ঠিক আছে, বলব। রোজমেরি এগিয়ে এসে দরজা খুলে দিল।
অফ-ডে গুলো ফুড়ুৎ করে উড়ে যায়। দুইদিন ঘরে বসে থেকে মহিবের মনে হল ভেরেণ্ডা ভেজেছে সে। বেশ ক’বার কল করেও শ্রীরাধাকে যখন সেলফোনে পাওয়া গেল না, তখন চট করে আরেকবার ওয়াইডব্লিওসিএ ঘুরে এলে কী হত। শেষমুহূর্তে মানে, রাত সাড়ে দশটায় মহিব সিদ্ধান্তে এল ওয়াইডব্লিওসিতে যাবে। অথচ কাল ভোরে আবার ডিউটি।
স্বল্প সময়ের ব্যবধানে মহিবকে দেখে কিছুটা অবাক হল লেসলি। মহিব বলল, জরুরি কাজ আছে। বন্ধুকে সেলফোনে পাচ্ছি না। সেকেণ্ড ফ্লোরের সেই কক্ষে এল আবার। নক করে করে ক্লান্ত হয়ে গেল মহিব। কেউ দরজা খুলল না। উদ্বিগ্ন হল – শ্রীরাধাকে সেলফোনে পাওয়া যাচ্ছে না, রোজমেরিকে কক্ষে পাওয়া যাচ্ছে না – এ যে বড় মুশকিলের কথা। ভুল হয়ে গেছে রোজমেরির সেল নাম্বারটা না নিয়ে।
অ্যাপার্টমেন্টের আরামদায়ক বিছানায় শুয়ে অ-আরামপ্রদ চিন্তাগুলো আসছিল। মেয়েটা একদম গায়েব হয়ে গেল! মরেটরে যায়নি তো? রোজমেরিই বা কোন্ জাহান্নমে উধাও হল? দুইটাই কি একসাথে মরল? অভিমান জমল মহিবের মাঝে। শখের বিছানায় বেশিক্ষণ শুয়ে থাকা যাবে না। ভোর চারটায় উঠে যেতে হবে। মহিবের সেলফোন বেজে উঠল। রাত একটায় কে ফোন করল? সেলফোনটা হাতে নিয়ে দেখল নাম্বারটা অপরিচিত। একটু ইতস্তত করে শেষ মুহূর্তে রিসিভ করল মহিব। অন্যপ্রান্ত থেকে একটা নারীকণ্ঠ বলল, রোজমেরি বলছি।
রোজমেরি! শোয়া থেকে উঠে বসে মহিব। তারপর গড়গড় করে বলে গেল – তোমার স্যুইটে গিয়েছিলাম বিকেলে। তোমাকে পেলাম না। শ্রীরাধাকে তো সেলফনে পাচ্ছি না, ব্যাপারটা কী বল তো!
কোনোরকম গৌরচন্দ্রিকা না করে বলে ফেলি, মহিব। রোজমেরি ভারী গলায় বলল, শ্রীরাধা মারা গেছে। ও আত্মহত্যা করেছে।
কী বললে তুমি! কবে? কীভাবে?
তিনদিন হয়ে গেল। তোমাকে জানাতে পারছিলাম না। শেষে সিকিউরিটি অফিসার লেসলির কাছে তোমার সেল নাম্বার পেলাম।
আমি আসছি এখুনি রোজমেরি।
কোথায়!
তোমার স্যুইটে।
না, মহিব। আমার ভাল লাগছে না। গত তিনদিন পুলিস-হাসপাতাল করে আমি খুব ক্লান্ত।
কিন্তু রোজমেরি, আমি যে অন্ধকারে ডুবে আছি। কিছুই জানতে পারলাম না!
ইস্টইয়র্ক হাসপাতালের মর্গে এখনো লাশ আছে। পুলিস আর হাসপাতাল লাশ নিয়ে আরো কয়েকদিন নাকি গবেষণা করবে। শ্রীরাধা ২৭ তলা থেকে পড়েছে। লাশ দেখে একজন কনস্টেবল অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সেই লাশ আমাকে দেখতে হয়েছে সনাক্ত করার জন্য।
শ্রীরাধা এখন এমনই বীভৎস! মহিবের কণ্ঠটা ধরে এল। না, রোজমেরি। শ্রীরাধা এরকম নারকীয়ভাবে মরতে পারে না। ওকে মেরে ফেলা হয়েছে। তুমি বুঝতে পারছ রোজমেরি কী বলছি আমি?
