমাত্রাটা অন্যদিনের মাত্রাটা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। একটা তালগাছের আগায় মামার চোখ গেল। তাল গাছ না হয়ে অন্য গাছ হলে মাথাটা অনেক আগেই ভেঙে পড়তো। একটা গাছে এত তালও হয়? তালগাছ একপায়ে দাঁড়িয়ে’ কবিতাটি কার? এই কবি এখানেই জন্ম নিয়েছিলেন? এই তালগাছের নিচেই বসে কি তিনি ওই কবিতাটি লিখেছেন? মামা কবি হলে তিনিও আজ একটা কবিতা লিখে ফেলতে পারতেন। আহা, মামা যে কেন কবি হলেন না! একটা বিরাট দিঘির কাছাকাছি এলো নিউটন মামা। জলের ওপর বাতাস বয়ে যাওয়াতে ছোট ছোট ঢেউয়ের সৃষ্টি হয়েছে দিঘিতে। এতো বড় দিঘি মামা জন্মের পর কোথাও দেখেনি। দিঘির চার পাড়েই তালগাছ আর তালগাছ। দুনিয়ায় এতো গাছ থাকতে এখানে এতো তালগাছের কেন ছড়াছড়ি হলো মামার মাথায় এলো না। বাড়ির সামনে এসে মামার চোখ দুটো হাতির কানের মত হয়ে গেল। এই আলীশান বাড়িটা যেন কোন রূপকথার রাজা-বাদশার বাড়ি। বাড়ির পুরো চত্বরেই নানান ফলফলাদির গাছ। আতাগাছের আতাগুলো পেকে পেকে হলুদ হয়ে আছে। সারি সারি পেয়ারার ডালগুলো পেয়ারার সাথে ঝুলে ঝুলে আছে। কয়েকটি কাঠ বিড়ালি এগাছ থেকে ওগাছে লেজ নাচিয়ে দৌড়াদৌড়ি করছে।

 

