কোনো কথা না বলে লোকটা বিচিত্র কায়দায় কয়েন খুঁজতে খুঁজতে একসময় দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেল। ভাল, আপনমনে বলল মহিব, কাজটা তো মন্দ নয়! আচ্ছা, আমি তো টহল দেবার কাজ করি, আমি কেন মাটির দিকেও একটু নজর দিই না? দুয়েকটি ডলার তো পেয়েও যেতে পারি। সে রাতে মহিব দশ সেন্টের একটি কয়েন কুড়িয়ে পেল। পোস্টে ফিরে এসে ভাবল : কুড়ি ডলার! গড়পরতায় প্রতিদিন মানে প্রতিরাতে কুড়ি ডলার পেলে তো বেশ ভারিক্কি চালেই দিন চলে যাবার কথা। কুড়ি ডলার মানে বাংলাদেশের চোদ্দশ টাকা।
কেবল টহল আর টহল। অর্থহীন মনে হয়। অনেকদিন ভান করেছে মহিব। নিজেকে বলেছে: বেশ এনজয় করছি কাজটা। কিন্তু মনকে তো আর ফাঁকি দেয়া যায় না। প্লাজার দক্ষিণ দিকের সর্বশেষ একতলা একটি লম্বাটে কক্ষ মহিবের ফ্রন্টডেস্ক অফিস। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় রাতভর তাকে টহল দিয়ে বেড়াতে হয়। ঠাণ্ডা, ঝুঁকি আর রাতজাগা। রাত্রিজাগরণ এককভাবে বহুমুখী সমস্যার জন্ম দেয়। মড়ার ওপর খাঁড়ার ঘা হল বাসা থেকে কর্মস্থলের দূরত্ব। এই দূরত্ব যদি বাংলাদেশে কোনো স্থানে হত তাহলে আর দেখতে হত না। এত লম্বা পথ মসৃণভাবেই পাড়ি দেয় মহিব। তাই কিছুটা রক্ষা।
চেকপোস্টের কামরাটা লম্বাটে। ফ্রন্টডোরটা কাচের ও স্টিলের পাত বসানো। ভেতরে বিশাল একটি হলঘর, তারপর ছোট্ট একটা রুম আর সবশেষে ওয়াশরুম। এই চেকপোস্টটা অক্সি টেকনোলজির অস্থায়ী কার্যালয়। মহিবের মূল চাকরিটা এখানে না, যে সিকিউরিটি কোম্পানিতে সে চাকরি করে, তারা ওকে নিয়োগ দিয়েছে এখানে। কাজ শুরু হয়ে গেছে অক্সির। বিশাল একটা জায়গা জুড়ে বসানো হয়েছে লোহার ফেন্স। সাইটের পশ্চিমদিকে গ্রিল ঘেরা স্থানে রাখা হয়েছে আজদাহা যান্ত্রিক দানবগুলো-ববক্যাট, অ্যাক্সকেভেটর, পিকআপ ভ্যান, টন টন ওজনের গারবেজ রিসাইকল মেশিন। লিফটার এবং আরো নানা যন্ত্রপাতি। এতদিন মহিব জানত না কী কাজ হবে এখানে। প্লাজার কয়েন ওয়াশ লণ্ড্রির কর্মচারি ফিলিপিনো রবার্ট যেন ঘাপটি মেরে ছিল। মহিবের কাছে এসে একরাতে বলল, অ্যাশফল্টের কাজই তো হবে, নাকি?
কী বলবে মহিব? একটু সময় নিয়ে মাঝামাঝি ধরনের একটা উত্তর দিল। বলল, সেটা তো হবেই। আরো অনেক গণ্ডগোল হয়ে গেছে। দেখছ না মাটির কালার কেমন বিবর্ণ? প্রবলভাবে সম্মতির ঘাড় নাড়ল রবার্ট। যেন মহিবের এই একটি উত্তরে সমস্ত কিছু সে বুঝে নিল। রবার্ট বৃদ্ধ, রিটায়ারমেন্টের পর এখন লণ্ড্রিতে পার্টতাইম কাজ করছে। কোনো সূত্র থেকে বা সাইট দেখার পরও মহিব বুঝতে পারছিল না প্রকৃত কী কাজ হবে এখানে। ওর চেকপোস্ট ঘেঁষে দক্ষিণ পশ্চিমের বাইরোড এবং প্লাজার পুরো চত্বরই অ্য্যাশফল্টের তৈরি। কিন্তু তা স্থানে স্থানে ক্ষয়ে গিয়ে বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা হয়েছে। এ থেকে ধারণা করা যায় পুরো প্লাজা এবং বাইরোডে অ্যাশফল্টের কাজই হবে।
কিন্তু অক্সির রকমসকম তো তেমন মনে হচ্ছে না। অ্যাশফল্টের কাজ করতে বা সড়ক সংস্কার করতে যেসব ম্যাটেরিয়ালস আর মেশিন দরকার, সেসব তো এখানে দেখা যাচ্ছে না। আরেকটি বিষয় ভাবিয়ে তুলেছে মহিবকে- আশপাশের দোকানিরা জানতে চাইছে কতদিন লাগবে কাজ শেষ হতে। এরকম প্রশ্ন করার যুক্তিও আছে। কাজটাকে ওরা উটকো ঝামেলা মনে করছে। ফেন্স দেবার কারণে তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয়ে গেছে। এরা চাইছে পাশের বাইরোড বা প্লাজার চত্বর দ্রুত পাকা হয়ে উঠুক। কিন্তু এত সময় লাগছে কেন? রাস্তা বা চত্বর পাকা করতে হলে করে ফেলো না। এত দহরম মহরম কেন?
