কিন্তু জীবনের এই কয়টা দিনে বুঝিয়াছি যে , অসাধ্য অসম্ভব কিছুই নাই । নবাব-অন্তঃপুরের বালিকার পক্ষে বাহিরের সংসার একান্ত দুর্গম বলিয়া মনে হইতে পারে , কিন্তু তাহা কাল্পনিক ; একবার বাহির হইয়া পড়িলেই একটা চলিবার পথ থাকেই । সে পথ নবাবি পথ নহে , কিন্তু পথ ; সে পথে মানুষ চিরকাল চলিয়া আসিয়াছে — তাহা বন্ধুর বিচিত্র সীমাহীন , তাহা শাখাপ্রশাখায় বিভক্ত , তাহা সুখেদুঃখে বাধাবিঘ্নে জটিল , কিন্তু তাহা পথ ।
এই সাধারণ মানবের পথে একাকিনী নবাবদুহিতার সুদীর্ঘ ভ্রমণবৃত্তান্ত সুখশ্রাব্য হইবে না , হইলেও সে-সব কথা বলিবার উৎসাহ আমার নাই । এক কথায় , দুঃখকষ্ট বিপদ অবমাননা অনেক ভোগ করিতে হইয়াছে , তবু জীবন অসহ্য হয় নাই । আতসবাজির মতো যত দাহন ততই উদ্দাম গতি লাভ করিয়াছি । যতক্ষণ বেগে চলিয়াছিলাম ততক্ষণ পুড়িতেছি বলিয়া বোধ ছিল না , আজ হঠাৎ সেই পরম দুঃখের, সেই চরম সুখের আলোকশিখাটি নিবিয়া গিয়া এই পথপ্রান্তের ধূলির উপর জড়পদার্থের ন্যায় পড়িয়া গিয়াছি — আজ আমার যাত্রা শেষ হইয়া গেছে , এইখানেই আমার কাহিনী সমাপ্ত । ”
এই বলিয়া নবাবপুত্রী থামিল । আমি মনে মনে ঘাড় নাড়িলাম ; এখানে তো কোনো মতেই শেষ হয় না । কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া ভাঙা হিন্দিতে বলিলাম , “ বেয়াদবি মাপ করিবেন , শেষদিককার কথাটা আর-একটু খোলসা করিয়া বলিলে অধীনের মনের ব্যাকুলতা অনেকটা হ্রাস হয় । ”
নবাবপুত্রী হাসিলেন । বুঝিলাম , আমার ভাঙা হিন্দিতে ফল হইয়াছে । যদি আমি খাস হিন্দিতে বাৎ চালাইতে পারিতাম তাহা হইলে আমার কাছে তাঁহার লজ্জা ভাঙিত না , কিন্তু আমি যে তাঁহার মাতৃভাষা অতি অল্পই জানি সেইটেই আমাদের উভয়ের মধ্যে বৃহৎ ব্যবধান , সেইটেই একটা আব্রু ।
তিনি পুনরায় আরম্ভ করিলেন , “ কেশরলালের সংবাদ আমি প্রায়ই পাইতাম কিন্তু কোনোমতেই তাঁহার সাক্ষাৎ লাভ করিতে পারি নাই । তিনি তাঁতিয়াটোপির দলে মিশিয়া সেই বিপ্লবাচ্ছন্ন আকাশতলে অকস্মাৎ কখনো পূর্বে , কখনো পশ্চিমে , কখনো ঈশানে , কখনো নৈঋতে , বজ্রপাতের মতো মুহূর্তের মধ্যে ভাঙিয়া পড়িয়া , মুহূর্তের মধ্যে অদৃশ্য হইতেছিলেন ।