নিউটন মামা খুব সাহসী হয়ে গেছে আজ। আশপাশে কাউকে না দেখেও ভেতরে ঢুকে পড়ল। বিরাট টানা ড্রয়িং রুম। দেয়ালে সাঁটানো বড় বড় জীবজন্তুর ছবি। নিশ্চয় অংকন শিল্পীদের অাঁকা এসব ছবি। এককথায় চমৎকার সংগ্রহ বলা যায়। দুই দুইবার হাতের তালি ফুটল ভেতরের একটি র”মে। এতক্ষণ পর প্রাণের আসিত্মত্ব পেল মামা। তালি-ফোটা রুমের ভেতর ঢুকল মামা। লোকটাকে দেখে সালাম করল। বিশাল একটা টেবিল নিয়ে হাস্য বদনে বসে আছেন লোকটা। মামাকে ইশারা করল চেয়ারে বসতে। লোকটা একটা কলম হাতের আঙুলে নাড়াচড়া করতে করতে বলল, ‘আমি ডঃ আফজাল ইকবাল।’ ‘জি, আমি নিউটন। ইফতেখার আহমেদ নিউটন।’ ‘তোমার জন্য আধঘন্টা সময় রিজার্ভ। অনেক দূর থেকে এসেছো বলে তোমার জন্য এই সময়। এখন বলো তুমি কি আমার প্রকাশিত বইয়ের ব্যাপারে জানতে এসেছো?’ ‘জি।’ ‘সব প্রশ্নের উওর হয়তো আমি তোমাকে দেবো না। যেটি দেবো না সেক্ষেত্রে আমি চুপ হয়ে থাকবো।’ ‘জি আচ্ছা।’ ‘তুমি শুরু করো।’ ‘আপনার সবগুলো বই পড়ে আমার বিশ্বাস হয়েছে পৃথিবীতে ভূত নামের কোন প্রাণী আছে। আপনি কী এটা বিশ্বাস থেকে লিখেছেন?’ ‘তুমি এমন একটি প্রাণীর নাম বলো যার কোন নাম নেই?’ ‘নাম নেই?’ ‘হ্যাঁ, নাম ছাড়া প্রাণী।’ ‘আমার কাছে নেই।’ ‘কিমত্মু ভূতের নাম সারা বিশ্বে ছড়িয়ে আছে। ইংল্যান্ডে যেমন আছে, আফ্রিকাতেও আছে। অলরাইট?’ ‘জি, জি।’ ‘পরের প্রশ্ন।’ ‘আপনার একটি বইয়ের নাম হলো ‘ভূতের সাত ঠ্যাং’। সব প্রাণীর ঠ্যাং জোড়া জোড়া হয়। ভূতের বেলায় তার উল্টো হবে কেন?’ ‘তোমার এক হাতে আঙুল কয়টা?’ ‘পাঁচটা।’ ‘ছয়টা হলো না কেন? তোমার মাথার চুল জোড়া না বিজোড়? তোমার নাক একটা হলো কেন? দুইটা হলে ক্ষতি কী ছিল? বিজ্ঞানী আলট্রেটর থিসিসেও বলা আছে ভূতের সাত ঠ্যাঙের কথা। আইনস্টাইন একবার ভূত দেখে জববর পালান পালিয়েছিল।’ ‘কিন্তু আইন স্টাইনের জীবনীতে তো এসব কিছুই পাইনি?’ ‘মানুষের জীবনের সব ঘটনা ইতিহাসের পাতায় আসে না। মানুষের দুর্বল দিকগুলো মানুষ প্রকাশ করতেই চায় না। তুমিও প্রকাশ করবে না।’ ‘আমি প্রকাশ করবো না মানে?’ ‘তুমি যে ভূত দেখে কোমড় কষে ভোঁ দৌড় দিয়েছিলে এ পর্যমত্ম কয়জন লোককে বলেছো?’ ‘আমাকে যে ভূতে পেয়েছিল আপনি কীভাবে জানেন?’ পেছনে কারুর পায়ের শব্দে মামার মনোযোগটা ওদিকে চলে গেল। ঘাড় বাঁকা করে তাকাতেই মামার সারা শরীর আঁতকে উঠল। বন মানুষের মতো একজন অস্বাভাবিক লোক। বিরাট বিরাট আঙুলের নখ। মাথার চুলগুলো এলোমেলো এবং জটায় ভরা। অনেক চেষ্টা করে দেখলে চোখ দেখা যাবে। লোকটার হাতে একটা ঝকঝকে কাঁচের থালা। থালায় নানান রকম ফল। মামার মাথায় ভয়-বিস্ময়গুলো ফরফর করে উড়তে থাকল। ড. আফজার ইকবাল বলল, ‘ভয় পাওয়ার কোন কারণ নেই। ঘরের কাজের লোক। দিনে তিনবার গোছল করে। খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নখ সাফ করে। গলগলা করে কুলি করে। এমন মানুষ আরো আছে।’ অদ্ভূত লোকটা থালা টেবিলে রেখে নি:শব্দে চলে গেল। নিউটন মামা ড. আফজালের চোখে চোখ ফেলে বলল, ‘আপনি ওকে এভাবে করে রেখেছেন কেন?’ ‘সারা ভূতকাপাড়া এলাকাটা আমার। আমি পুরো এলাকাটা নিজের মতো করে গড়ে তুলেছি। ভূতের গল্প লিখতে হলে ভূতুড়ে পরিবেশের দরকার। বাইরে ভেতরে সবখানে। তোমার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে এতো তালগাছ কেন লাগানো হয়েছে। ভূতেরা তালগাছ ভালোবাসে। ভূতের পাগুলো সাধারণত লম্বা লম্বা হয়। জুতমত করে বসার জন্য ওদের লম্বা লম্বা গাছ লাগে। কোথাও কোথাও তেতুলগাছও দেখবে। মেয়েদের মতই এরা তেতুল খায়। তেতুলের শরবত খায়।’ ‘ভূত তেতুলের শরবত খাবে কেন?’ তেতুলের গুণাগুণ নিয়ে মনুষ্য সমাজ আগে কিছূই জানত না। ভূতেরা জানত। তেতুলের শরবত খেলে হাইপার টেনশন আর কাজ করতে পারে না। তাই ভূত সমাজে হাইপার টেনশন বলতে কোন জিনিস নেই। ড. আফজাল ইকবালের কথা যতই শুনছে অবাকের বৃত্তটা ততই বড় হচ্ছে মামার। কত্তো জানে এই লোকটা ! ড. আফজাল ঠোঁটে হাসি ছড়িয়ে বলল, ‘কী ভাবছো?’ ‘আপনার পরিবার কী এখানে থাকে না?’ ‘পরিবার থাকলেই তো থাকবে।’ ‘আপনি বিয়ে টা করেন নি?’ ‘বিয়ে না করলে মানুষ বিশ বছর বেশি বাঁচে। তুমি কোনটার পক্ষে?’ ‘আমি? আমি কী নিরপেক্ষ হয়ে থাকতে পারি না?’ ‘তুমি কী হিজড়া হয়ে যেতে চাও?’ ‘না না, কোন মতেই না।’