পারছি। ওর হাজব্যাণ্ডকে আটক করে জিজ্ঞাসাবাদ করছে পুলিস।
শ্রীরাধা মরবার পর মহিব সিকিউরিটির চাকরি ছেড়ে দিল। প্রস্তুতি নিচ্ছিল দেশে ফিরে যাবার। নিষ্ঠুর নিয়তির টানে এভাবেই হয়তো বাকি জীবনটা কাটিয়ে দিতে হবে নিস্ফলতায় আর আত্মদাহে। এইসময় নিঃসঙ্গ মনের আকাশে উঁকি দিল যূঁথি। চাকরি ছেড়ে দিয়ে হাতপায়ে যখন খিল ধরে যাচ্ছিল, তখন একটা ভলান্টারি কাজে যোগ দেয় মহিব। একটা শিশু অধিকার প্রতিষ্ঠানের জন্য বাড়ি বাড়ি গিয়ে ফাণ্ড তোলার কাজ। সেখানে কাজ করত যূঁথি ও জেবা। দুই বান্ধবী। ওরিয়েন্টেশনে ওদের সাথে পরিচয়। যূঁথি সেন্টেনিয়্যাল কলেজে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছিল সরকারি অর্থায়নে। টরোন্টোতে খুব বেশি দিন হয়নি। এসেছে নিজের প্রচেষ্টায়। বাংলাদেশে সে একটা এনজিওতে চাকরি করত। আর জেবা অনেকবছর যাবৎ এই দেশে আছে। বাংলাদেশে ওরা দু’জন একই স্কুলে পড়ত।
প্রস্তাবটা এল জেবার কাছ থেকে, অনেকটা চমকে দেবার মতো। যূঁথি একাকী জীবন যাপনে হাঁপিয়ে উঠেছে। জেবার কথায় – দু’জনেই যখন একাকী, তখন পরস্পরের সঙ্গী হলে দোষ কী? সুতরাং যূঁথি মহিবের একাকী জীবনের সঙ্গী হল, আর মহিবও যূঁথির অনুর্বর জীবনটাকে রাঙিয়ে দিল প্রত্যাশার বর্ণিল প্রচ্ছায়ায়।
মাঝেমাধ্যেই শ্রীরাধার সুশ্রী অবয়ব উঁকি দিয়ে যায় মনে, তার কাচভাঙা হাসি কর্ণে সুধাবর্ষণ করে মহিবের শয়নে স্বপনে। মহিব কখনো কখনো আনমনা হয়ে যায়। এই দিকটা চোখ এড়াল না যূঁথির। মহিবকে সতর্ক করে এবং জোর করে চাকরির সন্ধানে পাঠায়। মহিব জোগাড় করে ফেলল ঠিকই একটা সুপারস্টোরে সেলস অ্যাসিস্ট্যান্ট রূপে। খুশি হয় যূঁথি। ওর শিক্ষাকালীন অনুদানের টাকা আর মহিবের চাকরির টাকায় বেশ ভাল চলে যাবে ওদের। ড্রাইভিং লাইসেন্স হল দুই জনেরই। গাড়িও কিনল দুইজন একসাথে। ভাল অ্যাপার্টমেন্টে উঠে গেল ওরা। কেটে গেল তিনটি বছর। কিন্তু অভাগা যেদিকে…। কে অভাগা? মহিব নাকি যূঁথি? ভাগ্যটা আসলে কী? দু’জনেই তো ভাবতে পারে – আমার ভাগ্যটাই মন্দ। কেন এমন হল? কেন এমন হয়?