আমি তখন যোগিনী সাজিয়া কাশীর শিবানন্দস্বামীকে পিতৃসম্বোধন করিয়া তাঁহার নিকট সংস্কৃত শাস্ত্র অধ্যয়ন করিতেছিলাম । ভারতবর্ষের সমস্ত সংবাদ তাঁহার পদতলে আসিয়া সমাগত হইত , আমি ভক্তিভরে শাস্ত্র শিক্ষা করিতাম এবং মর্মান্তিক উদ্বেগের সহিত যুদ্ধের সংবাদ সংগ্রহ করিতাম ।
ক্রমে ব্রিটিশরাজ হিন্দুস্থানের বিদ্রোহবহ্নি পদতলে দলন করিয়া নিবাইয়া দিল । তখন সহসা কেশরলালের সংবাদ আর পাওয়া গেল না । ভীষণ প্রলয়ালোকের রক্তরশ্মিতে ভারতবর্ষের দূরদূরান্তর হইতে যে-সকল বীর-মূর্তি ক্ষণে ক্ষণে দেখা যাইতেছিল , হঠাৎ তাহারা অন্ধকারে পড়িয়া গেল ।
তখন আমি আর থাকিতে পারিলাম না । গুরুর আশ্রয় ছাড়িয়া ভৈরবীবেশে আবার বাহির হইয়া পড়িলাম । পথে পথে , তীর্থে তীর্থে , মঠে মন্দিরে ভ্রমণ করিয়াছি , কোথাও কেশরলালের কোনো সন্ধান পাই নাই । দুই-একজন যাহারা তাহার নাম জানিত , কহিল , ‘ সে হয় যুদ্ধে নয় রাজদণ্ডে মৃত্যু লাভ করিয়াছে । ‘ আমার অন্তরাত্মা কহিল , ‘ কখনো নহে , কেশরলালের মৃত্যু নাই । সেই ব্রাক্ষ্মণ সেই দুঃসহ জলদগ্নি কখনো নির্বাণ পায় নাই , আমার আত্মাহুতি গ্রহণ করিবার জন্য সে এখনো কোন্ দুর্গম নির্জন যজ্ঞবেদীতে উর্ধ্বশিখা হইয়া জ্বলিতেছে । ‘
হিন্দুশাস্ত্রে, আছে জ্ঞানের দ্বারা তপস্যার দ্বারা শূদ্র ব্রাক্ষ্মণ হইয়াছে , মুসলমান ব্রাক্ষ্মণ হইতে পারে কি না সে-কথার কোনো উল্লেখ নাই, তাহার একমাত্র কারণ; তখন মুসলমান ছিল না । আমি জানিতাম কেশরলালের সহিত আমার মিলনের বহু বিলম্ব আছে , কারণ তৎপূর্বে আমাকে ব্রাক্ষ্মণ হইতে হইবে । একে একে ত্রিশ বৎসর উত্তীর্ণ হইল । আমি অন্তরে বাহিরে আচারে ব্যবহারে কায়মনোবাক্যে ব্রাক্ষ্মণ হইলাম , আমার সেই ব্রাক্ষ্মণ পিতামহীর রক্ত নিষ্কলুষতেজে আমার সর্বাঙ্গে প্রবাহিত হইল , আমি মনে মনে আমার সেই যৌবনারম্ভের প্রথম ব্রাক্ষ্মণ , আমার যৌবনশেষের শেষ ব্রাক্ষ্মণ , আমার ত্রিভুবনের এক ব্রাক্ষ্মণের পদতলে সম্পূর্ণ নিঃসংকোচে আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়া একটি অপরূপ দীপ্তিলাভ করিলাম ।
যুদ্ধবিপ্লবের মধ্যে কেশরলালের বীরত্বের কথা আমি অনেক শুনিয়াছি , কিন্তু সে কথা আমার হৃদয়ে মুদ্রিত হয় নাই । আমি সেই যে দেখিয়াছিলাম নিঃশব্দে জ্যোৎস্নানিশীথে নিস্তব্ধ যমুনার মধ্যস্রোতে একখানি ক্ষুদ্র নৌকার মধ্যে একাকী কেশরলাল ভাসিয়া চলিয়াছে , সেই চিত্রই আমার মনে অঙ্কিত হইয়া আছে । আমি