টিউবলাইট —- ঋতম সেন

বারান্দার সামনে দিয়ে তিনটে সাদা তার চলে গ্যাছে। রাস্তার ওপারের গাছটা ঝাঁকড়া হয়ে ল্যাম্পপোস্টটাকে প্রায় ঢেকে দিয়েছে।ডানদিকের বাড়ীটার পাঁচিলের কোণে একটা বেড়াল শুয়ে। বেড়াল না বেড়ালের বাচ্চা।এই বেড়ালটা আর তার মা আগে ওদের বাড়িতে যাতায়াত করতো। বারান্দায় স্টিলের চৌকো চৌকো দাঁতওলা জাল লাগানোর পর আর আসেনা। বেড়ালটা শুয়ে শুয়ে কাক দেখছিলো।তিনটে কাক রাস্তার ওপারের কালীমন্দিরওলা বাড়ীটার একদম মাথায় বসে ডাকাডাকি করছে।

এক একটা কাকা শব্দের সঙ্গে সঙ্গে বেড়ালবাচ্চা টাও মুখ তুলে মিঁয়াও মিঁয়াও করে ডাকছে। দুটো কাক উড়ে গ্যালো, বিট্টু বেড়ালটার চোখ ফেরানো দেখেই বুঝতে পারলো। বিট্টু ক্লাস ফাইভে পড়ে, হাওড়া জেলা স্কুলে, ওর আজ ছুটি, মা বাবা দুজনেই অফিসে গ্যাছেন, কাজের মেয়েটি ঘরে মেঝেতে ঘুমোচ্ছে, ও চুপি চুপি বিছানা থেকে উঠে তাকে ডিঙিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়িয়ে আছে।ও তারের জালে নখ দিয়ে ঠং ঠং করে শব্দ করলো।এবং দেখলো একটা পিঁপড়ে একটা সাদা তারের ওপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে বেশ অনেকটা চলে এসে বুঝতে পারছেনা কি করবে, ফিরে যাবে? না পুরোটা পেরিয়ে ওইদিকে যাবে, বিট্টু ভাবলো ও হলে ও অবশ্যই ফিরে যেতো।এই সময়ে বেড়ালটা কানখাড়া করে ওর দিকে তাকিয়ে হাই তুললো, ভয় পেয়েছে।

বিট্টু ভাবলো বেড়ালটাও ওর মতই ভীতু। ওর সঙ্গে আজ সকালে যেটা হয়েছে সেটা যদি ঐ বেড়ালবাচ্চাটার সঙ্গে হত তাহলে ও বোধ হয় হার্টফেল করেই মরে যেতো। ওদের শোয়ার ঘরে দুটো টিউবলাইট, একটার ঠিক ওপরেই ওর দাদুর বাবা আর মায়ের ছবি, দাদুর মায়ের ছবিটাকে ওর মাঝে মাঝেই বিদ্যাসাগরের মত মনে হয়-এটা ও কাউকে বলেনি যদিও এটা ভেবে মাঝে মাঝেই ও হাসে, আর আর একটার ওপরে ঘুলঘুলি। এই দুটোরই কিছু একটা সমস্যা আছে। যখন একটা জ্বলে তখন আরেকটা জ্বলেনা।একটা হয়ত জ্বলে আছে তখন আরেকটার জ্বলতে ইচ্ছে হলো, সেও জ্বললো, কিছুক্ষণ দুটোই একসঙ্গে জ্বললো, তারপর যেকোনো একটা নিভে গ্যালো, কিন্তু নিভে ঠিকই যায় , আর একসঙ্গে কখনোই জ্বলেনা বেশীক্ষণ। এটা ঠিক করার বহু চেষ্টা হয়েছে, সুকুমার কাকু যে একটা বাজারের থলিতে ইলেকট্রিকের কাজ করার যন্ত্র বয়ে আনে সে এসে প্রতিবার বলেছে কোনটা জ্বলছেনা? ও ছাড়া প্রত্যেকে তখনই যেটা জ্বলছিলোনা সেটা দেখিয়ে বলেছে ওইটা।