দুই জনেরই বয়স হয়েছে। বাচ্চা নেবার তাড়া ও আকুলতা দু’জনারই। কিন্তু বাচ্চা হচ্ছিলনা ওদের। খিটিমিটি শুরু হল। মহিব ভেঙে পড়ল বেশি। বাচ্চা নেবার আকুলতা তারও কোনো অংশে কম নয়। অথচ আহতচিত্তে সে শুনল সব ক’টা ডাক্তার ওকেই অঙ্গুলিনির্দেশ করছে : ত্রুটিটা আপনার। কীসের ত্রুটি? কেন ত্রুটি! এরকম ত্রুটি না হলে হত না! ওর ক্ষেত্রে ভাগ্য এমনভাবে বেঁকে বসল কেন?
যূঁথি একদিন চলে গেল। মহিবের কলিগ জেন একদিন বলল – কেন ত্রুটি, কার ত্রুটি তার চেয়ে বড় কথা হচ্ছে কত কুপল এমন সন্তানবিহীন পার করে দিচ্ছে। তোমাদের ক্ষেত্রে কেন এমনটা হল ভেবে পাচ্ছি না।
মন্দ নসিব। মহিব বলল।
একটা ভেগ টার্ম মহিব, ক্ষেপে গিয়ে বুড়ি বলল, তোমাদের গণ্ডায় গণ্ডায় ছানা হলেই যে তোমরা হ্যাপি কুপল হতে পারতে তার গ্যারান্টি কী?
জেনের কথায় যুক্তি আছে। মহিব উত্তর খুঁজে পায়না। যূঁথির চলে যাওয়াটা মহিবের কাছে এমনি অস্বভাবী একটা ঘোরের মতো যে, মহিব চেষ্টা করেও সেই ঘোরের ঘেরাটোপ থেকে বেরুতে পারেনি। জেন হাতের কাজ শেষ করে মহিবের কাছে এল। মহিবের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল – মন খারাপ করো না। হয়তো ত্রুটিটা তোমার। উন্নতচিকিৎসায় সেটা তো সেরেও যেতে পারে। তাছাড়া, এমনও হতে পারে যে এতদিনে তোমার মধ্যের ত্রুটি হয়তো এখন আর নেই। তুমি বরং ফের বিয়ে কর।
ধন্যবাদ, জেন। মহিব একটু হাসল। বলল, প্রার্থনা কর তেমনটিঈ যেন হয়। তোমার কথায় অনুপ্রাণিত বোধ করছি।
মহিব সুপারস্টোরের চাকরি ছেড়ে ফিরে গেল সেই পুরনো পেশায়। থিসলডাউন প্লাজায় একদিন উদ্দেশ্যবিহীন ঘুরছিল সে। সেই প্রজেক্টসাইট আর নেই, কাজ সমাপ্ত। মহিব বিক্ষিপ্ত চিত্তে ঘুরাফেরা করে। সেইসময় নজরে পড়ে নোটিসটা-প্লাজার জন্য সিকিউরিটি গার্ড নেয়া হবে। মহিব প্লাজার অফিসে যোগাযোগ করল। ওর অভিজ্ঞতা, বিশেষভাবে এই চত্বরে কাজ করার সুবাদে তাৎক্ষণিকভাবে চাকরি হয়ে গেল। এবার কোনো সিকিউরিটি কোম্পানির মাধ্যমে না, সরাসরি প্লাজা কর্তৃপক্ষ ওকে নিয়ে নিল। এটা শুভ দিক।
টহলের সময় পরিচিত অপরিচিত অনেকের সাথেই দেখা হয়। এমনি একদিন দেখা হল জেবার সাথে। বিয়ের অনুষ্ঠান, বিয়ে পরবর্তী সংসারজীবন – সবটাতেই জেবা ছিল ওদের নিত্যসাথী। জেবা ওয়ালমার্টে কাজ করে। বিয়ে করেনি কখনো। করবেও না। নিজস্ব বাড়ি, গাড়ি আর প্রাচুর্য, সব আছে তার। কিন্তু কী একটা যেন তার নেই। কী সেটা সে কখনো কাউকে বলেনি।
জেবা বলল, আপনাদের বিচ্ছেদটা আনএক্সপেক্টেড। সংসারটা টিকে থাকা উচিৎ ছিল।
আমি চেষ্টা করেছি। মহিব বলল।
জানি। জেবার কণ্ঠে সহানুভূতির সুর, আপনাকে ঠিকই চিনেছি। কী বলব? যূঁথি আমার বান্ধবী। ওকে আমি ফেরাতে চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু পারিনি। সে আবার বিয়ে করেছে জানতেন? তা-ও তো এক বছরের ওপর হয়ে গেল। আপনি জানতেন না, তাই না?