বিষয়টা ভাবনায় ফেলার মতো। কাজটা যে সাধারণ কোনো কিছু না সেটা ঠাওর করা যাচ্ছে। বড়সড় কোনো ব্যাপার ঘটতে যাচ্ছে। কিন্তু মাত্র দু’জন লোক কাজ করছে। জন আর রাজমা। দু’জনেই জন্মসূত্রে কানাডিয়। জন প্রজেক্ট সুপারভাইজার আর রাসমা হেলথ ও সেফটি অফিসার। জন ওয়াকিটকি হাতে ছুটে বেড়াচ্ছে আর রাজমা যা করে বা করছে, তা দেখার মতো। বেঁটে মোটা ও মাঝারি বয়সের এই মহিলা সব কাজ একাই সারছে। চেকপোস্টের বিশাল ঘর ঝাঁট দিচ্ছে নিজে। ছুটাছুটি করছে কনস্ট্রাকশনজনিত দুর্ঘটনা বা অসুস্থতা নিয়ন্ত্রণে সার্বিক ব্যবস্থা নিতে। গত কয়দিনের ডিউটির সুবাদে মহিব দেখল মহিলা চেকপোস্টটাকে একটা হাসপাতাল বানিয়ে ফেলেছে। অনটারিও প্রদেশের স্বাস্থ্য নীতিমালা, মিউনিসিপ্যালের স্বাস্থ্যবিষয়ক আদেশ-নির্দেশ, ফায়ার সেফটির যাবতীয় নোটিস সে ঝুলিয়ে দিয়েছে। ফার্স্ট এইড বক্স, ফায়ার এক্সটিঙ্গুইশার, এমার্জেন্সি আই ওয়াশ প্রভৃতি স্থাপন করেছে সে রুমটায়। হেলমেট পরার, মাক্স লাগানোর নির্দেশনা স্থানে স্থানে ঝুলিয়ে দিয়েছে। কাজকারবার দেখে মনে হচ্ছে এটি ভূমিকম্প পরবর্তী কোনো মেডিক্যাল টিমের তৎপরতা। সাইটের লোহার ফেন্সের যত্রতত্র ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে : CONSTRUCTION SITE. MUST BE WORN : HARD CAPS, SAFETY SHOES. মহিব মহিলার এই প্রাণান্তকর প্রচেষ্টা দেখে মহিলার হয়ে চেকপোস্টটা ঝাঁট দিয়ে দিল। আমাদের দেশে এরকম একজন পদস্থ মহিলার একজন কম্পিউটার অপারেটর, একজন পিওন, একজন ম্যাসেঞ্জার ও একজন ক্লিনার লাগত। তারপরও সেই পদস্থ অফিসার লোকবল বাড়ানোর জন্য কর্তৃপক্ষের কাছে হয়তো পত্র দিত। রাজমা ও জনের কাণ্ডকীর্তি যে হেলার নয়, তা স্পষ্ট করে দিল অক্সির জিওলজিস্ট টেড। সে ভোরে মনোগ্রাম লেখা পিকআপ চালিয়ে সাইটে আসে। এক ভোরে গাড়ির ভেতরে বসে কাগজপত্র দেখছিল সে। মহিব গিয়ে বলল, তুমি অফিসঘরে এসে বসতে পারো। লোকটা বড় ও দামি ব্যক্তি। কিন্তু মহিবের আমন্ত্রণকে সে আদেশ মান্য করে লাফ দিয়ে পিকআপ থেকে নেমে অফিসে ঢুকল। বিনয়ের সাথে বলল, ওয়াশরুমটা ব্যবহার করতে পারি?