সুকুমার কাকু ওই টিউবলাইটটা পালটে অন্য একটা লাগিয়ে দিয়েছে, কিন্তু সুকুমারকাকু চলে যাওয়ার পরেই যেকোনো একটা নিভে গ্যাছে। আজ সকালে সুকুমারকাকু এসেছিলো, আর ওদের খয়েরি থেকে প্রায় কমলা হয়ে যাওয়া টুলটার ওপর দাঁড়িয়ে টিউবলাইট লাগাতে গিয়ে একটা স্ক্রু তার ব্যাগ থেকে পড়ে গড়িয়ে গড়িয়ে কোথায় বেশ একটা চলে গ্যালো। ও অবাক হয়ে দেখলো -সুকুমার কাকু আর একটা স্ক্রু বের করে ঠিক একইভাবে ফেলে দিলো- এইটা একই পথ দিয়ে গড়িয়ে গিয়ে আগের স্ক্রুটার পাশ দিয়ে নিজে অন্য একটা কোথায় চলে গ্যালো, সুকুমারকাকু চশমার ফাঁক দিয়ে ওর দিকে তাকিয়ে হাসলো, ও আগের স্ক্রুটা তুলে এনে সুকুমারকাকুর হাতে দিলো, অন্যটা খুঁজতে যেতেই সুকুমারকাকু বললো ছেড়ে দে। তারপর থেকেই ওর মাথাটা ক্যামন ব্যাথা ব্যাথা করতে লাগলো আর চোখটা ক্যামন জ্বালাজ্বালা করতে লাগলো আর গালে শীত করতে লাগলো, সুকুমারকাকুর সামনেই নতুন লাগানো টিউবলাইটটা নিভে গ্যালো।

মাকে সুকুমারকাকু বললো বৌদি হয়ে গ্যাছে। মা রান্নাঘর থেকে জিজ্ঞেস করলো জ্বলছেনা ক্যানো?সুকুমারকাকু বললো সুইচ দেওয়া নেই তো। ও হাঁ করে তাকিয়ে বললো কই জ্বালানো তো। ও সুকুমারকাকুকে দেখে বুঝলো সেও এই টিউবলাইট দুটোর ব্যাপারটা জানে।সুকুমারকাকু ওকে বললো ধুর বোকা এটা অস্বাভাবিক কিছু নয়, এটা তো হয়েই থাকে। আমাদের পাড়ায় তো সবাই জানে, ঘরে দুটো মানুষ থাকলেই ঝগড়া হয় টিউবলাইট থাকলে তো হবেই,তুই জানিসনা? বলে বাজারের থলি টা উঠিয়ে নিয়ে হেঁকে বৌদি আসছি বলে চলে গ্যালো। ও হাঁ করে তাকিয়ে থাকলো আর সেই সময়ে দুটো টিউবলাইটই জ্বলে উঠে ওকে দেখতে থাকলো।ও রাগ করে দুটোকেই নিভিয়ে দিলো। এতদূর ভেবে ও দেখলো বেড়ালটা একটা তারে থাবা ঠেকিয়ে আবার পিছিয়ে এনে পরীক্ষা করছে জিনিসটা জ্যান্ত কিনা, ও পিছন ফিরে ঘরে ঢুকে দেখলো দুটো টিউবলাইটই জ্বলছে, মা চলে এসেছে, ওর জন্য সিঙাড়া এনেছে বিকেলে খাবে বলে।

আরো পড়তে পারেন...

ঘ্যাঁঘাসুর-২য় অংশ

‘তাই হোক’ বলিয়া একহাত লম্বা মানুষ চলিয়া গেল। যদুও নৌকা গড়িতে লাগিল। কিন্তু সে যত…

ব্ল্যাক বেল্ট

আমাদের বশির ভাই। সবাই ডাকে ব্ল্যাক বশির। সেরের ওপর সোয়া সের আছে। বশির ভাই কালোর…

ঘ্যাঁঘাসুর

এক যে ছিল রাজা, তাঁর ছিল একটি মেয়ে। মেয়েটি, হইয়া অবধি খালি অসুখেই ভুগিতেছে। একটি…