না, মহিব বলল, জানতে চাইনি। ঠিক রুচির মধ্যে পড়েনা।
রাইট, একটা বিষয় আপনাকে বলেই ফেলি। যাকে যূঁথি এবার বিয়ে করেছে তার পয়সা আছে, কিন্তু বয়সটা খুব বেশি। সেটা অবশ্যি যূঁথির একান্তই নিজস্ব বিষয়। কিন্তু পরের বিষয়টি খুব খারাপ।
কী সেটা!
আর বলবেন না। যূঁথির সন্তান এবারও হবে না। ও ভীষণ ভেঙে পড়েছে। সারাক্ষণ কেবল কাঁদে। আপনাকে আঘাত দিয়ে ও ভুল করেছে জানি, কিন্তু আফটার অল, আমার ছোটবেলার বন্ধু তো। তাই ওর জন্য কষ্ট লাগে।
সন্তান হবে না কেন?
এবার নাকি সমস্যাটা যূঁথির, ডাক্তার বলেছে, ভদ্রলোকের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা যূঁথির।
কিন্তু… মহিব কিছু বলতে গেল।
আপনাদের সময় ত্রুটি আপনার ছিল, যূঁথি ছিল সক্ষম। এখন উল্টোটা হয়েছে।
কেন! এর বেশি কিছু বলতে পারল না মহিব।
এরকম হতে পারে, কার কখন কোন্ রোগ বা সমস্যা হবে – সেটা তো আগাম বলা যায়না। তবে বিষয়টা দুঃখজনক। যাইহোক, কেমন চলছে দিনকাল? একদিন আসুন না আমার বাসায়।
আসব। মহিব বলল।
এরপর জেবা ঢুকে গেল শপারস ড্রাগ মার্টে। সেদিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে থাকে মহিব। যেন স্বপ্ন দেখছে সে, স্বপ্নটা ভাঙতে সময় লাগবে। মনের মধ্যে ঘুরপাক খায় একটি নাম। এই নামটা মহিব মন থেকে চিরতরে মুছে ফেলতে চায়। মহিবের মনে হয়, এবার ডাক্তারের কাছে গেলে ডাক্তার নিশ্চয়ই বলবে – শুভকাজটা শিগগির সেরে ফেলুন। আপনার বাচ্চা হবে গণ্ডায় গণ্ডায়।
তারা সব প্রহরী হবে বড় হয়ে। মহিব বিড়বিড় করে বলল। কয়েক ফোঁটা জল গড়াল ওর চিবুক বেয়ে। চোখের জলটুকু মুছে নিয়ে হাঁটতে লাগল প্লাজার উত্তর প্রান্তের উদ্দেশ্যে। মহিব সগর্বে টহল দিয়ে বেড়ায় আর মনে মনে বলে – আমি থিসলডাউনের প্রহরী।
গল্পের ১ম অংশ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
"আলোর পথ"-এ প্রকাশিত গল্পসমূহ ও লেখনী মূলত পাঠক, শুভানুধ্যায়ী এবং সম্মানিত অবদানকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে। এই কনটেন্টগুলোর উপর আমরা কোনো মেধাসত্ত্ব (copyright) দাবি করি না। যদি কোনো গল্প, ছবি বা তথ্যের কপিরাইট সংক্রান্ত বিষয়ে আপনার প্রশ্ন, সংশয় বা আপত্তি থাকে, তাহলে অনুগ্রহ করে আমাদের যোগাযোগ পৃষ্ঠায় যোগাযোগ করুন। আমরা যথাযথ আইনানুগ পদ্ধতিতে বিষয়টি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করব।