 

 

‘তাহলে?’ ‘বিষয়টা আমি আপনাকে পরে জানাবো, স্যার।’ ‘তুমি আমাকে কোন সময়ই স্যার বলবে না।’ ‘স্যার বলবো না?’ ‘যাঁর কাছে আমি লেখাপড়া করেছি শুধু তাঁদেরকেই স্যার বলি। আর কাউকেই না। ত্রিশ বছরের একটা ছেলেকে নবুবই বছরের একটা বুড়ো স্যার স্যার বলবে, বিষয়টা একদম বিচ্ছিরি না? অফিস আদালতে এসব স্যার স্যারকে আমি তু”ছাতি করি।’ ঢন ঢন ঢন তিনটে ঘড়ির ঘন্টার মতো শব্দ হলো। ঘন্টার মতো শব্দগুলো কোন পাশ থেকে এলো মামা আঁচ করতে পারল না ‘তুমি কী এখন উঠবে?’ ‘জি, জি স্যার।’ স্যার শব্দটা শুধু টিচারদের জন্য, মনে থাকবে তো? জি জি, থাকবে, অবশ্যই থাকবে।   কাল অনেকগুলো জায়গায় ঘুরেছে নিউটন মামা। নূপুর মার্কেট, নিউ মার্কেট, আন্দরকিল্লা সব জায়গায়। নূপুর মার্কেটে পুরনো বইয়ের দোকান থেকে একটা বিদেশি বই কিনে এনেছে। বইয়ের লেখক এ্যাডাম হুক। ৩৬০ পৃষ্টার বিশাল বই। বইটির নাম ‘ভূত গেছে প্রাসাদে’। আজ রাতেই বইটি পড়া শুরু করবে। এ্যাডাম হুক ইংল্যান্ডের লেখক। ভূত প্রাসাদ পর্যমত্ম রাজত্ব করছে। লেখক নিশ্চয় এ কথাগুলোও লিখে থাকবে। ড. আফজাল ইকবালের সাথে আলাপ করে ভূতের অস্থিত্বের বিষয়ে বিশ্বাসটা দ্বিগুণ তিনগুণে পৌঁছে গিয়েছে মামার। এতো জ্ঞান রাখে লোকটা! একজন লেখক হতে হলে যে জ্ঞানের পরিধি দরকার ডঃ আফজালের কাছে তার চেয়ে আরো বেশি মনে হয়েছে নিউটন মামার। ড. আফজাল ইকবাল মামার মাথার চুলের কথা বলেছে। মামার মাথার চুলগুলো জোড় না বিজোড়? মামার মাথায় কতো হাজার চুল আছে? মানুষের মাথার চুল কী এ পর্যমত্ম কেউ গুনে দেখেছে? একজন মানুষের শরীরে যতগুলো লোম আছে এই লোমগুলো কী বিজোড়? মামার মাথার ভেতর যখন জোড়-বিজোড়ের তুফান চলছে তখন ঘরে ঢুকল টিংকু আর পিংকু। টিংকু আর পিংকু হলো ফজু মিয়ার দুই ছেলে। ফজু মিয়ার স্ত্রী দু’দিন পরপরই নিউটন মামার বাড়িতে আসে। মা হাতের ভেতর গুঁজে গুঁজে কীসব দেয়। নিউটন মামা ওসব বিষয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করে না। টিংকু হলো ফজু মিয়ার বড় ছেলে। এবার ক্লাস সেভেনে ওঠেছে। ছেলে দুটোই মাশাল্লাহ। টিংকু ক্লাস ফাইভে বৃত্তি পেয়েছে। ক্লাস এইটের বৃত্তিও তার জন্য অপেক্ষা করছে হয়তো। টিংকু মামার টেবিলের পাশে এসে দাঁড়াল। টেবিলে ছড়ানো ভূতের বইগুলোর উপর চোখ গেল। এত্তো ভূতের বই দেখে ও চোখ দুটোকে পৃর্ণিমার চাঁদ বানাল। ‘এসব বই কি তোমার?’ টিংকু জিজ্ঞেস করল। ‘হ্যাঁ, কেন?’ ‘তুমি ভূতের বই পড়ো?’ ‘হ্যাঁ, পড়িতো।’ ‘পড়ো! ছোটরাই তো ভূতের বই পড়বে। তুমি পড়বে কেন?’ ‘পড়াতে কোন ছোট বড় নেই।’ ‘তুমি কী ভূত বিশ্বাস করো?’ ‘হ্যাঁ, করি।’ ‘ভূত কী রকম কেউ তো কোনদিন দেখেনি। যেটা কেউ কোনও দিন দেখেনি সেটা বিশ্বাস করার কী আছে?’ ‘তুমি বাতাস দেখেছো?’ ‘বাতাস!’ ‘হ্যাঁ, বাতাস।’ ‘বাতাস না দেখলেও ওর উপস্থিতি আমরা চবিবশ ঘন্টাই অনুভব করি।