কেবল অহরহ দেখিতেছিলাম , ব্রাক্ষ্মণ নির্জন স্রোত বাহিয়া নিশিদিন কোন্ অনির্দেশ মহারহস্যাভিমুখে ধাবিত হইতেছে, তাহার কোনো সঙ্গী নাই , কোনো সেবক নাই , কাহাকেও তাহার কোনা আবশ্যক নাই , সেই নির্মল আত্মনিমগ্ন পুরুষ আপনাতে আপনি সম্পূর্ণ ; আকাশের গ্রহচন্দ্রতারা তাহাকে নিঃশব্দে নিরীক্ষণ করিতেছে ।
এমনসময় সংবাদ পাইলাম কেশরলাল রাজদণ্ড হইতে পলায়ন করিয়া নেপালে আশ্রয় লইয়াছে । আমি নেপালে গেলাম । সেখানে দীর্ঘকাল বাস করিয়া সংবাদ পাইলাম , কেশরলাল বহুকাল হইল নেপাল ত্যাগ করিয়া কোথায় চলিয়া গিয়াছে কেহ জানে না ।
তাহার পর পাহাড়ে পাহাড়ে ভ্রমণ করিতেছি । এ হিন্দুর দেশ নহে — ভুটিয়া-লেপ্চাগণ ম্লেচ্ছ , ইহাদের আহারব্যবহারে আচারবিচার নাই , ইহাদের দেবতা, ইহাদের পূজার্চনাবিধি সকলই স্বতন্ত্র। বহুদিনের সাধনায় আমি যে বিশুদ্ধ শুচিতা লাভ করিয়াছি , ভয় হইতে লাগিল , পাছে তাহাতে রেখামাত্র চিহ্ন পড়ে । আমি বহু চেষ্টায় আপনাকে সর্বপ্রকার মলিন সংস্পর্শ হইতে রক্ষা করিয়া চলিতে লাগিলাম । আমি জানিতাম , আমার তরী তীরে আসিয়া পৌঁছিয়াছে , আমার জীবনের চরমতীর্থ অনতিদূরে ।
তাহার পরে আর কী বলিব । শেষ কথা অতি অল্প । প্রদীপ যখন নেবে তখন একটি ফুৎকারেই নিবিয়া যায় , সেকথা আর সুদীর্ঘ করিয়া কী ব্যাখ্যা করিব ।
আটত্রিশ বৎসর পরে এই দার্জিলিঙে আসিয়া আজ প্রাতঃকালে কেশরলালের দেখা পাইয়াছি ।
বক্তাকে এইখানে ক্ষান্ত হইতে দেখিয়া আমি ঔৎসুক্যের সহিত জিজ্ঞাসা করিলাম , “ কী দেখিলেন । ”
নবাবপুত্রী কহিলেন , “ দেখিলাম , বৃদ্ধ কেশরলাল ভুটিয়াপল্লীতে ভুটিয়া স্ত্রী এবং তাহার গর্ভজাত পৌত্রপৌত্রী লইয়া ম্লানবস্ত্রে মলিন অঙ্গনে ভুট্টা হইতে শস্য সংগ্রহ করিতেছে । ”
গল্প শেষ হইল। আমি ভাবিলাম , একটা সান্ত্বনার কথা বলা আবশ্যক । কহিলাম , “ আটত্রিশ বৎসর একাদিক্রমে যাহাকে প্রাণভয়ে বিজাতীয়ের সংস্রবে অহরহ থাকিতে হইয়াছে সে কেমন করিয়া আপন আচার রক্ষা করিবে । ”