 

 

’ ‘তুমি অন্ধকার কোন রাতে. অথবা আমাবস্যার কোন রাতে এদিক ওদিক হাঁটাহাঁটি করলে অবশ্যই ভূতের উপস্থিতি টের পাবে।’ ‘আমাবস্যা কখন মামা?’ ‘তুমি আমাকে মামা বলছো কেন, আমি কি তোমার মামা হই?’ ‘তুমি তো শুধু আমার না, তুমি হচ্ছো জগতের মামা, এমন কি তুমি গাছগাছালিরও মামা।’ পিংকুকে নিয়ে ফজু মিয়ার স্ত্রী ঢুকল। ফজু মিয়ার স্ত্রীর হাতে প্লাস্টিকের একটি ব্যাগ। ব্যাগের ভেতর কি যেন নড়াচড়া করছে। ব্যাগের দিকে মামার দু‘চোখ পড়েই থাকল। অন্য রুম থেকে ছুটে এলেন রিজিয়া খানম। ব্যাগের ভেতর কী সব নড়াচড়া দেখে তিনিও অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকলেন। ফজু মিয়ার স্ত্রীর দু’চোখ থেকে পানি নামছে গন্ড বেয়ে। মায়ের এমন চেহারা দেখে টিংকু পিংকুর চেহারাও বদলে গেল। ফজু মিয়ার স্ত্রী ধরা গলায় বলল, ‘আমি ওর হয়ে তোমাদের কাছে মাফ চাইতে এসেছি।’ রিজিয়া খানম কপাল কুঁচকে বলল, ‘মাফ! কিসের মাফ?’ ফজু মিয়ার স্ত্রী ব্যাগটা বাড়িয়ে বলল, ‘এখানে নয়টা কই মাছ আছে।’ ‘নয়টা কই মাছ! কই মাছ কার জন্য?’ ‘ কই মাছগুলো ফেরত দিতে এসেছি।’ ‘ আডুম বাগডুম কথা আমার একদম ভালো লাগে না। তোর কী আজ মাথা খারাপ হয়ে গেছে?’ ‘ আমার মাথা না, ওর মাথা খারাপ হয়ে গিয়েছিল।’ ‘ তুই কার কথা বলছিস?’ ‘ টিংকুর বাবার। সেদিন ঘরে কিছু ছিল না। রাত পৌনে এগারোটায় টিংকুর বাবা আমার সামনে একটা প্লাস্টিকের ব্যাগ থেকে নয়টি কই মাছ ঢেলে বলল, পাকাও। এতো বড় বড় কই মাছ দেখে আমার বুকের ভেতরে খুশির ঝিলিক ওঠল। ঝটপট কই মাছগুলো রান্না করে খেয়ে দেয়ে সেদিন মহানন্দে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু মাছের ঘটনাটা কাল রাতেই ওর মুখে শুনি। ভূত সেজে ও নিউটনের পিছু পিছু নিয়েছিল।’ নিউটন মামা চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞেস করল, ‘বোরখা পরা লোকটি টিংকুর বাবা ছিল? কোন ভূত টুত ছিল না?’ ‘না’ ‘কিন্তু গলার স্বর তো ভূতের মতই শুনেছিলাম?’ ‘ও হাজার রকমের স্বর পাল্টাতে পারে।

 

আমি টিংকু পিংকুকে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে যাবো। আমার এখানে আর একটুও ভালো লাগছে না। কেন যে আমার এখানে বিয়ে হয়েছিল!’ রিজিয়া খানম ফজু মিয়ার স্ত্রীর মাথায় হাত রাখল। কপালটা বুকে টেনে বলল, ‘এখানে বিয়ে না হলে তুই টিংকু পিংকুকে কোথায় পেতি? পাগলি কোথাকার! আমাদের বিল্ডিং এর কাজ শুরু হলে ফজু মিয়ার চাকরির একটা বিহিত হয়ে যাবে। এই কই মাছগুলো সেদিনের মত পাকিয়ে খাবি। ফজু মিয়ার পাতে তিন তিনটে দিবি। কী, দিবি তো?’। চোখ মুছতে মুছতে ফজু মিয়ার স্ত্রী বলল, ‘তিন তিনটে না , একটাও দেবো না।

’ টিংকু নিউটন মামার গা ঘেঁষে বলল, কি মামা, কী বুঝলে? নিউটন মামা মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল, মাথায় তো কিছুই ঢুকছে না। রিজিয়া খানম টিংকুর আম্মুকে নিয়ে অন্য রুমে চলে গেলেন। একসময় কাছে টেনে ফিসফিস করে বললেন, ‘একটা মহা উপকার করেছিস বোন। নিউটনের মাথায় ভূতের যে পোকা ঢুকেছিল তা আমি হাজার বছরেও বোধহয় নামাতে পারতাম না।’

আরো পড়তে পারেন...

সুবর্ণগোলক—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

কৈলাসশিখরে, নবমুকুলশোভিত দেবদারুতলায় শার্দ্দুলচর্ম্মাসনে বসিয়া হরপার্ব্বতী পাশা খেলিতেছিলেন। বাজি একটি স্বর্ণগোলক। মহাদেবের খেলায় দোষ এই-আড়ি…

বসন্ত এবং বিরহ—-বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

রামী। সখি, ঋতুরাজ বসন্ত আসিয়া ধরাতলে উদয় হইয়াছেন। আইস, আমরা বসন্ত বর্ণনা করি। বিশেষ আমরা…

গর্দ্দভ– বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়

হে গর্দ্দভ! আমার প্রদত্ত, এই নবীন সকল ভোজন করুন।১ , আমি বহুযত্নে, গোবৎসাদির অগম্য প্রান্তর…