নবাবকন্যা কহিলেন , “ আমি কি তাহা বুঝি না । কিন্তু এতদিন আমি কী মোহ লইয়া ফিরিতেছিলাম! যে ব্রক্ষ্মণ্য আমার কিশোর হৃদয় হরণ করিয়া লইয়াছিল আমি কি জানিতাম তাহা অভ্যাস তাহা সংস্কার মাত্র । আমি জানিতাম তাহা ধর্ম , তাহা অনাদি অনন্ত । তাহাই যদি না হইবে তবে ষোলোবৎসর বয়সে প্রথম পিতৃগৃহ হইতে বাহির হইয়া সেই জ্যোৎস্নানিশীথে আমার বিকশিত পুষ্পিত ভক্তিবেগকম্পিত দেহমনপ্রাণের প্রতিদানে ব্রাক্ষ্মণের দক্ষিণ হস্ত হইতে যে দুঃসহ অপমান প্রাপ্ত হইয়াছিলাম , কেন তাহা গুরুহস্তের দীক্ষার ন্যায় নিঃশব্দে অবনত মস্তকে দ্বিগুণিত ভক্তিভরে শিরোধার্য করিয়া লইয়াছিলাম । হায় ব্রাক্ষ্মণ , তুমি তো তোমার এক অভ্যাসের পরিবর্তে আর-এক অভ্যাস লাভ করিয়াছ , আমি আমার এক যৌবন এক জীবনের পরিবর্তে আর-এক জীবন যৌবন কোথায় ফিরিয়া পাইব । ”
এই বলিয়া রমণী উঠিয়া দাঁড়াইয়া কহিল , “ নমস্কার বাবুজি! ”
মুহূর্তপরেই যেন সংশোধন করিয়া কহিল , “ সেলাম বাবুসাহেব! ” এই মুসলমান অভিবাদনের দ্বারা যে যেন জীর্ণভিত্তি ধূলিশায়ী ভগ্ন ব্রক্ষ্মণ্যের নিকট শেষ বিদায় গ্রহণ করিল । আমি কোনো কথা না বলিতেই সে সেই হিমাদ্রিশেখরের ধূসর কুজ্ঝটিকারাশির মধ্যে মেঘের মতো মিলাইয়া গেল ।
আমি ক্ষণকাল চক্ষু মুদ্রিত করিয়া সমস্ত ঘটনাবলী মানসপটে চিত্রিত দেখিতে লাগিলাম । মছলন্দের আসনে যমুনাতীরের গবাক্ষে সুখাসীনা ষোড়শী নবাব বালিকাকে দেখিলাম , তীর্থমন্দিরে সন্ধ্যারতিকালে তপস্বিনীর ভক্তিগদগদ একাগ্র মূর্তি দেখিলাম , তাহার পরে এই দার্জিলিঙে ক্যালকাটা রোডের প্রান্তে প্রবীণার কুহেলিকাচ্ছন্ন ভগ্নহৃদয়ভারকাতর নৈরাশ্যমূর্তিও দেখিলাম, একটি সুকুমার রমণীদেহে ব্রাক্ষ্মণমুসলমানের রক্ততরঙ্গের বিপরীত সংঘর্ষজনিত বিচিত্র ব্যাকুল সংগীতধ্বনি সুন্দর সুসম্পূর্ণ উর্দু ভাষায় বিগলিত হইয়া আমার মস্তিষ্কের মধ্যে স্পন্দিত হইতে লাগিল ।
চক্ষু খুলিয়া দেখিলাম , হঠাৎ মেঘ কাটিয়া গিয়া স্নিগ্ধ রৌদ্রে নির্মল আকাশ ঝলমল করিতেছে , ঠেলাগাড়িতে ইংরাজ রমণী ও অশ্বপৃষ্ঠে ইংরাজ পুরুষগণ বায়ুসেবনে বাহির হইয়াছে , মধ্যে মধ্যে দুই-একটি বাঙালীর গলাবন্ধ বিজড়িত মুখমণ্ডল হইতে আমার প্রতি সকৌতুক কটাক্ষ বর্ষিত হইতেছে ।
দ্রুত উঠিয়া পড়িলাম , এই সূর্যালোকিত অনাবৃত জগৎদৃশ্যের মধ্যে সেই মেঘাচ্ছন্ন কাহিনীকে আর সত্য বলিয়া মনে হইল না । আমার বিশ্বাস , আমি পর্বতের কুয়াশার সহিত আমার সিগারেটের ধূম ভুরিপরিমাণে মিশ্রিত করিয়া একটি কল্পনাখণ্ড রচনা করিয়াছিলাম- সেই মুসলমানব্রাক্ষ্মণী , সেই বিপ্রবীর , সেই যমুনাতীরের কেল্লা, কিছুই হয়ত সত্য নহে ।